Prothomalo:
2025-08-02@17:39:24 GMT

মুক্তবুদ্ধির চর্চা কত দূর

Published: 2nd, August 2025 GMT

‘শিখাগোষ্ঠী’র চিন্তাচর্চা কি আমাদের সমাজ-সাহিত্যে কোনো কার্যকর প্রভাব ফেলতে পেরেছে? যেসব প্রত্যয় সামনে রেখে শিখা প্রকাশিত হয়েছিল, শতবর্ষ পরে সেই প্রয়োজন কি ফুরিয়েছে? এসব জিজ্ঞাসাকে সামনে রেখে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’–এর (১৯২৬-১৯৩৬) তৎপরতার একটা হাইপোথিসিস দাঁড় করানো যায়। শিখার (১৯২৭-১৯৩১) প্রকাশ কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, নানা ধরনের ঐতিহাসিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক পটভূমিতেই একটা প্রোডাক্ট তৈরি হয়। যাপিত জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, রাজনীতি-সংস্কৃতি থেকে এটাকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই।

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ, জগন্নাথ কলেজকে কেন্দ্র করে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা তরুণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে গড়ে ওঠে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’। সংগঠনের মূল স্লোগান ছিল ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’।

সেটাকে কালের সাপেক্ষে দেখা ও বিশ্লেষণ করাই অধিক যুক্তিযুক্ত। সে সময় বাংলা অঞ্চলের উর্দুভাষী ‘আশরাফ’ (অভিজাত—নিজেদের আরব, ইরান, তুরস্ক বংশোদ্ভূত মনে করত) অবাঙালি মুসলমান, বাঙালি হিন্দু, ‘আতরাফ’ (নিম্নবর্গ) বাঙালি মুসলমান—এই তিনটি বর্গ এবং তাদের শ্রেণিগত অবস্থানকে বিবেচনায় রাখা দরকার। প্রথমে ধরা যাক, ‘মুসলিম’ শব্দটি কেন? অবিভক্ত ভারতবর্ষের ধারণায় মুসলমান সম্প্রদায় (কমিউনিটি) কথাটাকে প্রধান করা হয়েছে, এই জন্য যে মুসলিম সংখ্যাধিক্যের তুলনায় তৎকালীন বাংলা অঞ্চলে প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায় সংখ্যায় কম হলেও তাদের প্রতাপ-প্রতিপত্তি ছিল বেশি। ইতিহাসের তথ্য থেকে জানা যায়, ঢাকার কয়েকজন ছাড়া পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ জমিদারি-ভূসম্পত্তি ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের হাতে। উনিশ শতক থেকে বিশ শতকের গোড়া পর্যন্ত আধুনিক বাংলা সাহিত্যচর্চার কেন্দ্রস্থল ছিল কলকাতা। এ অবস্থায় কলকাতার বাইরে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ, জগন্নাথ কলেজকে কেন্দ্র করে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা তরুণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে গড়ে ওঠে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’। আবুল হুসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল, কাজী আনোয়ারুল  কাদির, আবদুল কাদির প্রমুখের সমন্বয়ে গঠিত সংগঠনের মুল স্লোগান ছিল ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ধর্মের অন্ধ গোঁড়ামির মোকাবেলায় ‘মুক্ত বুদ্ধির’ চর্চা—‘আমরা প্রতিষ্ঠান গড়ব, সংগঠনের জোরে আমরা আগ্রাসী অন্ধকারের অবসান ঘটিয়ে আলোকের অভ্যুদয়ের নিশানায় মুক্তজ্ঞানের চর্চা করব। দেশময় ছড়িয়ে দেব মুক্তবুদ্ধির সেই আলোকবর্তিকা। অতএব তাই থেকে সহজ শব্দের এ নামকরণ শিখা।’ (মুস্তাফা, ২০১৯: ছয়) শিখা সমগ্র (২০১৯) সম্পাদক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ‘বিষয়-ভিত্তিক সূচীপত্র’তে দেখিয়েছেন, কবিতা ৩টি; সাহিত্য ও ভাষা ১০টি; সংগীত, নাটক ও শিল্পকলা ৬টি; সমাজ, ধর্ম ও জাগরণ ১৯টি; শিক্ষা ৪টি; অর্থনীতি ও রাজনীতি-৮টি; ইতিহাস এবং অন্যান্য বিবিধ প্রসঙ্গ ১৭টি; অভিভাষণ ও বিবরণী ১৭টিসহ মোট ৮১টি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। রক্ষণশীলতা ও গোঁড়ামি মোকাবিলায় উদীয়মান মুসলমান শিক্ষিত প্রজন্মের কাছে শিখা যে আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করেছে, তা পাঁচটি সংখ্যার বৈচিত্র্যময় সূচিপত্র দেখে অনুমান করা যায়। যদিও পত্রিকাটি স্বল্পায়ু, সমমনা আগ্রহী পাঠকের বাইরে এই বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার প্রসার ছিল সীমিত এবং দেশের সাধারণ জনমানুষের সংযোগ ছিল নগণ্য। এসব সীমাবদ্ধতা ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও শিখা সমকালে চিন্তাচর্চায় বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। প্রমাণ কী? শিবনারায়ণ রায় এটাকে শনাক্ত করেছেন ‘আ নিউ রেনেসাঁ’ হিসেবে—‘স্বল্প সময়ের জন্য প্রকাশিত হলেও শিখা এক ব্যতিক্রমী বৌদ্ধিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল। এর অনুসন্ধানের ব্যাপকতা ও দৃঢ়তা আর বাংলার সমাজের প্রভাবশালী একটি অংশের মধ্য থেকে যে প্রবল বিরোধিতা এর বিরুদ্ধে উঠেছিল, এই সবকিছু মিলিয়ে শিখা আন্দোলন এক শ বছর আগে কলকাতায় ঘটে যাওয়া আরেক ঐতিহাসিক আন্দোলনের স্মৃতি জাগিয়ে তোলে।

এতকাল আমরা যেটাকে বাংলার রেনেসাঁস বলে ঠিক করেছি বা ভুল করেছি, সেটা ছিল অবিভক্ত বাংলার ব্যাপার। প্রথম রেনেসাঁসের নায়কদের মধ্যে ইউরোপীয় ছিল, খ্রিষ্টান ছিল, কিন্তু মুসলমান ছিল না। দ্বিতীয় রেনেসাঁসের নায়কেরা সবাই মুসলমান। …দ্বিতীয় রেনেসাঁস হচ্ছে ঢাকাকেন্দ্রিক।অন্নদাশঙ্কর রায়

সে আন্দোলন ছিল ডিরোজিও ও তাঁর হিন্দু কলেজের ছাত্রদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা “ইয়াং বেঙ্গল” আন্দোলন। এখন পর্যন্ত “শিখা” আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস কেউ লেখেননি, সেই ইতিহাস এখনো অপেক্ষমাণ।’ (শিবনারায়ণ, ১৯৯৮: ৮২–৮৩)

শিবনারায়ণ রায়ের ‘শিখাগোষ্ঠী’র বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনকে উনিশ শতকের ডিরোজিওর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ইয়াং বেঙ্গলদের সঙ্গে তুলনাকে আমি অযৌক্তিক মনে করি। ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১) হিন্দু কলেজে শিক্ষকতাকালে তাঁর মেধা, প্রতিভা, সামর্থ্য—সবকিছু বিনিয়োগ করেছেন মূলত অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান কমিউনিটির কল্যাণের জন্য। তার প্রতিফলিত রূপ হচ্ছে বাবু কালচার, আধুনিকতা, রেনেসাঁ, রিফরমেশন, জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ইত্যাদি। ইয়াং বেঙ্গলদের কোনো কিছুর সঙ্গে ‘শিখাগোষ্ঠী’র কর্মকাণ্ডের দূরতম সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায় না। মুসলিম সাহিত্য সমাজের কর্মকাণ্ড ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক ও সুশৃঙ্খল। নিজ সম্প্রদায়ের প্রথাবদ্ধতা, পশ্চাৎপদতা, সংস্কারের বন্দিদশা থেকে মুক্তি, উন্নতি, সমৃদ্ধি, কল্যাণকর যুগোপযোগিতার দিকে অগ্রসর হওয়া। অন্নদাশঙ্কর রায় সেই ভুলকে আরও চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন—‘এতকাল আমরা যেটাকে বাংলার রেনেসাঁস বলে ঠিক করেছি বা ভুল করেছি, সেটা ছিল অবিভক্ত বাংলার ব্যাপার। পার্টিশনের পর পূর্ব বাংলা—এখন তো বাংলাদেশ—নতুন করে জেগে ওঠে। সেখানে দেখা দেয় দ্বিতীয় এক রেনেসাঁস। প্রথম রেনেসাঁসের নায়কদের মধ্যে ইউরোপীয় ছিল, খ্রিষ্টান ছিল, কিন্তু মুসলমান ছিল না। দ্বিতীয় রেনেসাঁসের নায়কেরা সবাই মুসলমান। …দ্বিতীয় রেনেসাঁস হচ্ছে ঢাকাকেন্দ্রিক।’ (অন্নদা, ১৯৮০: ভূমিকা)

‘শিখাগোষ্ঠী’র ঐতিহাসিক গুরুত্ব এ অভিমত থেকে স্পষ্ট। যদিও বিভাগোত্তরকালে পাকিস্তান ও ধর্ম ইসলামকে অভিন্ন করে দেখা, শাসকগোষ্ঠীর সামরিকমুখিতা বাঙালির ‘মুসলমান’ পরিচয়কে প্রশ্নের মুখোমুখি করে। আরবি তাদের ধর্মীয় ভাষা, উর্দু-ফারসি শিক্ষার বাহন, বাংলা তাদের মাতৃভাষা—এতগুলো ভাষা সমস্যায় বিভ্রান্ত একশ্রেণির বাঙালি আরবি হরফে বাংলা লেখার মতো আজগুবি প্রস্তাবও দেয়। এর ঐতিহাসিক মীমাংসা এনে দেয় ১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৭ সালে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দেওয়া—কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। এসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা রূপ লাভ করে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, মুসলিম লীগের পাকিস্তান রেজল্যুশন পাস হওয়ার পর কলকাতায় গঠিত ‘পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি’ (১৯৪২), ঢাকায় গঠিত ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ’ (১৯৪২)—এ দুটির নাম ভিন্ন হলেও উদ্দেশ্য ছিল প্রায় অভিন্ন—মুসলিম জাতীয়তাবাদ, মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র ধারণা প্রচার, ইসলামি ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদী একটি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ধারা তৈরি করা। আরবি, ফারসি, উর্দু শব্দ ধার করে বাংলায় ব্যবহার করা। কিন্তু ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে তাদের তৎপরতা হারিয়ে যায়। যদিও ঢাকার বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারণার মধ্যে উনিশ শতকে কলকাতায় উৎপাদিত জাতীয়তাবাদী ধারণার আরোপণ ছিল, কিন্তু মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে তা মাতৃভূমি বা স্বদেশ অনুরাগে রূপান্তরিত হয়। এই রূপান্তরের ফাংশনাল ন্যারেটিভ হিসেবে কাজ করেছে ‘শিখাগোষ্ঠী’র চিন্তাচর্চা। এই চেতনার প্রত্যক্ষ প্রতিফলন হচ্ছে উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, প্রগতিচেতনা, সেক্যুলার ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ‘মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদী’র বদলে ‘সমন্বয়বাদী’ চিন্তার প্রসার। উর্দু ভাষাকে বাতিল করে মাতৃভাষা বাংলার সূত্রে আত্মপরিচয় ধারণ বাঙালি মুসলমানের অভূতপূর্ব রূপান্তর বলা যায়। শিখা পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধের শিরোনাম—‘বাঙালী মুসলমানের সাহিত্য-সমস্যা’, ‘সঙ্গীত চর্চায় মুসলমান’, ‘নাট্যাভিনয় ও মুসলমান সমাজ’, ‘স্থাপত্য-চর্চায় মুসলমান’, ‘বাঙালী মুসলমানের সামাজিক গলদ’, ‘আমাদের নবজাগরণ ও শরিয়ত’, ‘বাঙালী মুসলমানের শিক্ষা সমস্যা’, ‘বাঙালী মুসলমানের আর্থিক সমস্যা’, ‘নারী জীবনে আধুনিক শিক্ষার আস্বাদ’, ‘মানব প্রগতি ও মুক্তবুদ্ধি’, ‘কুসংস্কারের একটা দিক’, ‘মুসলিম জাগরণ’, ‘নাস্তিকের ধর্ম’, ‘মুসলিম নারীর কথা’, ‘সভ্যতার উত্তরাধিকার’ প্রভৃতি। এসব নাম-শিরোনামের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা থেকে যে মুসলমান সমাজের চৈতন্যবদল ঘটেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

সুন্দর, কল্যাণ, মঙ্গল—যেসব প্রতিষ্ঠিত ব্যাপার আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করে, সেগুলোকে প্রশ্ন করতে না পারলে নতুন চিন্তার পরিসর তৈরি হবে না। ট্র্যাডিশনাল থিঙ্কিং, পুরোনো প্রতিষ্ঠিত চিন্তার আরামের মধ্যে বসবাস করা মানে জীবন অর্থহীন। প্রজ্ঞাবান মানুষের উচিত, নিরর্থক জীবনকে সার্থক করে তোলা; সেটাই প্রগতি।

মুসলমান সমাজের বিকাশের গতিপথ, শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যেসব জীবনদৃষ্টি, ইতিহাসবোধ বাঙালি সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, তা খুঁজে দেখার প্রয়োজনবোধ থেকেই অধ্যাপক আনিসুজ্জামান মুসলিম–মানস ও বাংলা সাহিত্য (১৯৬৪) গবেষণা করেন। এটা প্রাতিষ্ঠানিক সন্দর্ভ হলেও ‘মুসলিম–মানস’ আলাদাভাবে চিহ্নিত করা তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের বাস্তবতায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল। বিশেষত, মুসলমান জনগোষ্ঠীর স্বরূপ সন্ধান ‘বাঙালি জাতীয়তবাদী’ ধ্যানধারণা আবিষ্কারে এই গবেষণা যে মাইলফলকের ভূমিকা পালন করেছে, তা শিখা পত্রিকার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার প্রতিফলন নয় কি? আনিসুজ্জামানের গবেষণার বিষয় উনিশ শতকের সাময়িকপত্র-সাহিত্য হলেও তা তৎকালীন সমাজ-রাজনীতির বাস্তবতার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ছিল। কারণ, তিনি মুসলিম–মানস ও সাহিত্যপাঠে প্রভাবশালী প্রচলিত মতের অনুসরণ না করে নতুন দিশা দেখিয়েছেন। সেটা হচ্ছে—উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, প্রগতিশীল অবস্থান, যা বাঙালি মুসলমানদের সামষ্টিক পরিচয়ের নির্ভরযোগ্য ঠিকানা হয়ে ওঠে। উত্তরকালে আহমদ ছফার বাঙালি মুসলমানের মন এবং বদরুদ্দীন উমরের মুসলমানদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সেই ধারাবাহিকতারই গুরুত্বপূর্ণ চিহ্নায়ন। অর্থাৎ ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নিজ কমিউনিটি নিয়ে যে চিন্তা করেছে, মুসলমান জাতিকে যে জায়গায় দেখতে চেয়েছে, তার পরিবর্তিত পরিণত রূপ বাংলাদেশ নামের স্বাধীন সার্বভৌম ভূখণ্ড। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও রাজনীতি ইতিবাচক অর্থে নতুন অর্জনকে কাজে লাগিয়ে জ্ঞানতাত্ত্বিক সমাজ গঠন, অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রকাঠামো নির্মাণে বারবার গণ–অভ্যুত্থান করেও বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনে ব্যর্থ।

সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ জাতি স্বাধীনতার অল্প কিছুদিন পরই মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা—বৈষম্যহীন শোষণমুক্ত সমাজ, ন্যায্যতা, মানবিক মর্যাদা ও অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। শাসকশ্রেণির সীমাহীন দুর্নীতি, ব্যর্থতা, বিচারহীনতা, নানা নিরিখে বিভাজন-বৈষম্যের কারণে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ ব্যর্থ হয়ে যায়। সামরিক জেনারেলদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল, স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনগণ আন্দোলন-সংগ্রামে রাস্তায় নামে, সংঘটিত হয় একাধিক গণ–অভ্যুত্থান। সমাজের অভ্যন্তরে তৈরি হয় নানা ডিসকোর্স, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ন্যারেটিভ। সম্প্রদায়গত বোধ বা সম্প্রদায়প্রাণতার একটা ইতিবাচক দিক আছে—ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজের ‘শিখাগোষ্ঠী’ (১৯২৭–১৯৩১) যেভাবে সক্রিয় ছিল, তা এর কার্যকর উদাহরণ।

আশার কথা হচ্ছে, তরুণ চিন্তক দল বাংলাদেশের চিন্তাচর্চার সমস্যাগুলো শনাক্ত করতে পেরেছে। তরুণ চিন্তক দল যথেষ্ট তত্ত্বতালাশ করছে, যাচাই–বাছাই করছে, প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসতত্ত্ব, ম্যাটান্যারেটিভস নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করছে। তারা ‘ক্ষমতা সম্পর্ক’ সম্পর্কে সচেতন এবং অপেক্ষাকৃত সহজ ভাষায় কেজো গদ্য লিখছেন। পোস্টমডার্ন চিন্তার প্রভাবে হয়তো তাদের মধ্যে বড় অংশ ম্যাটান্যারেটিভ থেকে মুক্ত। অ্যান্টিথিসিস, সিনথেসিস, ম্যাটান্যারেটিভকে ক্রিটিক্যাল অ্যানালাইসিসের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন কেউ কেউ। জীবনদর্শন অর্থাৎ ধর্ম বা রাজনৈতিক মতাদর্শের মতো যে দৃষ্টিভঙ্গি পুরো জীবনকে ব্যাখ্যা ও নিয়ন্ত্রণ করে বলে মনে হয়, পোস্টমডার্ন চিন্তাবিদেরা তাকে বলে ‘ম্যাটান্যারেটিভ’। যেসব ব্যাপার, নির্দিষ্ট অর্থে, শব্দে, পরিভাষায় সমাজে প্রতিষ্ঠিত, সেগুলো সেই অর্থে ব্যবহার না করা, ইতিহাসতত্ত্বের দিক থেকে চিন্তার যেসব দায় আমরা বহন করে চলছি, সেগুলো সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা, জিজ্ঞাসার সামনে আনা, এটাই মুক্ত চিন্তাচর্চার পরিসর। যাচাই না করে, প্রশ্ন না করে কোনো কিছুকে গ্রহণ বা বর্জন করাই তরুণ চিন্তকের প্রধান বৈশিষ্ট্য। যেমন আধুনিকতা কাকে বলে? প্রগতিশীলতা কাকে বলে? ইতিহাসের সত্য কী? সুন্দর, কল্যাণ, মঙ্গল—যেসব প্রতিষ্ঠিত ব্যাপার আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করে, সেগুলোকে প্রশ্ন করতে না পারলে নতুন চিন্তার পরিসর তৈরি হবে না। ট্র্যাডিশনাল থিঙ্কিং, পুরোনো প্রতিষ্ঠিত চিন্তার আরামের মধ্যে বসবাস করা মানে জীবন অর্থহীন। প্রজ্ঞাবান মানুষের উচিত, নিরর্থক জীবনকে সার্থক করে তোলা; সেটাই প্রগতি।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: চ ন ত চর চ ম সলম ন র প রক শ ত কল য ণ চর চ র র জন ত আম দ র কলক ত সমস য জ বনক প রগত

এছাড়াও পড়ুন:

সমস্যা ও সংকটে মা–বাবাকে সন্তানের পাশে থাকতে হবে

ছবি: প্রথম আলো

সম্পর্কিত নিবন্ধ