চারদিকে সবাই নানাভাবে টাকা কামাই করছে। কীভাবে টাকা কামাই করা যায়, তা নিয়ে আলোচনায় বসেন বিএনপির পাঁচ নেতা। টাঙ্গাইল পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির কার্যালয়ে দেড় মাস আগে ওই বৈঠক হয়। সেখানে আলোচনায় উঠে আসে এলাকার বিত্তবানেরা সবাই পরিচিত। তাই সরাসরি চাঁদা চাওয়া যাবে না। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয় ‘কিলার গ্রুপ, হত্যাকারী দল’-এর নামে প্যাডে চিঠি দিয়ে চাঁদা দাবি করা হবে।

চাঁদা দাবির অভিযোগে শনিবার টাঙ্গাইলে গ্রেপ্তার বিএনপির পাঁচ নেতা–কর্মীর মধ্যে দুজন আদালতে এমন জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ সূত্র। তাঁরা হলেন ৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন ও সদস্য সাব্বির মিয়া।

পুলিশ সূত্র জানায়, সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বাদল কুমার চন্দ ওই দুজনের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেন। পরে এই দুজনসহ গ্রেপ্তার পাঁচজনকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। রাত আটটার দিকে তাঁদের কারাগারে নেওয়া হয়।

কারাগারে পাঠানো অপর তিনজন হলেন টাঙ্গাইল শহর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও ৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি জুবায়ের আহমেদ, শহর বিএনপির ধর্মবিষয়ক সম্পাদক ও ৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি গোলাম রাব্বানী ও শহর বিএনপির সদস্য ও ৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম মিয়া।

এক মৎস্য খামারের মালিকের কাছে ‘কিলার গ্রুপ, হত্যাকারী দল’—এর নামে প্যাডে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগে বিএনপির এই পাঁচ নেতা–কর্মীকে আজ শনিবার ভোরে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে ওই মৎস্য খামারের মালিক বাদী হয়ে টাঙ্গাইল সদর থানায় মামলা করেন।

পুলিশ সূত্র জানায়, আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে আবদুল্লাহ আল মামুন ও সাব্বির মিয়া আরও বলেছেন, চাঁদা চেয়ে চিঠির ভাষা কী হবে এবং কাদের চিঠি দেওয়া হবে, সেই তালিকাও তাঁরা সেদিন তৈরি করেন। এর মধ্যে কয়েকজনকে চিঠি দিয়েছেন। আবদুল্লাহ আল মামুন তাঁর নিজের ল্যাপটপে চিঠি তৈরি করেন।

টাঙ্গাইল সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তানভীর আহমেদ জানান, বৃহস্পতিবার রাতে পৌর এলাকায় সন্তোষে মৎস্য খামারের মালিক মো.

আজাহার আলীর কর্মচারীর হাতে অচেনা একজন একটি চিঠি দিয়ে যান। সেই চিঠি শুক্রবার সকালে সেই কর্মচারী আজাহার আলীকে দেন। চিঠিটি ‘কিলার গ্রুপ, হত্যাকারী দল’—এর প্যাডে লেখা। প্যাডে স্লোগান লেখা ছিল ‘চাঁদা দে, নইলে জীবন দে।’ চিঠিতে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। দাবি করা টাকা ৩ আগস্ট সন্ধ্যা সাতটার সময় একটি শপিং ব্যাগে করে কাগমারীতে মাহমুদুল হাসানের (সাবেক সংসদ সদস্য) বাসার সামনে একটি গাছের নিচে রেখে যেতে বলা হয়।

চিঠিটি শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। পরে পুলিশ শুক্রবার রাতে এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু করে। গোয়েন্দা পুলিশের সহযোগিতায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।

তিন নেতাকে বহিষ্কার

টাঙ্গাইল শহর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও ৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি জুবায়ের আহমেদ, ৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি গোলাম রব্বানী এবং সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম মিয়াকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

শনিবার রাতে টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির সভাপতি হাসানুজ্জামিল শাহীন ও সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, চাঁদাবাজির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকায় তাঁদের বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

যদিও এর আগে শহর বিএনপির সভাপতি মেহেদী হাসান (আলীম) ওই পাঁচজনের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, বিএনপির নেতা-কর্মীরা ষড়যন্ত্রের শিকার। রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও হেয় করার জন্য তাঁদের ফাঁসানো হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে এলাকায় কোনো বদনাম নেই।

আরও পড়ুনটাঙ্গাইলে ‘কিলার গ্রুপ’ লেখা প্যাডে চাঁদা দাবি, বিএনপির ৫ নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার৫ ঘণ্টা আগে

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শহর ব এনপ র স

এছাড়াও পড়ুন:

ভয়হীন ন্যায্য মানবিক মর্যাদার দেশ গড়ার প্রত্যাশা

দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীরা ভয়হীন ন্যায্য ও মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। গতকাল শনিবার জাতীয় জাদুঘরে ‘দৃশ্যমাধ্যম সমাজ সম্মিলন ২০২৫: কইলজ্যা কাঁপানো ৩৬ দিন’ শিরোনামে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাঁরা এই প্রত্যাশার কথা জানান।

আলোচনা, স্মৃতিচারণা, আলোকচিত্র ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সাজানো হয় এই সম্মিলন। সারা দিন ধরে চলে এই অনুষ্ঠান।

সন্ধ্যায় সম্মিলনের আলোচনা সভায় অধ্যাপক ও চিন্তক সলিমুল্লাহ খান বলেছেন, ‘বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করার জন্য নতুন ভাষার প্রয়োজন। মজলুমের পক্ষে থাকতে হবে, শুধু জুলুমের বিরুদ্ধে নয়, জালিমের বিরুদ্ধে থাকতে হবে।’ দেশের চলমান সংস্কার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদের যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা ভবিষ্যতে জাতির জন্য আরেকটি বিপর্যয় আনতে যাচ্ছে। তারা আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের মতো নির্বাচনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এটা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের লক্ষ্য ছিল না।

বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করার জন্য নতুন ভাষার প্রয়োজন। মজলুমের পক্ষে থাকতে হবে, শুধু জুলুমের বিরুদ্ধে নয়, জালিমের বিরুদ্ধে থাকতে হবে। সলিমুল্লাহ খান, অধ্যাপক ও চিন্তক

সলিমুল্লাহ খান বলেন, মূল বিষয় হলো জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা। সেই কাজ না করা গেলে এই দ্বিকক্ষ, রাষ্ট্রপতির হাতে সংরক্ষিত আসন থাকা—এসবই ভবিষ্যতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভীন হক বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে যে নারীরা রাজপথে সোচ্চার ছিলেন, তাঁদের আর দেখা যাচ্ছে না। তাঁরা যেন হারিয়ে গেছেন। কমিশনকে তাঁদের অনেকই বলছেন অভ্যুত্থানের পর তাঁদের আর জায়গা দেওয়া হয়নি। প্রয়োজন হলে নারীকে ব্যবহার, প্রয়োজনের শেষে ছুড়ে ফেলার এই প্রক্রিয়ার পরিবর্তন করতে হবে।

অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে বর্ষপূর্তির অনেক চাকচিক্যময়, উচ্চকণ্ঠ উদ্‌যাপন দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ভেতরটা মনে হচ্ছ অন্তঃসারশূন্য। সব আগের মতেই আছে উন্নয়নের বয়ান, ড্রোন শো উদ্‌যাপন। শুধু মুখ পরিবর্তন হয়েছে। এই রকমভাবে নারী নির্যাতন, সংখ্যালঘু নির্যাতন, সংঘবদ্ধ সন্ত্রাস হচ্ছে। চলছে ‘ট্যাগ দেওয়া’। আগে বলা হতো ‘স্বাধীনতাবিরোধী’, ‘রাজাকার’। এখন বলা হচ্ছে ‘স্বৈরাচারের দোসর’। এই এখন সাংস্কৃতিক কর্মীদের একটি বৃহৎ ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।

প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক ও কবি সাজ্জাদ শরিফ বলেন, ‘সাংস্কৃতিক কর্মীরা জনতার অব্যক্ত বাসনাকে ভাষা দেন। কিন্তু আমাদের একটি পুরো প্রজন্মের সংস্কৃতিজীবী ও বুদ্ধিজীবীরা সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁরা ইতিহাসের একরৈখিক বয়ান তৈরি করেছেন। একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কারিগরদের মতো কাজ করেছেন। এখন সংস্কৃতিজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের কর্তব্য মুক্তিযুদ্ধকে নতুন আলোয় ব্যাখ্যা করা। ক্ষমতার সঙ্গে নয়, জনতার সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টি করা।’

চলচ্চিত্র নির্মাতা কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের সঞ্চালনায় আরও বক্তব্য দেন লেখক ফিরোজ আহমেদ,শিল্পী ও শিক্ষক মুনেম ওয়াসিফ, পরিবেশকর্মী ও সংগঠক আমিরুল রাজীব। শেষে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

এর আগে ছিল নির্মাতা জাহিন ফারুক আমিনের সঞ্চালনায় ‘কথামালা’ শীর্ষক জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীদের স্মৃতিচারণা। এতে আলোকচিত্রী ও মানবাধিকারকর্মী ড. শহীদুল আলম বলেন, ‘আমরা এখন অনেকে ফ্যাসিবাদী সরকারের সমালোচনা করছি। কিন্তু সেই সরকার টিকে থাকার সময় সাহস করে কিছু বলিনি। যখন যা বলা দরকার, তখনই তা বলতে হবে।’

অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন বলেন, ‘গত বছর সবাই একত্র হতে পেরেছিলাম বলে পথে নেমে প্রতিবাদ করেছি। অনেকের সঙ্গে পথেই নতুন করে পরিচয় হয়েছিল। এখন এই ঐক্য ধরে রাখতে হবে।’ কথামালায় আরও অংশ নেন শিল্পী ও নির্মাতা ঋতু সাত্তার, আলোকচিত্রী ও রাজনৈতিক কর্মী তাসলিমা আখতার, পোশাক পরিকল্পক ইদিলা ফরিদ, প্রযোজক মুশফিকুর রহমান, নির্মাতা আল হাসিব খান, সংগীতশিল্পী হাসান ইথার ও নির্মাতা কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়।

এর আগে সকালে ‘কইলজ্যা কাঁপানো ৩৬ দিন: জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ও সাংস্কৃতিক নির্মাণ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে দিনভর সম্মিলনের কার্যক্রম শুরু হয়। আয়োজনের শুরুতে জাতীয় সংগীত পরিবেশন ও মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। পরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়।

অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন বলেন, জুলাই গণমানুষের অভ্যুত্থান। মানুষকে সম্পৃক্ত রাখা না গেলে জুলাইকে ধরে রাখা যাবে না। অন্যায়-অবিচার হলে মানুষ মেনে নেয় না।

নগর–পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়েছে। শ্রমজীবী মানুষ সবচেয়ে বেশি রক্ত দিয়েছে। মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল বসবাসের উপযোগী একটা নগর, যেখানে কোনো বৈষম্য থাকবে না। কিন্তু এই প্রান্তিক মানুষ, প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ কোনো সংস্কার আলোচনায় নেই।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা বলেন, ৫ আগস্টের আগে জনগণ বয়ান তৈরি করেছে। কিন্তু ৫ আগস্টের পর তা উল্টে গেছে। যারা ক্ষমতায় আছে, তারা নিজেদের মতো করে বয়ান তৈরি করছে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ মাহমুদুর রহমান সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ ভাইয়ের স্মৃতিচারণা করেন। এতে শহীদ সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়র মা শামসী আরা জামান, অধ্যাপক হাসান আশরাফ, অধ্যাপক দীনা এম সিদ্দিকী, চলচ্চিত্র নির্মাতা আকরাম খান প্রমুখ বক্তব্য দেন।

আরও পড়ুনমানুষকে বাদ দিয়ে জুলাইয়ের চেতনা ধরে রাখা যাবে না৬ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ