দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে জীবনসংগ্রামে নামা সেই বাবা পেলেন রিকশা
Published: 12th, August 2025 GMT
ভাড়া বাসায় দেখাশোনা করার মতো কেউ না থাকায় ছোট্ট দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে রিকশা চালাতেন সোহাগ মিয়া। কিন্তু ভাড়া নেওয়া রিকশার আয় দিয়ে সেভাবে সংসার চলে না। সেই রিকশাচালককে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এক ব্যক্তি। তিনি সোহাগ মিয়ার চাহিদা অনুযায়ী একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা কেনার অর্থসহায়তা করেছেন।
সেই টাকা দিয়ে মঙ্গলবার সোহাগ মিয়াকে একটি রিকশা কিনে দেওয়া হয়েছে। রিকশা পেয়ে সোহাগ মিয়া বলেছেন, ‘এহন দুই বাচ্চা লইয়্যা খাইয়্যা-পইর্যা থাকতে পারমু। ওগো ল্যাহাপড়া করাইতে পারমু। যে আমারে এই উপকার করছে, আল্লায় হ্যার ভালো করুক, মন খুইল্লা দোয়া করি।’
২ আগস্ট সোহাগ মিয়ার দুর্দশা নিয়ে প্রথম আলো অনলাইনে ‘বটতলায় থেমে থাকা রিকশায় এক বাবার জীবনসংগ্রামের ছবি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সংবাদটি প্রকাশের পর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কপ্রবাসী এক ব্যক্তি সোহাগ মিয়াকে সহায়তা করার জন্য যোগাযোগ করেন। এরপর তিনি সহায়তার অর্থ পাঠালে সোহাগ মিয়ার চাহিদা অনুযায়ী একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা কিনে দেওয়া হয়।
সোহাগ মিয়ার দুই সন্তান। ছেলে রমজানের বয়স সাড়ে ছয় বছর আর মেয়ে জান্নাতের বয়স চার বছর। ওদের মা নেই। তাই দুই সন্তানকে কোলে ও পাদানিতে বসিয়ে প্রতিদিন রিকশা চালান সোহাগ মিয়া। থাকেন নগরের জিয়া সড়ক এলাকার একটি খুপরিতে। পরিবারে আর কেউ নেই, যাঁর কাছে শিশুসন্তানদের রেখে জীবিকার জন্য বাইরে বের হবেন। বাধ্য হয়ে ছোট্ট দুই শিশুকে নিয়ে এভাবে প্রতিদিন রাস্তায় নামেন তিনি।
আরও পড়ুনবটতলায় থেমে থাকা রিকশায় এক বাবার জীবনসংগ্রামের ছবি০২ আগস্ট ২০২৫জীবিকার তাগিদে এক যুগ আগে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ থেকে বরিশালে আসেন সোহাগ মিয়া। দুই ভাই ও এক বোন। বাবার ১ শতাংশ বাড়ির জমি আছে। মা-বাবার মৃত্যুর পর ওইটুকু জমিতে ঘর তুলে মাথা গোঁজার মতো অবস্থা না থাকায় বড় ভাই আবুল হোসেন ঢাকায় গিয়ে শ্রমিকের কাজ নেন। বোন পুতুলের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় স্বামীর সংসারে আছেন। আর সোহাগ বরিশালে চলে আসেন।
আট বছর আগে বিয়ে করেন সোহাগ মিয়া। এরপর রিকশা চালিয়ে তাঁদের সংসার ভালোই চলছিল। একে একে দুই সন্তান আসে সংসারে। সম্প্রতি তাঁদের সংসারে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। প্রায় তিন মাস আগে স্ত্রী দুই সন্তানকে রেখে সোহাগকে তালাক দিয়ে অন্যত্র চলে যান। একদিকে সংসার ভাঙার কষ্ট, অন্যদিকে ছোট্ট দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে বিপদে পড়েন সোহাগ। ঘরে বসে থাকলে জীবন চলবে না। ছোট বাচ্চাদের মুখে খাবার তুলে দিতে বাধ্য হয়ে পথে নামেন, রিকশার হ্যান্ডল ধরেন শক্ত হাতে। কোলে ছোট্ট জান্নাতি, পাদানিতে ছেলে রমজান পাদানি আঁকড়ে ধরে বসে থাকে।
সকালে রান্নাবান্না করে বাচ্চাদের খাওয়ান ও নিজে খান। তারপর রাস্তায় নামেন। প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় করেন। এর মধ্যে রিকশার ভাড়া ৩০০ টাকা দিতে হয়। বাকি টাকা দিয়ে বাজারসদাই ও বাসাভাড়া দিয়ে জীবনটাকে জিইয়ে রাখেন।
মঙ্গলবার রিকশা পাওয়ার পর তিনি বিকেল পর্যন্ত ৫৯০ টাকা আয় করেছেন। রিকশা পাওয়ার খুশিতে বললেন, ‘এহন একটা গতি অইছে। যা আয় অইবে, বেইয়্যা নিজেরই থাকপে। মালিকের ভাড়া গোনা লাগবে না। এহন বাচ্চা দুইডারে বড় করমু, পড়াশোনা করামু।’
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
ঘর থেকে তুলে নিয়ে চুরির অপবাদে নির্যাতনের শিকার জাকিরের চোখ হারানোর শঙ্কা
অন্য সব দিনের মতোই গত শনিবার রাতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিজ ঘরে ঘুমিয়েছিলেন জাকির শেখ। গতকাল রোববার সকাল সাড়ে ছয়টায় হঠাৎ স্থানীয় শতাধিক ব্যক্তি জাকিরের বাড়িতে প্রবেশ করেন। ঘর থেকে তাঁকে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বাড়ির পাশের খোলা স্থানে। সেখানে চুরির অপবাদ দিয়ে অমানবিক নির্যাতন করেন কিছু উৎসুক জনতা। তাঁর দুই চোখ খেজুরের কাঁটা আর সুই দিয়ে খুঁচিয়ে নষ্ট করে ফেলার চেষ্টা করা হয় বলে অভিযোগ পরিবারের।
জাকির শেখের (৫০) বাড়ি মাদারীপুরের সদর উপজেলার শিরখাড়া ইউনিয়নের পশ্চিমমাঠ বাঘাবাড়ি এলাকায়। চিকিৎসকের বরাত দিয়ে তাঁর পরিবার জানিয়েছে, তাঁর দুটি চোখেই ভয়াবহ ক্ষত। চোখ দুটি পুরোপুরি হারানোর শঙ্কা রয়েছে। আজ সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জাকিরের চোখে অস্ত্রোপচার করেছেন চিকিৎসক।
একই ঘটনায় পিটুনির শিকার আরও দুজন মাদারীপুর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন।
জাকির শেখের বড় মেয়ে এনি আক্তার (২০) প্রথম আলোকে বলেন, ‘আব্বুর অবস্থা ভালো নয়। ডাক্তার বলেছেন, তাঁর চোখের ৮০ শতাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। চোখে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। আব্বুর চোখে বড় অপারেশন আজ হইছে। আব্বুর সঙ্গে আমি আছি। আমার আব্বুকে যারা চুরির মিথ্যে অপবাদ দিয়ে এই অবস্থা করেছে, তাদের বিচার চাই।’
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিরখাড়া ইউনিয়নের পশ্চিমমাঠ বাঘাবাড়ি এলাকার কয়েকটি বাড়িতে সম্প্রতি ছিঁচকে চুরির ঘটনা ঘটে। এরপর ‘স্থানীয় যুব সমাজের উদ্যোগে’ এলাকায় নিয়মিত পাহারায় বসেন স্থানীয় কয়েকজন যুবক। শনিবার দিবাগত রাত একটার দিকে বাবুল শিকদার (২৫) নামের এক যুবক তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়ি যাওয়ার পথে চোর সন্দেহে স্থানীয় কয়েকজন যুবক তাঁকে আটক করেন। বাবুল একই ইউনিয়নের রায়েরকান্দি গ্রামের বাসিন্দা। খবর পেয়ে বাবুলকে উদ্ধারে তাঁর এক আত্মীয় ইস্রাফিল মাতুব্বর (৪০) গেলে তাঁকেও আটক করেন স্থানীয় লোকজন। এরপর চোর সন্দেহে দুজনকে রাতভর মারধর করা হয়। এরপর জাকির শেখের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে পিটুনি ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটে।
জাকির শেখের পরিবারের অভিযোগ, পূর্বশত্রুতার জেরে চুরির মিথ্যা অপবাদ দিয়ে জাকিরকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন স্থায়ীয় কোহিনুর মাতুব্বর, কামাল, সজীব, ওমর, শফিকুলসহ বেশ কয়েকজন ব্যক্তি।
অভিযুক্ত কোহিনুর মাতুব্বর ও কামাল হোসেন বলেন, ‘চোর সন্দেহে প্রথম যাকে ধরা হইছে, তার স্বীকারোক্তিতে ছিল জাকির শেখের নাম। এখানে চোরদের সঙ্গে আমাদের কিসের শত্রুতা। এগুলো বলে ঘটনা আড়াল করা হচ্ছে। স্থানীয় লোকজন ছিঁচকে চোরের আতঙ্কে অতিষ্ঠ হয়ে গণপিটুনি দিয়েছে। এখানে ব্যক্তিগত শত্রুতা বা ক্ষোভ থেকে কাউকে আঘাত করা হয়নি।’
ফেরিওয়ালা জাকিরকে নির্যাতনে জড়িতদের বিচার চেয়ে সন্তানদের নিয়ে স্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন। আজ সকালে মাদারীপুর শহরের একটি বাসায়