‘আর্ট’ মানে আমার কাছে শুধু ক্যানভাসে পেইন্টিং না। আর্ট হচ্ছে ব্যক্তিগত চিন্তার দর্শন, অভিজ্ঞতা, হতে পারে কিছু আইডিয়া— যা শিল্পী তার নিজস্ব ভঙ্গিতে উপস্থাপন করে থাকেন। সেটা হতে পারে ক্যানভাসে, কাগজে, কম্পিউটার স্ক্রিনে কিংবা অন্য যে কোনো মাধ্যমে। মাধ্যমটা আসলে এখানে মূল বিষয় না, বরং একজন শিল্পী কী চিন্তা করছেন, কীভাবে চিন্তা করছেন সেটাই মুখ্য।’— কথাগুলো বলছিলেন চিত্রশিল্পী ও ভিজ্যুয়াল ডিজাইনার তৌহিন হাসান। 

তৌহিন হাসানের স্টুডিওর একটি বন্ধ দরজায় ঝুলিয়ে রাখা পুরোনো ভাঙা গিটার, বেহালার ভাঙা টুকরো, কয়েক ধরনের বাঁশিসহ নানা বাদ্যযন্ত্র। সেগুলো দেখিয়ে শিল্পী জানালেন, ‘‘এইটাও আমার কাছে একটা আর্ট। কারণ এইটা একটা কম্পোজিশন। অনেকের ধারণা, কেউ ক্যানভাসে ছবি আঁকছে মানে সে আর্টিস্ট। আমার কাছে কিন্তু তা নয়, আমি ক্যানভাসেও ছবি আঁকি, কম্পিউটারেও ছবি আঁকি, ডিজিটাল মিডিয়ায় কাজ করি, বইয়ের কাভার ডিজাইন করি, ম্যাগাজিনের পেইজ মেকআপও করি, এমনকি নানা কোম্পানির ব্রোশিওর-লিফলেটও। কনটেন্ট বুঝে, সেইভাবেই কাজটা করি। আলটিমেটলি সেই আর্ট-ই।’

আমাদের আলোচনা চলছিলো। কথা হচ্ছিলো চিত্রকর্মের বিষয়বস্তু থেকে শুরু করে সংস্কৃতির প্রভাব নিয়েও। ততক্ষণে ঝুম বৃষ্টি নেমে এলো। ছয় তলার চিলেকোঠায় তৌহিন হাসানের বাসা ও স্টুডিও। তার স্টুডিওতে মূর্ত-বিমূর্ত, শেষ হওয়া-না হওয়া ক্যানভাস, কালার প্লেটে নানা রকম রং, তুলি, বিভিন্ন শিল্পীর গানের সিডি সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা স্টুডিওর মেঝেতে। একে একে সবকিছু নিয়ে কথা এগোতে থাকলো। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার আগে ঠিকরে বের হলো রোদ। বলতে গেলে একটি  ফ্ল্যাটে শিল্পকর্ম আর এক শিল্পীর বসবাস। আমাকে স্টুডিওতে বসিয়ে রেখে নিজে চা বানাতে গেলেন। আমি স্টুডিওতে বসা, পুরো বিষয়টি যতটুকু বাস্তব মনে হচ্ছিলো তার চেয়ে বেশি পরাবাস্তব লাগছিলো। ততক্ষণে নিজেকে গুছিয়ে নিতে থাকলাম, কি কি বিষয়ে শিল্পীর সঙ্গে আলাপ করবো, সেসব নিয়ে। এর মাঝে মেঝেতে রাখা গানের সিডিগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলাম। ‘মাটির পুতুল’ নামের একটি সিডি হাতে তুলে নিলাম সেখান থেকে। তৌহিন হাসান চা নিয়ে এলেন। সিডিটা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘এই সিডির কভার ডিজাইন আমার করা।’ জানতে পারলাম, মাটির পুতুল সিডির কাভার ডিজাইন করার জন্য সিটিসেল চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড ২০১১ পেয়েছিলেন তৌহিন হাসান। তিনি বললেন, ‘চ্যানেল আই থেকে যেদিন ফোন করে পুরস্কারপ্রাপ্তির বিষয়টা জানালো, আমি ভীষণ বিস্মিত হয়েছিলাম। কারণ পুরস্কারের বিষয়টা কখনই আমার কল্পনায় ছিল না। সিডি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান লেজার ভিশন তাদের নির্বাচিত কিছু সিডি কভার পুরস্কারের আয়োজক কমিটিতে জমা দিয়েছিলেন, যা তারা প্রতি বছরই করে থাকেন। সেখান থেকে যে ‘মাটির পুতুল’ এ্যালবামটির কভার ডিজাইন বছররের সেরা ডিজাইনের এ্যাওয়ার্ড পেয়ে যাবে, সেটা সত্যিই আমার জন্য ছিল বিস্ময়কর। যদিও পরে অনেক খুশি হয়েছিলাম।’

সিডির কভার ডিজাইন প্রসঙ্গে জানতে চাইলেন শিল্পী জানান, ‘ওই একই ব্যাপার। প্রথমে কণ্ঠশিল্পী পুতুলের গানের বিষয়বস্তু জেনে বুঝে একটা আইডিয়া মাথায় খেলেছিল। এ্যালবামের নাম যেহেতু মাটির পুতুল, আমি পুতুলের একটা পোট্রেটকে মাটি দিয়ে বানাতে চাইলাম। এ বিষয়ে পুতুলের সঙ্গে কথা বললাম, পুতুলও জানালো তার আইডিয়াটা পছন্দ হয়েছে। তবে তার গানের মিউজিক কম্পোজিশন যেহেতু সেলটিক ঘরানার এবং বাংলাদেশের জন্য এই ঘরানাটা একেবারেই নতুন। সে চাইলো, তার এ্যালবামের কভারের কোথাও বাঙালিয়ানা সাজে কিছু ছবি রাখতে। এই যেমন একতারা হাতে, দোতারা হাতে- এই রকম। পরে আমি তার সেসব ছবিও কভারের পেছনের দিকে রেখেছিলাম। মূল ডিজাইনটা যখন শেষ হলো, লেজার ভিশনের স্বত্ত্বাধিকারী মাজহারুল ইসলামও খুব পছন্দ করেছিলেন ডিজাইনটা।’

এবার জানতে চাইলাম, ‘এটাও কি তাহলে আপনার একটা শিল্পকর্ম?’ উত্তরে শিল্পী খানিকটা হেসে জানালেন, ‘‘কেন না? একই জিনিস যদি আমি ক্যানভাসে আঁকতাম, তাহলে তো তুমি সেটাকে শিল্পকর্মই বলতে। বলতে, একটা পেইন্টিং। তবে পার্থক্য যেটা  সেটা হলো, এটা কমার্শিয়াল পারপাসে কম্পিউটারের গ্রাফিকসের মাধ্যমে তৈরি করা। কিন্তু আমার কাছে সেটা শিল্পকর্মই।’’ 

তৌহিন হাসান যেহেতু আর্টের নানা ফর্মে কাজ করেন তার অর্জনগুলোও সেই জানান এবং স্বীকৃতি দেয়। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র প্রবর্তিত বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকার জন্য সেরা প্রচ্ছদশিল্পী পুরস্কারও রয়েছে তার অর্জনের ঝুলিতে। ২০০৫ সালের পুরস্কারটি তার হাতে জাতীয় গ্রন্থকেন্ত্রের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেয়া হয় ২০০৭ সালে। এই বিষয়ে তিনি জানালেন, ‘ জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র প্রতি বছর সেরা প্রকাশক ও বইয়ের প্রচ্ছদশিল্পীকে জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত করে থাকে। যদিও ২০০৫ সালের পর অজানা কারণে পুরস্কারটির কার্যক্রম স্থগিত হয়ে আছে। কারণটা আমার জানা নেই। তবে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থেকে জেনেছিলাম, ১৯৬১ সালে প্রবর্তিত হওয়া এই পুরস্কার ২০০৫ সাল পর্যন্ত সর্বাধিকবার অর্জন করেছেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। এমনকি শিল্পী হাশেম খানও অনেকবার এই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন।’

তৌহিন হাসানের ধ্যান, জ্ঞান আর পরিচর্যার কেন্দ্রে থাকে শিল্পচর্চা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। অথচ হঠাৎ একদিন তার কাছে মনে হলো, ‘কেন এই বিষয়ে পড়ছি আমি?’— সন্তোষজনক কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে পরিবার-পরিজন কিংবা সহপাঠীদের কিছু না জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে ফেলেন। তারপর দীর্ঘ বিরতি নিয়ে ভর্তি হলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ (ইউডা)-এর চারুকলা বিভাগে। তিনি ছিলেন ওই চারুকলা বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী। ক্লাস করতে করতে পরে তার মনে হয়েছিল, ‘হ্যাঁ, এই বিষয়েইতো আমি পড়তে চেয়েছিলাম।’ ২০০৭ সালে তিনি চারুকলায় তার গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন। আর পড়াশোনার পাশাপাশি পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন লেখালেখিকে। পত্রিকায় ফিচার লিখতেন আর কাজ করতেন পত্রিকার ফিচার বিভাগে। যদিও অল্প কিছু বছর তিনি পত্রিকায় কাজ করেছিলেন, পরে পেশা পরিবর্তন করে পুরোপুরি কম্পিউটার গ্রাফিকস আর পেইন্টিং-এ মনোনিবেশ করেন।

তৌহিন হাসান বলেন, ‘তখন আমি দৈনিক আজকের কাগজ পত্রিকায় কাজ করি। পত্রিকায় একদিন বিজ্ঞাপন দেখলাম বার্জার পেইন্টস তরুণদের কাছ পেইন্টিং আহ্বান করেছে বাৎসরিক প্রতিযোগিতার জন্য। যাদের বয়স পয়ত্রিশের কম, তারা প্রতিযোগিতার জন্য পেইন্টিং জমা দিতে পারবে। মাথায় কী ভূত চাপলো, রং কিনলাম, তুলি কিনলাম, ক্যানভাস কিনলাম। আমি তখনও প্রফেশানাল ছবি আঁকা শুরু করিনি। ঘরে বসে টুকটাক আঁকতাম। কিন্তু সাহস করে এবার পুরোমাত্রায় আঁকা শুরু করলাম। নিজের মনের মতো করে তখন দুইটা ছবি আঁকলাম। বিষয়বস্তু ছিল রাত- রাতের শহর ও রাতজাগা পেঁচা নিয়ে। আঁকার সময় কিন্তু পুরস্কারের বিষয়টি আর মাথায় থাকলো না। ভেবেছিলাম, প্রাথমিক বাছাইয়ে যে ৪০টি শিল্পকর্ম নির্বাচন করে আয়োজকরা, যা দিয়ে ওরা একটি প্রদর্শনী করে, তাতে নির্বাচিত হলেই আমি খুশি। কারণ তাহলে সেটা হবে আমার জীবনের প্রথম শিল্প প্রদর্শনীতে অংশ নেয়া। যথারীতি অংশ নিলাম প্রতিযোগিতায়। এবং কিছুদিন পর চিঠি পেলাম যে, প্রাথমিক বাছাইয়ে চল্লিশটা চিত্রকর্মের মধ্যে আমার পেইন্টিংটাও আছে। তাতেই আমি ভীষণ খুশি ছিলাম। তার কিছুদিন পর, আয়োজক প্রতিষ্ঠান থেকে আরেকটা চিঠি এলো যে, আপনার পেইন্টিং পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে। নির্বাচিত ছয় জনের মধ্যে আপনি একজন। পরে আর কি! সেই খুশিতে বলতে গেলে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। পরে বিশাল আয়োজনের মধ্য দিয়ে ওরা আমিসহ মোট ছয়জন শিল্পীকে অ্যাওয়ার্ড দিয়েছিল। এইটা ছিলো আমার শিল্পীজীবনের প্রথম অ্যাওয়ার্ড। আরেকটা মজার বিষয় হলো, পরের বছর অর্থাৎ ২০০৫ সালে বার্জার পেইন্টস লি.

অ্যাওয়ার্ড পাওয়া এই ছয়টি পেইন্টিং দিয়ে ওদের বাৎসরিক ক্যালেন্ডার তৈরি করেছিল। প্রতি বছর ওরা তাই করে। অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত পেইন্টিংগুলো দিয়ে ক্যালেন্ডার করে। সেই ক্যালেন্ডার আমার বাসায় ঝুলে ছিল অনেক বছর। মানে, আমি ঘরের দেয়াল থেকে সেটা কখনো নামাইনি।’

পুরস্কারপ্রাপ্তি আশা করার বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?- এই প্রশ্নের উত্তরে তৌহিন হাসান বলেন, ‘‘অ্যাওয়ার্ডের জন্য আসলে কখনোই আলাদা মানসিকতা নিয়ে কাজ করা হয় না। মানে, আমার ধানা, কোন শিল্পীই তা করেন না। কাজগুলো করতাম নিজের খেয়ালে। কারণ হচ্ছে, কাজের মধ্যেই আসলে বোঝা যায়, সেটা স্বপ্রণোদিত কাজ কিনা। কারণ, তুমি জানো না, আয়োজক কমিটি পুরস্কারের জন্য কীভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে। সেটা জানলে, তুমি শিল্পচর্চা করতে পারবে না। বারবার আটকে যাবে, কিংবা তোমার কাজেই বোঝা যাবে যে, সেটা তোমার কাজ না। মানে তোমার স্টাইল বা তোমার কাজের সিগনেচার না। 

‘শিল্পচর্চা কেন করেন’— এই প্রশ্নের উত্তরে তৌহিন হাসান বলেন, ‘‘মানুষ সব সময়ই শিল্পপ্রেমী। সৃষ্টির আদিম থেকেই মানুষ শিল্পকে ভালবেসেছে। লক্ষ বছর আগে গুহাতে মানুষ যখন বাস করতো, তখন থেকেই সে শিল্পচর্চা করতে শুরু করেছিল। কেন? শিল্পের জন্য করতো না। সে একটা পশু শিকার করে আসার পরে এই পশুকে সে কেটেকুটে খাওয়ার পরে, ওই পশুটার জন্য তার মনের কোনে একটা বেদনা তৈরি হতো। শিকার করা পশুটির মুখের চেহারা সে এঁকে ফেলতে শুরু করলো গুহার দেয়ালগুলোকে। হরিণের মুখ, বাইসনের মুখ। আবার কোনো এক সময় সে হয়তো দশটা বাইসন শিকার করছে, দশটা বাইসনের ছবি এঁকে রাখতো। হয়তো হিসাব রাখতো। তার মানে হচ্ছে, এই যে রঙ পছন্দ করা, কম্পোজিশন করা, এইগুলো মানুষ আদিমকাল থেকেই করে আসছে। আমার ভিতরও হয়তো সেই আদিম প্রবৃত্তি এখনো কাজ করছে। যা কিছু দেখি, এঁকে ফেলতে ইচ্ছে করে।’’

তোহিন হাসান বলেন, ‘‘শিল্পকে কখনো ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, শিল্প একটা জীবন্ত চরিত্র, যে তোমার ওপর ক্রিয়াশীল। সে তোমাকে গাইড করবে, তুমি এইটা করো, এইটা পড়ো— এক কথায় শিল্প হচ্ছে তোমাকে উদ্বেলিত করার মতো একটা চরিত্র। তুমি কিন্তু শিল্পকে গাইড করতে পারবা না, চাইলেও পারবা না। শিল্প তোমাকে নির্দেশনা দেবে যে, তুমি এইটা করো, এইভাবে করো। তখন যদি তুমি বুঝতে পারো যে, তোমার এইটা করতে হবে, এইভাবে করতে হবে- তখন তুমি একটা ভালো কাজ করতে পারবে। আর্টিস্ট ব্লক কেন হয়? আর্টিস্ট ব্লক তৈরি হয় কারণ শিল্প তখন কোনো একটা কারণে হয়তো তোমার মনোযোগ পাচ্ছে না অথবা তুমি তার নির্দেশনা বুঝতে পারছো না। একটা গ্যাপ তৈরি হয়। তখন তুমি পেইন্টিং করতে পারবা না, আঁকাবুকি করতে পারবে না, মানে শিল্পের কোনো চর্চাই করতে পারবে না। শিল্পের সঙ্গে আসলে জোরাজুরি চলে না। শিল্প ভীষণ অভিমানী। তার মানে হলো, একজন শিল্পীকে শিল্পের সঙ্গে একটি জীবন্ত চরিত্রের মতো যোগাযোগ তৈরি করে নিতে হবে, অনেকটা বন্ধুর মতো। যোগাযোগটা বন্ধ করে দিলে, মনোযোগ কম দিলে; সেও তাই করবে।’’

তৌহিন হাসান আরও যোগ করেন, ‘‘মানুষ আসলে কখনোই একা না। তার চারপাশে প্রচুর ইনভিজিবল ক্যারেক্টার থাকে। যেসব মানুষ সেই ক্যারেক্টারগুলোকে অনুভব করতে পারে না, সে একাকীত্ব বোধ করে। একজন শিল্পী কখনও একা না। কারণ একজন শিল্পী পারে, মানুষ ছাড়াও একটি জড়বস্তুর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে, তার সঙ্গ কল্পনা করতে।’’

স্টুডিওতে ছোট বড় অনেক পেইন্টিং দেখা গেলো। বেশ কয়েকটি কাজ অসমাপ্ত। পাখি, চাঁদ, অন্ধকার রাত, পেঁচা বিশেষ করে রাতের অনুসঙ্গগুলোই বেশি প্রাধান্য পায় তৌহিন হাসানের পেইন্টিংয়ে। জানতে চাইলাম, কম্পিউটার গ্রাফিকসের ক্ষেত্রেও কি একই অনুসঙ্গগুলো থাকে? উত্তরে শিল্পী জানালেন, ‘‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রে না। কারণ, দুইটা দুই মিডিয়া। গ্রাফিকস সাধারণত করি কমার্শিয়াল কাজের ক্ষেত্রে, যেগুলো বেশিরভাগ প্রেসে ছাপা হয়। হয়তো বইয়ের প্রচ্ছদ, কিংবা কোন কোম্পানির ব্রোশিওর বা লিফলেট। আবার ধরো ম্যাগাজিনের ডিজাইন। এসবের দর্শক বা পাঠক কিন্তু আলাদা। তারা শিল্পগুলো দেখে বা অনুভব করে কাগজে ছাপার কালিতে। সেখানে শিল্পীর হাতের স্পর্শ থাকে না। যারা পেইন্টিং উপভোগ করেন, একেবারেই তাদের মতো না— তারা শিল্পীর রঙ-তুলির ছোঁয়া অনুভব করতে পারেন। সেসব কারণেই গ্রাফিকসের কাজ আলাদা রকমের হয়। আবার যখন ডিজিটাল আর্টওয়ার্ক করি, তখন হয়তো আমার পেইন্টিংয়ের অনেক অনুসঙ্গ সেখানে চলে আসে। কারণ, তখন সেটা শিল্পকর্ম— শিল্পীর চিন্তার আরেকরকম বহিপ্রকাশ। ক্যানভাসের বদলে হয়তো সেসব শিল্পকর্ম প্রিন্ট হয়ে ফ্রেমে বাধাই হয়, কোনো এক্সিবিশনে প্রদর্শিত হয়।’

আর্টের কোন স্টাইল আপনার পছন্দ? প্রশ্নের উত্তরে তৌহিন হাসান বলেন, ‘‘আমি আসলে সিম্বলিক কাজ করতে পছন্দ করি, মানে প্রতীকী। তুমি আমার ক্যানভাসে যা দেখবে কিংবা ডিজিটাল আর্টওয়ার্কে, কিন্তু অনুভব করবে অন্য কিছু একটা, যা হয়তো তোমার অভিজ্ঞতার মধ্যেই আছে। তবে বিমূর্ত না। মূর্ত জিনিসই, কিন্তু তুমি যেটা দেখছো আমি আসলে সেটা আঁকিনি বা আঁকতে চাইনি। ক্যানভাসের সব অনুসঙ্গ মিলে কিন্তু একটা গল্প তৈরি হয়। একটা পেইন্টিং যদি একটা গল্প তৈরি না করে তাহলে আমার ভালো লাগে না। গ্রাফিক ডিজাইনের কাজেও আমি একই কাজ করি। যেমন ধরো বইয়ের প্রচ্ছদ। আগে বইয়ের মূল সারমর্ম বুঝে নিই, মন দিয়ে পড়ে নিই। তারপর একটা সিম্বলিক আবহ তৈরি করে, বইয়ের প্রচ্ছদটি শেষ করি। তাতে আসলে কি হয়? পাঠক প্রচ্ছদটি দেখে সরাসরি বইয়ের ভিতরের কন্টেন্ট বুঝতে পারেন না, কিন্তু একটা আগ্রহ তৈরি হয় বইটি কেনার প্রতি। এখানেই আসলে বইয়ের প্রচ্ছদের স্বার্থকতা ’’
কথায় কথায় অনেক সময় গেলো। এবার শেষ করবো। আর শেষ প্রশ্নটা হচ্ছে, আর্টে বিমূর্ত অনেক বিষয় থাকে, সেক্ষেত্রে কখনও কারো প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে? তৌহিন হাসান বলেন, ‘‘একবার একটা মজার ঘটনা ঘটেছিলো। ‘সিটি নাইট সিরিজ’ দেখে একজন খুব প্রশংসা করলেন। কাছের মানুষ। আমি তাকে সিরিজের একটা চিত্রকর্ম গিফট করলাম। তো, চিত্রকর্মটি বাসায় নিয়ে যাওয়ার পরে তার স্ত্রী পেইন্টিংটি দেখে আমাকে কল করলেন। বললেন, একটা কাজ করেন, আপনার পেইন্টিংয়ে একটা মৃত একটা পাখি আছে। মরা পাখিতো ঘরে রাখা ভালো না, অশুভ লক্ষণ। মৃত পাখিটা মুছে দিয়ে, সেখানে একটা জীবন্ত পাখি এঁকে দিন, পাখিটাকে একটু উড়িয়ে দিন। আপনার পেইন্টিংটা আরো সুন্দর লাগবে তখন। ...তো আমি বললাম, ঠিক আছে ম্যাডাম, কোনো সমস্যা নাই। আপনি পেইন্টিংটা আমার স্টুডিওতে পাঠিয়ে দেন। আমি ঠিক করে দিচ্ছি। এরপর তিনি পেইন্টিংটি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন আমার স্টুডিওতে। যদিও আমি সেই পেইন্টিংটি আর ঠিক করে তার কাছে পাঠাইনি। পেইন্টিংটি আমার কাছেই রেখে দিয়েছি। হা-হা-হা।’’ বলেই উচ্চস্বরে হাসতে লাগলেন শিল্পী।

শিল্পের নান্দনিকতা মানুষকে স্পর্শ করে। তবে সব শিল্প সবাইকে স্পর্শ করে না। আবার শিল্পীও সবার কাছে পৌঁছাতে পারেন না, পৌঁছাতে চানও না। শিল্প তবু প্রবাহিত হয় এক একজনের কাছে এক রকমের  মাধুর্য হয়ে। তৌহিন হাসানের স্টুডিওতে শেষ হওয়া-না হওয়া পেইন্টিংগুলোও এক একটি ভিন্ন গল্প ধারণ করে আছে। আমি গল্প থামালাম। বেলা অনেকটা গাড়িয়ে গেছে। শিল্পীর সঙ্গে আলাপচারিতা শেষ করে পা বাড়ালাম নিজের গন্তেব্যের দিকে। 

ঢাকা/লিপি

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ত হ ন হ স ন বল ন একজন শ ল প ভ র ড জ ইন ন র প ইন ট প রস ক র র চ ত রকর ম শ ল পচর চ শ ল পকর ম ২০০৫ স ল আম র ক ছ আপন র প র ব ষয়ট শ ষ কর র জন য হয় ছ ল কর ছ ল ক জ কর প রথম পছন দ র একট

এছাড়াও পড়ুন:

৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে

বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।

আরো পড়ুন:

ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০

বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী

প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন। 

দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।

হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী। 

থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”

 

শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।

লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।

স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, ‍“হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”

রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?” 

থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”

তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”

বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”

ঢাকা/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজায় ২৬ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টির শিকার: জাতিসংঘ
  • গ্রাহকের কাছে পেয়ারা খেতে চায় জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা
  • গল্পটা এই ক্লাসরুম থেকেই শুরু: ইরফান সাজ্জাদ
  • রাশিয়ায় এক বাঙালি বিপ্লবীর খোঁজে
  • আপনার এত সাহস হয় কী করে, সাংবাদিককে নায়িকা
  • দুবাইয়ে বিকৃত যৌন ব্যবসা চক্রের প্রধানকে চিহ্নিত করল বিবিসির এক অনুসন্ধান
  • মহানবী (সা.)–এর ইন্তেকালের পরে শাসন নিয়ে যা ঘটেছে
  • কুবিতে নতুন ১৮ বিভাগ ও ৪ ইনস্টিটিউট চালুর সুপারিশ
  • সংগীতশিল্পী দীপ মারা গেছেন
  • ৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে