জাতীয় ঐকমত্য গঠনের লক্ষ্যে প্রণীত ‘জুলাই সনদ’ এর চূড়ান্ত খসড়ায় বাস্তবায়নের কোনো নির্দিষ্ট রোডম্যাপ রাখা হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্যকে সামনে রেখে একটি ‘সর্বসম্মত সমঝোতা’র কৌশল হিসেবে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

কমিশন সূত্র জানিয়েছে, শেষ মুহূর্তের আলোচনা ও প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে কমিশন এ সিদ্ধান্তে এসেছে যে, জুলাই সনদে বাস্তবায়নের কাঠামো না রাখলে দলগুলো সহজেই সই করতে রাজি হতে পারে। ফলে, মূল সনদে কেবল গঠনমূলক প্রস্তাবনা ও রাজনৈতিক সংস্কারের অঙ্গীকার থাকবে। বাস্তবায়ন কৌশল তুলে ধরা হবে একটি আলাদা সুপারিশপত্রে, যা পরে অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে দেওয়া হবে।

চূড়ান্ত খসড়া তিনটি অংশে বিভক্ত করা হয়েছে—
১.

প্রেক্ষাপট: জাতীয় সংকট ও ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা। 
২. গৃহীত সিদ্ধান্ত: সংস্কার ও রূপরেখা। 
৩. অঙ্গীকারপত্র: রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতিপত্র।

এতে কোথাও উল্লেখ নেই, এই সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবে কার্যকর হবে কীভাবে। আগের খসড়ায় যেসব কঠোর শব্দ ব্যবহার হয়েছিল, যেমন: ‘সংবিধানের ঊর্ধ্বে’, ‘আদালত প্রশ্ন করতে পারবে না’, তা এ সংস্করণে রাখা হয়নি, যাতে আইনি বিতর্ক এড়ানো যায়।

বিএনপির অবস্থান
বিএনপির নেতারা মনে করছেন, জুলাই সনদ একটি জাতিগত ঐকমত্যের চিত্র হতে পারে, যদি এর বাস্তবায়ন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, আমরা এটাকে শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নয়, বরং জাতির সঙ্গে করা প্রতিশ্রুতি হিসেবে দেখি। বাস্তবায়নের দায়িত্ব ভবিষ্যতের সংসদের হাতে থাকবে। সেটি আমরা পরিষ্কার করেছি। তবে, বিএনপি বারবার জানতে চাচ্ছে, এই সনদের আইনগত অবস্থান কী এবং এটি আদালতে প্রশ্নযোগ্য কি না। কারণ, এসব বিষয় স্পষ্ট না হলে ভবিষ্যতে এটি রাজনৈতিক ভুল ব্যাখ্যার সুযোগ তৈরি করবে।

‘আইনি ভিত্তি ছাড়া সনদের কার্যকারিতা নেই’
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে প্রকাশ্যে অসন্তোষ জানিয়েছে। দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, এই সনদ আমাদের দৃষ্টিতে এখনো অপূর্ণ। বাস্তবায়নের স্পষ্ট পথনির্দেশ না থাকলে এটি কেবল রাজনৈতিক আবেগের প্রকাশ, গঠনমূলক কিছু নয়।

তাদের প্রস্তাব, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য দুটি বাস্তবসম্মত উপায় আছে— রাষ্ট্রপতির ঘোষণা অথবা গণভোটের মাধ্যমে জনগণের স্বীকৃতি।

সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, আমরা চাই, অধ্যাদেশের মাধ্যমে সনদের প্রয়োগ শুরু হোক, পরে সংসদের অনুমোদন গ্রহণ করুক। নইলে ভবিষ্যতে এর কোনো কার্যকারিতা থাকবে না।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের একাধিক সদস্য বলেছেন, বাস্তবায়ন কাঠামো এখনই সনদে রাখলে অনেক দল সই করতে রাজি হবে না। ফলে, এই পর্যায়ে কমিশন বাস্তবায়ন অংশ বাদ দিয়ে, একটি আলাদা সুপারিশপত্র তৈরি করছে, যা অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হবে।

কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, এই মুহূর্তে বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট পন্থা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। আমরা এমন কিছু দিচ্ছি না, যা নিয়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষ তৈরি হয়। বৃহস্পতিবারের মধ্যে জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো যাবে। তবে, সনদে বাস্তবায়নের পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত থাকছে না। এ বিষয়ে দলগুলোর লিখিত মতামত চাওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ (সিপিবি) কিছু দল মনে করছে, যে বিষয়গুলোতে পূর্ণ ঐকমত্য নেই, সেগুলো সনদে রাখলে তা ঐক্যের বদলে বিভক্তি সৃষ্টি করবে। এই মুহূর্তে বাস্তবায়ন অংশ না রাখা কৌশলগতভাবে দায়মুক্তির পথ হলেও, ভবিষ্যতে এটি দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব ও জবাবদিহির সংকট তৈরি করতে পারে।  

বিএনপি চায়, আইনসম্মত ব্যাখ্যা। জামায়াত চায়, রাষ্ট্রীয় অনুমোদন। কমিশন চায়, সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্যতার জন্য বাস্তবায়ন ইস্যুতে নিরপেক্ষ থাকতে। এই তিন অবস্থানের মধ্যে সেতুবন্ধন না হলে সনদের স্থায়িত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে বলে মনে করছেন রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা।

কমিশনের সময়রেখা অনুযায়ী, এ সপ্তাহের মধ্যেই দলগুলোর কাছে চূড়ান্ত খসড়া পাঠানো হবে। প্রতিটি দল তাদের অবস্থান জানাবে, তারা সই করবে কি না?

আলাদা বাস্তবায়ন সুপারিশপত্র প্রস্তুত করে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দেওয়া হবে।

দলগুলোর ওপর কোনো চাপ প্রয়োগ করা হবে না; যারা সই করবে, তাদের নিয়েই আগানো হবে।

‘জুলাই জাতীয় সনদ’ একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক উদ্যোগ। এটি জাতীয় ঐক্যের সম্ভাবনা জাগাচ্ছে। কিন্তু, বাস্তবায়নের কাঠামো অনুপস্থিত থাকায় সনদের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, সংসদে নিম্নকক্ষ আসনভিত্তিক ও উচ্চকক্ষ সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে। বাস্তবায়নই মূল চ্যালেঞ্জ। সংস্কারের পক্ষে জনমত আছে, ২০১৩ থেকে আমরা কাজ করছি। ১ হাজার ৪০০ জন অংশ নিয়েছেন জরিপে। রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব রয়েছে, শুধু ভিন্নমত (নোট অব ডিসেন্ট) দিয়ে দায় শেষ নয়।

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার বলেছেন, জুলাই অভ্যুত্থানের পর বড় পরিবর্তনের সুযোগ এসেছে। আগের ছয়টি কমিশন প্রস্তাবনা দিয়েছে, ঐকমত্য কমিশন তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। নারী আসন বাড়ানো, রাজনৈতিক দলে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই লক্ষ্য। দলগুলো ধাপে ধাপে ৫%-১০%-৩৩% মনোনয়ন নারীদের দিতে রাজি হয়েছে।

তিনি বলেন, ছয় মাসে অনেক অর্জন হয়েছে, যা অন্য দেশে করতে ২ বছর লাগে। তবে, সংস্কারের বাইরেও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তা মোকাবিলা করতেই হবে।

জাতীয় ঐকমত কমিশনের এক সদস্য জানিয়েছেন, কমিশন কৌশলে এমন এক ভারসাম্য বজায় রাখতে চাচ্ছে, যাতে দলগুলো বিভক্ত না হয়। কিন্তু, এই আপস ভবিষ্যতের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বড় ধরনের জটিলতা তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে, যখন প্রতিটি দল এর ব্যাখ্যা নিজস্বভাবে ব্যাখ্যা করতে শুরু করবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই সনদ কে সই করছে এবং কে করছে না, তা শুধু এই মুহূর্তের রাজনীতিই নয়, আগামী দিনের জাতীয় সংলাপকেও নির্ধারণ করবে।

ঢাকা/রফিক

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর জ ত য় ঐকমত য স প র শপত র চ ড় ন ত খসড় জ ল ই সনদ র বল ছ ন অবস থ ন প রস ত ব এনপ সনদ র সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

২৭০ দিন আলোচনার পর অনৈক্যে হতাশ উপদেষ্টা

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থানে হতাশা প্রকাশ করেছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। ২৭০ দিন আলোচনার পরও ঐকমত্য না হওয়ায় তিনি বলেন, সরকার কীভাবে কাজ করবে, তা বোঝা কঠিন। গণভোটের সময় ও পদ্ধতি নিয়ে মতভেদ চরমে পৌঁছেছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দুটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে গণভোট অথবা নির্বাচিত সংসদের হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য ঐকমত্যের সরকারের ধারণাকে দুর্বল করে দিচ্ছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সনদ বাস্তবায়নে দ্রুত সিদ্ধান্ত, আরপিওতে পরিবর্তন আসছে
  • তড়িঘড়ি না করে সংবিধান সংস্কারে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান
  • কিছু রাজনৈতিক দল ঐকমত্য কমিশনে গিয়ে ফাঁদে পড়েছে: জাপা মহাসচিব
  • ঐকমত্য কমিশন হাজির করেছে অনৈক্যের দলিল: বিএনপি নেতা জহির উদ্দিন স্বপন
  • জুলাই সনদ নিয়ে জট খুলুন, সময় কিন্তু চলে যাচ্ছে
  • সমস্যা সমাধান করে নির্বাচনের পথে এগোন: অন্তর্বর্তী সরকারকে মির্জা ফখরুল
  • অধ্যাপক আলী রীয়াজের নতুন বই প্রকাশিত
  • সুপারিশ নিয়ে বিতর্ক, কতটা যৌক্তিক
  • গণভোট নিয়ে ‘ক্রসরোডে’ সরকার
  • ২৭০ দিন আলোচনার পর অনৈক্যে হতাশ উপদেষ্টা