বিশ্বের সেরা ধনী নারীদের একজন জ্যাকুলিন মার্স। তিনি মার্স কনফেকশনারি সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী। একই সঙ্গে তিনি বিশ্বের অন্যতম নিভৃতচারী ধনকুবেরও। ১৯৩৯ সালে ফরেস্ট মার্স সিনিয়র ও অড্রি রুথ মায়ারের ঘরে জন্ম নেওয়া জ্যাকুলিন বেড়ে ওঠেন এমন এক পরিবারে, যাদের সাফল্যের কাহিনি আমেরিকার ব্যবসায়িক ইতিহাসে অনন্য।

মার্সের পিতামহ দাদা ফ্রাঙ্ক সি.

মার্স ১৯১১ সালে মার্স ইনকরপোরেটেড প্রতিষ্ঠা করেন। সাধারণ ক্যান্ডির রেসিপি দিয়ে এই ব্যবসার সূত্রপাত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই ছোট ব্যবসা থেকে তৈরি হয় মিল্কি ওয়ে, স্নিকার্সের মতো জনপ্রিয় চকলেট। ধীরে ধীরে তা বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ক্যান্ডির পাশাপাশি পোষা প্রাণীর খাবার, সাধারণ খাদ্যপণ্য ও চুইংগামের মতো বহুবিধ খাতে এই ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে। খবর ফোর্বস।

ফোর্বসের তালিকা অনুসারে, জ্যাকুলিন এখন বিশ্বের ৪৩তম শীর্ষ ধনী। এখন তাঁর সম্পদের পরিমাণ ৪০ দশমিক ৯ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ৯০ কোটি ডলার। কিন্তু অনেক উত্তরাধিকারীর মতো তিনি নিছক মালিক হয়ে চুপচাপ বসে থাকেননি।

১৯৬১ সালে ব্রিন মাওর কলেজ থেকে নৃতত্ত্বে ডিগ্রি অর্জনের পর জ্যাকুলিন মার্স ইনকরপোরেটেডে যোগ দেন। প্রায় দুই দশক সেখানে কাজ করেছেন তিনি। কোম্পানির ফুড প্রোডাক্টস গ্রুপের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। পরবর্তীকালে পরিচালনা পর্ষদে জায়গা করে নেন। ২০১৬ সালে পর্ষদ থেকে সরে দাঁড়ানোর মধ্য দিয়ে তাঁর করপোরেট অধ্যায়ের ইতি ঘটে। কোম্পানির ভেতরে তাঁর উত্তরাধিকার অবশ্য অক্ষুণ্ন থেকে যায়।

১৯৯৯ সালে জ্যাকুলিনের বাবা মারা গেলে মার্স ইনকরপোরেটেডের বিশাল অংশীদারত্ব তিন ভাইবোনের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। সেই সময় থেকে জ্যাকুলিন কোম্পানির এক-তৃতীয়াংশ মালিকানা ধরে রেখেছেন। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সেই শেয়ার এবং কোম্পানির ব্যবসায়িক সফলতার সূত্রে এখন তিনি ৪ হাজার কোটি ডলারের বেশি অর্থের মালিক।

সাধারণ জীবন

জ্যাকুলিন মার্স অন্যান্য ধনকুবেরের মতো জমকালো জীবন যাপন করেন না। তিনি সচরাচর কাউকে সাক্ষাৎ দেন না, সংবাদমাধ্যম থেকেও দূরে থাকেন। তাঁর নিজের নামের চেয়ে বেশি পরিচিত মার্স ব্র্যান্ড। তিনি বরং জনসমক্ষে পরিচিত হয়েছেন দাতব্য কাজ ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে। তিনি ছিলেন স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশনের ট্রাস্টি। সেই সঙ্গে ন্যাশনাল স্পোর্টিং লাইব্রেরি অ্যান্ড মিউজিয়ামের সঙ্গে জড়িত। ওয়াশিংটন ন্যাশনাল অপেরার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। ছিলেন ন্যাশনাল আর্কাইভস ফাউন্ডেশনের পর্ষদ সদস্য। পরিবেশ রক্ষায়ও তিনি সক্রিয়। ভার্জিনিয়ায় নিজের জমি সংরক্ষণ ট্রাস্টের আওতায় দিয়েছেন, পরিচালনা করছেন একটি জৈব কৃষিখামার। অশ্বারোহণ সব সময় তাঁর নেশা। যুক্তরাষ্ট্রের ইকুয়েস্ট্রিয়ান টিমে তাঁর সম্পৃক্ততা থেকে বোঝা যায়, ব্যক্তিগত আগ্রহ ও জনকল্যাণকে তিনি কীভাবে একসূত্রে মিলিয়েছেন।

আজও জ্যাকুলিন মার্স জনসমক্ষে নেই, বরং গোপনেই চালিয়ে যাচ্ছেন দাতব্য কাজ, সংস্কৃতি ও অশ্বারোহণ কার্যক্রম। তাঁর ছেলে স্টিফেন ব্যাজার বর্তমানে মার্সের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য। ফলে পরিবারের ব্যবসায়িক ঐতিহ্য অব্যাহত আছে। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, মার্স ইনকরপোরেটেড যক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল পারিবারিক বেসরকারি কোম্পানিগুলোর একটি। এই কোম্পানির সফলতা প্রমাণ করে, গোপনীয়তা ও ধারাবাহিকতা রক্ষা করে প্রকাশ্যে শেয়ারবাজারের বড় বড় কোম্পানির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সম্ভব।

একমাত্র বিতর্ক

জ্যাকুলিনের জীবন অবশ্য বিতর্কহীন নয়। ২০১৩ সালে ভার্জিনিয়ায় তিনি এক মর্মান্তিক গাড়ি দুর্ঘটনায় জড়িয়ে পড়েন। তাঁর গাড়ি উল্টো লেনে চলে গিয়ে একটি মাইক্রোভ্যানকে ধাক্কা দিলে এক যাত্রী মারা যান এবং কয়েকজন আহত হন। তিনি নিয়ন্ত্রণহীন গাড়ি চালনার দায় স্বীকার করেন। শাস্তি হিসেবে আদালত তাঁকে জরিমানা করেন এবং তাঁর ড্রাইভিং লাইসেন্স সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়। এই ঘটনাই হয়তো একমাত্র উপলক্ষ, যখন তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও সংবাদমাধ্যমের প্রধান শিরোনামে চলে আসেন।

অনেকে বলেন, জ্যাকুলিন মার্স নিজের প্রচেষ্টা ও পারিবারিক উত্তরাধিকারের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। একদিকে তিনি সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী, অন্যদিকে কোম্পানিকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর নিজস্ব শ্রম এবং অংশগ্রহণও রয়েছে। একই সঙ্গে তিনি শিল্প-সংস্কৃতি, পরিবেশ ও ঐতিহ্য রক্ষায় সমাজে অবদান রেখেছেন। প্রচারমুখর বা সেলিব্রেটি ধনকুবেরদের ভিড়ে তিনি আলাদা—অপরিসীম ধনী ও প্রভাবশালী, কিন্তু পাদপ্রদীপের আলোয় না থাকা নিস্তরঙ্গ জীবন যাপনকারী শীর্ষ ধনী।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

ষষ্ঠ বাংলাদেশি হিসেবে ‘আমা দাবলাম’ জয় করলেন তৌকির

ষষ্ঠ বাংলাদেশি হিসেবে হিমালয়ের অন্যতম পর্বত ‘আমা দাবলাম’ জয় করছেন পাবনার সন্তান আহসানুজ্জামান তৌকির (২৭)। গত ৪ নভেম্বর নেপাল সময় দুপর ১টার দিকে ৬ হাজার ৮১২ মিটার উচ্চতার এই পর্বতের চূড়া স্পর্শ করেন তিনি। 

পর্বতারোহণ বিষয়ক অর্গানাইজেশন রোপ ফোরের পৃষ্ঠপোষকতা ও তত্ত্বাবধানে এই অভিযানটি পরিচালিত হয়। তার এই অভিযানে সঙ্গী হিসাবে ছিলেন রোপ ফোরের আরেকজন তরুণ পর্বতারোহী আবরারুল আমিন অর্ণব।

আরো পড়ুন:

রঙ হারাচ্ছে অদম্য মেধাবীর ভবিষ্যতের স্বপ্ন

উপজেলায় এইচএসসিতে একমাত্র জিপিএ-৫ পেলেন অনুরাগ

আমা দাবলাম খাড়া বরফ দেয়াল, গভীর ক্রেভাস, ঝুলন্ত বরফ খণ্ড এবং কঠিন আবহাওয়ার জন্য পৃথিবীর অন্যতম চ্যালেঞ্জিং পর্বত হিসেবে পরিচিত। তৌকিরের এই অভিযানটি ছিল বাংলাদেশি পর্বতারোহণ ইতিহাসে এক গৌরবময় সংযোজন।

চূড়ায় পৌঁছার প্রতিক্রিয়ায় তৌকির বলেন, “আমা দাবলাম আমার কাছে শুধু একটা পর্বত নয়, এটা ছিল নিজের সীমা পরীক্ষা করার যাত্রা। পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর এই পর্বতের চূড়ায় দাঁড়িয়ে যখন লাল-সবুজ পতাকাটা তুলে ধরলাম, মনে হলো এটি শুধু আমার সফলতা নয়, এটি বাংলাদেশের সব তরুণের স্বপ্নের স্পন্দন।”

তিনি বলেন, “আমার এই অভিযানটা ছিল পৃথিবীর সব বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের জন্য, যাদের জীবনটা কেটে যায় অন্যের ওপর ডিপেন্ড (নির্ভর) করে এবং চার দেয়ালের আলোতে পৃথিবী দেখে। আমি বিশ্বাস করি, পৃথিবীতে আসা সব প্রাণী শক্তিশালী। আসুন, ডিপেন্ডেবল এই মানুষগুলোর ওপর আরো বিনয়ী হই, ভালোবাসা এবং সাহায্যে তৈরি করি তাদের নতুন পৃথিবী।”

যেভাবে ‘আমা দাবলাম’ জয় করলেন তৌকির
গত ১২ অক্টোবর দুঃসাহসিক এই অভিযানের জন্য দেশ ছাড়েন তৌকির। এরপর প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে শুরু হয় তার মূল অভিযান। হিমালয়ের পাহাড়ি বন্ধুর পথ ধরে ট্রেকিং করে তিনি বেস ক্যাম্পে পৌঁছান ২২ অক্টোবর। বেস ক্যাম্পে পৌঁছে তৌকির শুরু করেন উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ায় কৌশল। যা এক্লিমাটাইজ রোটেশন নামে পরিচিত। 

পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের ২৯ অক্টোবর সামিটের কথা থাকলেও ২৭ অক্টোবর থেকে হিমালয়ের শুরু হয় তীব্র তুষার পাত। এই তুষার পাতের মধ্যেই তৌকির অবস্থান করেন আমা দাবলাম ক্যাম্প-১ এ। যার উচ্চতা প্রায় ১৯ হাজার ফিট। ২৮ অক্টোবর আবহাওয়া আরো খারাপ হলে তাদের শেরপা লিডার সিদ্ধান্ত নেন বেস ক্যাম্পে ফিরে যাবার। তীব্র এই তুষার ঝড়ের মধ্যে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে তাদের দল বেস ক্যাম্পে পৌঁছায়। বেস ক্যাম্পে পৌঁছে শুরু হয় নতুন দুশ্চিন্তার কারণ।

৬৮১২ মিটার উচ্চতার আমা দাবলাম পর্বত

তুষার পাতের কারণে ফিক্সড রোপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবহাওয়া ভালো হতে শুরু করলেও নতুন রুট ওপেন না করা পর্যন্ত সামিট পুশ সম্ভব হচ্ছিল না। এভাবেই কেটে যায় পাঁচদিন। তরপর সুখবর আসে রুট ওপেন হবার। নভেম্বরের ২ তারিখ শুরু হয় আবার সামিট বিট। এইদিনে তৌকির পৌঁছে যান ১৯ হাজার ফিট উচ্চতার ক্যাম্প-১ এ। এরপর ৩ তারিখ ইয়োলো টাওয়ার খ্যাত ১৯ হাজার ৬৮৫ ফিট উচ্চতার ক্যাম্প-২ এ পৌঁছান। বিশ্রাম নিয়ে শুরু করেন সামিট পুশ। তীব্র বাতাস, ফিক্সড রোপে অতিরিক্ত ট্রাফিক এবং আইস ফলকে উপেক্ষা করে ৪ নভেম্বর ২২ হাজার ৩৪৯ ফিট উচ্চতার ‘আমা দাবালাম’ চূড়ায় পৌছান তিনি।

তৌকির বিশ্বাস করেন, ‍“স্বপ্ন যদি সত্যিকার অর্থে জ্বলে, তবে পাহাড়ও নত হয়। প্রতিটি শিখর আমাদের শেখায়, সীমা কেবল মনেই থাকে, সফলতায় নয়।”

তরুণ এই পর্বতারোহী এবারের স্বপ্ন পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া ‘মাউন্ট এভারেস্ট’। এই লক্ষ্য নিয়েই তিনি এগোচ্ছেন। এখন প্রয়োজন তার সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তৌকির ২০২৬ সালেই পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ায় আবারো উড়াতে চান বাংলাদেশের পতাকা।

এর আগে, গত বছরের অক্টোবরে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে নেপালের তিনটি ছয় হাজার মিটার পর্বত চূড়া স্পর্শ করেন পাবনার সন্তান আহসানুজ্জামান তৌকির। ২৭ দিনের অভিযানে গিয়ে কোন শেরপা সাপোর্ট ছাড়াই পর্বতগুলো আরোহণ করেন তিনি। পর্বতগুলো হলো ৬১১৯ মিটার উচ্চতার লবুচে পিক, ৬১৬৫ মিটার উচ্চতার আইল্যান্ড পিক ও ৬৪৬১ মিটার উচ্চতার মেরা পিক।

তারও আগে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে তৌকির খুম্বু রিজিওনের ৫০৭৬ মিটার উচ্চতার নাগা অর্জুন এবং ৬১১৯ মিটার উচ্চতার লবুচে পিক পর্বতের চূড়ায় আরোহণ করে বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা উড়িয়েছেন।

তৌকির পাবনার চাটমোহর পৌর সদরের বালুচর মহল্লার আকরাম হোসেন সাবু-সুলতানা সামিয়া পারভীন দম্পতি ছেলে। দুই ভাইয়ের মধ্যে ছোট তিনি। চাটমোহর রাজা চন্দ্রনাথ ও বাবু শম্ভুনাথ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। রাজশাহী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা এবং অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্রিপল-ই তে বিএসসি সম্পন্ন করেছেন

ঢাকা/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ষষ্ঠ বাংলাদেশি হিসেবে ‘আমা দাবলাম’ জয় করলেন তৌকির
  • এ সপ্তাহের রাশিফল (১৫-২১ নভেম্বর)