এনসিপি ক্ষমতায় না গেলেও ‘পোষা’ বিরোধী দল হবে না: সারজিস আলম
Published: 24th, October 2025 GMT
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) লক্ষ্য ক্ষমতায় যাওয়া আর তা না হলেও থাকবে শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকায়, এ কথা বলেছেন দলটির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম।
সারজিস আলম আজ শুক্রবার রাজধানীর শাহবাগে শহীদ আবু সাঈদ ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে এনসিপির এক সভায় এ কথা বলেন। দলটির ঢাকা মহানগর (উত্তর ও দক্ষিণ) এবং ঢাকা জেলা শাখা এই সমন্বয় সভা আয়োজন করে।
সারজিস আলম বলেন, ‘এনসিপি বাংলাদেশে ৪৬ নম্বর রাজনৈতিক দল হতে আসেনি। আমরা হয় জনগণের হয়ে সরকারি দল হিসেবে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করব, না হয় শক্তিশালী বিরোধী দল হব। জাতীয় পার্টির মতো পোষা বিরোধী দল হতেও আমরা আসিনি।’
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে জাতীয় পার্টি যখন সংসদে প্রধান বিরোধী দলের আসনে ছিল, তখন তারা ‘পোষা’ বিরোধী দল হিসেবে সমালোচিত হতো।
জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণেরা এনসিপি গড়ে নির্বাচনের পথে এগোচ্ছেন। আগামীকাল শনিবার থেকে এনসিপি জেলা-মহানগরের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা শুরু করতে যাচ্ছে বলে সভায় জানান সারজিস। আজ থেকে তিন দিনের মধ্যে এনসিপির ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা সম্ভব হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
সারজিস বলেন, ‘১৫ নভেম্বরের মধ্যে দেশের প্রতিটি জেলা ও মহানগরের আহ্বায়ক কমিটি করতে হবে। ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে দেশের প্রতিটি ওয়ার্ডে, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড কিংবা মহানগর, থানা, ওয়ার্ড, বাংলাদেশের প্রতিটি ওয়ার্ডে এনসিপির আহ্বায়ক কমিটি থাকতে হবে। যদি আমরা এটা করতে পারি, তাহলে আগামী সংসদ নির্বাচনে এনসিপি বাংলাদেশের শক্তিশালী দুটি রাজনৈতিক দলের একটি হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে।’
কমিটি করার ক্ষেত্রে কিছু ‘ক্রাইটেরিয়া’ বা মানদণ্ডের দিকে নজর রাখার আহ্বান জানিয়ে সারজিস বলেন, আলাদাভাবে প্রতিটি থানায় গিয়ে সমন্বয় সভা করে সেই থানার আহ্বায়ক কমিটি দিতে হবে। বাংলামোটরের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বসে কোনো কমিটি দেওয়া যাবে না। কমিটিগুলোর আহ্বায়ক চল্লিশোর্ধ্ব হতে হবে, সদস্যসচিব কোনোভাবেই ৩৫ বছরের নিচে হবে না। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান-পূর্ববর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ এবং তার যেকোনো অঙ্গসংগঠনের পদে ছিল, এমন কেউ এনসিপির কোনো আহ্বায়ক কমিটিতে আসতে পারবে না। নিষ্ক্রিয়, বিতর্কিত কাউকে কমিটিতে রাখা যাবে না।
অন্য সব রাজনৈতিক দলের ভালো মানুষদের জন্য এনসিপির দরজা খোলা বলে জানান সারজিস। তবে তিনি সেই সঙ্গে বলেন, ‘একদম স্পষ্ট কথা হচ্ছে, কেউ যদি মনে করেন এনসিপিতে এসে আগের বা নিজের কোনো ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করবেন বা প্রত্যাশা করবেন, তাহলে আপনারা হয় আগের জায়গায় ফিরে যান অথবা এনসিপি থেকে দূরে থাকুন।’
আগামীর বাংলাদেশ যদি জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা সামনে ধারণ করে এগিয়ে চলে, তাহলে দুই বছর পরে এনসিপি বাংলাদেশের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত, গ্রহণযোগ্য এবং প্রত্যাশিত রাজনৈতিক দল হবে বলে মনে করেন সারজিস। সেই দিকটি মাথায় নিয়ে দলের নেতা–কর্মীদের কাজ করে যাওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
এনসিপির এই সমন্বয় সভায় দলের সদস্যসচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ (দক্ষিণাঞ্চল), জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা বক্তব্য দেন।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে সাধারণ মানুষ বেশি চাপে
দেশে দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকা উচ্চ মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে নিম্নআয়ের পরিবার এ কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে গত এক বছর ধরে উচ্চ সুদ হারের কারণে ব্যবসা ও বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে ছোট উদ্যোক্তারা বেশি চাপে পড়েছেন।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ স্টেট অব দ্য ইকোনমি ২০২৫’ প্রতিবেদনে দেশের গত এক বছরের অর্থনীতির এমন চিত্র উঠে এসেছে। আজ সোমবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সম্মেলনকক্ষে আয়োজিত এক সেমিনারে প্রথমবারের মতো এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। একই সঙ্গে ২০২৫ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) অগ্রগতি প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার অর্থবিষয়ক বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গত এক বছরে সামষ্টিক অর্থনীতিতে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে। তবে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের কারণে এখনো বেশ কিছু সংকট রয়েছে। বিভিন্ন সংস্কার উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে এই সংকট ধীরে ধীরে কাটবে।
বিপ্লব–পরবর্তী সময়ে অনিশ্চয়তার কারণে কোনো দেশেই প্রত্যাশিত বিনিয়োগ আসে না বলে জানান আনিসুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বলেন, কোনো দেশে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আসে? কারণ, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাঁদের অর্থের নিরাপত্তা ও নিশ্চিয়তা চায়। তারপরও গণ–অভ্যুত্থানের পর এক বছরে এফডিআই বেড়েছে ১৯ শতাংশ। এটি ইতিবাচক।
‘আমরা ঋণের ফাঁদে পড়ে গেছি’সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রয়োজনীয় সংস্কার ও আর্থিক শৃঙ্খলা নিশ্চিত করে রাজস্ব আদায় বাড়াতে না পারলে বাংলাদেশ গুরুতর ঋণের ফাঁদে পড়ে যেতে পারে, এমন আশঙ্কা আছে। এটি দেশের জন্য ভালো হবে না।
মোস্তাফিজুর রহমানের এই মন্তব্যের ভিত্তিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান মন্তব্য করেন, ‘আমরা ইতিমধ্যেই ঋণের ফাঁদে পড়েছি; এ সত্য স্বীকার না করলে সামনে এগোনো সম্ভব না। কয়েক বছর আগেও আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশের বেশি ছিল, এখন তা ৭ শতাংশের ঘরে ঘোরাফেরা করছে।’
নেতিবাচক ঝুড়ি বেশি ভারীবিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ঝুড়ির চেয়ে নেতিবাচক ঝুড়ি বেশি ভারী। একদিকে অর্থনীতির সংগ্রাম চলছে, অন্যদিকে জীবিকার সংগ্রামও চলছে। তবে এর চেয়েও পরিস্থিতি খারাপ হতে পারত। গত দেড় বছরের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, সরকারের সদিচ্ছা স্পষ্ট, কিন্তু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অগ্রগতি সীমিত।’
সমস্যাগ্রস্ত পাঁচটি ব্যাংক একীভূতের প্রক্রিয়া দ্রুত এগোচ্ছে জানিয়ে সেমিনারে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, এসব ব্যাংকের আমানত বিমার সীমা ১ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ লাখ টাকা করা হয়েছে। আগামী এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে আমানতকারীদের মধ্যে এই অর্থ দেওয়া শুরু হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বলেন, ‘এক প্রান্তিকে ভালো হলে অন্য প্রান্তিকে খারাপ—এই হচ্ছে আমাদের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা। আমাদের অর্থনীতি প্রিমিটিভ অ্যাকিউমুলেশনে (সম্পদ ও ক্ষমতা ধনী বা ক্ষমতাসীন শ্রেণির হাতে যাওয়া) পরিচালিত। লুটপাট ও চাঁদাবাজি এই ব্যবস্থার একটি বড় অংশ। ব্যবসায়ের টাকা চাঁদাবাজির মাধ্যমে চাঁদাবাজ বা রাজনীতিবিদদের হাতে চলে যায়। এমন পরিস্থিতিতে খুব বেশি প্রবৃদ্ধি আশা করা যায় না।’
অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, দায়িত্বশীল গণমাধ্যম হওয়া সত্ত্বেও অনেকেই নিজেদের এজেন্ডা সামনে রেখে নির্দিষ্ট কিছু তথ্যকে অস্বাভাবিক বড় করে তুলে ধরছেন। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যে বিপ্লবের পরে আসা একটি ঐতিহাসিক সরকার, এই বিষয়টা তাদের উপস্থাপনায় থাকে না। আবার এসব তথ্যকে সামনে রেখে অনেকে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছেন। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের দুটি টার্মিনাল চুক্তিকে ঘিরে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সবচেয়ে কম সহযোগিতা পেয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজি–বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ, অর্থ বিভাগের সচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার, পরিকল্পনা বিভাগের সচিব এস এম শাকিল আখতার। স্বাগত বক্তব্য দেন পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য মঞ্জুর হোসেন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জিইডির অতিরিক্ত সচিব মনিরা বেগম।