মানব সভ্যতার ইতিহাসে শান্তি ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম এসেছে দুনিয়ায় শান্তি, ন্যায়বিচার এবং সত্য প্রতিষ্ঠার বার্তা নিয়ে। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর জন্য ন্যায়ের ওপর দৃঢ়ভাবে অবস্থানকারী হও এবং সত্যের সাক্ষ্য দাও।” [সুরা নিসা : আয়াত ১৩৫]

অন্যদিকে সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও ফ্যাসিবাদ সমাজের শান্তি বিনষ্ট করে, রাষ্ট্রকে করে অস্থির, জনগণকে করে নিপীড়িত। তাই ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে আলেমদের ভূমিকা অপরিহার্য। আলেমরা হলেন ‘নবীগণের উত্তরাধিকারী’ [আবু দাউদ : হাদিস ৩৬৪১]। তাদের দায়িত্ব সমাজকে সত্যের পথে আহ্বান করা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, রাষ্ট্রনায়ককে সৎ পরামর্শ দেওয়া এবং জনগণকে ন্যায় ও শান্তির দিকে পরিচালিত করা।

সন্ত্রাস দমনে আলেমদের ভূমিকা

ইসলামে সন্ত্রাস, খুন-খারাবি ও নিরীহ মানুষের ওপর হামলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি একজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করল, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করল।” [সুরা মায়েদা : আয়াত ৩২]

সন্ত্রাস মূলত ইসলামের শিক্ষা ও মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর পরিপন্থী। আলেমদের কাজ হচ্ছে কুরআন-সুন্নাহর এই সত্যকে জনগণের সামনে তুলে ধরা, বিভ্রান্ত তরুণদের সঠিক পথে ফেরানো, মসজিদ-মাদরাসা থেকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক খুতবা ও বক্তব্য প্রদান।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “মুসলিম সেই ব্যক্তি, যার হাত ও জবান (ক্ষমতা ও ভাষা) থেকে অপর মুসলিম নিরাপদ থাকে।” [সহিহ বুখারি : হাদিস ১০]

আজকের বিশ্বে ‘সন্ত্রাসবাদ’ অনেক সময় রাজনৈতিক স্বার্থে সংজ্ঞায়িত হলেও ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে আলেমদের কর্তব্য হচ্ছে, প্রকৃত ইসলামি অবস্থান ব্যাখ্যা করা, যাতে যুবসমাজ ভুল পথে না যায় এবং রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়।

দুর্নীতি দমনে আলেমদের ভূমিকা

দুর্নীতি হলো রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার অন্যতম প্রধান রোগ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমরা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করো না।” [সুরা আরাফ : আয়াত ৫৬] দুর্নীতিকে ইসলামে ‘খেয়ানত’ বলা হয়েছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।” [সহিহ মুসলিম : হাদিস ১০১]

আলেমদের দায়িত্ব দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া, সরকারি ও বেসরকারি খাতে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার দাবি তোলা, জনগণকে ইসলামি আমানতদারি ও জবাবদিহিতার শিক্ষা দেওয়া। ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, ইসলামি খেলাফতের আলেমরা সবসময় শাসকদের পরামর্শক ও সমালোচক হিসেবে কাজ করেছেন, যাতে রাষ্ট্রে দুর্নীতি দমন হয়।

ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধে আলেমদের ভূমিকা

ফ্যাসিবাদ মানে হলো একক দল বা ব্যক্তির স্বৈরাচারী ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা, যা মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ফেরাউনের শাসনব্যবস্থাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে বলেছেন, “ফেরাউন পৃথিবীতে উদ্ধত আচরণ করেছিল এবং সে তার প্রজাদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত করেছিল; তাদের মধ্যে একদলকে সে দুর্বল করে রেখেছিল।” [সুরা কাসাস : আয়াত ৪]

এটি স্পষ্ট ফ্যাসিবাদী শাসনের নিদর্শন। আল্লাহর নবী মুসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর নির্দেশে সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। আলেমদেরও আজকের বিশ্বে একই ভূমিকা পালন করতে হবে ফ্যাসিবাদী শাসন, স্বৈরতন্ত্র ও দমননীতির বিরুদ্ধে জনগণকে জাগ্রত করার জন্য। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “জুলুমকারী শাসকের সামনে সত্য কথা বলা সর্বোত্তম জিহাদ।” [সুনান আবু দাউদ : হাদিস ৪৩৪৪] অতএব, আলেমদের উচিত রাষ্ট্রীয় অন্যায় ও ফ্যাসিবাদী আচরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া।

সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গঠনে আলেমদের ভূমিকা

ইসলামের লক্ষ্য শুধু উপাসনা নয়, বরং একটি ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আমি চাই পৃথিবীতে যাদের দুর্বল করা হয়েছিল তাদেরকে নেতা বানাতে এবং তাদেরকে উত্তরাধিকারী করতে।” [সুরা কাসাস : আয়াত ৫]

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে শিক্ষা, ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক সমতা ও সামাজিক নিরাপত্তাকে ভিত্তি করেছিলেন। আলেমরা এই দিকগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন- 

শিক্ষা প্রসার : সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা।
সামাজিক ন্যায় : ধনী-গরিবের বৈষম্য দূরীকরণে ইসলামি অর্থনীতি প্রচার।
নৈতিক নেতৃত্ব : রাষ্ট্রনায়কদের সঠিক পরামর্শ প্রদান।
গবেষণা ও দাওয়াহ : আধুনিক সমস্যার সমাধানে ইসলামি ফিকহের প্রয়োগ।

ঐতিহাসিক প্রমাণ

ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায়, আলেমরা সবসময় ন্যায় ও সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। যেমন: ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ.

খলিফার অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্য উচ্চারণ করেছিলেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবি রহ. ভারতবর্ষে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারে নেতৃত্ব দেন। বাংলাদেশেও আলেমরা স্বাধীনতা আন্দোলন ও সামাজিক সংস্কারে ভূমিকা রেখেছেন।

পরিশেষে কথা হলো সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও ফ্যাসিবাদ মানবসমাজকে অস্থির করে তোলে, রাষ্ট্রকে দুর্বল করে। ইসলামের দৃষ্টিতে এগুলো ‘ফাসাদ ফিল্ আরদ’। আলেমদের উচিত কুরআন-হাদিসের আলোকে জনগণকে সচেতন করা, শাসকদের সত্যের পরামর্শ দেওয়া এবং ন্যায়ভিত্তিক সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমরা সৎকাজে সহযোগিতা করো এবং গুনাহ ও সীমালঙ্ঘনে সহযোগিতা করো না।” [সুরা মায়েদা : আয়াত ২]

অতএব, আলেমদের দায়িত্ব শুধু ইবাদত শিক্ষা নয়; বরং সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও ফ্যাসিবাদ দমনে নেতৃত্ব দেওয়া এবং একটি শান্তিপূর্ণ, ন্যায়ভিত্তিক ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গড়ে তোলা।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামি লেখক ফোরাম; পরিচালক, সম্পাদনা কেন্দ্র

ঢাকা/শাহেদ

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর আল ল হ ত য় ল র ষ ট র গঠন সন ত র স ইসল ম র অন য য় বল ছ ন কর ছ ল

এছাড়াও পড়ুন:

জলবায়ু অর্থায়ন হতে হবে ন্যায্য, জনগণকেন্দ্রিক ও সক্ষমতা-ভিত্তিক

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, “জলবায়ু অর্থায়ন সংস্কারে অবশ্যই স্থানীয় জনগণের চাহিদা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও স্বচ্ছতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।”

তিনি বলেন, “দ্রুত তহবিল বিতরণ, সঠিক পরিকল্পনা, আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে সমন্বয় এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী সুরক্ষায় সক্ষম তহবিল কাঠামোই এখন জরুরি।”

আরো পড়ুন:

সরকার পরিবেশ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় নিরলস কাজ করছে: উপদেষ্টা 

বিশ্বের বৃহত্তম শহরের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে ঢাকা

বুধবার (১০ ডিসেম্বর) রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে অনুষ্ঠিত “বাংলাদেশের জাতীয় জলবায়ু অর্থায়ন কৌশল প্রণয়ন” শীর্ষক পরামর্শ কর্মশালার প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।

কর্মশালায় সরকারি উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা, উন্নয়ন সহযোগী এবং জলবায়ু অর্থায়ন বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন।

তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, “বৈশ্বিক জলবায়ু অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি মূলত ‘নতুন ও অতিরিক্ত’ সহায়তার নীতির ভিত্তিতে গঠিত হয়েছিল। সময়ের সাথে সেই প্রতিশ্রুতি শিথিল হয়েছে। জলবায়ু সংকটে দায়ী অনেক উন্নত দেশ এখনো বৈজ্ঞানিক সত্য অস্বীকার করে। এই অস্বীকার জলবায়ু অর্থায়নকে জটিল ও অন্যায্য করে তোলে।”

তিনি বলেন, “কয়েকটি দেশ প্রতিশ্রুতি পালন করলেও অনেকে জলবায়ু আলোচনাকে কৌশলগতভাবে ব্যবহার করে।”

দেশীয় পরিস্থিতিতে তিনি অসম বাজেট বরাদ্দের বিষয়টি তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, “প্রতি বছর পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সর্বনিম্ন বাজেট বরাদ্দ পায়, অথচ বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। অভিযোজন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং স্থানীয় পর্যায়ের স্থিতিস্থাপকতা পর্যাপ্ত অর্থায়ন পায় না।”

স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও কার্যকর জাতীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা না থাকার বিষয়েও তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, “শুধু অর্থ দিলেই হবে না। সংস্থাগুলোর পরিকল্পনাগত দক্ষতা, কর্মী সক্ষমতা এবং দ্রুত বাস্তবায়ন ব্যবস্থা থাকতে হবে। সচেতনতামূলক সামগ্রী প্রকাশ করতেও দীর্ঘ সময় লেগে যায়। প্রক্রিয়াই যদি লক্ষ্য হয়ে যায়, তবে ফলাফল ক্ষতিগ্রস্ত হবেই।”

তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়কে প্রক্রিয়া সহজ করার পাশাপাশি স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।

পরে মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আয়োজিত ‘সবার জন্য ন্যায়বিচার ও অধিকার নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশের অঙ্গীকার’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “সরকার ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে এখন নবগঠিত পুলিশ কমিশন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে—যা পূর্বে ছিল না। সঠিক ব্যক্তি নেতৃত্ব দিলে এটি একটি বড় অর্জন হবে।”

তিনি বলেন, “আমরা পুলিশের ক্ষেত্রে কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে পেরেছি। বন ও পরিবেশ অধিকার রক্ষাতেও অগ্রগতি হয়েছে। ভবিষ্যতের নেতৃত্ব দেশকে কীভাবে পরিচালনা করবে তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। তবে অন্তত মত প্রকাশের যে পরিসর তৈরি হয়েছে, তাতে একতরফা সিদ্ধান্ত নেওয়া আগের মতো সহজ থাকবে না।”

অনুষ্ঠানে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির বাংলাদেশ প্রতিনিধি স্টেফান লিলার এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও সংসদ বিভাগ সচিব ড. হাফিজ আহমেদ চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

ঢাকা/এএএম/এসবি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জলবায়ু অর্থায়ন হতে হবে ন্যায্য, জনগণকেন্দ্রিক ও সক্ষমতা-ভিত্তিক