প্রশাসন পক্ষপাত করবে না: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
Published: 26th, October 2025 GMT
অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার দাবি উত্থাপিত হয়েছে। অতীতের মতো এবারও প্রশাসন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড অতীতেও ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। প্রশাসন পক্ষপাত করবে না।
রবিবার (২৬ অক্টোবর) সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে উপদেষ্টা পরিষদের আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত ১৫তম সভা শেষে তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।
আরো পড়ুন:
গুম প্রতিরোধে শুধু আইনগত নয়, প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার: আসিফ নজরুল
বাংলাদেশের রিজার্ভ বৃদ্ধি, প্রশংসা করল আইএমএফ
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, প্রশাসনিক প্রস্তুতি এবং নিরাপত্তা জোরদার করতে এ সভার আয়োজন করা হয়।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, কোনো কর্মকর্তা বা পুলিশ সদস্যের বদলি বা পদায়নে অনিয়মের অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রিক্রুটমেন্ট বা পোস্টিং বাণিজ্যের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব প্রতিরোধে গণমাধ্যমের ভূমিকার বিষয়ে তিনি বলেন, নির্বাচনের সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব, বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা রোধে বিশেষ নজরদারির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা গণমাধ্যমকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, গণমাধ্যম সত্য ঘটনা তুলে ধরলে গুজবের জায়গা থাকবে না। জনগণকেও সচেতন হতে হবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী একা সব গণ্ডগোল থামাতে পারবে না। স্থানীয় জনগণের সহযোগিতা ছাড়া স্থায়ী শান্তি সম্ভব নয়।
অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি
সম্প্রতি অগ্নিকাণ্ড বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে সভায় ফায়ার সেফটি ও মহড়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
ফায়ার সার্ভিসকে নিয়মিত মহড়া করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জনগণকে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ব্যবহারে প্রশিক্ষণ দিতে উদ্যোগ নেওয়া হবে।
মাদক নিয়ন্ত্রণ, নারী-শিশু সুরক্ষা এবং প্রবাসীদের কল্যাণ
সভায় মাদক নিয়ন্ত্রণ, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ, এবং প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির বিষয়েও আলোচনা হয়েছে।
পোশাক শিল্পের নিরাপত্তা ও শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে প্রশাসনের কার্যক্রম জোরদারের আহ্বান জানানো হয়েছে উপদেষ্টা পরিষদের সভায়।
রাজনৈতিক সহিংসতা ও স্থানীয় বিরোধ মোকাবিলায় সমন্বিত উদ্যোগ
সভায় বলা হয়েছে, নির্বাচনের সময় পারিবারিক বা স্থানীয় পর্যায়ের ক্ষুদ্র সংঘাতও বড় আকার নিতে পারে।
রাঙ্গুনিয়া, রামু ও রাউজানসহ কিছু এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। এসব এলাকায় অতিরিক্ত নজরদারির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা/এএএম/রফিক
.উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
দুর্নীতি ও ফ্যাসিবাদ দমন এবং সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গঠনে আলেমদের ভূমিকা
মানব সভ্যতার ইতিহাসে শান্তি ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম এসেছে দুনিয়ায় শান্তি, ন্যায়বিচার এবং সত্য প্রতিষ্ঠার বার্তা নিয়ে। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর জন্য ন্যায়ের ওপর দৃঢ়ভাবে অবস্থানকারী হও এবং সত্যের সাক্ষ্য দাও।” [সুরা নিসা : আয়াত ১৩৫]
অন্যদিকে সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও ফ্যাসিবাদ সমাজের শান্তি বিনষ্ট করে, রাষ্ট্রকে করে অস্থির, জনগণকে করে নিপীড়িত। তাই ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে আলেমদের ভূমিকা অপরিহার্য। আলেমরা হলেন ‘নবীগণের উত্তরাধিকারী’ [আবু দাউদ : হাদিস ৩৬৪১]। তাদের দায়িত্ব সমাজকে সত্যের পথে আহ্বান করা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, রাষ্ট্রনায়ককে সৎ পরামর্শ দেওয়া এবং জনগণকে ন্যায় ও শান্তির দিকে পরিচালিত করা।
সন্ত্রাস দমনে আলেমদের ভূমিকা
ইসলামে সন্ত্রাস, খুন-খারাবি ও নিরীহ মানুষের ওপর হামলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি একজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করল, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করল।” [সুরা মায়েদা : আয়াত ৩২]
সন্ত্রাস মূলত ইসলামের শিক্ষা ও মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর পরিপন্থী। আলেমদের কাজ হচ্ছে কুরআন-সুন্নাহর এই সত্যকে জনগণের সামনে তুলে ধরা, বিভ্রান্ত তরুণদের সঠিক পথে ফেরানো, মসজিদ-মাদরাসা থেকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক খুতবা ও বক্তব্য প্রদান।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “মুসলিম সেই ব্যক্তি, যার হাত ও জবান (ক্ষমতা ও ভাষা) থেকে অপর মুসলিম নিরাপদ থাকে।” [সহিহ বুখারি : হাদিস ১০]
আজকের বিশ্বে ‘সন্ত্রাসবাদ’ অনেক সময় রাজনৈতিক স্বার্থে সংজ্ঞায়িত হলেও ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে আলেমদের কর্তব্য হচ্ছে, প্রকৃত ইসলামি অবস্থান ব্যাখ্যা করা, যাতে যুবসমাজ ভুল পথে না যায় এবং রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়।
দুর্নীতি দমনে আলেমদের ভূমিকা
দুর্নীতি হলো রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার অন্যতম প্রধান রোগ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমরা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করো না।” [সুরা আরাফ : আয়াত ৫৬] দুর্নীতিকে ইসলামে ‘খেয়ানত’ বলা হয়েছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।” [সহিহ মুসলিম : হাদিস ১০১]
আলেমদের দায়িত্ব দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া, সরকারি ও বেসরকারি খাতে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার দাবি তোলা, জনগণকে ইসলামি আমানতদারি ও জবাবদিহিতার শিক্ষা দেওয়া। ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, ইসলামি খেলাফতের আলেমরা সবসময় শাসকদের পরামর্শক ও সমালোচক হিসেবে কাজ করেছেন, যাতে রাষ্ট্রে দুর্নীতি দমন হয়।
ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধে আলেমদের ভূমিকা
ফ্যাসিবাদ মানে হলো একক দল বা ব্যক্তির স্বৈরাচারী ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা, যা মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ফেরাউনের শাসনব্যবস্থাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে বলেছেন, “ফেরাউন পৃথিবীতে উদ্ধত আচরণ করেছিল এবং সে তার প্রজাদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত করেছিল; তাদের মধ্যে একদলকে সে দুর্বল করে রেখেছিল।” [সুরা কাসাস : আয়াত ৪]
এটি স্পষ্ট ফ্যাসিবাদী শাসনের নিদর্শন। আল্লাহর নবী মুসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর নির্দেশে সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। আলেমদেরও আজকের বিশ্বে একই ভূমিকা পালন করতে হবে ফ্যাসিবাদী শাসন, স্বৈরতন্ত্র ও দমননীতির বিরুদ্ধে জনগণকে জাগ্রত করার জন্য। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “জুলুমকারী শাসকের সামনে সত্য কথা বলা সর্বোত্তম জিহাদ।” [সুনান আবু দাউদ : হাদিস ৪৩৪৪] অতএব, আলেমদের উচিত রাষ্ট্রীয় অন্যায় ও ফ্যাসিবাদী আচরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া।
সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গঠনে আলেমদের ভূমিকা
ইসলামের লক্ষ্য শুধু উপাসনা নয়, বরং একটি ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আমি চাই পৃথিবীতে যাদের দুর্বল করা হয়েছিল তাদেরকে নেতা বানাতে এবং তাদেরকে উত্তরাধিকারী করতে।” [সুরা কাসাস : আয়াত ৫]
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে শিক্ষা, ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক সমতা ও সামাজিক নিরাপত্তাকে ভিত্তি করেছিলেন। আলেমরা এই দিকগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন-
শিক্ষা প্রসার : সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা।
সামাজিক ন্যায় : ধনী-গরিবের বৈষম্য দূরীকরণে ইসলামি অর্থনীতি প্রচার।
নৈতিক নেতৃত্ব : রাষ্ট্রনায়কদের সঠিক পরামর্শ প্রদান।
গবেষণা ও দাওয়াহ : আধুনিক সমস্যার সমাধানে ইসলামি ফিকহের প্রয়োগ।
ঐতিহাসিক প্রমাণ
ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায়, আলেমরা সবসময় ন্যায় ও সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। যেমন: ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. খলিফার অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্য উচ্চারণ করেছিলেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবি রহ. ভারতবর্ষে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারে নেতৃত্ব দেন। বাংলাদেশেও আলেমরা স্বাধীনতা আন্দোলন ও সামাজিক সংস্কারে ভূমিকা রেখেছেন।
পরিশেষে কথা হলো সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও ফ্যাসিবাদ মানবসমাজকে অস্থির করে তোলে, রাষ্ট্রকে দুর্বল করে। ইসলামের দৃষ্টিতে এগুলো ‘ফাসাদ ফিল্ আরদ’। আলেমদের উচিত কুরআন-হাদিসের আলোকে জনগণকে সচেতন করা, শাসকদের সত্যের পরামর্শ দেওয়া এবং ন্যায়ভিত্তিক সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমরা সৎকাজে সহযোগিতা করো এবং গুনাহ ও সীমালঙ্ঘনে সহযোগিতা করো না।” [সুরা মায়েদা : আয়াত ২]
অতএব, আলেমদের দায়িত্ব শুধু ইবাদত শিক্ষা নয়; বরং সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও ফ্যাসিবাদ দমনে নেতৃত্ব দেওয়া এবং একটি শান্তিপূর্ণ, ন্যায়ভিত্তিক ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গড়ে তোলা।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামি লেখক ফোরাম; পরিচালক, সম্পাদনা কেন্দ্র
ঢাকা/শাহেদ