সিলেট-তামাবিল সড়কটি ভৌগোলিক কারণে অতি গুরুত্বপূর্ণ। তামাবিলের ওপাশে ভারতের ডাউকি-শিলং সড়ক। এপাশে বাংলাদেশ অংশের সড়ক ধরে সিলেট থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ভৈরব হয়ে ঢাকা পর্যন্ত চলে যাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই তাই সড়কটি দখলের পরিকল্পনা করে পাকিস্তানি বাহিনী। ভারতীয় সেনা আসার পথ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিচরণ ঠেকাতে পাকিস্তানি বাহিনী সড়কের পাশের রাধানগর গ্রামে ক্যাম্প বসায়।

রাধানগর গ্রামের অবস্থান সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায়। এক হাজারের বেশি পাকিস্তানি সেনার অবস্থান ছিল ওই ক্যাম্পে। এখানে সিলেট শহরে থাকা সেনাদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনী আশপাশের গ্রামে অত্যাচার-নিপীড়ন, ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা চালায়।

তবে প্রায় এক মাসের যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ২৯ নভেম্বর মধ্যরাতে মুক্তিযোদ্ধারা রাধানগর ক্যাম্প নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেন। সেই যুদ্ধের কথা লেখা আছে দিব্য প্রকাশ থেকে প্রকাশিত লে.

কর্নেল (অব.) এস আই এম নূরুন্নবী খান বীর বিক্রমের অপারেশন রাধানগর বইয়ে। তিনি ছাড়াও মেজর শাফায়াত জামিলসহ কয়েকজন এ লড়াইয়ের নেতৃত্বে ছিলেন।

নূরুন্নবী খান তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘দখলদার বাহিনী পুরো রাধানগর এলাকাটিকে একটি দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করে ফেলে। রাধানগরে তাদের অবস্থান সুসংহত করার পাশাপাশি উক্ত এলাকার লুনি, দুয়ারীখেল, গোরা, শিমুলতলা, ছাত্তার গাঁ, ভিত্রিখেল, বাউরবাগ, বাউরবাগ হাওর, হোঁয়াওয়া গ্রামসহ এক বিস্তৃত এলাকায় তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এসব এলাকায় বর্বর বাহিনী ঘরবাড়ি জ্বালানো, নারী ধর্ষণ, লুণ্ঠনসহ নানাবিধ বর্বরোচিত কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে।’

পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করার বিষয়টি প্রভাবকের মতো কাজ করেছে। এ থেকে প্রেরণা পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। প্রবল উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন দেশকে শত্রুমুক্ত করতে। যুদ্ধ করে একের পর এক অঞ্চল মুক্ত করেছেন। হাসান মোরশেদ, গবেষক

মানুষকে দুর্বিষহ অবস্থা থেকে মুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধারা তাই পাকিস্তানি বাহিনীর রাধানগর ক্যাম্প পুরোপুরি ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেন। ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা অভিযান শুরু করেন। তিন দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে অবরুদ্ধ করেন। পালিয়ে যাওয়ার পথ হিসেবে দক্ষিণে গোয়াইনঘাটের অংশটি শুধু খোলা রাখেন।

উভয় পক্ষে আক্রমণ–পাল্টা আক্রমণ চলতে থাকে। ২৬ নভেম্বর ভারতীয় গুর্খা বাহিনীর একটি রেজিমেন্ট রাধানগর ও আশপাশের এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ করে। তবে সফল হতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস (সেক্টর ৫) বইয়ে বলা হয়েছে, ৭১ জন ভারতীয় সেনা শহীদ হন। এতে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনাদের মনোবল বিপর্যস্ত হয়। পরে অবশ্য ২৮ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা আবার আক্রমণ চালান। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি বাহিনীও পাল্টা আক্রমণ চালায়। এমন আক্রমণের শুরুতেই বীর মুক্তিযোদ্ধা সিপাহি নুরুল হক (বীর উত্তম) শহীদ হন।

রাধানগর যুদ্ধে জয়ের পর মুক্তিযোদ্ধারা সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার রাধানগর হাইস্কুল মাঠে জড়ো হয়ে বিজয় উল্লাস করেন

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র ধ নগর অবস থ ন

এছাড়াও পড়ুন:

৫ দিনের ছাতক যুদ্ধ বেকায়দায় ফেলে পাকিস্তানি বাহিনীকে

‘১৯৭১ সালে আমি বেশ কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছি। আহত হয়েছিলাম একবার। তবে ছাতকের যুদ্ধ ছিল ভয়াবহ। মনে হয়েছিল, এই যুদ্ধেই হয়তো প্রাণ যাবে। সুনামগঞ্জ অঞ্চলে এটিই ছিল সবচেয়ে বড় যুদ্ধ।’ বলছিলেন সুনামগঞ্জের যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান।

সুনামগঞ্জের ছাতক মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে ছিল। সেটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে অক্টোবরে ছাতক অপারেশনের পরিকল্পনা হয়। গুরুত্বপূর্ণ এই যুদ্ধের কথা উঠে এসেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান (দ্বিতীয় খণ্ড), প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত সম্মুখযুদ্ধ ১৯৭১ মুক্তিযোদ্ধাদের কলমে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস (চতুর্থ খণ্ড) বইয়ে।

সম্মুখযুদ্ধ ১৯৭১ মুক্তিযোদ্ধাদের কলমে বইয়ে মো. ইদ্রিস আলী বীর প্রতীক ‘অপারেশন ছাতক’ নামে একটি লেখা লিখেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ছাতকের উত্তরে দোয়ারাবাজারের সীমান্তে বাঁশতলার অবস্থান। এটি ৫ নম্বর সেক্টরের সেলা সাবসেক্টরের সদর দপ্তর। তাদের সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল মীর শওকত আলী। ছাতক অপারেশন চালাতে মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গারো পাহাড়ের তেলঢালা ক্যাম্প থেকে বাঁশতলায় আসে। এই রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর শাফায়াত জামিল।

পাঁচ দিনের এই যুদ্ধে ২৫ থেকে ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হন। ছাতক যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী যে যথেষ্ট বেকায়দায় পড়েছিল, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক তাঁর উইটনেস টু সারেন্ডার বইয়ে সে কথা স্বীকার করেন।মো. ইদ্রিস আলী বীর প্রতীক

ছাতক শহর ও সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ঘিরে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান। এই পুরো এলাকায় ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সেনা। সঙ্গে ১২ আজাদ-কাশ্মীর ফোর্স (একেএফ), ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্স (ইপিসিএএফ) ও স্থানীয় রাজাকারদের দল।

সুনামগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা বজলুল মজিদ চৌধুরী ছাতক যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন। তাঁর লেখা রক্তাক্ত ৭১ সুনামগঞ্জ বইয়ে তিনি এই যুদ্ধ সম্পর্কে লিখেছেন, ক্যাপ্টেন আনোয়ারের ‘এ’ কোম্পানি বালিউড়া বাজারে অবস্থান নেয়। মেজর আকবরের ‘বি’ কোম্পানি জয়নগর টিলায় যায়। ‘সি’ কোম্পানির মেজর মহসিনকে দোয়ারাবাজারে এবং ‘ডি’ কোম্পানির অধিনায়ক লে. নুরুন্নবীকে ছাতক-সিলেট রোডের গোবিন্দগঞ্জে অবস্থান নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়। লে. মনজুর ‘ই’ কোম্পানি নিয়ে কোম্পানীগঞ্জের বিপরীতে রাধানগরে অবস্থান নেন। এ ছাড়া সাবসেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন হেলালের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর তিনটি কোম্পানি, ক্যাপ্টেন আনোয়ার ও ক্যাপ্টেন আকবরের কোম্পানিও ছিল।

ছাতক যুদ্ধে শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ। সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারের বাঁশতলা এলাকা

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • যুদ্ধ ছাড়াই ৭ আমিরাতকে কীভাবে একটি রাষ্ট্র বানিয়ে ফেললেন শেখ জায়েদ
  •  ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে…’ 
  • আজ খোকসা মুক্ত দিবস
  • সাগরতলে সবচেয়ে দীর্ঘ ও গভীর রাস্তা বানাচ্ছে নরওয়ে
  • একটি কঙ্কাল
  • বাংলাদেশ নিয়ে জর্জ হ্যারিসনের কথা
  • ইমরান খানের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন বোন উজমা
  • ৫ দিনের ছাতক যুদ্ধ বেকায়দায় ফেলে পাকিস্তানি বাহিনীকে
  • সংযুক্ত আরব আমিরাত: মরুভূমির বুকে ঐক্যের বিজয়