Prothomalo:
2025-12-03@15:45:18 GMT

একটি কঙ্কাল

Published: 3rd, December 2025 GMT

দুই চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস আটকে আধশোয়া হয়ে আছি বিছানায়। হাতে তাদামাসা হুকিউরার বই ‘রক্ত ও কাদা ১৯৭১’। রুশা ও ঋভূ বইটা উপহার দিয়েছে আমাকে। লিখেছে, ‘প্রিয় মেজ চাচাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।’

তাদামাসা হুকিউরা আন্তর্জাতিক রেডক্রসের প্রতিনিধি হিসেবে আট মাস বাংলাদেশে অবস্থান শেষে ১৯৭২ সালের মে মাসের এক রাতে ফিরে যান নিজ দেশ জাপানে। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ‘রক্ত ও কাদা ১৯৭১’ নামে বই লিখতে শুরু করেন ১২ নভেম্বর ১৯৭০–এ। শেষ করেন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এ। বইয়ের পাতায় পাতায় শিউরে ওঠার মতো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নিষ্ঠুরতা আর নির্মমতা। বিস্ময়ে হতবাক হওয়ার মতো সব ঘটনার বর্ণনা। একেবারেই চেনাজানা মানুষ সম্পর্কে অনেক না জানা কথা। যেমন হাতিয়ার রফিক ভাই। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ২১ বছরের তুখোড় তরুণ। হাতিয়ার মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ছিলেন তিনি। যুদ্ধের সেই সব ভয়াবহ দিনে রফিক ভাইয়ের সঙ্গে হালিম ভাইয়ের রাজনৈতিক টানাপোড়েন ছিল।

বইয়ের মাঝখানে তর্জনী দিয়ে রেখেছি। বইয়ের ভূমিকাটুকু পড়া শেষ করেছি মাত্র। হাতে ধরা বইয়ে তর্জনী সেখানেই। তাদামাসা হুকিউরা বইয়ের ভূমিকার শিরোনাম দিয়েছেন, ‘একটি কঙ্কাল’। তিনি ভূমিকা লেখা শুরু করেছেন এভাবে—

রক্ত ও কাদা ১৯৭১
তাদামাসা হুকিউরা

জাপানি ভাষা থেকে অনুবাদ: কাজুহিরো ওয়াতানাবে
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
প্রকাশ: প্রথম প্রকাশ এপ্রিল ২০১২
প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী
সহযোহী শিল্পী: অশোক কর্মকার
পৃষ্ঠা: ১৯২
মূল্য: ৩০০ টাকা

বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে ক্লিক করুন

‘আমার এক আত্মীয় মেডিকেল কলেজের ছাত্র। সে নাকি সম্প্রতি ১ লাখ ২০ হাজার ইয়েন দিয়ে একটি কঙ্কাল কিনেছে গবেষণার কাজে সহায়ক হবে বলে। কথাটা শুনে আমার কেন যেন ভালো লাগছিল না। পরে জানা গেল, কঙ্কালটি এক বাঙালি মহিলার, যেমনটি আমি দুশ্চিন্তা করেছিলাম। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ২০ বছরের মতো।

‘১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৯ মাসে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর হাতে ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। দুই কোটি মানুষ হয়েছিলেন গৃহহারা। এই ছোট্ট দেশের অধিকাংশ এলাকা পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে।’

তাদামাসা হুকিউরা ভূমিকা লেখা শেষ করেছেন এভাবে—যেখানে এসে আমার নিশ্বাস আটকে গেছে। আমি গভীর ব্যথা অনুভব করেছি বুকের ভেতর। তিনি লিখেছেন,

‘সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, যুদ্ধ চলাকালীন ৯ মাসে ২ লাখ মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়। তাঁদের মধ্যে অনেককে হত্যাও করা হয়। শুনেছি, কঙ্কালের ব্যবসায়ীরা ভারতের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে এক হাজার কঙ্কাল জাপানে আমদানি করেছে। আমার আত্মীয় যে কঙ্কাল কিনেছে, সেটিও সম্ভবত ওইভাবে চলে এসেছে। বাংলাদেশ কি এতই কষ্টে আছে যে কঙ্কাল পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়!’

হ্যাঁ, তখন আমাদের ভীষণ খারাপ অবস্থা ছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন এক দেশ। ৯ মাস কঠিন মুক্তিযুদ্ধের আগে আমাদের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়। সেখানে শুধু লাখ লাখ মানুষই মারা যায়নি, ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফসলের খেত। শুরু হয়েছে খাবারের জন্য হাহাকার। অভাব মোকাবিলার জন্য সরকারকে ৩০ লাখ টন চাল বিদেশ থেকে আমদানি বা সাহায্য হিসেবে নিতে হয়েছে। বাজারে চালের দাম বেড়ে গেছে তিন গুণ। সংকট দেখা দিয়েছে শিশুখাদ্যের। গুঁড়া দুধের মজুত অনেক কম।

‘সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, যুদ্ধ চলাকালীন ৯ মাসে ২ লাখ মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়। তাঁদের মধ্যে অনেককে হত্যাও করা হয়। শুনেছি, কঙ্কালের ব্যবসায়ীরা ভারতের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে এক হাজার কঙ্কাল জাপানে আমদানি করেছে। আমার আত্মীয় যে কঙ্কাল কিনেছে, সেটিও সম্ভবত ওইভাবে চলে এসেছে। বাংলাদেশ কি এতই কষ্টে আছে যে কঙ্কাল পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়!’

ভয়াবহ দিন গেছে আমাদের। তা–ই বলে কি এত খারাপ অবস্থা ছিল বাংলাদেশের যে বিক্রি করতে হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের কঙ্কাল! কারা সেদিন ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশ থেকে কঙ্কালের ব্যবসা চালিয়েছিল। কারা সেদিন এই দেশ থেকে অর্থের বিনিময়ে পাচার করেছিল বাংলাদেশের সন্তানদের কঙ্কাল! কারা তারা?

প্রচলিত ইতিহাসের বাইরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ভিন্নমাত্রার ইতিহাস ‘রক্ত ও কাদা ১৯৭১’ আমাদের নতুনভাবে দেশকে জানতে ও ভালোবাসতে শেখায়। অতি সহজ ভাষায় লেখা এই বই আমাদের এক ঘটনা থেকে নিয়ে যায় আরেক ঘটনায়। পড়তে পড়তে আমরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই মানুষের ভালোবাসায়, আনন্দে ভরে ওঠে মন, আবার শিউরে উঠি পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর নির্মম নিষ্ঠুরতায়। উত্তেজনায় নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে এই বই পড়তে পড়তে।

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সাক্ষী হতে আমাদের সবারই ‘রক্ত ও কাদা ১৯৭১’ পড়া দরকার। যে বই না পড়লে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ আর এই গর্বিত বিজয়কে জানা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: রক ত ও ক দ আম দ র হ ক উর প রক শ বইয় র

এছাড়াও পড়ুন:

গৌরবময় বিজয়ের মাস শুরু

আজ পহেলা ডিসেম্বর। মহান বিজয়ের মাসের প্রথম দিন। বিজয়ের মাস, বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জনের মাস। ১৯৭১ সালের এই মাসেই অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা।

মাসের প্রথম দিন থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পিছিয়ে আসতে থাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধারাও এগোতে থাকেন রাজধানী ঢাকার দিকে। একে একে বিভিন্ন রণাঙ্গনে উড়তে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা।

৩০ লাখ শহীদ আর ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সাক্ষর এবারের বিজয়ের মাস নানা অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে পালিত হবে। শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাবে বাঙালি জাতি।

বাঙালি জাতির কয়েক হাজার বছরের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বপ্ন সাধ পূরণ হয় এ মাসে। বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় গৌরবদীপ্ত চূড়ান্ত বিজয় আসে এ মাসের ১৬ ডিসেম্বর। স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বে আত্মপরিচয় লাভ করে বাঙালিরা। অর্জন করে নিজস্ব ভূ-খণ্ড আর সবুজের বুকে লাল সূর্য খচিত নিজস্ব জাতীয় পতাকা। ভাষার ভিত্তিতে যে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছিল, এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিজয়ের মাধ্যমে ঘোষিত স্বাধীনতা পূর্ণতা পায় এ দিনে।

বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্নপূরণ হবার পাশাপাশি বহু তরতাজা প্রাণ বিসর্জন আর মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে এই অর্জন হওয়ায় বেদনাবিধূর এক শোকগাঁথার মাসও এই ডিসেম্বর। এ মাসেই স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর আল-শামসদের সহযোগিতায় হানাদার গোষ্ঠী দেশের মেধাবী, শ্রেষ্ঠ সন্তান-বুদ্ধিজীবী হত্যার নৃশংস হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল। সমগ্র জাতিকে মেধাহীন করে দেওয়ার এ ধরনের ঘৃণ্য হত্যাযজ্ঞের দ্বিতীয় কোনো নজির বিশ্বে নেই।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণ আর ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর জল, স্থল আর আকাশপথে সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরাজয়ের খবর চারদিক থেকে ভেসে আসতে থাকে। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। 

৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। আর জাতি অর্জন করে হাজার বছরের স্বপ্নের স্বাধীনতা।

মহান এ বিজয়ের মাস উদযাপনে জাতীয় কর্মসূচির পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকে বিস্তারিত কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।

আগামী ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবারের বিজয় উদযাপন উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান উপদেষ্টার বাণী প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশসহ সংবাদপত্রগুলো বিশেষ নিবন্ধ, সাহিত্য সাময়িকী ও ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হবে। ওই দিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশের সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবন এবং বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাস ও মিশনগুলোতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে।

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, বিটিভি, বাংলাদেশ বেতার ও বিভিন্ন বেসরকারি বেতার বা টিভি চ্যানেলে সঠিক মাপ এবং রংসহ জাতীয় পতাকা উত্তোলনের বিধি-বিধান জনসাধারণের জন্য প্রচারের ব্যবস্থা করবে। গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি ভবন ও স্থাপনায় আলোকসজ্জা করা হবে। তবে ১৪ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে আলোকসজ্জায় আলো জ্বালানো যাবে না। ১৬ ডিসেম্বর সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকাসহ দেশের সব জেলা ও উপজেলায় একত্রিশ বার তোপধ্বনি করা হবে।

ওই দিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে (সকাল ৬টা ৩৪ মিনিট) রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এছাড়া, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টার নেতৃত্বে বীরশ্রেষ্ঠ পরিবারের সদস্যরা, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা, বীর মুক্তিযোদ্ধারা ও বিদেশি কূটনীতিকরা পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অনুরূপ কর্মসূচি পালিত হবে। ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় বিভাগ, জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশ, জাতীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত পরিবেশন, কুচকাওয়াজ ও ডিসপ্লে প্রদর্শনসহ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।

মহান বিজয় দিবস উদ্‌যাপন উপলক্ষে সারা দেশে নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। আজ ঐতিহাসিক কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে মশাল রোড শোর মাধ্যমে এবারের উদ্‌যাপন কর্মসূচি শুরু করবে দলটি। আগামী ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে মহাসমাবেশ করারও ঘোষণা দিয়েছে। 

ঢাকা/ইভা   

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আজ ঠাকুরগাঁও মুক্ত দিবস
  • বাংলাদেশ নিয়ে জর্জ হ্যারিসনের কথা
  • ৫ দিনের ছাতক যুদ্ধ বেকায়দায় ফেলে পাকিস্তানি বাহিনীকে
  • সংযুক্ত আরব আমিরাত: মরুভূমির বুকে ঐক্যের বিজয়
  • খলাপাড়ার গণহত্যা দিবস: স্বাধীনতার প্রান্তে শহীদ হন ১০৬ জন
  • এক রেহানার বিষাদগাথা
  • গৌরবময় বিজয়ের মাস শুরু
  • পঞ্চগড়ে বিজয়ের দিনে বিষাদের ছায়া