Samakal:
2025-11-02@23:23:31 GMT

এই চিঠি পোস্ট করা হয়নি

Published: 30th, January 2025 GMT

এই চিঠি পোস্ট করা হয়নি

একটা পোস্ট অফিসের বারান্দা লাল সুরকি দিয়ে তৈরি। অফিস ঘরের জানালায় লম্বা গরাদ। গরাদের শরীর আঁকড়ে ধরেছে মাধবীলতার ঝাড়। ভিতরে জানালা ঘেঁষে পুরোনো দিনের মেহগনি কাঠের একটা টেবিল। টেবিলের ওপর নানান কাগজপত্রের স্তূপ। একটা কাঠের বাটিভর্তি আঠা। যতদূর মনে পড়ে গ্রামে ‘গদ’ বলত সবাই। ড্রয়ার টানলে ভর্তি ডাকটিকিট, এনভেলপ, কাঠের তৈরি সিল। আমাদের বাড়ির পোস্ট অফিস যেখানে একদা পায়ে ঘুঙুর বেঁধে বর্শা হাতে রানার আসত অনেক রাতে। মানুষটার চোখ জ্বলজ্বল করত নানান উত্তেজনায়। সবকিছুরই নিজস্ব ঘ্রাণ থাকে। যেমন থাকে লিখে রেখে দেওয়া কোনো চিঠির মধ্যে। শব্দের গন্ধ কী রকম হয়? 
আমি টেবিলে বসে তোমাকে চিঠি লিখছি। তুমি বাড়ির পুকুরঘাটের অসংখ্য সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছ ভেজা কাপড় হাতে। উঠানে রৌদ্রে মেলে দিচ্ছ সাদা শাড়ি। টিয়া পাখিদের ব্যস্ত ওড়াউড়ি, হাওয়ায় বাতাবি লেবুর গাছের নিচে ঝরে পড়ছে অসংখ্য ফুলের অসমাপ্ত বেদনা।
তুই অনেক দিন চিঠি লিখিস না। শরীর ভালো আছে তোর? ভালো করে খাওয়াদাওয়া করিস।
কে বলল লিখি না? এই যে লিখছি চিঠি তোমাকে। চিঠিতে প্রিয়তমাসু অথবা সুচরিতাসু সম্বোধন লেখার বয়সে দক্ষিণের ঘরে বসে লিখছি তোমাকে। তুমি খাবার ঘরের চৌকির ওপর বড় বোলে ভাত বেড়ে রাখছ, কাচের ফুল তোলা ছোট প্লেট দিয়ে ঢেকে রাখছ লাউ আর চিংড়ি মাছ দিয়ে শীতকালে রাঁধা মিষ্টি তরকারি। তুমি কিছুই জানতে পারছ না। একটা বড় চিঠি লিখছি আমি তোমাকে।
দাদু, কেমন আছ তুমি? অনেক দিন হলো তোমার চিঠি পাই না। আমাদের একতলা বাসার পেছনের বারান্দায় এই শীতে ভুলু কুকুরটা অনেকগুলো বাচ্চা দিয়েছে। ওদের পিচবোর্ড দিয়ে ঘেরা একটা জায়গায় বস্তা পেতে ওদের রাখার ব্যবস্থা করেছি। জানো, অনেক রাতে বাসায় এখনও চোর আসে। যদি বাচ্চাগুলো চুরি করে! তাই রাতে ওদের তোমার ঘরে এনে রাখি।
হারিকেনগুলোর চিমনি পরিষ্কার করতে এসেছে অলোক ভাই বিকালবেলা। উত্তরের ঘরের বারান্দায় সার দিয়ে রাখা বাতিগুলো সন্ধ্যা নামলে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠবে বিভিন্ন ঘরে। শীতের কুয়াশা ভাঁজ খুলে ছড়িয়ে যাচ্ছে মহিষখোলার মাঠে। অন্ধকার জমছে জাম গাছের গোড়ায়। লেবু ঝোঁপের আড়ালে জেগে উঠছে জোনাকি।
তোকে একটা চিঠি দিয়েছি পরশু। পেলি কিনা জানাবি। ভেবেছিলাম গত পরশু তুই আসবি। মনে হচ্ছিল তোর কথা। সেই কবে ঢাকায় গেলি। বললি এক সপ্তাহ পর আসবি। কই, এলি না তো! মিনা মিয়াকে পাঠিয়েছিলাম মানিকনগর ঘাটে। ও দুপুর পর্যন্ত বসে থেকে ফিরে এসেছে। জানিস, রান্নাঘরের পাশে মরিচ গাছটা ঝাঁকিয়ে মরিচ হয়েছে এবার। সবুজ গোল গোল মরিচ। পরিষ্কারের মা আজকে সকালে এসেছিল ভাঁপা পিঠা বানাতে। তোর ভাবি মানা করে দিয়েছে। অনুর একটাই কথা– বুবু, ছেলেটা বাড়ি এলে পিঠা বানাব। 
শীত পার হয়ে বসন্তে পড়েছে মাস। আমি কি এখনও চিঠি লিখে চলেছি তোমাকে? ঘুম থেকে উঠে লিখছি, ঘুমের মধ্যে লিখছি। ঘরের দরজায় ধাক্কা দিয়ে তুমি বলছ, নাশতা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, খাবি আয়। উঠানে বড় মোরগটা ডাকছে ডানা ঝাপটে। গোয়ালঘরে কেউ গরুর দুধ দোয়াচ্ছে। শীত শেষ হয়ে গেছে দেখে আলস্য ভেঙে কোকিল ডাকছে দূরে। আচ্ছা, তুমি আমাকে প্রথম কবে কোলে নিয়েছিলে সেই শিশুকালে? ১৯৬৪ সালের মার্চ না এপ্রিল মাসে? তারিখটা মনে আছে নাকি ভুলে গেছ? তখন কি এই শহরে এত কোকিলের উৎপাত ছিল? 
সেই যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে একটা নিভুনিভু শান্ত পাড়ার টিনের বাড়িতে আমার জীবনের শুরু। তারপর থেকেই তোমার কোলেপিঠে বড় হয়ে ওঠা। সাদা থানে তরকারি আর জর্দার গন্ধ মিলেমিশে গিয়ে কবে যেন আমার আশ্রয়ের চিরস্থায়ী ঘ্রাণ হয়ে উঠেছিলে তুমি। আজও কি তুমি তোমার আঁচলে আড়াল করে রাখতে চাও আমাকে? 
তোমার মনে পড়ে, রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভীষণ বারুদ মাখা বিস্ফোরক দিনগুলোতে আমার জন্য দুপুরবেলা ভাত আগলে বসে থাকতে? আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাড়ি না ফিরলে ভাত খেতে না। আমি বাধ্য হয়ে ফিরতাম। আমার পরনের শার্টে তখন টিয়ার গ্যাসের ঝাঁজের বদলে তোমার অপেক্ষার দাগ লেগে থাকত। নেশায় ভীষণ লাল আমার চোখে জেগে থাকত ঘরে ফেরার পথ। 

আমি চিঠি লিখছি। একটাই চিঠি লিখে চলেছি। একটা জীবন ধরেই তো লিখছি তোমাকে। কোনো একদিন আমি গ্রামে যাচ্ছি হয়তো। দুপুরে তুমি লঞ্চঘাটে ছাতা হাতে লোক পাঠিয়েছ। তার চোখ ফাঁকি দিয়ে আমি ঘাটের ঢাল বেয়ে নেমে পড়েছি সড়কে। মাথার ওপর জুন মাসের রোদ। খালের পানিতে যেন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। গাছগুলো ক্লান্ত রোদ সহ্য করতে করতে। হাওয়া ভেসে আসছে ক্ষেতের ওপর হাত বুলিয়ে। ভেজা পাটখড়ির গাদা থেকে কেমন একটা গন্ধ। তোমার মনে পড়ে, সেই দিনগুলির কথা? অপেক্ষা মৃত্যুর চেয়েও কষ্টের। 
নয় বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল তোমার। চৌদ্দতে সাদা থান পরে ফিরলে বাপের বাড়িতে। কোলের কাছে ধরা দুই সন্তান। তখন সাদা শীতের মতো ছিল তোমার জীবন? কখনও সেই শীত কেটেছিল কি? চিঠি, চিঠি, চিঠি। অনেক শব্দ লেখা কাগজ উড়ছে দেখো আমাদের গ্রামের বাড়ির বৈঠকখানার পোস্ট অফিসের বারান্দায়। চিঠি উড়ছে এই শহরে ভাড়া বাড়ির ঘরে, হাসপাতালের বেডে। সব তোমার আমাকে লেখা চিঠি, সব আমার তোমাকে লেখা চিঠি।   
হলুদ রঙের খাম, পোস্টকার্ড। তাতে লাগানো ডাকটিকিটে চা বাগানের ছবি, ইলিশ মাছের ছবি। তুমি নানান ছবিওয়ালা ডাকটিকিট লাগিয়ে আমাকে চিঠি লিখতে। চীন দেশে তৈরি একটা কালির কলম ছিল তোমার। মাঝে মাঝে আমাকে কালি ভরে দিতে বলতে। রাতে সব কাজ শেষ করে কাঠের চেয়ার-টেবিলে বসে চিঠি লিখছ তুমি। আমি আজও দেখতে পাই তোমার চশমার কালো ফ্রেম, মনোযোগী দৃষ্টি কাগজে ফুটিয়ে তুলছে গুটি গুটি অক্ষর। তুমি আমাকেই চিঠি লিখে চলেছ। আর আমি দূরত্বে বসে দেখছি তোমাকে। আমাদের দুজনের মাঝে নিঃশব্দ সম্পর্কটা কবে থেকে গড়ে উঠেছিল? বাড়ি গেলে তোমার বিছানার পাশে দাঁড়ানো বহু পুরোনো কাঠের আলমারিটার ওপর ছিল আমার একচ্ছত্র অধিকার। তোমার ব্যবহৃত পানি খাওয়ার গ্লাস, পান রাখার পেতলের পাত্র, পানির সোরাই, কাঠের তলায় ট্রাংকে পুরোনো বইপত্র, ভাঁজ করা জাপানি পাখা, কাচের বাক্সে রাখা রুশ দেশের পুতুল– সবকিছু ছিল আমার একান্ত নিজস্ব। ভীষণ এক দাবি তোমার প্রতি আমার। তোমারও তাই ছিল আমি জানি। ওই আলমারিতে বিস্কুটের কৌটাটাও বাড়ি গেলে আমার হয়ে যেত। গ্রামের বাজার থেকে কেনা নাবিস্কো বিস্কুটের ঘ্রাণে জীবন ভরে উঠত একদা। জানো, তোমার পানি খাওয়ার গেলাসটা আমি আজও ব্যবহার করি। ওই গেলাসের গায়ে তোমার নামের আদ্যক্ষর খোদাই করা– এইচবি, হাসিনা বানু। 
আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা ছিল মহাভারতের ধৃতরাষ্ট্রের ন্যায় অন্ধ। কিছু সম্পর্ক এ রকমই হতে হয় এখন বুঝি। টেকেন ফর গ্রান্টেড বলে একটা কথা আছে। আমিও তোমার কাছে তাই ছিলাম। কেউ বলত, প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তুলেছ তুমি আমাকে। কিন্তু তীব্র ভালোবাসা পাওয়ার অনুভূতি ছাড়া জীবনের অনেক অনুভূতি মরে যায়। মানুষ তা জানতে না পেরেই মরে যায়। আমার শেষ পাওয়া চিঠির ডাকনাম ভালোবাসা ছিল আমি আজ বুঝতে পারি। 
আমার চলার পথ এখনও স্থির নয়। কেঁপে উঠি আজও পথ বদলের ধাক্কায়। আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হই। আমার মাথার চুল সাদা হয়ে গেছে। মুখের রেখায় বয়সের দাগ। উচ্ছৃঙ্খল আর উদ্বাস্তু রয়ে গেলাম একটা জীবন। তুমি জানো, ছোটবেলায় অসুখ করলে মনে হতো, তোমাকে জড়িয়ে ধরলে আমার সব অসুখ সেরে যাবে? যেতও তাই। ভালোবাসার জোর বোধ হয় একেই বলে। কবে জড়িয়ে ধরেছিলে শিশু শরীর আমার, শীতের মতো সাদা শাড়ি পরিত্রাণ হয়েছিল আমার তার ইতিহাস জানে আমার সব না-লেখা চিঠির ভূমিকা। 
কত চিঠি লেখা হয়েছিল একদিন। রানার আসেনি। সেই গ্রামের বৈঠকখানার পোস্ট অফিস আজ ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার চিঠির শুরুতে লেখা থাকত– শ্রদ্ধাভাজনেষু দাদু। তুমি লিখতে, কল্যাণীয়েষু অদিত। ডাকঘর মৃত চিঠি বহন করে না বলে শুনেছি। আজন্ম ভালোবাসার কাঙাল আমি আজও চিঠি লিখে চলেছি শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে। তোমার স্নেহের হাওয়া কবে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আমি ডাকঘর খুঁজি হয়তো আজও। খুঁজি পুরোনো দিনে লেখা চিঠির শব্দগুলো। লিখতে বসে তোমাকে লেখাই হলো না আমার অভিমান আর যন্ত্রণার ভূমিকা। চিঠিগুলো ডাকঘরে জমে থাকা শীত শেষে মরে যাওয়া কুয়াশার মতো তোমার সাদা আঁচলের সূত্র খুঁজতে খুঁজতে এতদূর। 
ভালো কথা, ইতি শব্দটা বড় মারাত্মক। কেমন সব শেষ হয়ে যাওয়ার গন্ধ লেখে থাকে দুটি শব্দের শরীরে। আমি কোনোদিন লিখতে চাইনি তোমাকে এমন শব্দ। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

আফগানিস্তানে মধ্যরাতে শক্তিশালী ভূমিকম্পের আঘাত

আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় হিন্দুকুশ অঞ্চলে ৬ দশমিক ৩ মাত্রার একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। যুক্তরাষ্ট্র ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) এ তথ্য জানিয়েছে। দুই মাস আগেই দেশটিতে এক ভূমিকম্পে কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।

ইউএসজিএস জানায়, রোববার দিবাগত রাতে আফগানিস্তানের হিন্দুকুশ অঞ্চলে মাজার-ই-শরিফ শহরের কাছে খোলম এলাকায় ভূমিকম্পটি আঘাত হানে। স্থানীয় সময় রাত ১২টা ৫৯ মিনিটে আঘাত হানা এই ভূমিকম্পের গভীরতা প্রথমে ১০ কিলোমিটার বলা হয়। পরে তা সংশোধন করে গভীরতা ২৮ কিলোমিটার বলে জানায় সংস্থাটি।

আফগানিস্তানের জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থা জানিয়েছে, হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পরে জানানো হবে।

উল্লেখ্য, গত ৩১ আগস্ট আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতী ভূমিকম্পটি আঘাত হেনেছিল। দেশটির পূর্বাঞ্চলে আঘাত হানা রিখটার স্কেলে ৬ মাত্রার ওই ভূমিকম্পে ২ হাজার ২০০ জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারান।

আরও পড়ুনআফগানিস্তানে ভূমিকম্পে নিহত বেড়ে ২২০৫, খোলা আকাশের নিচে মানুষ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

আফগানিস্তানে প্রায়শই ভূমিকম্প আঘাত হানে। বিশেষ করে হিন্দুকুশ পর্বতমালা বরাবর, যেখানে ইউরেশীয় এবং ভারতীয় টেকটোনিক প্লেটগুলো মিলিত হয়েছে।

ব্রিটিশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার ভূমিকম্পবিদ ব্রায়ান ব্যাপটির দেওয়া তথ্য মতে, ১৯০০ সাল থেকে উত্তর-পূর্ব আফগানিস্তানে রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার বেশি ১২টি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে।

আরও পড়ুন৩৫ বছরে আফগানিস্তানে ভয়াবহ যত ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ