সরাসরি কোনো ছাত্র সংগঠনের কর্মী না হলেও ’৬৯ ও ’৭০ সালের রাজনৈতিক উত্তাল দিনগুলোতে মিছিল-মিটিংয়ে সক্রিয়ভাবে অংশ নিই। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল ভারতে যাই। সেখানে ৭ এপ্রিল থেকে শিলিগুড়ির মুজিব ক্যাম্পে মাসব্যাপী গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শেষে ৬ নম্বর সেক্টরের নীলফামারী জেলা সীমান্তের হিমকুমারী ক্যাম্পে যোগদান করি। সেখানে ১ নম্বর কোম্পানির সেকশন কমান্ডার হিসেবে বিভিন্ন ব্রিজ, কালভার্ট, বিওপি ইত্যাদি ধ্বংস ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার দায়িত্ব পালন করি।
মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের প্রতিটি দিন অনেক স্মৃতিবিজড়িত। আমাদের তরুণ, যুবক, ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক সহযোদ্ধা হিসেবে মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। অনেকে শহীদ হয়েছেন, অনেকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে আমাদের সহযোগিতা দিয়েছেন। বিশেষ করে যে গ্রামীণ নারীরা সহযোগিতা দিয়েছেন, তারা এখন ইতিহাসের আড়ালে। ১৯৭১-এর ১৭ ডিসেম্বর রংপুরে ফিরে মেডিকেল কলেজে স্থাপিত ক্যাম্পে অস্ত্র জমা দিয়ে বাসায় ফিরে আসি। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি প্রিয়জনের সান্নিধ্য পাওয়ার। পরদিন সকালে আমার প্রিয় সংগঠন রংপুর টাউনহলের পেছনে শিখা সংসদে এসে যা দেখতে পাই, তা ভাষায় বর্ণনাতীত। তখনও টাউনহলের গ্রিন রুমে একজন নারী পানি পানি বলে হাঁকছিলেন। শিখার পিয়ন নির্মলকে পানি দিতে বলি। নিয়তির নির্মম পরিহাস, পানি পানের পরপরই ওই নারী জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন, আর কিছু বলতে পারেননি। আরেকটি মেয়ে তার হাতের আঙুলের রক্ত দিয়ে হলের দেয়ালে লিখেছিল– ‘আমি বাঁচতে চাই।’ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের কাউকেই বাঁচতে দেয়নি। তারা রংপুর অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে নারী-পুরুষকে ধরে নিয়ে এসে এখানে তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। ১৮ ডিসেম্বর সকালেও টাউনহলের পেছনের হর্টিকালচার ফার্মে অসংখ্য মানুষের লাশ শেয়াল-কুকুরে টানাহ্যাঁচড়া করে। টাউনহলের পেছনের পাকা ইঁদারায় পড়ে ছিল অসংখ্য ধর্ষিত নারীর লাশ। এ সময় ১৬৭টি মাথার খুলি উদ্ধার করা হয়েছিল টাউনহল বধ্যভূমি থেকে। কিছু লাশের অংশবিশেষ ফার্মের মাটিতে গর্ত করে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল। এরপর ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির পশ্চিমাংশের একটি কক্ষে দেশের প্রথম মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন ‘মুক্তিসেনানী সংস্থা’ গঠন করা হয়। এর সভাপতি ছিলেন তখনকার পাবলিক লাইব্রেরিয়ান এবং পরে সরকারের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহাবুব উল আলম। যিনি মুক্তিযুদ্ধের ওপর কয়েকটি বইও লিখেছেন। আমি ছিলাম ওই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। 
১৯৭১ সালের উত্তাল ৩ মার্চ। এদিন ছিল রংপুরের জন্য এক ঐতিহাসিক দিন। মহান মুক্তিযুদ্ধে রংপুরে প্রথম শহীদ হন ১১ বছরের টগবগে কিশোর শঙ্কু সমাজদার, যার রক্তে রক্তাক্ত হয়েছিল রংপুরের মাটি। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল বিদ্রোহের আগুন। সারাদেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। এদিন অবাঙালির গুলিতে নিহত হন কিশোর শঙ্কু। পাকিস্তানি দখলদারদের শোষণ-শাসন এবং ষড়যন্ত্র থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল রংপুরের মানুষ। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ যুবক, ছাত্র, কৃষক, দিনমজুর, নারী-পুরুষসহ সর্বস্তরের মানুষ রংপুর শহরের কাচারিবাজারে সমবেত হয়েছিল। সকাল ৯টায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া কৈলাসরঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র শঙ্কু সমাজদারও শহরের গুণপাড়ার বাসা থেকে বেরিয়েছিল মিছিলে অংশগ্রহণের জন্য। মিছিলটি শহরের তেঁতুলতলা (বর্তমান শাপলা চত্বর) এলাকায় আসতেই কলেজ রোড থেকে কারমাইকেল কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি শহীদ মুখতার ইলাহি, জিয়াউল হক সেবুসহ অন্যদের নেতৃত্বে আরেকটি মিছিল এসে যোগ হয় মূল মিছিলের সঙ্গে। মিছিলটি আলমনগর এলাকায় অবাঙালি ব্যবসায়ী সরফরাজ খানের বাসার সামনে যেতেই কিশোর শঙ্কু ওই বাসার দেয়ালে উর্দুতে লেখা সাইনবোর্ড দেখে তা নামিয়ে ফেলতে ছুটে যায়। তখনই বাসার ছাদ থেকে মিছিলে গুলিবর্ষণ করা হয়। সেখানে গুলিবিদ্ধ হয় মিছিলে আসা স্কুলছাত্র শঙ্কু সমাজদার। গুলির বিকট শব্দে মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। মাটিয়ে লুটিয়ে পড়া গুলিবিদ্ধ কিশোর শঙ্কুকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালের দিকে। কিন্তু ততক্ষণে ইতিহাস রচিত হয়ে গেছে। পথেই কিশোর শঙ্কু মারা যায়। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সারাদেশের ভূমিকার পাশাপাশি সংগ্রামী ও অবহেলিত জনপদ রংপুরের অবদান ছিল অগ্রগণ্য।

অনুলিখন
স্বপন চৌধুরী
রংপুর অফিস

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: দ বস হয় ছ ল স গঠন

এছাড়াও পড়ুন:

ব্যক্তি উদ্যোগে গড়া সংগ্রহশালা, আছে ৪০০ বছর আগের ইটসহ নানা দুর্লভ জিনিস

পুরোনো ক্যালকুলেটর, শত বছরের পুরোনো টাইপ রাইটার, ১৩০ বছর আগের ঘড়ি, দেড় শ বছরের পুরোনো লাঠি, ৪০০ বছর আগের ইট, গ্রামোফোনসহ নানা দুর্লভ জিনিসে ভরা এক সংগ্রহশালা। এটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার বাসিন্দা আলী মাহমেদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে উঠেছে।

আখাউড়ার বড় বাজার মসজিদের পেছনে আলী মাহমেদের বাড়ি। সম্প্রতি সেই বাড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়ে চারপাশজুড়ে থাকা গাছপালা। বাড়িটির উত্তর দিকে আখাউড়া রেলওয়ে জংশন স্টেশন। দক্ষিণ দিকে গাছের গুঁড়ি দিয়ে বানানো চেয়ার। আছে ফায়ারপ্লেস। ঘরে ঢুকতেই পুরোনো সব জিনিস স্বাগত জানায়, নিয়ে যায় সুদূর অতীতে। বাড়ির প্রতিটি কক্ষ, সিঁড়ির পাশের প্রতিটি দেয়াল পুরোনো নানা জিনিস দিয়ে সাজানো।

ফায়ারপ্লেসের স্থানে ৪০০ বছর পুরোনো ইট। তির, ধুনক, টাইপরাইটার, গ্রামোফোন, ভিনাইল রেকর্ড, বুকশেলফে সাজানো সারি সারি বই। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতেই হাতের বাম পাশের দেয়ালে শেলফে পুরোনো টেপ রেকর্ডার, কম্পিউটার, বাদ্যযন্ত্র, ক্যাসেট প্লেয়ার, ১৯৫৭ সালের টেলিফোন সেট, পুরোনো ছোট টেলিভিশন। আরেকটি শেলফে সাজানো বিভিন্ন ধরনের পুরোনো জিনিসের সংগ্রহ।

আলী মাহমেদ একজন লেখক। তিনি এলাকায় সবার কাছে মোহাম্মদ আলী নামে পরিচিত। তাঁর বাবা প্রয়াত নিজাম উদ্দিন আহমেদ আখাউড়ার দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন। দেশি-বিদেশি লেখকের বই, নিজের লেখা সব বই এবং নব্বইয়ের দশকে পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রতিটি লেখা যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছেন আলী মাহমেদ।

পুরোনো জিনিস সংগ্রহে নিজের আগ্রহের প্রসঙ্গে আলী মাহমেদ বলেন, ‘১৯৮৩ সালে বাবা মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর বাবার সবকিছু জুতা, মোজা, চশমা ইত্যাদি সংগ্রহ করা শুরু করি। সম্ভবত এখান থেকেই দুর্লভ-দুষ্প্রাপ্য জিনিসপত্র সংগ্রহের আগ্রহ তৈরি হয়। প্রাচীন, দুর্লভ জিনিসপত্র সংগ্রহ করার শখ হয়। যখন যেখানে যা পেয়েছি সংগ্রহ করে রাখার চেষ্টা করেছি। যাঁরা আমাকে চেনেন, তাঁরা জানেন আমি দুর্লভ জিনিসপত্র সংগ্রহ করতে পছন্দ করি। বিভিন্ন এলাকার অনেক লোক নিজ উদ্যোগে ঐতিহ্যবাহী মূল্যবান জিনিসপত্র এনে আমার কাছে দিয়ে গেছেন।’

আখাউড়ায় আলী মাহমেদের সংগ্রহে হুঁক্কা, বল্লম, বদনা, পাদুকা, থালাবাটি, কোরবানির ছুরি, যুদ্ধের অস্ত্র, কলের গান, ঢাকঢোল, মঙ্গলসূত্র, মাটির তৈরি তৈজসপত্র, বাঁশের খড়ের পণ্য, ঘোড়ার চাবুক, খুন্তি, লাঙল, দা, মই, হাতুড়ি, ফলা, কাস্তে, পুঁথি, বাঁশি, সানাই, টোপর, তযবিহ, জায়নামাজসহ হাজারখানেক জিনিসপত্র আছে। তবে সন্তানদের পড়াশোনার জন্য তাঁকে ঢাকায় থাকতে হচ্ছে। অনেক জিনিস তিনি ঢাকার বাসায় নিয়ে গেছেন। 

ঢাকার বাসায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পরনের কাপড়, গুলির বাক্স, তামার বুলেট ও খোসা, ১৯৬০ সালের ক্যামেরা, পুরোনো ইয়াসিকা ক্যামেরা, টিঅ্যান্ডটির সঙ্গে ব্যবহৃত প্রাচীন মডেম, ১৯৯৬ সালে কেনা বাংলা সফটওয়্যার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মেডেল, চোখ পরীক্ষা করার যন্ত্র, তাঁর নানির ১৯৪২ সালের শাড়ি, ১৯৫৫ সালের পত্রিকা তওহীদ–এর একটি কপি, টেলিস্কোপ, জাহাজের বাতি ও কম্পাস, রেলের বাতি (লাল, সবুজ ও হলুদ), কলমের কালি রাখার পাত্র, সিলভারের পানদানি, তাঁর নানার ১৯৪২ সালের চশমা, বাবার হাতের ঘড়িসহ অনেক কিছু রেখেছেন।

আলাপে আলী মাহমেদ জানালেন, আবদুল জব্বার বীর প্রতীক তাঁকে ১৯৭১ সালের গুলির বাক্স দিয়েছেন। একজন পবিত্র হজ পালনে গিয়েছিলেন। ফেরার সময় তাঁর জন্য মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর রওজা শরিফের একটি পাথর এনেছিলেন। সেটি তিনি নিজের সংগ্রহশালায় রেখে দিয়েছেন। 

স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে আলী মাহমেদের সংসার। স্ত্রী ফারজানা আফরোজ গৃহিণী। ছেলে আহমেদ ইফতেখার অর্থনীতিতে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন এবং মেয়ে নাহিয়ান আঞ্জুম মাইক্রোবায়োলজি নিয়ে পড়াশোনা করছেন। তিনি জানালেন, সংগ্রহশালার জিনিসপত্র নিয়ে ছেলের বেশ আগ্রহ আছে। তাঁর স্ত্রী নিয়মিত এসব পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন করে তাঁকে সহায়তা করেন।

আলী মাহমেদের সংগ্রহের বেশির ভাগই আখাউড়ার বাড়িতে। তাঁর কাছে এমন অনেক জিনিস আছে, যেগুলো তরুণ প্রজন্ম নিজের চোখে দেখেনি। তাদের জন্য তিনি এসব রেখে যাচ্ছেন। তাঁর আশা, এগুলো একদিন সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেবে সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আকাশপথে কিলো ফ্লাইটের আক্রমণ
  • পাকিস্তানে বাঙালি বন্দিশিবিরের গোপন ইতিহাস
  • ব্যক্তি উদ্যোগে গড়া সংগ্রহশালা, আছে ৪০০ বছর আগের ইটসহ নানা দুর্লভ জিনিস
  • ২২টি যুদ্ধের পর শত্রুমুক্ত হয় কুষ্টিয়া
  • এবারের নির্বাচনের লড়াইটা কঠিন: মির্জা ফখরুল
  • বিজয়যাত্রার সূচনা হলো সর্বাত্মক যুদ্ধে
  • টাঙ্গাইল শত্রুমুক্ত হয় ১১ ডিসেম্বর
  • সে ছিল ক্যাটালিস্ট
  • গ্রেনেড ছোড়ার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন ফোরকান বেগম