বছর পেরিয়ে আবারও শুরু হচ্ছে কান চলচ্চিত্র উৎসব। এবার ৭৮তম আসর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আগামী ১৩ মে, ফ্রান্সের কান শহরের পালে দ্য ফেস্টিভ্যাল ভবনে। উৎসবের দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ১৪ মে লাল গালিচা হয়ে গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়েরে হাজির হবেন হলিউড সুপারস্টার টম ক্রুজ। এদিন তাঁর নতুন সিনেমা ‘মিশন: ইমপসিবল– দ্য ফাইনাল রেকনিং’-এর অফিশিয়াল স্ক্রিনিং হবে।
এ আয়োজনে টমের সঙ্গে থাকবেন পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার ক্রিস্টোফার ম্যাককোয়ারি এবং পুরো টিম। এটি হবে টমের তৃতীয় কান সফর। প্রথমবার তিনি এসেছিলেন ১৯৯২ সালে, রন হাওয়ার্ডের ‘ফার অ্যান্ড অ্যাওয়ে’ নিয়ে। দীর্ঘ বিরতির পর ২০২২ সালে টম কানে ফিরেছিলেন ‘টপ গান: ম্যাভরিক’ নিয়ে। সেই সফর ছিল একেবারে স্মরণীয়। তখন তাঁকে প্রদান করা হয়েছিল গৌরবসূচক পাম দ’র।
জানা গেছে, প্রায় তিন দশকের অ্যাকশন, স্টান্ট আর ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত সমাপ্তি হতে চলেছে ‘মিশন: ইমপসিবল– দ্য ফাইনাল রেকনিং’ সিনেমার মাধ্যমে। এবারের পর্বে আরও অভিনয় করেছেন হেইলি অ্যাটওয়েল, ভিং রেইমস, সায়মন পেগ, এসাই মোরালেস, পম ক্লেমেন্টিয়েফ, হেনরি জার্নি, মারিয়েলা গ্যারিগা, অ্যাঞ্জেলা ব্যাসেট প্রমুখ। ছবিটি ফ্রান্সে মুক্তি পাচ্ছে ২১ মে আর যুক্তরাষ্ট্রে ২৩ মে।
এদিকে ৭৮তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে রবার্ট ডি নিরোকে সম্মানসূচক পাম দ’র প্রদান করা হবে। পাম দ’র প্রাপ্তির ঘোষণা পেয়ে ডি নিরো বলেন, ‘কান উৎসবের প্রতি আমার গভীর অনুভব রয়েছে। এখন, যখন বিশ্ব নানা বিভাজনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন কান আমাদের একত্রিত করে– গল্পকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা, দর্শক ও বন্ধুদের। এটা যেন ঘরে ফেরার মতো।’
২০২৫ সালে কান উৎসবের মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে নির্বাচিত হয়েছে ২২টি চলচ্চিত্র, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত নির্মাতাদের নতুন কাজ, পাশাপাশি বেশ কিছু নতুন নির্মাতার অভিষেক চলচ্চিত্র।
ফরাসি নির্মাতা এমিলি বোনিনের ‘লিভ ওয়ান ডে’ সিনেমার প্রদর্শনী দিয়ে শুরু হবে উৎসব। ওয়েস অ্যান্ডারসনের ‘দ্য ফোনিশিয়ান স্কিম’, রিচার্ড লিংকলেটারের ‘নুভেল ভ্যাগ’, অ্যারি অ্যাস্টারের ‘এডিংটন’সহ অনেক জনপ্রিয় পরিচালিত সিনেমা এবার অংশ নিচ্ছে প্রতিযোগিতায়। কানের ডেলিগেট জেনারেল থিয়েরি ফ্রেমো ও সভাপতি আইরিশ নব্লোচ গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে এ বছরের লাইনআপ ঘোষণা করেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত ‘দ্য মাস্টারমাইন্ড’ নিয়ে কানে ফিরছেন কেলি রিচার্ড।
২০২১ সালে কান জয়ের পর এবার ‘সেন্টিমেন্টাল ভ্যালু’ সিনেমা নিয়ে উৎসবে ফিরছেন নির্মাতা জোয়াকিন ট্রায়ার। ইরানি পরিচালক জাফর পানাহিও এবার কানে আসছেন তাঁর নতুন সিনেমা ‘আ সিম্পল অ্যাকসিডেন্ট’ নিয়ে। দু’বারের পাম ডি’অরজয়ী ডার্ডেন ব্রাদার্সকে পাওয়া যাবে তাদের নতুন সিনেমা ‘ইয়াং মাদারস’ নিয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার নির্মাতা অলিভার হারমানাস ‘দ্য হিস্টোরি অব সাউন্ড’ দিয়ে এবারই প্রথম কানে পা রাখবেন।
২০২১ সালে স্বর্ণপামজয়ী নির্মাতা জুলিয়া ডুকোরনাউ নিয়ে আসছেন ‘আলফা’ সিনেমা। এ ছাড়া ‘আঁ সার্তে রিগা’, ‘আউট অব কম্পিটিশন’, ‘মিডনাইট স্ক্রিনিংস’, ‘কান প্রিমিয়ার’ এবং ‘স্পেশাল স্ক্রিনিংস’– প্রতিটি বিভাগেই দেখা যাবে নানা ঘরানার, নানা দেশের চলচ্চিত্র।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: টম ক র জ চলচ চ ত র র নত ন
এছাড়াও পড়ুন:
সন্ধ্যা নদীর দুকূলে উৎসবের ঢেউ, উজিরপুরে নৌকাবাইচে মাতলেন হাজারো মানুষ
বরিশালের উজিরপুর উপজেলার সন্ধ্যা নদীর তীরে আজ বৃহস্পতিবারের বিকেলটা ছিল রং, ঢোলের তালে উল্লাস ও হাজারো মানুষের আনন্দমুখর উপস্থিতিতে ভরপুর। আকাশজুড়ে কালো মেঘ—এমন পরিবেশে সন্ধ্যা নদীর বুকজুড়ে ঢেউখেলানো পানিতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল মাঝিদের ‘হা-দে-রে-ও’ কোরাস। অনেক দিন পর নদী ও গ্রামের মানুষ একসঙ্গে ফিরে পেয়েছে তাদের হারানো ঐতিহ্য—নৌকাবাইচ।
বিকেল চারটার দিকে উজিরপুর উপজেলার শিকারপুর কলেজের সামনে থেকে শুরু হয় ‘উজিরপুর নৌকাবাইচ ২০২৫’। প্রতিযোগিতা চলে সেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর এম এ জলিল সেতু পর্যন্ত। পুরো নদীপাড় তখন উৎসবে পরিণত হয়। দুই তীরে মানুষের ভিড়, ঢোলের আওয়াজ, উৎসাহ আর উচ্ছ্বাসে মুখর হয়ে ওঠে সন্ধ্যা নদীর একূল-ওকূল।
উজিরপুর উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা ‘আভাস’-এর যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত এ প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন বরিশালের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বরিশাল জেলা পুলিশ সুপার মো. শরিফ উদ্দীন এবং বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের জনশিক্ষা বিভাগের পরিচালক আসমা ফেরদৌসি। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন উজিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. আলী সুজা। এ আয়োজনে সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ও ইউনেসকো।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘গ্রামবাংলার এই ঐতিহ্য আমাদের সাংস্কৃতিক শিকড়ের প্রতীক। নদী ও নৌকাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই উৎসব আমাদের ঐক্য, সহযোগিতা ও আনন্দের ধারাবাহিকতা টিকিয়ে রাখে। তাই আমাদের নিজেদের প্রয়োজনে এই সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা, লালন করা সবার কর্তব্য।’
এ বছর নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় ছয়টি ‘বাচারি’ নৌকা। প্রতিটি নৌকার নামকরণ করা হয় বাংলাদেশের ইতিহাস, সাহিত্য ও মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের নামে—শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, কবি জীবনানন্দ দাশ, সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল, বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, কবি সুফিয়া কামাল ও জুলাই শহীদ।
গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুর জেলার অভিজ্ঞ নৌকাবাইচ প্রতিযোগী কালিপদ তালুকদার, লাজারেস ফলিয়া, কিরণ মৃধা, সঞ্জয় রায়, শংকর বাড়ৈ ও সৈকত রায় তাঁদের দল ও নৌকা নিয়ে অংশ নেন এই প্রতিযোগিতায়।
গোপালগঞ্জের প্রতিযোগী লাজারেস ফলিয়া বলেন, ‘এর আগে আমরা উজিরপুরের হারতায় ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচে অংশ নিয়েছিলাম, কিন্তু সন্ধ্যা নদীতে এবারই প্রথম। এত মানুষের ভালোবাসা ও উৎসাহ আমাদের দলকে দারুণ অনুপ্রেরণা দিয়েছে।’
নদীর তীরে দাঁড়িয়ে প্রতিযোগিতা উপভোগ করছিলেন বৃদ্ধ সিরাজ মিয়া। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বসিত আট বছরের নাতি। সিরাজ মিয়া বলেন, ‘আমাদের সময় নৌকাবাইচ ছিল গ্রামের সবচেয়ে বড় উৎসব। আজ নাতিকে নিয়ে এসেছি যেন সে দেখতে পারে আমাদের সেই ঐতিহ্য। আগে আমাদের এলাকায় বৈশাখে কিংবা কালীপূজার সময় প্রতিবছর নৌকাবাইচ হতো। সেই উৎসব ঘিরে মানুষের কত আনন্দ-উচ্ছ্বাস ছিল। কিন্তু এখন আর তেমনটা হয় না। অনেক দিন পর এই উৎসবে এসে পুরোনো স্মৃতি মনে পড়ে গেল।’
নৌকাবাইচের আয়োজক উন্নয়ন সংস্থা ‘আভাস’-এর প্রতিনিধি শহিদুল ইসলাম বলেন, এটি ইউনেসকো প্রস্তাবিত ঐতিহ্যবাহী উৎসব। স্থানীয় প্রশাসন ও সাধারণ মানুষের আগ্রহে নৌকাবাইচটি এক উৎসবে রূপ নিয়েছে। সামনেও এমন উৎসবের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার চেষ্টা থাকবে।
প্রতিযোগিতা শেষে অনুষ্ঠিত হয় পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। বিজয়ী দল ছিল শেরেবাংলা ফজলুল হক দল (মাদারীপুরের লাজারেস ফলিয়া দল)। প্রথম রানার্সআপ সেক্টর কমান্ডার এম এ জলিল দল (কালিপদ তালুকদার দল) এবং দ্বিতীয় রানার্সআপ জুলাই শহীদ দল (কিরণ মৃধা দল)।
স্থানীয় তরুণ মো. মাহফুজ বলেন, ‘এই আয়োজন শুধু বিনোদন নয়, বরং বরিশাল অঞ্চলের গ্রামীণ ঐতিহ্য, লোকজ ক্রীড়া ও নদীসংস্কৃতির পুনর্জাগরণ ঘটিয়েছে। আমরা চাই, প্রতিবছর এই আয়োজন অব্যাহত থাকুক।’