ছবি : প্রথম আলো

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

অস্ত্রবাহী জাহাজে আক্রমণ, বদলে গেল যুদ্ধের মোড়

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় টাঙ্গাইলে ছোট-বড় অনেক যুদ্ধ হয়। এর মধ্যে জেলার ভূঞাপুরের মাটিকাটায় জাহাজ ধ্বংস সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। শত্রুপক্ষের প্রচুর অস্ত্র মুক্তিবাহিনীর হাতে চলে আসে। সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল, শত্রুদের মনোবল ভেঙে যায়।

এই যুদ্ধের কথা উল্লেখ আছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস (সেক্টর-এগার), গতিধারা প্রকাশিত মো. হাবিবউল্লাহ বাহারের টাঙ্গাইল জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও অনন্যা প্রকাশিত কাদের সিদ্দিকীর (বীর উত্তম) স্বাধীনতা ’৭১ বইয়ে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস (সেক্টর-এগার) বইয়ে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ৫ আগস্ট দুপুরে কাদেরিয়া বাহিনীর বেতারে ধরা পড়ে যে ঢাকার সদরঘাটের ইপিআর জেটিতে সাতটি যুদ্ধজাহাজে অস্ত্র ও বিভিন্ন রসদ বোঝাই হচ্ছে। এগুলোর গন্তব্যস্থল উত্তরবঙ্গে গাইবান্ধার ফুলছড়িঘাট। সেখান থেকে এসব অস্ত্র খালাস করে রংপুর ও সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে নেওয়া হবে। ১৫ আগস্টের আগেই জাহাজগুলো সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের মাটিকাটা এলাকা অতিক্রম করবে।

একই বইয়ে লেখা হয়েছে, ৯ আগস্ট রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর সাতটি ছোট-বড় জাহাজ হঠাৎ ভূঞাপুরে ধলেশ্বরী নদীর সিরাজকান্দি ঘাটে নোঙর করে। এ খবর দ্রুত পৌঁছে যায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের যে দলটি ছিল, তার দলনেতা ছিলেন হাবিবুর রহমান। তাঁরা সবাই কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্য।

বইটিতে উল্লেখ আছে, টাঙ্গাইল অঞ্চলে যুদ্ধরত কাদেরিয়া বাহিনীর অধিনায়ক কাদের সিদ্দিকী এই বলে হাবিবুর রহমানকে নির্দেশনা দেন যে জাহাজে আক্রমণ করে অস্ত্রশস্ত্র নিতে পারলে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সহজ হবে। এ জন্য তিনি রেজাউল করিমের নেতৃত্বে আরও একটি দলকে তাঁর কাছে পাঠান। মাটিকাটায় তাঁরা অবস্থান নেন। ১১ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে জাহাজগুলো তাঁদের অবস্থানের কাছাকাছি চলে আসে।

একই বইয়ে লেখা আছে, মুক্তিযোদ্ধাদের দল নদীর যে পাড়ে অবস্থান নিয়েছিল, তার পাশ দিয়েই ওই জাহাজগুলো যাচ্ছিল। হাবিবুর সহযোদ্ধাদের বলে দিলেন তাঁর সংকেতের আগে কেউ যেন গুলি না করেন। এর মধ্যে দুটি জাহাজ চলে যায়। সবাই অস্ত্রের ট্রিগারে আঙুল রেখে অপেক্ষা করছেন। এমন সময় বড় দুটি জাহাজ ‘এস ইউ ইঞ্জিনিয়ার্স এলসি-৩’ ও ‘এসটি রাজন’ তাদের সামনে আসে। সংকেত পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা মর্টার, এলএমজি ও রাইফেল থেকে গুলি ছোড়া শুরু করেন। মর্টারের গোলা আঘাত করে সারেঙের কেবিন ও পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানে। হতাহত হন বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা। বেঁচে যাওয়া অন্য পাকিস্তানি সেনারা প্রতিরোধের চেষ্টা না করে দ্রুত স্পিডবোটে পালিয়ে যান। অন্য জাহাজগুলো সাহায্যে এগিয়ে না এসে পালাতে থাকে।

প্রথমা প্রকাশন প্রকাশিত একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা (প্রথম খণ্ড) বইয়ে বলা হয়েছে, হাবিবুরের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধারা জাহাজ দুটি থেকে সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র নামিয়ে নিতে থাকেন। ৬ ঘণ্টায় তাঁরা প্রায় ৫০০ অস্ত্র ও গোলাবারুদের বাক্স নামাতে সক্ষম হন। এরপরও বিপুল অস্ত্র জাহাজে থেকে যায়। ওই ঘটনার পর হাবিবুর রহমানের নাম হয়ে যায় ‘জাহাজমারা হাবিব’।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস (সেক্টর-এগার) বইয়ে উল্লেখ আছে, রাত ১০টায় হাবিবুর আর জাহাজে থাকতে সাহস করেননি। যেকোনো সময় প্রতিপক্ষের হামলার ঝুঁকি ছিল। জাহাজে আগুন ধরিয়ে বাকি অস্ত্র ও গোলাবারুদ ধ্বংস করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। আগুন ধরিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা চলে আসেন। আগুনে গোলাবারুদ বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে দুটি জাহাজই ধ্বংস হয়। জাহাজের লগবুক ও মুভমেন্ট অর্ডার অনুসারে জাহাজের ১ লাখ ২০ হাজার বাক্সে ২১ কোটি টাকার নানা ধরনের চায়নিজ, ব্রিটিশ ও মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র ছিল।

অল্প কিছু অস্ত্র আর অসীম সাহসে মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন যে বীরত্ব দেখিয়েছিলেন, তা টাঙ্গাইল অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যায় অনেক দূর। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের মজুত ও সাহস-মনোবল বাড়ে আর ক্রমেই ভীত হয়ে চলাচল সীমিত করে পাকিস্তানি বাহিনী।

সম্পর্কিত নিবন্ধ