ছবি : প্রথম আলো

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

দুই খণ্ড পাথর

তুমুল অবগাহনের পর রাতটাকে তার ফ্যাদা ফ্যাদা লাগে। মনে হয়, তারাগুলো নিভছে না ওই অন্ধকার বাড়িয়ে দিতেই শুধু। আর চাঁদ যা ঝুলে আছে নিছক কলঙ্কের উপহার, তা–ও শূন্যতার ভেতর দৃশ্যের অন্তরালের অন্ধকার দূর করতে পারছে না। সে আরও অন্ধকারে হারিয়ে যাবার লোভে নাদান নাখান্দার মতো পাহাড়ে উঠতে থাকে। রাতের পাহাড় তাকে আরও বেশি গুলিয়ে ফেললে ঝোপ, লতা আর ক্যাকটাসে তার পা জড়িয়ে যায় এবং বৃত্তের ভেতর তার চক্রভ্রমণ তাকে ক্লান্ত, অবসন্ন, বেকার করে দিলে সে এসবকে ঝেড়ে ফেলে এবং মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নেয় যে তাকে পারতেই হবে এবং তার ভেতরের অদম্য জেদ তাকে প্রবহমান রাখে এবং সে বিরামহীন হাঁটতে থাকে, কখনো পায়ে হাঁটে, কখনো হামাগুড়ি দেয়, কখনো বুকে ভর করে সরীসৃপের মতো তার যাত্রা দুর্লঙ্ঘ।

পাথর আর ঝুরঝুরে মাটির পাহাড় তাকে পিছলে নামিয়ে দিতে চায়। আবার উঠে সে বুক ভরে শ্বাস নেয় একটু। আবার ওঠে। উঠতে উঠতে চাঁদ যখন মধ্য আকাশে প্রায় এবং ঝিঁঝিদেরও ঘুমের সময় হয়ে গেছে আর সরীসৃপেরা শিকার ধরে নিয়ে গর্তে নিশ্চিন্তে প্রবেশ করেছে এবং তাদের ভোজ উৎসবে মেতে উঠেছে এবং যখন পাখিদের ডানা শান্ত এবং যখন ঝরনার জল চুপিচুপি ঝরে, যখন বাঘের থাবা গুটিয়ে নিয়েছে কিংবা সিংহেরা ফিরে গেছে গুহায় এবং শেয়ালেরাও একটু আগে শেষ শিকারটি তুলে নিয়ে ফিরে গেছে তাদের আশ্রয়ে এবং যখন ইঁদুরগুলো দুয়েকটা দিকভ্রম ছোটাছুটি করে গর্তে যাবার চেষ্টাকালে টের পাচ্ছে যে তাদের গর্তের আবাসে কোনো সাপ ঢুকে বসে আছে এবং যখন টুপটাপ ঝরছে না কোনো পাথরও এবং যখন বায়ু চলাচল মন্থর এবং যখন গাছের পাতারাও নিশ্চিন্তে ঘুমায়, ততক্ষণে সে প্রায় চূড়াটির কাছাকাছি চলে এসেছে।

আশ্চর্য হয়ে তারা দেখল, তির ভিন্ন দিকে চলে যাচ্ছে এবং তার গায়ে বিঁধছে না কিংবা বেমালুম হাওয়া হয়ে যাচ্ছে তির কিংবা তাকে ভেদ করে তির চলে যাচ্ছে অথচ সে থাকছে একদম অক্ষত, রক্তপাতহীন, তখন পাহাড়িরা মনে করল, সে নিশ্চয়ই জাদুকর এবং তারা তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাল।

দিনের বেলায় এসেছিল সে এখানে। সকালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী গ্রামে যখন তাকে প্রথম দেখা যায়, তখন ওরা তাকে তির মেরেছিল বিদ্ধ করতে। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে তারা দেখল, তির ভিন্ন দিকে চলে যাচ্ছে এবং তার গায়ে বিঁধছে না কিংবা বেমালুম হাওয়া হয়ে যাচ্ছে তির কিংবা তাকে ভেদ করে তির চলে যাচ্ছে অথচ সে থাকছে একদম অক্ষত, রক্তপাতহীন, তখন পাহাড়িরা মনে করল, সে নিশ্চয়ই জাদুকর এবং তারা তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাল তাদের গ্রামে, কিন্তু সে অভ্যর্থনা প্রত্যাখ্যান করল। এবং যখন তারা ফুল নিয়ে এল তাকে দিতে, তারা দেখতে পেল, পথের মধ্যেই তাদের হাতের ফুল শুকিয়ে যাচ্ছে এবং যখন তারা তার জন্য ফলমূল সংগ্রহ করতে গেল, তখন এমন কোনো ফল পেল না যা কীটদুষ্ট নয়। তখন তারা ভাবল, সে হয়তো অভিশপ্ত, কারণ তার জন্য বহন করা পানিও বিনা রোদে বাষ্প হয়ে যেতে থাকল এবং তিরাসশূন্য, আহারশূন্য মানুষটি অতঃপর যখন বিস্তৃত বটগাছটির নিচে বসল, তখন তাদের মনে হলো, লোকটি ঈশ্বরের কাছাকাছি কেউ এবং তারা নিজেদের তখন দোষারোপ করতে লাগল যে এই লোককে তারা তির দিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিল এবং তার কাছে তারা এখন পর্যন্ত ক্ষমা চায়নি।

এ জন্যই বোধ হয় সবকিছু এমন রহস্যজনকভাবে বদলে যাচ্ছে। এমনকি যখন তারা তাকে তাদের ঐতিহ্যবাহী তামাক ও সুরার পাত্রও প্রস্তাব করার চেষ্টা করল, তারা দেখতে পেল যে তাদের চুয়ানিতে তলানি পড়ে গেছে আর তামাক হয়ে যাচ্ছে পোড়া ছাই। গ্রামটির সবাই তখন একে একে জড়ো হতে থাকল এবং একসময় একটা উৎসবের মতো তারা সবাই দুপুরে সেখানেই খেল এবং লোকটি তেমনি, আগের মতোই নির্বিকার বসে রইল সেখানে। এবং যখন সবার খানা শেষ হলো এবং যখন সবাই ভাতঘুমে ক্লান্ত এবং যখন সত্যি সত্যিই তারা সবাই ঘুমিয়ে গেল এই নির্জন দুপুরে, যা অবিশ্বাস্য হলেও তা–ই ঘটল এবং সে তখন উঠে দাঁড়াল এবং বিস্তৃত বটের পাতার কানে কানে কী যেন বলল এবং ধীর–শান্ত পায়ে পাহাড়ের গভীরে হারিয়ে গেল এবং পরিত্যক্ত একটি গুহা, যা জন্তু–জানোয়ার ব্যবহার করে না এবং গুহাটি যে এলাকায়, সেখানে কস্মিনকালেও কোনো মানুষের পা পড়েনি, সে রকম নির্জন, প্রাণীর চিহ্নহীন একটি গুহায় ঘুমিয়ে পড়ল।

রাত শেষ হবার আগে চূড়াতেও পৌঁছায়। তার মনে হয়, তার নেমে যাওয়া দরকার। যে কাজ সে করতে এসেছে, তা আসলে না করলেও চলে। কিন্তু সে নামতে পারে না। কী যেন অচিন এক শক্তি তাকে আকৃষ্ট করে রাখে এবং সে দেখে, রাতের বাস্তবতায় পাহাড়ের চূড়া থেকে চারপাশের দৃশ্য অন্য রকম অবাস্তব ও অপার্থিব।

ঘুম ভাঙলে বিকেলবেলায় সে দেখতে পেল, পাহাড়ের গুহাটি কোনো এক কালে মানুষের ব্যবহারের উপযোগী ছিল এবং মানুষ তা ব্যবহারও করেছে এবং তারপর কোনো এক কালে পাহাড়ের ধসের কারণে হয়তো মুখটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং এর ভেতরে তিনটা মানুষ আটকা পড়ে আর কালের দীর্ঘ যাত্রায় এখন শুধু লাশগুলোর কঙ্কালের অবয়বের একটা দাগ আছে গুহাটির উপরিভাগের ছাদে এবং তার মনে হয়, ধসের ফলে হয়তো এই পুরো পাহাড়ি অংশ ভেঙে পড়েছিল এবং তখনই গুহার মুখটা বন্ধ হয়ে যায় এবং তারপর দম বন্ধ হয়ে লোক তিনটি মারা যায় এবং তাদের লাশগুলো যখন বহু বছর পড়ে ছিল গুহার ভেতর এবং তত দিনে যখন লাশগুলো কঙ্কালে রূপান্তরিত হয়েছে এবং দেবে গেছে পাথুরে মাটির সাথে, তখন হয়তো আরেকটি ধস নামে এবং আগের মতোই পাহাড়ের পুরো অংশটি ভেঙে পড়ে এবং উল্টে যায়। ফলে লাশের কঙ্কালের চিহ্নগুলো তখন গর্তের ওপরের দিকে চলে যায়।

সে সন্ধ্যার কাছাকাছি সময়ে একবার গুহার বাইরে বেরোতে চায় এবং বাইরে উঁকি দিয়ে দেখে, খাটাশ ও কিছু বনশুয়োর দূরে বিচরণ করছে এবং সে শুনতে পায়, পাখিরা নীড়ে ফিরে যাচ্ছে কিচিরমিচির করতে করতে। সে দুয়েকটি হরিণও দেখতে পায় এবং দেখে কিছু বানর, কুব কুব ডাকতে ডাকতে সেগুলো গাছের ডালে তাদের রাতরচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। সে তখন আবারও গুহার ভেতরে প্রবেশ করে এবং রাত নামার, রাত গাঢ় হবার জন্য অপেক্ষা করে আবার একটি ঘুম দেয়।

দ্বিতীয়বার যখন ঘুম ভাঙে তার, তখন থেকে সে হাঁটছে। হাঁটছে তো হাঁটছে ক্লান্তিহীন। তার পা দুটো ছড়ে যাচ্ছে আর হাঁটু দিয়ে রক্ত ঝরছে, ধুলা–পাথরে তার পোশাক মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে, তার নাক দিয়ে প্রবেশ করছে ধুলা, তার চোখের মধ্যে পড়ছে ধুলা এবং সে সম্মুখীন হচ্ছে বাধার, ঝরঝরে মাটির, লতা–ঝোপের এবং ক্যাকটাসের, এবং তার পা হরকে যাচ্ছে এবং সে পায়ে হেঁটে, হামাগুড়ি দিয়ে, বুকে ভর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এবং তখন তার কাছে চাঁদটাকে মনে হচ্ছে ধোঁয়াশা এবং তারাগুলো তার অন্ধকার আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

সে তবু ওঠে এবং রাত শেষ হবার আগে চূড়াতেও পৌঁছায়। তখন তার মনে হয়, তার নেমে যাওয়া দরকার। যে কাজ সে করতে এসেছে, তা আসলে না করলেও চলে। কিন্তু তবু সে নামতে পারে না। কী যেন অচিন এক শক্তি তাকে আকৃষ্ট করে রাখে এবং সে দেখে, রাতের বাস্তবতায় পাহাড়ের চূড়া থেকে চারপাশের দৃশ্য অন্য রকম অবাস্তব ও অপার্থিব। তার কাছে মনে হয় প্রকৃতি কিছু জমাট অন্ধকারের আখর এবং তার কাছে মনে হয় আকাশ দূরে কোথাও ভেঙে পড়ছে। তখন সে পাহাড়ের চূড়ায় বসে।

জামার পকেট থেকে বের করে আনে বহুকাল ধরে বয়ে বেড়ানো পাথরটিকে। এটিকে আরেকটি পাথরের সাহায্যে সমান দুটুকরায় ভাঙে। অতঃপর একটি খণ্ড নিক্ষেপ করে উত্তর দিকে। শীতরাজ্য ভেদ করে সে পাথর পৃথিবীর অপর প্রান্তে গিয়ে পড়ে। আরেকটি সে নিক্ষেপ করে দক্ষিণ দিকে, সমস্ত বসন্তের হাওয়া অতিক্রম করে সে পাথর পৃথিবীর পরিধির শেষ প্রান্তে গিয়ে পড়ে। এবার সে পাথর দুটিকে ডাকে। পাথরেরা উড়ে আসছে। আকাশে চাঁদ ডুবে যাচ্ছে, তারাগুলো ঝরে যাচ্ছে টুপটাপ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ