অপরাধের পরিসংখ্যান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির একপক্ষীয় চিত্র তুলে ধরে। এতে সবসময় সামগ্রিক চিত্র উঠে আসে না। কারণ পরিসংখ্যান অনেক সময় অপরাধের অন্তর্নিহিত কারণগুলোকে বিবেচনা করে না। বাংলাদেশের ২০২৪ সালের পরিস্থিতির তুলনায় ২০২৫ সালের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং অভূতপূর্ব। পৃথিবীর অন্য দেশে আন্দোলন বা বিপ্লবের মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী বা স্বৈরশাসকের সরকারের পতনের পরের চিত্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে তুলনা করতে হবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে, স্বৈরশাসনের পতনের পর অপরাধের হার শুরুর দিকে বৃদ্ধি পায়। পরে তা সময়ের সঙ্গে কমে আসে। শ্রীলঙ্কায় আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের পর ২০২২ সালে গুরুতর অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। এমনকি ২০২১ সালে আফগানিস্তানে তালেবান সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর শুরুর দিকে অপরাধের হার বেড়েছিল।
আরেকটু পেছনে গেলে দেখা যায়, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯১-৯২ সালের মধ্যে রাশিয়ায় অপরাধের হার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছিল। লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ যেমন– এল সালভাদর, গুয়েতেমালা ও ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্রে উত্তরণকালে অপরাধ ও সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। বাংলাদেশও এই প্রবণতার বাইরে নয়।
আবার বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও। জুলাই অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর দেশের প্রধান আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশ যে চ্যালঞ্জের মুখে পড়েছিল, তেমন পরিস্থিতিতে অন্যান্য দেশের পুলিশ বাহিনীকে পড়তে হয়নি। বর্তমানে পুলিশ একটি পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবুও সময়ের সঙ্গে পুলিশ বাহিনী পরিস্থিতিকে সামলে নিচ্ছে। আশা করা যায়, বাংলাদেশে অপরাধের হার দিন দিন কমে আসবে।
আট মাসের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলার সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘মব জাস্টিস’। নিজেরা আইন হাতে তুলে নেওয়া। কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও আক্রমণ করা হচ্ছে। এই আচরণের পেছনে হয়তো বিভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায়। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এমনটা চলতে থাকলে তা সামগ্রিকভাবেই রাষ্ট্রের কাঠামোয় আঘাত হানবে। দেশের সুনাম নষ্ট হবে বহির্বিশ্বে।
এ ক্ষেত্রে আমাদের ইউলসন অ্যান্ড কেলিং (১৯৮২)-এর ব্রোকেন উইন্ডোজ তত্ত্ব বিবেচনায় নিতে হবে। এই তত্ত্বমতে, ছোট অপরাধ ও বিশৃঙ্খলা যদি নিয়ন্ত্রণ না করা হয়, তাহলে মানুষ ভাবতে শুরু করে– আইনের প্রয়োগ নেই। তখন তারা নিজেরা তা করতে শুরু করে। তাই ‘মব জাস্টিস’ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
অভ্যুত্থান বা বিপ্লবের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক করতে অনেক দেশ নরম-গরম কৌশল (হার্ড অ্যান্ড সফ্ট স্ট্র্যাটেজি) নিয়েছে। যেমন শ্রীলঙ্কা জরুরি আইন ও কাউফিউ জারি করে কঠোরভাবে সব ধরনের বিক্ষোভ ও সন্ত্রাস দমন করেছে। একই সঙ্গে তারা জাতীয় সংলাপ ও কমিউনিটি পুলিশিং ফোরামকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করেছে। আফগানিস্তান দ্রুত সময়ের মধ্যে বিভিন্ন অপরাধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। রাশিয়া গ্যাং এবং মাফিয়া-শাসিত অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এফএসবি ও পুলিশের যৌথ অভিযান পরিচালনা করেছে। পাশাপাশি স্থানীয় সরকার এবং এনজিওর মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নাগরিক সম্পৃক্ততা বাড়িয়েছে। আবার এল সালভাদর অপরাধীদের গ্রেপ্তারে ন্যাশনাল ক্র্যাকডাউন প্রোগ্রাম পরিচালনার পাশাপাশি ডিজিটাল পুলিশিং ব্যবস্থা চালু করে মানুষের সঙ্গে পুলিশের সম্পৃক্ততা বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশও ইতোমধ্যে কার্যকর বেশ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এর পরও যারা ‘মব জাস্টিস’-এর মতো পরিস্থিতি তৈরি করে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ করছে, তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। উইলিয়াম শেকসপিয়রের নাটকের একটি বিখ্যাত উক্তি– ‘আমাকে শুধু দয়ালু হওয়ার জন্য নির্মম হতে হবে (আই মাস্ট বি ক্রুয়েল অনলি টু বি কাইন্ড)।’
দেশের বর্তমানে সংঘটিত ‘মব জাস্টিস’-এর পেছনে রাজনৈতিক ফ্যাক্টরকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ কারণে এখানেও এখন ‘নরম-গরম’ কৌশল কাজে লাগাতে হবে। নাগরিক সম্পৃক্ততা বাড়ানোর জন্য নাগরিক পুলিশিং জোরদার করার পাশাপাশি রাজনৈতিক দল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, এনজিও, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। তাহলে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করা যায়।
লেখক: মো.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: মত মত অপর ধ র হ র র পতন র পর মব জ স ট স পর স থ ত ব যবস থ র অপর ধ
এছাড়াও পড়ুন:
অজ্ঞাতনামা লাশ আর কারা হেফাজতে মৃত্যু বেড়েছে, শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকায় জনমনে সন্দেহ: এমএসএফ
চলতি অক্টোবর মাসে দেশে অজ্ঞাতনামা লাশ এবং কারা হেফাজতে মৃত্যু সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় বেশ খানিকটা বেড়েছে। এ তথ্য তুলে ধরেছে মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)। প্রতিষ্ঠানটির অক্টোবর মাসের মানবাধিকার প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এমএসএফ বলেছে, এসব ঘটনায় জনজীবনের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি জোরালোভাবে সবার সামনে প্রতিফলিত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ দুই ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে জনমনে সন্দেহ আছে।
এমএসএফ প্রতি মাসে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরে। আজ শুক্রবার অক্টোবর মাসের প্রতিবেদন গণমাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং নিজস্ব তথ্যানুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে এমএসএফ মানবাধিকার প্রতিবেদন তৈরি করে।
বেড়েছে অজ্ঞাতনামা লাশএমএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অক্টোবর মাসে মোট ৬৬টি অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে। এটি অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়; বরং নাগরিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত মাসে (সেপ্টেম্বর) এর সংখ্যা ছিল ৫২। এসব অজ্ঞাতনামা লাশের বেশির ভাগই নদী বা ডোবায় ভাসমান, মহাসড়ক বা সড়কের পাশে, সেতুর নিচে, রেললাইনের পাশে, ফসলি জমিতে ও পরিত্যক্ত স্থানে পাওয়া যায়। অল্পসংখ্যক মৃতদেহ গলাকাটা, বস্তাবন্দী ও রক্তাক্ত বা শরীরে আঘাতের চিহ্নসংবলিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।
এমএসএফ বলেছে, অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের ঘটনা বেড়েই চলেছে এবং তা জনজীবনের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি জোরালোভাবে সবার সামনে প্রতিফলিত হচ্ছে। পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা লাশের পরিচয় উদ্ধারে অপারগতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১টি শিশু, ১ কিশোর, ১১ জন নারী ও ৫৩ জন পুরুষের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭ বছর বয়সী শিশু; ১৫ বছর বয়সী কিশোর; ২০ থেকে ৩০ বয়সী ১৫ জন পুরুষ ও ২ জন নারী; ৩১ থেকে ৪০ বয়সী ১৯ জন পুরুষ ও ৬ জন নারী; ৪১ থেকে ৫০ বয়সী ১ নারী ও ৫ জন পুরুষ এবং ৫০ বছর বয়সের বেশি ১১ জন পুরুষ ও ১ নারী রয়েছেন। এর মধ্যে অজ্ঞাতনামা তিনজনের বয়স শনাক্ত করা যায়নি।
এমএসএফ বলেছে, শুধু অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে বলে জানিয়েই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না; বরং পরিচয় জানার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। পরিচয় উদ্ধার করে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।
কারা হেফাজতে মৃত্যু বাড়ছেইএমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে কারা হেফাজতে মোট ১৩ জন বন্দীর মৃত্যু হয়েছে। গত মাসে এ সংখ্যা ছিল মোট ৮। এ মাসে ছয়জন কয়েদি ও সাতজন হাজতির মৃত্যু হয়েছে।
কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চারজন কয়েদি ও দুজন হাজতি, গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে একজন কয়েদি ও শেরপুর জেলা কারাগারে একজন কয়েদি মারা যান। এ ছাড়া খুলনা জেলা কারাগারে, টাঙ্গাইল জেলা কারাগারে, চট্টগ্রাম জেলা কারাগারে, সিরাজগঞ্জ কারাগারে ও মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারে একজন করে হাজতি বন্দী মারা যান। সব বন্দীর মৃত্যু হয় কারাগারের বাইরে হাসপাতালে।
এমএসএফের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কারা হেফাজতে মৃত্যু এবং অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের সংখ্যা বৃদ্ধি মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতির চিত্র তুলে ধরে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই লাশ উদ্ধার করেই ক্ষান্ত হচ্ছে। কিন্তু এসব লাশ উদ্ধার করে তার পরিচয় শনাক্ত করা এবং সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত করে মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটন করাই শুধু নয়, এসব লাশ আত্মীয়-পরিজনের কাছে পৌঁছে দেওয়া এসব বাহিনীর কাজ। কিন্তু একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু মামলা করা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আর কোনো কাজ নেই।
সাইদুর রহমান বলেন, অজ্ঞাতনামা লাশের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং হেফাজতে মৃত্যু বৃদ্ধি জনমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করে।
গণপিটুনিতে হত্যা চলছেই, বেড়েছে রাজনৈতিক সহিংসতাঅক্টোবর মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ৪৯টি ঘটনার শিকার হয়েছেন ৫৪৯ জন। এর মধ্যে ২ জন নিহত এবং ৫৪৭ জন আহত হয়েছেন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে চারজন গুলিবিদ্ধ এবং নিহত ব্যক্তিরা বিএনপির কর্মী–সমর্থক। সেপ্টেম্বর মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ৩৮টি ঘটনা ঘটেছিল।
সহিংসতার ৪৯টি ঘটনার মধ্যে ১১টি ঘটনায় রাজনৈতিক বিরোধ ও সহিংসতাকে কেন্দ্র করে পার্টি অফিস, বসতবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ও অগ্নিকাণ্ড এবং ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। তবে এসব ঘটনায় হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
অক্টোবর মাসে মোট গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে ৪৪টি। আগের মাসে এ ঘটনা ঘটেছিল ৪৩টি। এ মাসে গণপিটুনির শিকার হয়ে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ১২। আগের মাসে নিহত হয়েছিলেন ২৪ জন।