পঞ্চাশের দশকে আবিষ্কৃত প্লাস্টিক একসময় আধুনিকতার প্রতীক ছিল। সাশ্রয়ী, বহুমুখী ও টেকসই এই উপাদান বিশ্বজুড়ে শিল্প, কৃষি, চিকিৎসা থেকে শুরু করে ঘরোয়া ব্যবহারে এক অনিবার্য জায়গা করে নেয়। কিন্তু কৃত্রিম এই বস্তু যখন বিপুল হারে উৎপাদিত হয়ে ব্যবহারের পর ব্যবস্থাহীনভাবে পরিবেশে মিশতে থাকে, তখন সেটি এক বৈশ্বিক সংকটে রূপ নেয়।

প্লাস্টিক এখন শুধু শহরের ড্রেন বা সাগরের পাড়েই নয়, মানুষের খাদ্যচক্রে, এমনকি রক্ত ও হৃৎপিণ্ডে জায়গা করে নিচ্ছে। ২০২৫ সালের বিশ্ব পরিবেশ দিবসে জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) তাই ‘প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করুন’ শীর্ষক প্রতিপাদ্য নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে আহ্বান জানিয়েছে, তা নিছক প্রতীকী কোনো আয়োজন নয়, বরং এটি সময়ের এক কঠিন বাস্তবতা।

বিগত সাত দশকে বিশ্বে প্লাস্টিক উৎপাদন বেড়েছে কয়েক শ গুণ। প্রতিবছর প্রায় ৪৫ কোটি টন প্লাস্টিক উৎপন্ন হচ্ছে, যার ৪০ শতাংশই একবার ব্যবহারযোগ্য। সেগুলোর বিরাট অংশই শেষ পর্যন্ত জমা হয় প্রকৃতিতে—নদী, সাগর, বন কিংবা উন্মুক্ত জমিতে—যেখানে তা শত শত বছর অবিকৃত অবস্থায় থেকে যায়। এসব প্লাস্টিক ক্ষয়ে ক্ষয়ে পরিণত হয় মাইক্রোপ্লাস্টিকে এবং তা সহজেই জলজ প্রাণীর দেহে প্রবেশ করে এবং খাদ্যচক্র পেরিয়ে মানুষের শরীরেও ঢুকে পড়ে।

গবেষণা বলছে, একজন মার্কিন নাগরিক বছরে প্রায় এক লাখ মাইক্রোপ্লাস্টিক–কণা গ্রহণ করেন খাবার ও শ্বাসের মাধ্যমে। এসব কণায় থাকা রাসায়নিক পদার্থ, যেমন বিসফেনল বা থ্যালেটস শরীরে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে, বন্ধ্যত্ব, স্নায়বিক ব্যাধি এমনকি ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। এসব কণা মানুষের রক্ত, প্ল্যাসেন্টা এমনকি হৃদ্‌যন্ত্রেও শনাক্ত হয়েছে। এটি একটি ভয়ংকর স্বাস্থ্যঝুঁকির সংকেত।

তবে মানবদেহের ঝুঁকি ছাড়াও প্লাস্টিক দূষণের প্রভাব পড়ছে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যে। ইউনেসকোর হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর অন্তত ১০ লাখ সামুদ্রিক পাখি এবং ১ লাখ সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী প্লাস্টিক খেয়ে বা প্লাস্টিকে জড়িয়ে মারা যাচ্ছে। বৃহৎ সমুদ্রের ওপর দিয়ে একেকটি ‘প্লাস্টিক দ্বীপ’ ভেসে বেড়াচ্ছে, যেমন প্রশান্ত মহাসাগরে ৮০ হাজার টনের এক বিশাল আবর্জনার স্তূপ, যাতে রয়েছে প্রায় ১ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন প্লাস্টিকের টুকরা।

প্লাস্টিক দূষণের একটি বড় পরোক্ষ ক্ষতি হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। প্লাস্টিক মূলত জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে তৈরি হয় এবং এর উৎপাদন, পরিবহন ও ধ্বংসের প্রতিটি স্তরেই গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয়।

একটি পরিচ্ছন্ন, সবুজ ও টেকসই ভবিষ্যৎ গঠনে আর্থিক খাতের ভূমিকা শুধু অর্থায়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, তারা নীতিনির্ধারক, পরামর্শদাতা ও সচেতনতা সৃষ্টিকারীর ভূমিকাও পালন করতে পারে। যখন আর্থিক ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের নীতিতে পরিবেশ-সচেতনতা যুক্ত করে, তখন ‘প্লাস্টিক বন্ধ হোক—প্রকৃতি বাঁচুক’, এই স্লোগান বাস্তব হয়ে ওঠে। আর সেটিই হতে পারে বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিশ্রুতির বাস্তব প্রতিফলন।

গবেষণা বলছে, বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে প্লাস্টিক উৎপাদন থেকে বছরে ২ দশমিক ৮ গিগাটন কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হবে, যা বৈশ্বিক কার্বন সীমা (৪২০-৫৭০ গিগাটন) বজায় রাখার লক্ষ্যে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

এ সংকট থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়। দেশে প্রতিবছর প্রায় আট লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, যার এক-তৃতীয়াংশের বেশি উৎপন্ন হয় শুধু ঢাকা শহরে। এসব বর্জ্যের অর্ধেকেরও কম পুনর্ব্যবহারযোগ্য ব্যবস্থায় ফিরে আসে, বাকিগুলো শহরের ড্রেন, খাল, নদীতে জমা হয়ে পানিনিষ্কাশন ব্যাহত করে এবং বন্যা বা জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী হয়ে ওঠে।

জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তবে এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে এখনো অনেক পথ বাকি।

এ প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠতে পারে—প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কী ভূমিকা থাকতে পারে? শুধু পরিবেশবিদ, সরকারি সংস্থা কিংবা ভোক্তাদের দায়িত্বে বিষয়টি ছেড়ে দিলে চলবে না। কারণ, অর্থনীতি, বিনিয়োগ ও ভোক্তা আচরণ নির্ধারণে আর্থিক খাতের প্রভাব অপরিসীম।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তারা অর্থায়নের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব উদ্যোগে গতি এনে দিতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো টেকসই অর্থায়নে প্রায় ১ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে, যা পূর্ববর্তী প্রান্তিক থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেশি। এই প্রবণতাকে যদি পরিবেশবান্ধব, প্রযুক্তিনির্ভর ও প্লাস্টিক-বিকল্প উদ্যোগের দিকে বিশেষভাবে মোড় নেওয়া যায়, তবে তা সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

ভারতের উদাহরণ উল্লেখযোগ্য—সেখানে ক্ষুদ্র শিল্প উন্নয়ন ব্যাংক (এসআইডিবিআই) ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য বায়োডিগ্রেডেবল পণ্য তৈরিতে সহজ শর্তে অর্থায়ন করছে। বাংলাদেশেও এসএমই ফাউন্ডেশন ও বিভিন্ন ব্যাংকের এসএমই ইউনিটের মাধ্যমে এমন প্রণোদনা চালু করা যেতে পারে।

তবে বিনিয়োগের বাইরেও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের কর্মপরিবেশে প্লাস্টিকবিরোধী সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারে। অফিসে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করে তার পরিবর্তে কাচ, ধাতব বা কাগজের পণ্য ব্যবহার একটি কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে। অনেক আন্তর্জাতিক ব্যাংক ও করপোরেট সংস্থা ইতিমধ্যে এই পথ অনুসরণ করেছে।

বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পরিবেশ, সমাজ ও প্রশাসনের মানদণ্ড, অর্থাৎ ইএসজি স্কোর বিবেচনায় আনা গেলে তা আরও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। জাতিসংঘের দায়িত্বশীল বিনিয়োগ নীতিমালা (পিআরআই) অনুসরণ করে বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ৭০ শতাংশ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইএসজি স্কোর অনুসরণ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও ইতিমধ্যে টেকসই ব্যাংকিং সূচক চালু করেছে, যা একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ।

সবশেষে বলা যায়, করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার আওতায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্লাস্টিকবিরোধী ক্যাম্পেইন, সচেতনতা সেমিনার, বৃক্ষরোপণ বা পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্যের প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এসব কার্যক্রম কেবল করপোরেট ভাবমূর্তি রক্ষার মাধ্যম নয়, বরং সমাজ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সঙ্গে একটি দায়শীল সংযোগ গড়ে তোলার পথ।

একটি পরিচ্ছন্ন, সবুজ ও টেকসই ভবিষ্যৎ গঠনে আর্থিক খাতের ভূমিকা শুধু অর্থায়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, তারা নীতিনির্ধারক, পরামর্শদাতা ও সচেতনতা সৃষ্টিকারীর ভূমিকাও পালন করতে পারে। যখন আর্থিক ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের নীতিতে পরিবেশ-সচেতনতা যুক্ত করে, তখন ‘প্লাস্টিক বন্ধ হোক—প্রকৃতি বাঁচুক’, এই স্লোগান বাস্তব হয়ে ওঠে। আর সেটিই হতে পারে বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিশ্রুতির বাস্তব প্রতিফলন।

এম এম মাহবুব হাসান ব্যাংকার ও উন্নয়ন গবেষক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: করপ র ট পর ব শ ট কসই উৎপ দ

এছাড়াও পড়ুন:

‘দুই বছর ধরে ঘুরছি, তবু এনআইডি ঠিক হলো না’

দুই বছর ধরে জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) মা–বাবার নাম সংশোধনের জন্য চট্টগ্রামের নির্বাচন কার্যালয়ে ঘুরছেন মো. সাইফুল ইসলাম। কিন্তু এত দিনের চেষ্টার পরও মেলেনি সমাধান।

নগরের উত্তর কাট্টলীতে বসবাসকারী সাইফুল পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। জীবিকার তাগিদে যখন যা পান, তা-ই করেন। কয়েক বছর ধরে বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সে লক্ষ্যে পাসপোর্ট করতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর এনআইডিতে বাবা ও মায়ের নাম ভুল। এরপর পাসপোর্ট কার্যালয়ের পরামর্শে এনআইডি সংশোধনের জন্য প্রায় দুই বছর আগে চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে আবেদন করেন তিনি।

গত মঙ্গলবার চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কার্যালয় প্রাঙ্গণে কথা হয় সাইফুলের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় এক ব্যক্তি। প্রথম আলোকে সাইফুল বলেন, ‘জাতীয় পরিচয়পত্র করার সময় বাবার ডাকনাম কবির আহম্মদ আর মায়ের নাম বুলুয়ারা বেগম দিয়েছিলাম। কিন্তু বাবার আসল নাম এস এম তৈয়বুর রহমান ও মায়ের নাম বুলু আক্তার। এ কারণে সংশোধনের আবেদন করেছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।’

সাইফুল জানান, জাতীয়তা সনদ, প্রত্যয়নপত্র, মা-বাবার এনআইডির অনুলিপি, ভাইয়ের এনআইডি, এমনকি মা-বাবার নিকাহনামাও জমা দিয়েছেন। তবু ফল মেলেনি।

সাইফুল জানান, জাতীয়তা সনদ, প্রত্যয়নপত্র, মা–বাবার এনআইডির অনুলিপি, ভাইয়ের এনআইডি, এমনকি মা–বাবার নিকাহনামাও জমা দিয়েছেন। তবু ফল মেলেনি। তিনি বলেন, ‘দুই বছর ধরে ঘুরছি। কত কাগজ দিলাম, কত লোক ধরলাম। এখন পর্যন্ত কিছু হলো না। ১০-১৫ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে।’

জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের জন্য চট্টগ্রাম নির্বাচন কার্যালয়ে অনেকেই ভিড় করেন প্রতিদিন

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • হার্ভার্ড-ট্রাম্প লড়াই থেকে বাংলাদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা
  • ঢাবির সূর্যসেন হলের শিক্ষার্থীদের দেখার কেউ নেই
  • ‘দুই বছর ধরে ঘুরছি, তবু এনআইডি ঠিক হলো না’
  • মুখ দিয়ে লিখে স্নাতকোত্তর পাস করেছেন বাহার
  • কুয়া