এমএফএসে খরচ ব্যাংকের ৭ থেকে ১৫ গুণ বেশি
Published: 27th, May 2025 GMT
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, বাংলাদেশে মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবা (এমএফএস) পেতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের চেয়ে ৭ থেকে ১৫ গুণ বেশি খরচ হয়। প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায়ও বাংলাদেশে এমএফএস সেবার খরচ বেশি। ‘মোবাইল আর্থিক সেবা খাতে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক টিআইবির এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য দেওয়া হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবির কার্যালয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নগদ উত্তোলনে এমএফএসে খরচ প্রতি ২৫ হাজার টাকায় ২০০ থেকে ৪৬২ টাকা। যেখানে ব্যাংকের খরচ সর্বোচ্চ ২৯ টাকা। ‘সেন্ড মানি’ করতে এমএফএসে ২৫ হাজার টাকায় সর্বােচ্চ খরচ ১৫০ টাকা। অথচ ব্যাংকে কোনো খরচ নেই। ২০২৪ সালে সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকা ‘ক্যাশ আউট’-এর ক্ষেত্রে গ্রাহকদের থেকে কমপক্ষে ৪ হাজার ৪১০ কোটি টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়েছে। যেখানে সমপরিমাণ নগদ উত্তোলনে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আয় করেছে মাত্র ৬৩৯ কোটি টাকা। বাংলাদেশে এমএফএসে খরচের হার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের তুলনায় অস্বাভাবিক।
প্রতিবেদনে এমএফএস মাধ্যম ব্যবহার করে প্রতারণা ও অর্থ পাচার হয় বলে উল্লেখ করা হয়। এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড.
তিনি উল্লেখ করেন, কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের পর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বৈদেশিক রেমিট্যান্সের রেকর্ড বেড়েছে। এর অন্যতম কারণ হলো, এমএফএস ব্যবহার করে অবৈধ হুন্ডি লেনদেন নিয়ন্ত্রিত হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে (বিকাশ) ২৫ হাজার টাকা নগদ উত্তোলনে ৩৭২ টাকা ৫০ থেকে ৪৬২ টাকা ৫০ পয়সা আদায় করা হয়। যেখানে সমপরিমাণ টাকা উত্তোলনে পাকিস্তানে (ইজি প্যায়সা) ৩৫৫ টাকা ৭০ পয়সা এবং মিয়ানমারে (ওয়েভ পে) ২৩১ টাকা ৩০ পয়সা সেবামূল্য হিসেবে আদায় করা হয়। ভারতে (ফোন পে) এ ধরনের সেবায় কোনো সেবামূল্য আদায় করা হয় না।
ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, এমএফএস খাত করায়ত্ত করার জন্য রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ব্যবহার করা হয়েছে। বিশেষ করে ‘নগদ’-কে বিশেষ অনৈতিক সুযোগ দেওয়া হয়েছে। জনগণকে আর্থিকভাবে শোষণ, রাষ্ট্রের অর্থ আত্মসাতের পাশাপাশি ঘুষ লেনদেন ও অর্থ পাচারের জন্যও এ খাতকে ব্যবহার করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ‘নগদ’-এর পরিচালনাকারী চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান থার্ড ওয়েভ নিয়ম লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত প্রায় ৬৪৫ কোটি টাকার ই-মানি তৈরি করেছে। প্রভাব বিস্তার করে সুরক্ষা ভাতা ও উপবৃত্তির অর্থ বিতরণের সুবিধা গ্রহণ, আন্তঃলেনদেন প্ল্যাটফর্ম (বিনিময়) সম্পর্কিত অনিয়ম-দুর্নীতি এবং অর্থ পাচার ও অবৈধ বৈদেশিক লেনদেনের মতো ঘটনা পাওয়া গেছে। তথ্য বলছে, ২ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা নগদের শেয়ারহোল্ডারদের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা হয়েছে।
মোবাইল আর্থিক সেবা খাতে বিদ্যমান সুশাসনের চ্যালেঞ্জ উত্তরণে ১৩ দফা সুপারিশ প্রস্তাব করেছে টিআইবি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে এমএফএস খাতের জন্য স্বতন্ত্র আইন প্রণয়ন, লেনদেন খরচ কমানো এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আন্তঃলেনদেন ব্যবস্থা সহজ ও সাশ্রয়ী করা, আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার আলোকে এ পরিচালন ও ব্যবস্থাপনা কাঠামো নিশ্চিত করা, এজেন্ট ও পরিবেশকদের কমিশনের সীমা নির্ধারণ, তদারকি নিশ্চিত করা ইত্যাদি।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন টিআইবির উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবির রিসার্চ ফেলো মোহাম্মদ নূরে আলম এবং রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট কাজী আমিনুল হাসান।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর ট আইব র র অর থ আর থ ক ল নদ ন
এছাড়াও পড়ুন:
২০২৬ সালের নির্বাচন কেবল একটি তারিখ নয়
বাংলাদেশ এখন এক সংবেদনশীল সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলন যে আশার স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়েছিল, তা এখনো স্থায়ী রাজনৈতিক রূপ পায়নি। অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষণা দিয়েছে, আগামী ফেব্রুয়ারিতেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু শুধু তারিখ ঘোষণা করাই যথেষ্ট নয়। প্রশ্ন হলো এই নির্বাচন কি সত্যিই গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারবে?
রাজনীতি এখন দ্রুত পাল্টাচ্ছে। একসময়ের শক্তিশালী আওয়ামী লীগ জাতীয় নিরাপত্তা আইনের আওতায় কার্যক্রম স্থগিত দেখছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী আদালতের রায়ে আবার রাজনৈতিক ময়দানে ফিরে এসেছে। এসব পরিবর্তন আমাদের পুরোনো অভিজ্ঞতাকেই স্মরণ করিয়ে দেয় যে এক দলের পতন অন্য দলের জন্য জায়গা খুলে দেয়; কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য খুব কমই কিছু বদলায়।
এই অনিশ্চিত প্রেক্ষাপটে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জানিয়েছেন, তিনি দেশে ফিরে নির্বাচনে অংশ নেবেন। প্রায় দুই দশক ধরে লন্ডনে নির্বাসিত এই রাজনীতিক এখন সংস্কার, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও প্রতিহিংসামুক্ত রাজনীতির প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। অনেকেই আগ্রহ নিয়ে দেখছেন; কিন্তু সন্দেহও আছে, বিএনপি কি সত্যিই অতীত থেকে শিক্ষা নিতে পেরেছে?
তারেক রহমানের ফিরে আসা যেমন তার নিজের জন্য একটি পরীক্ষা, তেমনি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্যও একটি দায়িত্বের মুহূর্ত। সরকার যদি সত্যিই আইনের শাসনে বিশ্বাস করে, তবে আইন যেন কারও জন্য আশ্রয় না হয়, আবার কারও জন্য অস্ত্রও না হয়। সমান আচরণই হবে এই নির্বাচনপূর্ব সময়ের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।
একটি নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নির্ভর করে প্রক্রিয়ার ওপর, স্লোগানের ওপর নয়। স্বচ্ছ সময়সূচি, মনোনয়নপ্রক্রিয়ার পরিষ্কার নির্দেশনা এবং সব দলের জন্য সমান প্রতিযোগিতার সুযোগ, এই তিন শর্ত পূরণ হলেই জনগণ ভোটকেন্দ্রে যেতে আস্থা পাবেন। প্রতিটি বিলম্ব, অস্পষ্টতা বা যাচাই–বাছাই করা সেই আস্থা নষ্ট করবে।
কিন্তু নিয়মই সব নয়, বাংলাদেশের জগগণ চায় যে আদালত, পুলিশ ও নির্বাচন কমিশন রাষ্ট্রের পক্ষে কাজ করছে, কোনো দলের নয়। বৈধতা ঘোষণায় আসে না, তা মানুষ অনুভব করে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে। যদি তারা ভয়, পক্ষপাত বা অনিয়ম দেখে, তাহলে আন্তর্জাতিক তদারকি দিয়েও সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে না।
২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলন এই সমাজকে এক নতুন চেতনা উপহার দিয়েছিল। তরুণেরা রাজনীতিকে নৈতিকতার প্রশ্নে ফিরিয়ে এনেছিলেন। তারা কোনো নতুন নায়ক খুঁজছিলেন না, খুঁজছিলেন ন্যায্যতা ও মর্যাদা। এখন প্রশ্ন হলো, সেই শক্তিটা কি টিকে থাকবে, নাকি পুরোনো ক্ষমতার সংস্কৃতি আবার সবকিছু গ্রাস করবে?
অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ হলো এমন একটি নির্বাচন নিশ্চিত করা, যা নিয়ে কারও সন্দেহ থাকবে না। আর বিরোধী দলের দায়িত্ব হলো সেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রতিশোধ নয়, সংস্কারের রাজনীতি দেখানো। দুই পক্ষই যদি নিজেদের সীমা ছাড়িয়ে একটু উদার হয়, তাহলে এই ভোট সত্যিকারের নতুন সূচনা হতে পারে।
বাংলাদেশ অনেক বছর ধরেই এমন এক নির্বাচনের অপেক্ষায় আছে, যা সত্যিকার অর্থে জনগণের মনে হবে তাদের নিজের। ফেব্রুয়ারি ২০২৬ সেই সুযোগ এনে দিচ্ছে; কিন্তু সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। এই এক বছরের মধ্যে আমাদের রাজনীতি যদি শৃঙ্খলা, ন্যায্যতা ও সাহস দেখাতে পারে, তাহলে এই নির্বাচন হবে কেবল ক্ষমতার লড়াই নয়, এটি হবে বিশ্বাস পুনর্গঠনের এক নতুন অধ্যায়।
বাংলাদেশ এখনো সেই সুযোগ হারায়নি। প্রশ্ন শুধু—আমরা কি তা কাজে লাগাতে পারব?
আরিফুর রহমান যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব আলাবামার পিএইচডি গবেষক। তাঁর গবেষণার বিষয় ‘সামাজিক আন্দোলন ও দক্ষিণ এশিয়ার গণতান্ত্রিক রূপান্তর’।