শুক্রবার (৬ জুন) রাতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বরগুনা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে মারা যান মোনালিসা জেরিন (৩০)। তিনি সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত জাফরুল হাসান ফরহাদের ছোট মেয়ে। এ নিয়ে চলতি বছর বরগুনায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারালেন ৭ জন। যা সারাদেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যায় জেলা পরিসংখ্যানে সর্বোচ্চ। উদ্বেগের বিষয় ডেঙ্গু আক্রান্তের দিকেও শীর্ষে অবস্থান করছে বরগুনা। 

জেলা স্বাস্থ্য প্রশাসনের দেওয়া তথ্য মতে, ২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৭৮৩। এর মধ্যে শুধু বরগুনা জেলায় রোগীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১১৭। এ হিসেবে দেশে ডেঙ্গু রোগীর ২৫ শতাংশই বরগুনা জেলায়। গত ৭ দিনে দেশে ৪৮১ জন রোগী নতুন করে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে বরগুনাতে রয়েছেন ২০৪ জন।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য বলছে, বরগুনার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল ও ৫টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেঙ্গু শনাক্তকরণ ও প্লাটিলেট টেস্ট বন্ধ রয়েছে কিট সংকটের কারণে। এ ছাড়া স্যালাইন সংকটেও ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা। 

রবিবার (৮ জুন) দুপুরে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে সরেজমিনে দেখা যায়, ৬০০ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি রয়েছে। বেড সংকটে বেশিরভাগ রোগী বিছানা পেতেছেন মেঝেতে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সার্বক্ষণিক মশারির মধ্যে থাকার কথা থাকলেও নিয়ম-নীতি মানছেন না অনেকে। ফলে সাধারণ রোগীর সঙ্গে মিশে গেছেন ডেঙ্গু রোগীরা। এমনকি আক্রান্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে স্বজনরাও একই বিছানায় থাকছেনে। রয়েছে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ। 

ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন মো.

শাহরিয়ার বলেন, ‘‘দুদিন জ্বরে ভুগছি। সকালে হাসপাতালে আসার পর বলল, বাহির থেকে ডেঙ্গু টেস্ট করিয়ে এনে রিপোর্ট দেখাতে। হাসপাতালে কেন টেস্ট করানো যাবে না জানতে চাইলে তারা ক্ষেপে যায়। বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে টেস্ট করাই। পজিটিভ এসেছে। এরপর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। কিন্তু কোনো বেড ফাঁকা নাই। মেঝেতে শুয়ে আছি।’’

হাসপাতাল থেকে মশারি দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন শাহরিয়ার।  

চারদিন ধরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন সদরের দক্ষিণ মনসাতলীর  মনোজ শীল। তিনি বলেন, ‘‘ভয়াবহ পরিস্থিতি! হাসপাতালে স্যালাইন দিতে পারছে না। নাপা পর্যন্ত বাইরে থেকে কিনতে বলছে। আমরা তো ভাই ঠেকে গিয়ে এখানে এসেছি। এখন তারা যা বলবে শুনতে হবে।’’ 

শিশু ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায় হাসপাতালে ভর্তি শিশুদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৮ জনই ডেঙ্গু আক্রান্ত। কলেজ রোড এলাকার সাইমন (৯) শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি আছে তিনদিন। সাইমনের মা সোনিয়া আক্তার বলেন, ‘‘হাসপাতালে ওষুধ নাই, স্যালাইন নাই, এমনকি সিভিসি প্লাটিলেট টেস্ট পর্যন্ত করানো যায় না। অসুস্থ শিশুকে নিয়ে প্রতিদিন টেস্ট করানোর জন্য বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিকে ঘুরতে হয়। এটা যে কি কষ্টের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বুঝবে না। এখানে ভর্তি থাকা মানেই শুধু মনের শান্তি যে- বাচ্চা অসুস্থ হাসপাতালে ভর্তি করছি।’’ 

একই চিত্র জেলার আমতলী, তালতলী, পাথরঘাটা, বামনা ও বেতাগী উপজেলায়। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা না পেয়ে অনেকেই জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। অনেকে ভরসা রাখতে না পেরে পাশে পটুয়াখালী ও বরিশালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। 

তালতলীর স্থানীয় সাংবাদিক হাইরাজ মাঝি বলেন, ‘‘হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষা ও সিবিসি টেস্ট করানো যাচ্ছে না। রোগীরা প্রাইভেট ক্লিনিকে বাড়তি টাকা ব্যয় করে টেস্ট করতে বাধ্য হচ্ছেন। উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা সেবা নিয়েও অভিযোগ রয়েছে। চিকিৎসকরা হিমশিম খাচ্ছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আলাদা নজর দেওয়া উচিত এসব উপজেলায়।’’ 

বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. রেজোয়ানুর আলম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘‘একের পর এক ডেঙ্গু রোগী আসছে হাসপাতালে। চিকিৎসক সংকট থাকায় আমরাও হিমশিম খাচ্ছি। পরিস্থিতি জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় এবং ঢাকায় জানানো হয়েছে।’’

বরগুনার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আবুল ফাত্তাহ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘‘ডেঙ্গুর প্রবণতা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃষ্টির মৌসুম পর্যন্ত এমন বাড়তেই থাকবে। সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। জেলা প্রশাসন সঙ্গে নিয়ে জেলা স্বাস্থ্য প্রশাসন ডেঙ্গু দমনে সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছে। এমন পরিস্থিতি দু’একদিনে তৈরি হয়নি। ফলে দু’একদিনে এ পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া যাবে না।’’

‘‘ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে হাসপাতালে অথবা চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ঘরে বসে থাকার কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বরগুনায় সবচেয়ে বেশি,’’ বলেন তিনি। 
 

ঢাকা/শান্ত

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ট স ট কর পর স থ ত বরগ ন উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

আদি সময়ে ঈদুল আজহার উদ্‌যাপন

মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সময়ে ঈদের উৎসব ছিল সাধারণ কিন্তু আধ্যাত্মিকভাবে গভীর। তবে পরবর্তী ইসলামি সাম্রাজ্যগুলোতে—উমাইয়া, আব্বাসি, ফাতেমি ও মামলুক যুগে ঈদুল আজহা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা, বিশাল মিছিল এবং সমাজব্যাপী কোরবানির মাধ্যমে একটি গৌরবময় উৎসবে রূপান্তরিত হয়। এ প্রবন্ধে আমরা ইসলামি ইতিহাসে ঈদুল আজহার রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উদ্‌যাপন, কোরবানির অনুষ্ঠানের বিবর্তন ও এর সমাজে প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।

উমাইয়া যুগ: রাষ্ট্রীয় প্রতীক হিসেবে উত্থান

উমাইয়া খিলাফত (৪১-১৩২ হি./৬৬১-৭৫০ খ্রি.) ঈদুল আজহাকে রাষ্ট্রীয় মাত্রা প্রদান করে। ইবনে কাসির (মৃ. ৭৭৪ হি.) তাঁর ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন, খলিফা মারওয়ান ইবনে হাকাম (মৃ. ৬৫ হি.) ঈদের নামাজের আগে খুতবা দেওয়ার প্রথা শুরু করেন। এ খুতবায় রাজনৈতিক বার্তা দেওয়া হতো, যা খিলাফতের বৈধতা ও শক্তি প্রদর্শন করত। উমাইয়া খলিফারা নবীজি (সা.)-এর হারবা (বর্শা) ও বুরদা (চাদর) ব্যবহার করে তাঁদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতীকায়িত করতেন।

খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান ঈদুল আজহার সময় দামেস্কের প্রধান মসজিদে বিশাল পরিসরে কোরবানির আয়োজন করতেন। তিনি নিজে কোরবানির পশু জবাই করতেন এবং মাংস দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতেন।

পশু কোরবানির প্রচলনও উমাইয়া যুগে ব্যাপক গুরুত্ব পায়। ইবনে হিশাম (মৃ. ২১৮ হি.) উল্লেখ করেন, খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান (মৃ. ৮৬ হি.) ঈদুল আজহার সময় দামেস্কের প্রধান মসজিদে বিশাল পরিসরে কোরবানির আয়োজন করতেন। তিনি নিজে কোরবানির পশু জবাই করতেন এবং মাংস দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতেন। এ প্রচলন জনগণের মধ্যে খলিফার উদারতা ও ধার্মিকতার প্রতিচ্ছবি তৈরি করত। উমাইয়া শাসকেরা প্রায়ই বিদ্রোহী অঞ্চলের নেতাদের ঈদের ভোজে আমন্ত্রণ জানাতেন, যা রাজনৈতিক মিলনের একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করত।

আব্বাসি যুগ: গৌরব ও দানশীলতা

আব্বাসি খিলাফত (১৩২-৬৫৬ হি./৭৫০-১২৫৮ খ্রি.) ঈদুল আজহাকে রাষ্ট্রীয় উৎসবে রূপান্তরিত করে। ইবনে জাওজি (মৃ. ৫৯৭ হি.) তাঁর ‘আল-মুনতাজাম’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন, খলিফা মুক্‌তাফি (মৃ. ৫৫৫ হি.) ৫৫৩ হিজরিতে (১১৫৮ খ্রি.) ঈদুল আজহার জন্য একটি বিশাল মিছিলের আয়োজন করেন। এ মিছিলে অশ্বারোহী সৈন্য, সোনায় সজ্জিত ঘোড়া ও বহু আমির, এমনকি ফকিহরাও অংশ নিতেন। মিছিলটি বাগদাদের প্রধান রাস্তা দিয়ে যেত এবং জনগণ তাকবির ধ্বনি দিয়ে তাদের স্বাগত জানাত।

আরও পড়ুনমানব–হত্যার প্রথম ঘটনা২৭ মে ২০২৩খলিফা মুক্‌তাফি ঈদুল আজহার জন্য একটি বিশাল মিছিলের আয়োজন করেন। এ মিছিলে অশ্বারোহী সৈন্য, সোনায় সজ্জিত ঘোড়া ও বহু আমির, এমনকি ফকিহরাও অংশ নিতেন।

কোরবানির মাংস বিতরণ আব্বাসি যুগে একটি বড় সামাজিক ঘটনা ছিল। সুয়ুতি (মৃ. ৯১১ হি.) তাঁর তারিখ–উল–খুলাফা গ্রন্থে উল্লেখ করেন, খলিফা মামুন (মৃ. ২১৮ হি.) ঈদুল আজহার সময় হাজারো পশু কোরবানি করতেন। পশুর মাংস দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করা হতো এবং খলিফার প্রাসাদে বিশাল ভোজের আয়োজন করা হতো। এ ভোজে ফকিহ, কবি, এমনকি সাধারণ জনগণও আমন্ত্রিত হতেন। মামুন নিজে ভোজে উপস্থিত থেকে খাবার পরিবেশন করতেন।

ইবনে তাগরিবারদি (মৃ. ৮৭৪ হি.) একটি চমৎকার ঘটনা বর্ণনা করেন, ২৩৭ হিজরিতে (৮৫২ খ্রি.) খলিফা মুতাওয়াক্কিল ঈদুল আজহার দিনে একজন বিদ্রোহীর মৃতদেহ তাঁর পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেন। এ ঘটনা জনগণের মধ্যে ব্যাপক আনন্দের সৃষ্টি করে এবং খলিফার দয়ার প্রশংসা করা হয়। এ ধরনের কাজগুলো ঈদুল আজহাকে রাজনৈতিক ও সামাজিক মিলনের একটি মঞ্চ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

ফাতেমি যুগ: বৈচিত্র্য ও উৎসব

ফাতেমি খিলাফত (২৯৭-৫৬৭ হি./৯০৯-১১৭১ খ্রি.) ঈদুল আজহাকে একটি বর্ণিল ও সাংস্কৃতিক উৎসবে রূপান্তরিত করে। মাকরিজি (মৃ. ৮৪৫ হি.) তাঁর ইত্তিআজ আল-হুনাফা গ্রন্থে বর্ণনা করেন, খলিফা আজিজ (মৃ. ৩৮৬ হি.) ঈদের নামাজের জন্য কায়রোর বিশাল মাঠে বিশেষ মঞ্চ (মাসাতিব) নির্মাণ করতেন। এ মঞ্চে দাঁড়িয়ে মুয়াজ্জিন ও ফকিহরা তাকবির ধ্বনি দিতেন এবং জনগণ উৎসবমুখর পরিবেশে সেখানে অংশ নিত।

ইবনে কাসির উল্লেখ করেন, মামলুক সুলতান বাইবার্স ঈদুল আজহার সময় কারাবন্দীদের মুক্তি দিতেন, বিশেষ করে রাজনৈতিক বন্দীদের।

ফাতেমিদের সময়ে কোরবানির করার আয়োজন ছিল অত্যন্ত সংগঠিত। ইবনে তাগরি বারদি উল্লেখ করেন, ফাতেমি খলিফারা ঈদুল আজহার জন্য হাজারো পশু ক্রয় করতেন। পশুগুলো কায়রোর প্রধান মাঠে জবাই করা হতো এবং মাংস দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে সংরক্ষণ করা হতো।

ফাতেমিদের একটি উল্লেখযোগ্য প্রথা ছিল ‘ঈদিয়া’ বা ঈদ উপহার। মাকরিজি বর্ণনা করেন, খলিফারা ফকিহ, সুফি, এমনকি অমুসলিম বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ঈদিয়া হিসেবে নগদ অর্থ, পোশাক ও মিষ্টান্ন উপহার দিতেন। একটি মজার প্রথা ছিল মিষ্টির ভেতরে সোনার দিনার লুকিয়ে রাখা, যা অতিথিদের সীমাহীন বিস্ময় ও আনন্দ জোগাত।

ফাতেমিদের ঈদের ভোজও বিখ্যাত ছিল। মাকরিজি উল্লেখ করেন, খলিফা মুসতানসিরের (মৃ. ৪৮৭ হি.) ঈদুল আজহার ভোজে ৩০০ রকমের খাবার পরিবেশন করা হতো। এ ভোজে কুসকুস, হারিসা ও বিভিন্ন মিষ্টান্ন যেমন খুশকনান (মিষ্টি রুটি) ও বেসতানদুদ (মিষ্টি পিঠা) থাকত। ভোজসভাগুলো শুধু আনন্দের নয়; বরং সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানের আদান-প্রদানের মাধ্যম ছিল।

আরও পড়ুনযেভাবে ঈদ উৎসব উদ্‌যাপন শুরু হয়েছিল২৯ মার্চ ২০২৫ঈদুল আজহার ভোজে ৩০০ রকমের খাবার পরিবেশন করা হতো

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ডায়াবেটিসের লক্ষণ নেই, কিন্তু সুগার ২৫
  • ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার অভিলাষ দেখছেন বাম নেতারা
  • আদি সময়ে ঈদুল আজহার উদ্‌যাপন
  • আইন আছে, প্রয়োগ নেই