কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে প্রতিবছর কেন একই রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়? সাধারণ কোরবানিদাতা ও মৌসুমি ছোট ব্যবসায়ীরা কেন বলেন, চামড়ার ন্যায্য দাম পাননি? কেন কিছু কিছু এলাকা থেকে চামড়া ফেলে দেওয়া বা মাটিতে পুঁতে ফেলার খবর আসে? কেন বিভিন্ন এলাকায় চামড়া পচে যায়, নষ্ট হয়? 

এর বিপরীতে প্রতিবছর ব্যবসায়ীরা কেন বলেন, সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে চামড়া কিনেছেন তারা। সরকার কেন বলে, এবার সবচেয়ে বেশি দামে চামড়া বিক্রি হয়েছে। যারা সঠিক দাম পাননি বলে অভিযোগ করেন, তাদের ব্যাপারে কেন বলা হয়, তারা সময়মতো আড়তে না এনে চামড়া নষ্ট করে ফেলেছেন। তাই বিক্রি হয়নি।   
এ দুই বিপরীতমুখী বাস্তবতার মাঝে আছে একটি ‘লবণরেখা’। ভেঙে বললে, লবণমুক্ত চামড়া বনাম লবণযুক্ত চামড়া। শুরুর প্রশ্নগুলো ওঠে মূলত লবণ ছাড়া চামড়ার বিক্রয় পরিস্থিতি নিয়ে। আর বড় ব্যবসায়ী ও সরকারের বক্তব্যটি থাকে লবণ দেওয়া চামড়ার বাজার নিয়ে। 

পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সব সরকারই প্রতিবছর চামড়ার যে দাম নির্ধারণ করেছে তা মূলত লবণ দেওয়া চামড়ার। চামড়া কিনে লবণ দেন মূলত স্থানীয় মাঝারি ব্যবসায়ীরা। তারা সেগুলো ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করেন। সারাদেশে এ ধরনের ব্যবসায়ী ও ট্যানারি মালিকের সংখ্যা ১ লাখের কাছাকাছি। এই তথ্য বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের। সরকারের চামড়া ব্যবস্থাপনার মধ্যে মূলত তারাই পড়েন। 

এর বাইরে সাধারণ কোরবানিদাতা থেকে পাড়া-মহল্লার তরুণ মৌসুমি ক্রেতা এবং মাদ্রাসা, মসজিদ ও এতিমখানার সংগ্রহ করা চামড়া এই ব্যবস্থাপনার বাইরে থেকে যায়। সংখ্যায় হিসাব করলে এটা কোটির কাছাকাছি। তারা লবণহীন চামড়া কেনাবেচা ও লেনদেন করেন। তাই অব্যবস্থাপনায় দাম পাওয়া বা না পাওয়া ভুক্তভোগীর সংখ্যাটা লবণযুক্ত চামড়ার ব্যবসায়ীদের তুলনায় বেশ বড়। ফলে না পাওয়ার আওয়াজটা অনেক বড় হয়। 
 
এবারের বেচাকেনার চিত্র 
ঢাকায় প্রতিটি গরু বা মহিষের কাঁচা চামড়া ৬৫০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ঢাকার বাইরে গ্রামেগঞ্জে বেচাকেনা হয়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়। ছাগলের চামড়ার ক্রেতা তেমন একটা খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। 

গত শনিবার ঈদের দিন বিকেলে গুলশান-২ মোড়ে গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন এতিমখানার লোকজন ভ্যানে করে চামড়া এনে জড়ো করেছেন। ২০টি চামড়া বিক্রির জন্য নিয়ে আসা কবির হোসেন বলেন, ‘একটি বড় গরুর চামড়া কিনে এনেছি ৮০০ টাকা দিয়ে। এখন দাম বলছেন ৭০০ টাকা। কীভাবে বিক্রি করব?’ 
ঢাকার বাইরের চিত্র আরও নেতিবাচক। লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জের জামেয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা ১৮০ পিস চামড়া সংগ্রহ করেছে। তারা নিজের খরচে স্থানীয় আড়তদারের কাছে নিয়ে গিয়ে ছোট চামড়া বিক্রি করেছে ৪০০ টাকা আর বড় চামড়া ৪৫০ টাকা দরে। এই আড়তদাররা লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করে এ চামড়া বিক্রি করবেন বড় ব্যবসায়ী বা ট্যানারি মালিকদের কাছে। চট্টগ্রামে ১০ টনের মতো চামড়া ময়লার ভাগাড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে বলে সিটি করপোরেশন জানিয়েছে।

সরকার নির্ধারিত দাম কত 
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গতবারের চেয়ে ৫ টাকা বাড়িয়ে ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, ঢাকার বাইরে নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। এতে ঢাকায় লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার সর্বনিম্ন দাম ১ হাজার ৩৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার ১৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। খাসির লবণযুক্ত চামড়া প্রতি বর্গফুট ২২ থেকে ২৭ টাকা এবং বকরির চামড়া ২০-২২ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। 

সাধারণত বড় আকারের গরুর চামড়া ৩১-৪০ বর্গফুট, মাঝারি আকারের চামড়া ২১-৩০ এবং ছোট আকারের গরুর চামড়া ১৬-২০ বর্গফুটের হয়। 
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেছেন, বিগত ১২ বছরের মধ্যে এবার সবচেয়ে বেশি দামে চামড়া বিক্রি হয়েছে। সরকার চামড়ার পুরোনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে চামড়া সংরক্ষণ না করে পচিয়ে ফেললে সে দায়িত্ব সরকারের না। গতকাল মঙ্গলবার জয়পুরহাটের আরাফাত নগর এলাকায় চামড়ার আড়ত ও চামড়ার সংরক্ষণাগার পরিদর্শনকালে তিনি এ কথা বলেন।

মৌসুমি ব্যবসায়ী নেই, মাদ্রাসায় দান
বছর পাঁচেক আগেও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা পাড়ামহল্লায় ও বাড়িতে গিয়ে দরদাম করে চামড়া কিনতেন। কয়েক বছর টানা দাম না পাওয়ায় পাল্টে গেছে সেই চিত্র। লোকসানের ভয়ে এ ব্যবসা আগের মতো নেই।

মৌসুমি ব্যবসায়ীদের মতে, সরকার প্রতি বছর লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করে। কিন্তু লবণ ছাড়া অর্থাৎ রক্ত-মাংসযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করে না। ফলে প্রাথমিক ধাপের এ চামড়ার ন্যায্য দর পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে দিন দিন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা হারিয়ে যাচ্ছেন। সাধারণ মানুষ ক্রেতা না পেয়ে এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানায় বিনামূল্যে চামড়া দান করে দেয়। অনেক এলাকায় এখন মাদ্রাসা ও এতিমখানাকে ফোন করে ডেকে এনে চামড়া দিতে হয়। এসব প্রতিষ্ঠানকে কম দামে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য করেন স্থানীয় আড়তদাররা।

বিশেষজ্ঞরা চামড়ার দাম বেঁধে দেওয়ার বিপক্ষে। তাদের মতে, উপযুক্ত দাম নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ অর্জন করার বিকল্প নেই। দাম নির্ধারণ না করে কোরবানির চামড়াকে ছেড়ে দিতে হবে মুক্ত বাজারের ওপর। তাহলে লবণ দেওয়ার আগে কিংবা পরে সব স্তরেই চামড়ার ন্যায্য দাম নিশ্চিত হবে।

কত পশু কোরবানি হয়েছে
প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ বছর কোরবানি হয়েছে ৯১ লাখ ৩৬ হাজার ৭৩৪টি পশু, যার মধ্যে গরু-মহিষ ৪৭ লাখ ৫ হাজার ১০৬টি। ছাগল ও ভেড়া ৪৪ লাখ ৩০ হাজার ৬৬৮ এবং অন্যান্য ৯৬০টি।

চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা
ট্যানারি মালিক সূত্রে জানা গেছে, এ বছর ৮৫ থেকে ৯০ লাখ পিস চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তারা। গত বছর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ কোটি ১০ লাখ পিস। তারা জানান, সারা বছর যে পরিমাণ চামড়া সংগ্রহ করা হয়, তার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ সংগ্রহ হয় কোরবানির ঈদে।

কী বলছেন ট্যানারি মালিকরা
সমতা লেদার কমপ্লেক্সের পরিচালক ও বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান সমকালকে বলেন, সঠিক সময়ে যথাযথভাবে লবণ না দিলে চামড়া নষ্ট হয়ে যায়। তবে এ বছর ঢাকায় কোথাও চামড়া ফেলে দিতে হয়নি। কারণ এখানে চামড়া সংগ্রহকারীরা সঠিক সময়ে সঠিক নিয়মে চামড়া সংগ্রহ ও সরবরাহ করেছেন। ঢাকায় এবার ৮ থেকে ১০ লাখ পিস চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। ইতোমধ্যে ট্যানারি মালিকরা লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি চামড়া সংগ্রহ করেছেন।

লবণ ছাড়া চামড়ার দাম কম কেন– জানতে চাইলে মিজানুর রহমান বলেন, বিভিন্ন কারণে চামড়া নষ্ট হয়। সে জন্য দাম পাচ্ছে না অনেকে। তবে অন্য বছরের চেয়ে এবার দাম সন্তোষজনক। চামড়া কেনার ক্ষেত্রে ট্যানারি মালিকদের মধ্যে কোনো সিন্ডিকেট নেই।

মিজানুর রহমানের মতে, মাঝারি আকারের তথা ২০-২৫ বর্গফুটের একটি চামড়ায় ৫ থেকে ৬ কেজি মোটা দানার লবণ প্রয়োজন হয়। এ ধরনের লবণের কেজি ১০ থেকে ১৫ টাকা। আড়তদারদের হিসাবে, মাঝারি আকারের একটি চামড়ায় লবণ বাবদ খরচ হয় কমবেশি ৭০ টাকা। এর সঙ্গে শ্রমিক ও পরিবহন খরচ মিলিয়ে প্রতিটি চামড়ায় খরচ হয় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। এ হিসাবে আড়তদারের প্রতিটি চামড়ায় খরচ হতে পারে ১ হাজার টাকার মতো। 

ওয়েট ব্লু চামড়ার রপ্তানি বাড়ানোর তাগিদ
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি মো.

ইলিয়াস হোসেন বলেন, কোরবানির পর লবণ ছাড়া পশুর চামড়া ৮ থেকে ৯ ঘণ্টার বেশি রাখা যায় না। ফলে কোরবানির দিনই বিক্রি হয় লবণ ছাড়া চামড়া। এ পর্যায়ে দর নির্ধারিত থাকে না।

বাংলাদেশ থেকে সাধারণত ‘ক্রাস্ট’ ও ‘ফিনিশড লেদার’ অর্থাৎ সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াজাত চামড়া রপ্তানি হয়। ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানি হয় না বলা চলে। এবার ন্যায্য দর নিশ্চিত করতে সরকার কাঁচা চামড়া এবং ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানি তিন মাসের জন্য শিথিল করেছে। চামড়া থেকে পশম ছাড়িয়ে প্রক্রিয়াজাত করার পর যেটি পাওয়া যায়, তাকেই ওয়েট ব্লু চামড়া বলা হয়। এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ীরা।

ইলিয়াস হোসেন বলেন, এই সুযোগটি অব্যাহত রাখা দরকার। এ জন্য সরকারের উচিত প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। তাহলে ভবিষ্যতে চামড়ার চাহিদা বাড়বে, ভালো দামও পাওয়া যাবে।

দাম নিশ্চিত করবেন কীভাবে
ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলোজির অধ্যাপক সবুর আহমেদ বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে দর নির্ধারণ করে দেওয়া ঠিক নয়। প্রায় এক দশক ধরে লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে। এর পর থেকে ক্রমান্বয়ে দামও কমছে। এলডব্লিউজি সনদ না থাকায় এই পতন আরও ত্বরান্বিত হচ্ছে।

চামড়ার হারিয়ে যাওয়া জৌলুস ফেরাতে অধ্যাপক সবুর আহমেদ কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছেন। যেমন, প্রথমত এলডব্লিউজি সনদ অর্জন করতে হবে। সে জন্য জরুরি ভিত্তিতে সাভারে অবস্থিত ট্যানারি শিল্পের বর্জ্য শোধনাগার বা ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) বাস্তবায়ন করতে হবে। চামড়ার দাম নির্ধারণ করা যাবে না। সহজে ঋণ দিতে হবে ট্যানারি মালিকদের নয়, কাঁচা চামড়া সংগ্রহকারীদের। এসব উদ্যোগ নিলে চামড়ার দাম বাড়বে। 

সরকারের ভাবনা
জানতে চাইলে গত রাতে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, ভবিষ্যতে চামড়ার দাম নির্ধারণ না করার পক্ষে সরকার। কারণ দাম বেঁধে দিলে তা নিয়ে সমস্যা হয়। এবার চামড়া সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন জায়গায় বিনামূল্যে লবণ দেওয়া হয়েছে। ফলে অনেকেই চামড়া তাৎক্ষণিক বিক্রি না করে সংরক্ষণ করেছেন। এতে তারা ভালো দাম পাবেন।

বাণিজ্য সচিব বলেন, সাভারে ট্যানারি পল্লির কাছে একটা শেড তৈরি করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। ক্রমান্বয়ে চট্টগ্রাম ও নাটোরে শেড করা হবে। তাতে চামড়া সংরক্ষণ করা সহজ হবে। দামও বাড়বে।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ন শ চ ত কর ব যবস য় র র ব যবস য় ক রব ন র র লক ষ য সরক র র লবণ ছ ড় র রহম ন ব যবস থ আড়তদ র কর ছ ন ক ন বল ন বল ন র লবণ

এছাড়াও পড়ুন:

দেশে পাঙাশের বৃহত্তম আড়ত দ্বীপনগর, পাওয়া যায় দেশি-বিদেশি অনেক মাছ

রাজধানীর গাবতলী–মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের পাশে বিজিবি মার্কেটে গড়ে ওঠা দ্বীপনগর মাছের আড়ত প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত বেশ জমজমাট থাকে। এই তিন ঘণ্টায় বিক্রি হয় দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার মাছ। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসে এসব নানা জাতের দেশি-বিদেশি মাছ।

এ আড়তে গরিবের মাছখ্যাত পাঙাশ থেকে শুরু করে রুই, কাতলা, মৃগেল, তেলাপিয়া, কই, শিং, টাকি, মাগুর, পুঁটি, বাইম, চিংড়িসহ বিভিন্ন ধরনের দেশি ও চাষের মাছ পাওয়া যায়। নদীর পাশাপাশি সাগরের বাইলা, চাপিলা, সুরমা, পোয়া, রিঠা, লইট্টা, টুনা প্রভৃতি মাছ পাওয়া যায়। ওমান, চীন ও ভারত থেকে আমদানি করা মাছ সরাসরি এখানে আসে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।

আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৬ সালে প্রথমে বিজিবি মার্কেটে মাছ বিক্রি শুরু হয়। তবে ২০০৯ সালে এ বাজারে দ্বীপনগর আড়তের যাত্রা শুরু হলেও বাজার জমে ওঠে ২০১৫ সালের পর থেকে। পরে পাঁচটি হিমাগার ও একটি বরফকল নিয়ে এটি এখন একটি পূর্ণাঙ্গ মৎস্য আড়তে পরিণত হয়, যেখানে ছোট–বড় প্রায় ৪০০ পাইকারি দোকান রয়েছে।

আড়তদার ও বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, দ্বীপনগর আড়তে জ্যান্ত মাছের পাইকারদের বিনা মূল্যে পানি সরবরাহ করায় তাঁদের প্রত্যেকের প্রায় ৫০০ টাকা করে সাশ্রয় হয়। তার ওপর যাতায়াতের সুবিধা ভালো, ওজনে কেউ মাছ কম দেয় না, চুরিও হয় না এবং সবচেয়ে বড় কথা হলো, এখানে চাঁদাবাজিমুক্ত পরিবেশে বেচাকেনা করা যায়। এসব কারণে এটি এরই মধ্যে ঢাকার অন্যতম বৃহৎ ও জনপ্রিয় আড়তে পরিণত হয়েছে। ফলে এখানে দিন দিন পাইকার বাড়ছে এবং মোকামও আশপাশে বিস্তৃত হচ্ছে।

দ্বীপনগর আড়তের ‘অটুট বন্ধন মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতি’র সভাপতি মো. ইনসার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে দৈনিক প্রায় ৪০ হাজার কেজি পাঙাশ বিক্রি হয়, যা কারওয়ান বাজারেও হয় না। সব ধরনের মাছ মিলিয়ে দৈনিক দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়।’

* দ্বীপনগর আড়তে পাঙাশ, রুই, কাতলা, মৃগেল, তেলাপিয়া, কই, শিং, টাকি, মাগুর, পুঁটি, বাইম, চিংড়িসহ বিভিন্ন ধরনের দেশি ও চাষের মাছ পাওয়া যায়।
* নদী ও সাগরের বাইলা, চাপিলা, সুরমা, পোয়া, রিঠা, লইট্টা, টুনা প্রভৃতি মাছও বিক্রি হয়।
* প্রতিবেশী ভারত থেকে শুরু করে ওমান, সুদান, জর্ডান, চীন ও জাপান থেকে আমদানি করা মাছ এখানে বিক্রি হয়।

আড়তদার ও পাইকারদের দাবি, এটি দেশে পাঙাশ মাছের সবচেয়ে বড় আড়ত। এখানে দিনে ৩৫ থেকে ৪০ ট্রাক পাঙাশ মাছ আসে। এসব ট্রাকে ৩০ থেকে ৪০টি করে পাঙাশের ড্রাম থাকে। এর একেকটিতে ৪০ কেজি মাছ থাকে। গড়ে ৩৫টি ট্রাকে ৩৫টি করে ড্রাম এবং প্রতি ড্রামে ৪০ কেজি ধরে হিসাব করলে দেখা যায়, এখানে দৈনিক ৪৯ হাজার কেজি পাঙাশ মাছ বিক্রি হয়, যার দাম ৬৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা।

বিশেষ করে রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, শ্যামলী, গাবতলী, সাভার, উত্তরা এবং আবদুল্লাহপুর এলাকার পাইকারেরা দ্বীপনগর আড়তে মাছ কিনতে আসেন। অটুট বন্ধন মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি মনির হোসেন বলেন, কম দামে পাওয়া যায় বলে পাইকারেরা এখানে মাছ কিনতে আসেন। তাঁর নিজস্ব বরফকল রয়েছে। ৯০ থেকে ১০০ টাকায় বরফের পাটা বিক্রি করেন। তাই বাইরে থেকে বরফ আনতে হয় না।

সম্প্রতি সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ভোরের আলো ফোটার আগেই বিভিন্ন এলাকার পাইকারেরা মাছ কিনতে দ্বীপনগর আড়তে চলে আসেন। সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত নিলামের হাঁকডাকে সরগরম হয়ে ওঠে পুরো আড়ত। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা তাজা ও হিমায়িত মাছের পাশাপাশি বিদেশ থেকে আনা মাছের বেচাবিক্রি শেষ হয়ে যায়। ৯টার পরপরই সব ব্যস্ততা শেষে ধোয়ামোছার কাজ শুরু হয়ে যায়।

সাভার নবীনগর থেকে আসা পাইকার ফরিদুল ইসলাম জানান, তিনি এখান থেকে দৈনিক ১৫০–২০০ কেজি সাগরের মাছ নিয়ে এলাকার বাজারে বিক্রি করেন।

আড়তদারেরা জানান, দেশের সিলেট, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, নওগাঁ, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, টেকেরহাট, খুলনা, রাজশাহী, মোংলা, সাতক্ষীরাসহ সব অঞ্চল থেকেই মিঠাপানি এবং নদী ও সাগরের মাছ আসে দ্বীপনগর আড়তে। ওমান, সুদান, জর্ডান, জাপান, চীন এবং ভারত থেকেও সামুদ্রিক মাছ আনা হয়।

মেসার্স ঢাকা গাবতলী ফিশ আড়তের স্বত্বাধিকারী মো. আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দৈনিক ৫ টনের মতো মাছ বিক্রি হয়, যার দাম ৫ থেকে ৭ লাখ টাকার মতো।’ তাঁদের হিমাগারে মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ২ মাস পর্যন্ত মাছ ঠিক থাকে। প্রয়োজনে তাপমাত্রা আরও কমানো যায় বলে জানান তিনি। তবে আড়তদারদের হিসাবে এসব হিমাগার থেকে দৈনিক ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার মাছ বিক্রি হয়।

৫৫০ টাকা করে বাইম মাছ কেনার পর আদাবর বাজারের একজন পাইকার প্রথম আলোকে জানান, তিনি এই মাছ বিক্রি করবেন ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায়। পোয়া মাছ কিনেছেন ৩৩০ টাকা কেজি দরে, বেচবেন ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায়। ওই পাইকার আরও জানান, আগে কারওয়ান বাজার থেকে মাছ কিনলেও এখন সুবিধা থাকায় দ্বীপনগরে আসেন। প্রতিদিন পাঙাশ, তেলাপিয়া, রুই মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির ৫০ থেকে ৭০ কেজি মাছ কেনেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সামুদ্রিক মাছে ভরপুর আড়ত, দাম কেমন
  • মেঘনার পাড়ে ‘আড়াই ঘণ্টার হাট’, দৈনিক বেচাকেনা ২৫-২৬ লাখ টাকার টাটকা মাছ
  • দেশে পাঙাশের বৃহত্তম আড়ত দ্বীপনগর, পাওয়া যায় দেশি-বিদেশি অনেক মাছ