রাতারাতি তারকা হলে দীর্ঘ সময় দর্শকের মনে থাকা কঠিন: রিচি
Published: 15th, June 2025 GMT
রিচি সোলায়মান। ছোটপর্দার জনপ্রিয় এই অভিনেত্রী এখন অনেকটাই আড়ালে। আজ বিশ্ব বাবা দিবস উপলক্ষে প্রকাশ হয়েছে বিশেষ গানচিত্র ‘বাবা শুনতে কী পাও’। এতে অভিনয় করেছেন রিচি সোলায়মান। এই গানচিত্র এবং সাম্প্রতিক নানা বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন মীর সামী
আপনার অভিনীত গানচিত্র ‘বাবা শুনতে কী পাও’ নিয়ে কিছু বলুন?
‘বাবা শুনতে কি পাও’ শিরোনামের এই বিশেষ গানটি তৈরি করেছেন প্রান্তিক সুর। তাতে কণ্ঠ দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী গজল ঘরানার শিল্পী শিরিন চৌধুরী। গানটির কথাও লিখেছেন শিল্পী নিজে। গানচিত্রে একটি সুন্দর সামাজিক বার্তা পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিয়ের পর একটা মেয়ের স্বপ্ন যেন মরে না যায় এবং শুধু মানুষটাকে নয়, তার স্বপ্নকেও ভালোবাসার সংবেদনশীল এবং হৃদয়স্পর্শী বাবার অনুরোধের বার্তা থাকছে এতে। গানের কথার সূত্র ধরে গল্পনির্ভর ভিডিওটিতে বাবার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন আবুল হায়াত আর মেয়ের ভূমিকায় আমি। অনেকদিন পর হায়াত চাচার সঙ্গে কাজ করলাম।
এই কাজটির সঙ্গে যুক্ত হলেন কীভাবে?
কিছুদিন আগে নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী আমায় গানচিত্রটিতে অভিনয়ের জন্য বললেন। যখন শুনলাম এই গানে বাবার ভূমিকায় অভিনয় কবেন আবুল হায়াত চাচা; ঠিক তখনই রাজি হয়েছি। কারণ, আমি হায়াত চাচার পরিচালনায় অনেক নাটকে তাঁর মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছি। তাই ভাবলাম বাবা দিবসের এই কাজটি আমাদের আরও একটি ডকুমেন্টেশন হয়ে থাক। আমাদের এই কাজে একজন মেয়ের দৃষ্টিভঙ্গিতে বাবাকে ঘিরে তার স্মৃতি, ভালোবাসা আর না বলা কথাগুলো উঠে এসেছে। কাজটি করার সময় আমার বাবার কথা খুব মনে পড়ছিল। একজন বাবার অবদান যে কত বিশাল, সেটি অনেক সময় আমরা বুঝতে পারি না–এই গানচিত্রে সেটিই তুলে ধরা হয়েছে।
আপনাকে এখন টিভি নাটকে খুব কম দেখা যায়। ইচ্ছা করেই দূরে সরে আছেন?
আমি এখন পরিবার আর নিজের সময়কে প্রাধান্য দিচ্ছি। পাশাপাশি কাজের মানের প্রতিও সবসময় সংবেদনশীল ছিলাম। নাটকের সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়ে কখনও বিশ্বাসী ছিলাম না। এখন তো অনেক সময় দেখা যায় গল্প বা চরিত্রের গভীরতা কম, কাজগুলো অনেকটাই ‘কনটেন্ট ভিউ’ নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। আমি চাই, যখন কাজ করি, সেটি যেন দর্শকের মনে থাকে। তাই শুরু থেকে এখনও বেছে বেছেই কাজ করছি।
এখন নাটকে ‘ভিউ’ ও ‘ট্রেন্ড’ অনুসারে শিল্পী নির্বাচন হয় বলে অভিযোগ আছে.
..
এটি ঠিক যে এখন ‘ভিউ’ একটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন হলো– দীর্ঘ মেয়াদে এই দর্শক আসলে কাদের মনে রাখে? আমার মনে হয়, একটি শিল্পমাধ্যমে যখন কেবল সংখ্যা দিয়ে শিল্পী বা কাজের মান বিচার হয়, তখন সেখানে অন্তর্নিহিত শিল্পবোধ অনেকটা হারিয়ে যায়। আমি বিশ্বাস করি অভিনেতা বা অভিনেত্রী হিসেবে আমাদের প্রথম দায় নিজের চরিত্রের প্রতি। ‘ভিউ’ দিয়ে নয়, শিল্পের গভীরতা দিয়ে একজন শিল্পীকে বিচার করা উচিত।
বর্তমান সময়ে ওটিটি মাধ্যমের প্রসারে নাটকের গুণগত মানে কী প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন?
ওটিটি একটা বড় প্ল্যাটফর্ম। নতুন গল্প আর নতুন নির্মাতাদের সুযোগ এনে দিয়েছে। এখানেও একটি সিন্ডিকেট তৈরি হচ্ছে। যারা আগে টিভিতে প্রভাবশালী ছিলেন, এখন তারা ওটিটিতেও আধিপত্য রাখছেন। এটি শিল্পের জন্য মোটেই ভালো নয়। প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও অনেক শিল্পী সুযোগ পাচ্ছেন না। আমি বলব, ওটিটি হোক কিংবা টিভি–প্রতিভা ও গল্পকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত, ‘চেনা মুখ’ বা ‘সেলিব্রেটি প্যাকেজ’কে নয়।
যে সিন্ডিকেটের কথা বললেন, তা কী ভাঙা যায় না?
অবশ্যই যায়। যারা বিষয়টি নিয়ে কাজ করবেন, তারাই এখন সেই দলের হয়ে যাচ্ছে। ফলে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? আমি যখন নিয়মিত কাজ করেছি, সেই সময় কিন্তু সবাই যার যার যোগ্যতা দিয়ে কাজ করেছেন। এখন পরিচয়ের ভিত্তিতে হচ্ছে। ফলে ধীরে ধীরে আমাদের নাট্যাঙ্গনের শিল্পটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
ওটিটির কাজে আগ্রহ অনুভব করেন?
অবশ্যই। যদি ভালো গল্প আর শক্তিশালী চরিত্র পাই, আমি ওটিটিতেও কাজ করতে চাই। অশ্লীলতা বা অহেতুক সাহসী দৃশ্যের নামে যদি গল্পের গুরুত্ব হারিয়ে যায়, তাহলে সেটি আমাকে টানে না। শিল্পমান থাকলেই আমি আগ্রহী।
বর্তমান প্রজন্মের নতুন অভিনেত্রীদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
নতুনদের মধ্যে অনেকেই খুব ভালো করছেন। আমি তাদের একটা কথাই বলি, নিজেকে সময় দিন, নিজেকে গড়ুন। রাতারাতি তারকা হওয়া যায়। দীর্ঘ সময় দর্শকের মনে থাকা কঠিন। টিকে থাকার জন্য শুধু সৌন্দর্য নয়, কাজের প্রতি নিষ্ঠা, অধ্যবসায় ও আত্মসমালোচনাও জরুরি।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আম দ র ক জ কর কর ছ ন সময় দ
এছাড়াও পড়ুন:
রেনু বেগমের ‘বুকভাসা চোখের পানি’ কেন
‘৩২ বছর ধরে পঙ্গু স্বামীক নিয়া ঘর করি। শ্বশুরের ১৪ একর জমি ছিল। সোগ নদীতে গেইচে। অগেও দুইবার বাড়ি ভাঙছে। এ বছরও বাড়ি ভাঙি যাইবে। খালি আল্লাহর কাছে কান্দি আর কই, আল্লাহ হামাক বাঁচান। হামার বাড়িটা ভাঙি যায়, তবুও কেউ রক্ষা করিল না।’ ঈদের আগের রাতে রেনু বেগম কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন।
কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙা ইউনিয়নের বুড়িরহাটে তিস্তা নদীসংলগ্ন রেনু বেগমের বাড়ি। তাঁদের বাড়িটি নদীগর্ভে বিলীন হতে পারে, এ খবর পেয়ে ঈদের আগের রাতে সেখানে গিয়েছিলাম। রেনু বেগম ঘড়িয়ালডাঙা ইউনিয়নের সংরক্ষিত আসনে দুইবার নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। তৃতীয়বার ৫৯ ভোটে হেরেছেন। তাঁর হেরে যাওয়ার পরের বছর বাড়ি ভাঙতে শুরু করে। তাঁর থাকার টিনের ঘরের একাংশ বর্তমানে ভাঙনের মধ্যে পড়েছে। রেনু বেগমকে সহায়তা করার কেউ নেই। বরং এক মেয়ে ঘরজামাইসহ থাকেন। আরেক মেয়ে বিধবা হয়েছেন। তাঁর মেয়েকেও পালনের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে।
ঈদের আগের রাতে রেনু বেগমের বাড়ি রক্ষা করা যাবে কি না, বুঝতে পারছিলাম না। এটা বুঝতে পারছিলাম, বাড়িটি রক্ষা করতে হলে রাতেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। তিস্তায় কখন পানি বাড়বে, এটি বলা কঠিন। ঈদের রাতে ফোন দেওয়ার বিষয়ে উচিত-অনুচিত না ভেবে আমি পানি উন্নয়ন বোর্ডের রংপুর বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমানকে ফোন দিই। বিষয়টি জানিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করি। আরও কয়েকজন সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীর সঙ্গেও কথা বলি। রংপুরের প্রধান প্রকৌশলী আমাকে জানান, রাতেই কাজ শুরু করবেন। কখন কাজ শুরু হবে, আমি সেই অপেক্ষায় থাকি। অপেক্ষার ফাঁকে রেনু বেগমের সঙ্গে অনেক বিষয়ে কথা হয়।
রেনু বেগম এখন যে বাড়িতে আছেন, তাঁর গোয়ালঘর গত বছরে ভেঙে গেছে। এ বছর ভেঙেছে রান্নাঘর। অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ ছিলেন রেনু বেগমরা। নদীর ভাঙনে নিঃস্ব। তাঁদের অনেক জিনিসপত্র ছিল। সেগুলো ছিল রান্নাঘরে। কয়েক দিন আগে রাতে বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ ছিলেন না। প্রচণ্ড ঝড় ছিল। সারা রাত বাতাস। বাড়িও নদীসংলগ্ন। জোরে জোরে কেঁদে কেবল আল্লাহকে ডেকেছেন রেনু বেগম। বাতাসে ঘরের চাল উড়ে যাওয়ার শব্দ পেয়ে আরও আতঙ্কিত হয়েছেন।
একটি ঘরের বেড়া ভেঙে গেছে। এমন শব্দ শুনে তিনি এক মেয়ে ও তিন নাতনিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিলেন। সকালে উঠে দেখেন, তাঁর রান্নাঘর সম্পূর্ণটাই নদীতে চলে গেছে। চেয়ার-টেবিলসহ অনেক ফার্নিচার, প্রয়োজনীয় আসবাব—কিছুই ধরে রাতে পারেননি। মুরগি ছিল, সেগুলোও আর পাননি। রেনু বেগম বলেছিলেন, ‘আমি অনেককে বলছিল, বাহে হামার বাড়িটা বাঁচে দাও। মানুষের মনে কোনো মায়া নাই। যদি মানুষের জন্য মায়া না থাকে, তাহলে তারা কিসের মানুষ? রাইতে ঘুমাই না। কখন যে বাড়ি ভাঙি যায়, সেটাই ভয়।’
প্রতিবছর নদীভাঙনের শিকার মানুষগুলোর আর্থিক ক্ষতির কোনো পরিসংখ্যান রাখা না হলেও সেই ক্ষতি নিয়ে কথা হয়। ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করারও চেষ্টা হয়। কিন্তু নদীভাঙনে যে মানবিক ক্ষতি, সেই ক্ষতি কি পরিমাপ করা যায়? নদীপারের একজন মানুষেরও বাড়ি নদীগর্ভে আর বিলীন না হোক। নদীভাঙনের বিপর্যয় থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হোক। রেনু বেগমদের বুকে যেন চোখের পানি আর না জমে।আকাশে মেঘ তখন চাঁদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছিল। রাতও গভীর হচ্ছিল। নদীর দিকে ঘন অন্ধকার। আমার সঙ্গে হামিদুল নামের একজন গিয়েছিল। তার কথার স্বরে বুঝতে পারছিলাম, সে রেনু বেগমের এই কষ্টের কথা নিতে পারছে না। আমি রেনু বেগমের সঙ্গে যতই কথা বলছিলাম, আমার বুকটাও কষ্টে ভারী হয়ে উঠছিল। একের পর এক কষ্টের কথা বলছিলেন তিনি। একজন মানুষ কত কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে?
পরিবারের জন্য অন্যের বাড়িতে প্রায় এক যুগ কাজ করেছেন তিনি। ওই বাড়িতে একবার লোহার শলাকা ওপর থেকে মাথার ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল। দুই দিন জ্ঞান ফেরেনি। তাঁর নাকি বাঁচারই কথা ছিল না। মাথায় হাত দিয়ে ক্ষতের জায়গা দেখাচ্ছিলেন রেনু বেগম।
প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য তাঁর অন্য আত্মীয়ের খবর জিজ্ঞেস করেছিলাম। তখন আরেক কষ্টের ঝুড়ি খুললেন। তাঁর স্বামীরা ছয় ভাই ছিলেন। নদীভাঙনের কবলে পড়ে একেকজন একেক দিকে গেছেন। এক ভাই চলে যান কুমিল্লায় কাজ করতে। সেখানেই মারা গেছেন। এক ভাই কাজের সন্ধানে যান দিনাজপুরে। এক ভাই রাজারহাটে অন্য খানে কাজ করেন। দুই ভাই ১০ শতক জমি ভাড়া নিয়ে সেখানে থাকেন। এই বাড়ি ভেঙে গেলে তাঁরা চলে যাবেন ঢাকায়। ঢাকায় কোথায় যাবেন, কী করবেন, তা তিনি জানেন না।
ঈদের দিন কী করবেন, এ কথা জিজ্ঞেস করতেই আবারও কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘খাওয়ার কিচ্ছু নাই। বাপের বাড়ি থাকি আইজ ৫০০ টাকা আনছি। কী করমো, জানি না। আল্লাক কই, আল্লাহ হামাক তুলি নেও। আমার বুকভরা চোখের পানি। আমার কোনো সুখ নাই বাবা।’ এরই মধ্যে যাঁরা নদীভাঙন রোধে কাজ করেন, তাঁদের একজন এসে হাজির হন। প্রধান প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান তাঁকে পাঠিয়েছেন।
মাহবুবুর রহমান রংপুর থেকে ঈদের রাতে ৪০ কিলোমিটার দূরে বুড়ির হাটে আসতে চেয়েছিলেন। কাজ শুরু হওয়ায় আর আসতে হয়নি। প্রকৌশলীদের সম্পর্কে হাজারও খারাপ কথার মধ্যে তাঁর আন্তরিকতাটুকু মনে রাখার মতো। তিনি কঠোর নির্দেশনা দিয়ে ভাঙন বন্ধে কাজের নির্দেশনা দিয়েছেন। এ বছর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান চান, তিস্তায় যেন একটি বাড়িও না ভাঙে। তার জন্য যে ব্যবস্থা নিতে হয়, তিনি তা-ই সে ব্যবস্থা নিতে চান।
বাড়িটি আর কতদিন টিকে থাকবে