ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র কেড়ে নিল তরুণ ইরানি কবি আর তাঁর পুরো পরিবারকে
Published: 16th, June 2025 GMT
মাত্র ১০ দিন পরে ছিল পারনিয়া আব্বাসির ২৪তম জন্মদিন। নিজের জন্মদিন উদ্যাপন পরিকল্পনা কি করে ফেলছিলেন এই তরুণী, হয়তো আরও একটি চমৎকার কবিতা তাঁর কলম থেকে বেরিয়ে আসত।
কিন্তু এসব কিছু আর হলো না; বরং রক্তে ভেসে যাওয়া গোলাপি রঙের ম্যাট্রেসের ওপর বিশাল বিশাল কংক্রিট খণ্ডের স্তূপের নিচ থেকে বেরিয়ে আসা কয়েক গোছা চুলে পরিণত হয়েছেন পারনিয়া।
নিজের নোট বইয়ে পারনিয়ার লেখা শেষ কবিতা ছিল—
‘আমি পুড়ে যাই,
আমি বিবর্ণ হয়ে যাই,
আমি এক নীরব তারা হয়ে উঠি,
যে তোমার আকাশে ধোঁয়া হয়ে যায়.
মাত্র ২৩ বছর বয়সে সত্যি সত্যি নীরব তারা হয়ে গেছেন ইরানের উদীয়মান এই কবি। গত শুক্রবার ভোররাতে তেহরানে ইসরায়েলের হামলায় পারনিয়ার পরিবারের সব সদস্য নিহত হন।
সেদিন সকালেই হয়তো পারনিয়ার সঙ্গে দেখা হতো তাঁর প্রিয় বান্ধবী মরিয়মের। কান্নাজড়ানো গলায় মরিয়ম বলেন, ‘তিনি সবই ছিলেন। একজন কবি, একজন শিক্ষক ও একজন কন্যা। তিনি মাত্র কয়েক দিন আগে ব্যবস্থাপনায় স্নাতক পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ইরানের মেল্লি ব্যাংকের কেন্দ্রীয় শাখায় নিজের চাকরি ধরে রাখতে তিনি ভর্তি স্থগিত রেখেছিলেন।’
পারনিয়া ছিলেন শিক্ষিত এক তরুণী, যাঁর দুই চোখ ভরা ছিল স্বপ্ন। তিনি নিজের পেশা ও দেশের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। ঘাজভিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুবাদ বিষয়ে লেখাপড়া করা এই তরুণী জীবনে আরও অনেকটা এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।পারনিয়া ছিলেন শিক্ষিত এক তরুণী, যাঁর দুই চোখ ভরা ছিল স্বপ্ন। তিনি নিজের পেশা ও দেশের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। ঘাজভিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুবাদ বিষয়ে লেখাপড়া করা এই তরুণী জীবনে আরও অনেকটা এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।
ক্ষেপণাস্ত্রের একটি আঘাতে, আগুনের একঝলকে এ সবকিছু শেষ হয়ে গেল। শুক্রবার ইসরায়েলের ছোড়া একটি ক্ষেপণাস্ত্র তেহরানের সাত্তারখান সড়কের অর্কিড কমপ্লেক্সে তাঁদের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে আঘাত হানে। ক্ষেপণাস্ত্রটি যখন পারনিয়াদের ভবনে আঘাত হানে, ঠিক সেই মুহূর্তে স্বপ্নবান এ তরুণী কি ঘুমের ঘোরে কোনো স্বপ্ন দেখছিলেন?
আরও পড়ুনইসরায়েলের গুপ্তহত্যার পর ইরানের নতুন সামরিক নেতৃত্বে কারা এলেন৯ ঘণ্টা আগেমরিয়ম জানিয়েছেন, ক্ষেপণাস্ত্রটি পারনিয়াদের ভবনের ঠিক মাঝখানে আঘাত হানে। যে কারণে ভবনের পুরো একটি অংশ ধসে পড়ে, ভবনের আরও বেশ কয়েকজন বাসিন্দা নিহত হয়েছেন।
ধসে পড়া ভবনের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোড়ন তুলেছে। ওই ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একটি গোলাপি রঙের ম্যাট্রেস, সেটির এক প্রান্ত রক্তে ভেসে যাচ্ছে, রক্তের ওপর কয়েক গোছা চুল, যেন কংক্রিটের চাদর মুড়ি দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে কেউ।
ধসে পড়া ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে সবার প্রথমে পারনিয়ার মৃতদেহ বের করে আনেন উদ্ধারকর্মীরা। এরপর আনা হয় তাঁর ভাই পারহামের মৃতদেহ, ১৬ বছরের এ কিশোরের জীবন সবে শুরু হয়েছিল।
তিনি সবই ছিলেন। একজন কবি, একজন শিক্ষক ও একজন কন্যা। তিনি মাত্র কয়েক দিন আগে ব্যবস্থাপনায় স্নাতক পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ইরানের মেল্লি ব্যাংকের কেন্দ্রীয় শাখায় নিজের চাকরি ধরে রাখতে তিনি ভর্তি স্থগিত রেখেছিলেন।মরিয়ম, নিহত পারনিয়ার বান্ধবীপারনিয়ার বাবা অবসরে যাওয়া শিক্ষাকর্মী আর মা মেল্লি ব্যাংকের সাবেক কর্মীর মৃতদেহ তখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে। কয়েক ঘণ্টা পর ভারী যন্ত্রপাতি এনে কংক্রিটের স্তূপ সরিয়ে তাঁদের মৃতদেহ বের করা হয়।
আরও পড়ুনইসরায়েলি হামলায় নিহত আইআরজিসি গোয়েন্দাপ্রধান কাজেমি কে ছিলেন১০ ঘণ্টা আগেতেহরানের ওই ভবনের চতুর্থ ব্লকে ১০টি অ্যাপার্টমেন্ট ছিল—তৃতীয় থেকে পঞ্চম তলা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। মরিয়ম বলেন, ‘মনে হচ্ছিল, যেন ওই ইউনিটগুলো পুরো হারিয়ে গেছে।’
যা পড়ে আছে, তা হলো কয়েক গোছা চুল এবং আর এক তরুণীর লেখা সেই পঙ্ক্তিগুলো—যিনি একসময় আগুনে পুড়ে যাওয়ার আর বিবর্ণ হয়ে মুছে যাওয়ার কথা লিখেছিলেন। শেষ পর্যন্ত বাস্তবতা এমন নির্মম হয়ে তাঁর সামনে এল, যা তিনি কখনো কল্পনাও করেননি হয়তো।
ধ্বংসস্তূপে পরিণত তাঁরই ঘরের নীরবতায় সেই পঙ্ক্তিগুলোর প্রতিধ্বনি যেন শোনা যাচ্ছিল।
পারনিয়ার নীরব তারা হয়ে যাওয়া শুধু একটি যুদ্ধের গল্প নয়, এটা এক চুরি হয়ে যাওয়া ভবিষ্যতের গল্প, না–বলা কবিতার গল্প, আর এমন সব জীবনের গল্প, যেগুলোর শেষ কখনোই ধ্বংসস্তূপ আর আগুনে হওয়ার কথা ছিল না।
আরও পড়ুনখামেনিকে হত্যার ইসরায়েলি পরিকল্পনা ট্রাম্পের আটকানোর কথা জানিয়ে দেওয়ার মানে কী৮ ঘণ্টা আগেউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রন য় র ইসর য় ল ভবন র
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ