যুক্তরাষ্ট্র কি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে
Published: 18th, June 2025 GMT
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাত তীব্রতর হওয়ার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন এই সংঘাতে জড়াবে, নাকি এখনো কূটনৈতিক সমাধানের পথে হাঁটবে, সে বিষয়ে মিশ্র ইঙ্গিত দিচ্ছে।
প্রকাশ্যে ট্রাম্প প্রশাসন সমঝোতার কথা বলছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের সমঝোতা আলোচনাকারীরা চলতি সপ্তাহে বসতেও চেয়েছিলেন। গত বৃহস্পতিবার ট্রাম্পও ট্রুথ সোশ্যালে এক পোস্টে বলেছিলেন, ‘আমরা একটি কূটনৈতিক সমাধানের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ রয়েছি।’
কিন্তু এর ১৪ ঘণ্টা পর যখন ইসরায়েল ইরানে হামলা শুরু করেছে, ট্রাম্প তখন এক পোস্টে বলেন, তিনি ইরানকে একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে ৬০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন এবং সেই সময়সীমা পার হয়েছে। এরপর রোববার ট্রাম্প জোরের সঙ্গে বললেন যে ইসরায়েল ও ইরানের একটি চুক্তি করা উচিত এবং তাঁর সহায়তা নিয়ে দেশ দুটি তা করবে।
সোমবার ট্রাম্প যখন জি–৭ সম্মেলন থেকে আগেভাগে ফেরার জন্য ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্যে কানাডা ত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, সে সময় তাঁর সতর্কবার্তা আশঙ্কা জাগানিয়া হয়ে ওঠে। তিনি এক পোস্টে বলেন, ইরানের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র থাকতে পারে না এবং ‘তেহরান থেকে সবাইকে অবিলম্বে সরিয়ে নেওয়া উচিত’! পরে এয়ারফোর্স ওয়ানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট সাংবাদিকদের বলেন যে তিনি ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতির সমঝোতা আলোচনার জন্য ওয়াশিংটনে ফিরছেন না। তিনি ‘এর চেয়ে আরও অনেক বড় কিছু’ চান।
ট্রাম্পের এই বক্তব্য ইসরায়েল–ইরান সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র সত্যিকারে কোন মাত্রায় যুক্ত এবং এখানে আসলে দেশটি কী করতে চায়, তা নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
ইরানে ইসরায়েলের হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের যুক্ততার কথা অস্বীকার করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। রোববার তিনি ট্রুথ সোশ্যালে এক পোস্টে লিখেছিলেন, ‘আজ রাতে ইরানে যে হামলা হয়েছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’
ট্রাম্প কি যুদ্ধে জড়াবেন?
ইসরায়েলের হামলায় ইরানের নাতাঞ্জ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনার ভূপৃষ্ঠের ওপরের অংশ ধ্বংস হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই পারমাণবিক কেন্দ্রে ইউরেনিয়ামকে ৬০ শতাংশ বিশুদ্ধতায় সমৃদ্ধ করেছে, যা পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশের তুলনায় অনেক বেশি, কিন্তু পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ৯০ শতাংশের নিচে। ইসরায়েলি হামলার কারণে নাতাঞ্জে বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়ে ভূগর্ভস্থ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের অংশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ)।
কিন্তু আইএইএর মূল্যায়নে, ইসরায়েল ইরানের ফোরদোয় অপর ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারেনি। কেন্দ্রটি পাহাড়ের ভূগর্ভে তৈরি করা হয়েছে, এর মূল কক্ষগুলো মাটির নিচে ৮০ থেকে ৯০ মিটার (প্রায় ২৬০ থেকে ৩০০ ফুট) গভীরে। এখানেও ইউরেনিয়ামকে ৬০ শতাংশ বিশুদ্ধতায় সমৃদ্ধ করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক কেলসি ডেভেনপোর্ট বলেন, ইসরায়েল যদি এসব ভূগর্ভস্থ স্থাপনায় হামলা করতে চায়, তাহলে সম্ভবত তাদের যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা দরকার হবে। কারণ, সেখানে ক্ষয়ক্ষতি করতে সক্ষম বোমা যুক্তরাষ্ট্রের হাতে আছে।
ডেভেনপোর্ট বলেন, এই সব বোমা দিয়ে বারবার হামলা চালালে ভূগর্ভস্থ ওই সব পারমাণবিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস করা সম্ভব। ওয়াশিংটন এখনো এই বোমা ইসরায়েলকে দেয়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক চিন্তুক প্রতিষ্ঠান স্টিমসন সেন্টারের ডিস্টিংগুইশড ফেলো বারবারা স্লেভিনও আল–জাজিরাকে বলেছেন, ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করার যে লক্ষ্যের কথা বলছে, সেটি অর্জন করতে হলে তাদের যুক্তরাষ্ট্রের সমরাস্ত্র দরকার হবে।
বারবারা স্লেভিন বলেন, ‘আমরা জানি যে (ট্রাম্প) বিজয়ীর পাশে থাকতে পছন্দ করেন। এই মুহূর্তে তিনি ইসরায়েলিদের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন, সেই কারণে তিনি এই অবস্থান বজায় রাখছেন এবং আমি মনে করি, এটাই (ইসরায়েলের প্রতি) আমাদের একধরনের মৌন সমর্থন।’
শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্র একটি বড়সংখ্যক বিমান মধ্যপ্রাচ্যে উড়িয়ে নিয়েছে, যেগুলো মাঝ আকাশে যুদ্ধবিমান ও বোমারু বিমানে জ্বালানি সরবরাহ করে। একই সঙ্গে সোমবার দক্ষিণ চীন সাগর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী রণতরি ইউএসএস নিমিটজ মধ্যপ্রাচ্যের দিকে যাত্রা করেছে। গতকাল মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্র ওই অঞ্চলে আরও যুদ্ধবিমান পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে।
এ বিষয়ে স্কটল্যান্ডের সেন্ট অ্যান্ড্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরানিয়ান ইতিহাসের অধ্যাপক আলী আনসারি মনে করেন, ইসরায়েলের হামলার প্রাথমিক সফলতার কারণে ট্রাম্প ‘বিজয়ের গর্বের’ ভাগীদার হওয়ার জন্য এই সংঘাতে জড়িত হওয়ার বিষয়ে প্রলুব্ধ হতে পারেন। এতে ইরানের পতন হতে পারে বলেও তিনি মনে করেন।
আলী আনসারি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ফোরদোয় হামলায় যোগ দিতে পারে, যদিও আমি মনে করি, আমেরিকার হামলার সত্যিকার হুমকিই ইরানিদের আলোচনার টেবিলে আনতে পারে।’ তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কিছু ছাড় দিলে ইরান তা সম্মানের সঙ্গেই মেনে নিতে পারে। কিন্তু ইসরায়েলের কাছে তারা তা পারবে না, যদিও শেষ পর্যন্ত তাদের আর কোনো উপায় না–ও থাকতে পারে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র র য ক তর ষ ট র ইসর য় ল র এক প স ট র জন য ইউর ন হওয় র
এছাড়াও পড়ুন:
ড্রোন ও উড়ুক্কু যানে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চীনের
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির দৃশ্যপট যেন বাস্তবে রূপায়ণ করছে চীন। শহরজীবনের পরিবহন ও লজিস্টিকস খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে স্বল্প উচ্চতার আকাশ অর্থনীতির বিস্তার ঘটাচ্ছে দেশটি। চীনের মাটিতে যেকোনো বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের পেছনে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা থাকে। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। স্বচালিত উড়ন্ত গাড়ি ও ডেলিভারি ড্রোনের ব্যবহার বাড়িয়ে আকাশপথকে নাগরিক জীবনের নিয়মিত যাতায়াত ও সেবার অংশ করে তোলার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে চীনের সরকার ও বেসরকারি খাত।
ইতিমধ্যে স্বচালিত উড়ন্ত গাড়িকে বাণিজ্যিক যাত্রী পরিবহনের লাইসেন্স বা অনুমোদন দেওয়া শুরু হয়েছে; তৈরি করা হয়েছে অনুকূল নীতিমালা। ড্রোনের মাধ্যমে পণ্য সরবরাহেও দ্রুত প্রসার ঘটছে। চীনের এই উচ্চাভিলাষী উদ্যোগ শুধু দেশীয় বাজারেই নয়, বৈশ্বিক পর্যায়েও তাদের আকাশপথে যাতায়াতের উদ্ভাবনে নেতৃত্বে নিয়ে যেতে পারে—এমনটাই ধারণা করছেন প্রযুক্তিবিদেরা।
বিশ্বের অনেক দেশেই ড্রোন ডেলিভারি ও উড়ন্ত গাড়ির ব্যবহার এখন পরীক্ষামূলক পর্যায়ে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে ২০২১ সালের পর থেকে ওয়ালমার্ট পণ্য সরবরাহে দেড় লাখ বার ড্রোন ব্যবহার করেছে। কিন্তু চীনে এই প্রযুক্তি এখন আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন নয়, হয়ে উঠছে বাস্তবতার অংশ।
এখন পর্যন্ত এই অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে ছোট হলেও এটির বিস্তার ঘটছে দ্রুতগতিতে। চীনের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের অনুমান, ২০২৫ সালের মধ্যে এই খাতের বার্ষিক আয় দাঁড়াবে ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন বা দেড় লাখ কোটি ইউয়ান বা ২০ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। ২০৩৫ সালের মধ্যে তা ৩ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন বা সাড়ে তিন লাখ ইউয়ানে উঠতে পারে।
চীনের জনপ্রিয় খাদ্য সরবরাহকারী কোম্পানি মেইতুয়ান একাই ২০২৪ সালে ড্রোন ব্যবহার করে ২ লাখের বেশি পণ্য সরবরাহ করেছে। , যেটি আগের বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এই খাত যে সম্প্রসারণ হচ্ছে, তার আরেকটি নজির হলো, উড়ুক্কু গাড়ি প্রস্তুতকারী কোম্পানি ইহ্যাংয়ের শেয়ারদর গত দুই বছরে প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে।
চীনের অনেক কোম্পানি এখন এই খাতে কাজ করছে। চায়না লো অল্টিটিউড ইকোনমি অ্যালায়েন্সের প্রধান লো জুন এক সম্মেলনে জানিয়েছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে চীনে কমপক্ষে ১০০টি কোম্পানি এ ধরনের যান উৎপাদন করবে। ২০২৪ সালের শেষে চীনে বেসরকারি ব্যবহারে নিয়োজিত ড্রোনের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ লাখ।
চীনের শহর ও গ্রাম, সীমান্ত ও দ্বীপ—সবখানেই এখন ড্রোনের ছোঁয়া। খাবার ছাড়া শুধু গত এক বছরে ড্রোনে পণ্য সরবরাহ হয়েছে ২৭ লাখেরও বেশিবার। দ্য ইকোনমিস্ট-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্দান্ত গতিতে এগোচ্ছে এক নতুন আকাশ অর্থনীতি। চীনের ডাক বিভাগ চায়না পোস্টও পণ্য সরবরাহে ড্রোন ব্যবহার শুরু করেছে। শহরের হাসপাতালগুলোয় জরুরি ভিত্তিতে রক্ত পৌঁছানো হচ্ছে, কৃষিজমিতে সার ও কীটনাশক ছিটাচ্ছে লাখ লাখ কৃষিড্রোন। ড্রোনের বিচিত্র ব্যবহারও হচ্ছে। যেমন কোথাও উঁচু ভবনে আগুন নিয়ন্ত্রণে হাজির হচ্ছে ড্রোন। সীমান্ত এলাকায় মাদক চোরাচালানের ওপর নজরদারিতেও ব্যবহৃত হচ্ছে ড্রোন। আবার রোগের পরীক্ষার নমুনা দ্রুত ল্যাবে পৌঁছে দিতেও ব্যবহৃত হচ্ছে আকাশপথ।
২০২৩ সালের শুরুর দিকে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং বার্ষিক সরকারি কর্মপরিকল্পনায় ‘লো অল্টিটিউড ইকোনমি’কে ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির প্রধান খাত হিসেবে ঘোষণা করেন। এ কারণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের পাশে জায়গা করে নেয় ড্রোন ও উড়ুক্কু যান। গত বছরের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা সংস্থা এই নতুন আকাশ অর্থনীতির জন্য আলাদা বিভাগও চালু করেছে। চীন স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, ড্রোন ও উড়ুক্কু গাড়ি এখন আর কল্পনা নয়, নতুন বাস্তবতা।
এদিকে ড্রোনের চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও উড়ুক্কু গাড়ি উৎপাদনেও গতি এসেছে। দেশটির বড় বড় গাড়ি কোম্পানি এখন উড়ুক্কু যান তৈরির দিকে ঝুঁকছেন।
চীনের আকাশপথে দীর্ঘদিন সেনাবাহিনীর কড়া নিয়ন্ত্রণে ছিল। আকাশপথের প্রায় ৯০ শতাংশ জায়গা সামরিক কাজের জন্য বরাদ্দ থাকায় বেসামরিক যাত্রার সুযোগ ছিল খুবই সীমিত। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে। স্বল্প উচ্চতার এই আকাশ অর্থনীতির জন্য সরকার আকাশপথ বাণিজ্যের জন্য খুলে দিতে শুরু করেছে। ৬০০ মিটারের নিচের আকাশপথ বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের জন্য শেনজেন, হেফেইসহ ছয়টি শহরকে বিশেষ অনুমতি দেওয়া হয়েছে। চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও নতুন করে ‘লো অল্টিটিউড প্রযুক্তি ও প্রকৌশল’ বিষয়ে কোর্স চালু করছে। অর্থনৈতিক মন্দায় জর্জরিত অনেক জেলা প্রশাসন এখন এই নতুন শিল্প নিয়ে আগ্রহী। ড্রোন ও উড়ুক্কু গাড়ি খাতের বদৌলতে তারা অর্থনৈতিক সাফল্য আশা করছে।
[দ্য ইকোনমিস্ট-এর প্রতিবেদন অবলম্বনে অনুবাদ করা]