Samakal:
2025-06-21@01:40:05 GMT

হাওরতীরের ব্যাটনবাড়ি

Published: 20th, June 2025 GMT

হাওরতীরের ব্যাটনবাড়ি

বেলা দুপুর গড়িয়ে বিকেল। মোটরবাইকে চড়ে উঁচু-নিচু টিলাপথ পাড়ি দিয়ে ব্যাটনবাড়িটির উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছি আমরা। কাছাকাছি পৌঁছে চৌধুরীবাড়ির খোঁজ করতেই পথচারী মুরব্বি আঙুলের ইশারায় সাদা বাড়িটির দিকে ইঙ্গিত করলেন। হাওর হাকালুকির তীরঘেঁষে শত বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে চুন-সুরকি আর ব্যাটনে গড়া এক ঐতিহ্যিক বাস্তুভিটা। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার ঘিলাছড়া ইউনিয়নে বাড়িটির অবস্থান। 
বাড়ির ভেতরের প্রবেশদ্বারেই মাথা নিচু করে ঝুঁকে রয়েছে একটি বাগানবিলাস। ধবধবে সাদা রঙের দেয়ালঘেঁষে ঝুলছে থোকা থোকা লাল ফুল–এ এক আভিজাত্যের মিশেল। বৈঠকখানায় স্বাগত জানালেন বাড়ির বর্তমান স্বত্বাধিকারী ব্যবসায়ী শাহনেওয়াজ চৌধুরী ও অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষিকা দেওয়ান আশরাফি। ঐতিহ্য লালনের পরম্পরায় বাড়িতে এখন চতুর্থ পুরুষের বাস। 
একসময় সিলেট ও আসাম একই ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ছিল। সে কারণে এ ধরনের বাড়ি সিলেটে ‘আসাম টাইপ হাউস’ বা আসামরীতির বাড়ি নামে পরিচিতি পেয়েছে। বাংলো ধরনের বাড়িগুলোর দেয়াল বানাতে বাঁশ-কাঠের ব্যাটন ব্যবহার করা হয় বলে এগুলো ‘বাংলা ব্যাটন স্টাইল’ বাড়ি হিসেবেও পরিচিত। স্থানীয়রা সহজ করে বলেন ব্যাটনের ঘর।
বাড়িটি ঘুরে দেখাতে দেখাতে দেওয়ান আশরাফি জানালেন, বাড়িটি নির্মাণ করেছেন আব্দুল গণি চৌধুরী। এটি গণি মিয়া চৌধুরীবাড়ি নামেই পরিচিত। কথিত আছে সিলেটের প্রভাবশালী জমিদার আলী আমজদ খানও এখানে প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি আব্দুল গণি চৌধুরীর কারণে। পালকি রাখার জন্য আব্দুল গণি চৌধুরীর কাছে জায়গা চেয়েও পাননি আলী আমজদ। 
বাড়ির সৌন্দর্যে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে বাহারি ফুল ও ফলের গাছ। পুরো বাড়িটিতে অদ্ভুত ছাতা মেলে ধরেছে বেশ কয়েকটি বয়সী লিচুগাছ। গাছগুলোর বয়স নাকি প্রায় দু’শ বছর! এই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন লিচুগাছটিও রয়েছে এখানে। প্রাকৃতিক পরিবেশ থাকায় ভোর হতেই বিভিন্ন ধরনের পাখির কলকাকলীতে মুখর হয়ে ওঠে বাড়িটি। শাহনেওয়াজ চৌধুরী বললেন, ‘হাওরলাগোয়া হওয়াতে শীতে এখানে পরিযায়ী পাখিরাও আসে। আমরা নিজেরা কখনোই পাখিকে বিরক্ত করি না। কোনো শিকারিকেও এই গ্রামে প্রবেশ করতে দিই না। আবার এ বাড়িতে কোনো যৌতুক দেওয়া-নেওয়ারও নিয়ম নেই।’
বাড়িটি আধেক পাকা দেয়ালের ওপরের অংশ কাঠ-বাঁশের ব্যাটনে গড়া। বাঁশের তরজা নির্মাণ করে তাতে দেওয়া হয়েছে মাটির প্রলেপ। পরবর্তী সময়ে তা কাঠের ফ্রেমে আটকে দেওয়া হয়েছে। চুন-সুরকির আস্তরণ, খোলা বারান্দার সিলিংয়ে বাঁশের নানা রকম দেশজ নকশা, গরাদের জানালা, টিনের চালা আর কালো রঙের ব্যাটন। সাদামাটা বাড়িটিও যেন অদ্ভুত সৌন্দর্য নিয়ে বছরের পর বছর টিকে আছে। 
হাওর এলাকা হলেও এখানকার বাড়িগুলো সব টিলার ওপরে। নিচে জলাভূমি ওপরে টিলা। ভরা বর্ষায় যখন থই থই পানি, টিলাবাড়ি থেকে তখন হাওরের আসল রূপটি প্রত্যক্ষ করা যায়। গল্প-কথায় যুক্ত হলেন প্রতিবেশী স্কুলশিক্ষক নূর মাহমুদ চৌধুরী। বললেন, ‘এ ধরনের ঘর সিলেটের ঐতিহ্য। আমরা আস্ত গাছ দিয়ে বারান্দার খুঁটি নির্মাণ করতে দেখেছি। এখন এসব দেখা যায় না। পরবর্তী প্রজন্মকে ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত করাতে হলে এ বাড়িগুলো সংরক্ষণ করা জরুরি।’
২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে শামছুল মজিদ চৌধুরী সাকির ‘আসাম টাইপ ইউনিক হেরিটেজ হাউজেস ইন সিলেট’ শীর্ষক গ্রন্থে স্থপতি আনোয়ার ইকবালের ‘আসামবাড়ি’ শিরোনামের নিবন্ধ থেকে জানা যায়, ঔপনিবেশিক আমলে স্থানীয় উপকরণে, স্থানীয় প্রযুক্তিতে নতুন এক স্থাপত্যধারার প্রচলন হয়। গবেষণালব্ধ জ্ঞান ব্যবহার করে ইংরেজরা আসামের প্রকৃতি, পরিবেশ ও আবহাওয়া অনুকূল একটি নতুন স্থাপত্যধারা প্রস্তাব করে; যা পরবর্তীকালে সিলেটসহ এই রাজ্যের বরাক উপত্যকায় ‘আসাম টাইপ হাউস’ হিসেবে পরিচিতি পায়। এ ধরনের ঘর নির্মাণে উপাদান হিসেবে বেছে নেওয়া হলো বাঁশ, কাঠ, নলখাগড়া। জানালার চৌকাঠ পর্যন্ত পাকা দেয়াল। তার ওপরের অংশ ব্যাটন। উল্লিখিত গ্রন্থে শামছুল মজিদ চৌধুরী সাকি আরও জানিয়েছেন, বাড়িগুলো শীতে উষ্ণ ও গ্রীষ্মে শীতল থাকে। বাড়িগুলো একই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব ও আরামপ্রদ। পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশনের জন্য বায়ু চলাচলের সুযোগ থাকে। ফলে কখনও দেয়াল ভেজা বা স্যাঁতসেঁতে হয় না, যদিও উপমহাদেশের অন্যতম বৃষ্টিবহুল এলাকায় সিলেটের অবস্থান। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হয়। এ ধরনের ঘরের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, রান্নাঘর থেকে কোনো কারণে আগুন ছড়িয়ে গেলে তা যেন সহজে শোয়ারঘরে পৌঁছাতে না পারে, সে জন্য মাঝখানে রাখা হতো একটি খোলা বারান্দা। ১৮৯৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর বৈভবশালী প্রাসাদগুলো মুখ থুবড়ে পড়লেও আসাম টাইপ ব্যাটন বাড়িগুলো টিকে ছিল সগর্বে। ফলে রাতারাতি এই রীতির নির্মাণপদ্ধতি সমাজের সকল স্তরে জনপ্রিয় হয়ে উঠল। এই ধারায় নির্মিত হতে লাগল বনেদি বাড়িগুলোও। 
তবে কালের পরিক্রমায় আসাম টাইপের এই বাড়িগুলো হারিয়ে যাচ্ছে– একথা মানতেই হয়। নতুন বাড়ি নির্মাণের তাগিদে ভেঙে ফেলা হচ্ছে শত বছরের ঐতিহ্যিক নির্মাণ। শাহনেওয়াজ চৌধুরী ও দেওয়ান আশরাফি দম্পতি জানান, সামর্থ্য থাকলেও এ বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি করার কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। এ দম্পতির ছেলেমেয়েরাও ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রয়োজনীয় সংস্কার করে বাড়িটি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে রেখে যেতে চান স্থাপত্য ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে। v
লেখক: ঐতিহ্য সংগ্রাহক

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র ব য টন এ ধরন র পরবর ত পর চ ত

এছাড়াও পড়ুন:

টেস্ট মর্যাদা প্রাপ্তির রজতজয়ন্তী উদযাপনে বড় আয়োজন বিসিবির

বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদা প্রাপ্তির ২৫ বছর পূর্তির উপলক্ষকে স্মরণ করে উদযাপন করতে বড় আয়োজন হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)।

আগামীকাল শনিবার থেকে পাঁচ বিভাগীয় শহর ও রাজধানী মিরপুরে হবে ‘ক্রিকেট কার্নিভ্যাল’ শীর্ষক সিক্স-এ-সাইড অনূর্ধ্ব-১২ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। এক দিনব্যাপী এসব আয়োজনে থাকবে ছোট দৈর্ঘ্যের ম্যাচ ও চিত্র প্রদর্শনী। ‘তৃণমূলে ক্রিকেট ছড়িয়ে দেওয়ার’ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্যও এই রজতজয়ন্তী উদ্যাপনকে কাজে লাগাতে চাইছেন বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল। ‘প্যারেন্টাল/ফ্রি ফর অল কোচিং সেন্টার’ নামের আয়োজনের মাধ্যমে আগ্রহী অভিভাবকদের ক্রিকেট কৌশল ও খেলার মূল ধারণা সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হবে।

২০০০ সালের ২৬ জুন দশম দল হিসেবে আইসিসি থেকে টেস্ট খেলার চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছিল বাংলাদেশ। পরবর্তীতে নভেম্বরে ঢাকা স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে অভিষেক টেস্ট খেলে বাংলাদেশ। যে টেস্টে প্রথম বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে সেঞ্চুরি করেছিলেন আমিনুল ইসলাম। কাকতলীয়ভাবে তার হাত ধরেই এবার রজতজয়ন্তী উদযাপন করবে বাংলাদেশ।

২১ জুন খুলনা থেকে শুরু হবে রজতজয়ন্তীর এই আয়োজন। পরবর্তীতে রাজশাহী (২২ জুন), সিলেট (২৩ জুন), চট্টগ্রাম (২৪ জুন), ঢাকার রিয়া গোপ মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স (২৫ জুন) এবং রংপুর ও বরিশাল (২৮ জুন) পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে এই উদযাপন।

একই সময়ে স্কুল–কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের জন্য পেসার ও স্পিনার হান্টের আয়োজনও করা হবে।শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচয়পত্র দেখিয়ে এতে অংশ নেওয়া যাবে। প্রতিটি ভেন্যুতে একটি করে কমেন্ট্রি বুথও থাকবে। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক মুহূর্তের ভিডিওগুলো সেখানে উপস্থাপন করা হবে। আগ্রহী দর্শকরা চাইলে ভিডিওর ওপর ধারাভাষ্য দিতে পারবেন।

টেস্ট ক্রিকেটের ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলোর ছবি আঁকার জন্য একটি ছবি আঁকা প্রতিযোগিতারও আয়োজন করছে বিসিবি। দর্শকদের জন্য থাকবে হিট দ্য স্টাম্প চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া দর্শকরা চাইলে ‘গুড লাক উইশ’ বোর্ডে নিজেরা তাঁদের বিশেষ বার্তা ও শুভকামনা জানিয়ে যেতে পারবেন।

আগামী ২৬ জুন মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে হবে কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠান, নাম দেওয়া হয়েছে- ‘বাংলাদেশের ২৫ বছর টেস্ট ক্রিকেট যাত্রার উদযাপন’। সংবর্ধনা ছাড়াও প্রথম টেস্ট ঘিরে স্মৃতিচারণ করতে পারবেন সেই সময়কার খেলোয়াড় ও কর্মকর্তারা। এ উপলক্ষে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে তাদের মতবিনিময় পর্বও থাকবে। উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশের হয়ে টেস্ট খেলা বর্তমান ও সাবেক ক্রিকেটাররাও। আয়োজনের অংশ হিসেবে হতে পারে সংক্ষিপ্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা সঙ্গীতানুষ্ঠান।

ঢাকা/ইয়াসিন

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মায়ের মৃত্যুর খবরে দেশে আসা প্রবাসীকে পিটিয়ে হত্যা
  • টেস্ট মর্যাদা প্রাপ্তির রজতজয়ন্তী উদযাপনে বড় আয়োজন বিসিবির
  • ব্র্যাক ব্যাংক পিএলসির শেয়ারহোল্ডারদের ২৫% লভ্যাংশ অনুমোদন
  • ক্লাব বিশ্বকাপে দুর্দান্ত সূচনা চ্যাম্পিয়ন ম্যানসিটির
  • ইউনূস সরকারের ৩০০ দিন: পুনর্মিলন নাকি বিভাজন, কোন পথে বাংলাদেশ
  • খামেনির ‘যুদ্ধ শুরু’ ঘোষণার পর ইসরায়েলে ব্যাপক হামলা ইরানের
  • ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশের তালা বিএনপিকে ভোগাবে