বেলা দুপুর গড়িয়ে বিকেল। মোটরবাইকে চড়ে উঁচু-নিচু টিলাপথ পাড়ি দিয়ে ব্যাটনবাড়িটির উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছি আমরা। কাছাকাছি পৌঁছে চৌধুরীবাড়ির খোঁজ করতেই পথচারী মুরব্বি আঙুলের ইশারায় সাদা বাড়িটির দিকে ইঙ্গিত করলেন। হাওর হাকালুকির তীরঘেঁষে শত বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে চুন-সুরকি আর ব্যাটনে গড়া এক ঐতিহ্যিক বাস্তুভিটা। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার ঘিলাছড়া ইউনিয়নে বাড়িটির অবস্থান।
বাড়ির ভেতরের প্রবেশদ্বারেই মাথা নিচু করে ঝুঁকে রয়েছে একটি বাগানবিলাস। ধবধবে সাদা রঙের দেয়ালঘেঁষে ঝুলছে থোকা থোকা লাল ফুল–এ এক আভিজাত্যের মিশেল। বৈঠকখানায় স্বাগত জানালেন বাড়ির বর্তমান স্বত্বাধিকারী ব্যবসায়ী শাহনেওয়াজ চৌধুরী ও অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষিকা দেওয়ান আশরাফি। ঐতিহ্য লালনের পরম্পরায় বাড়িতে এখন চতুর্থ পুরুষের বাস।
একসময় সিলেট ও আসাম একই ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ছিল। সে কারণে এ ধরনের বাড়ি সিলেটে ‘আসাম টাইপ হাউস’ বা আসামরীতির বাড়ি নামে পরিচিতি পেয়েছে। বাংলো ধরনের বাড়িগুলোর দেয়াল বানাতে বাঁশ-কাঠের ব্যাটন ব্যবহার করা হয় বলে এগুলো ‘বাংলা ব্যাটন স্টাইল’ বাড়ি হিসেবেও পরিচিত। স্থানীয়রা সহজ করে বলেন ব্যাটনের ঘর।
বাড়িটি ঘুরে দেখাতে দেখাতে দেওয়ান আশরাফি জানালেন, বাড়িটি নির্মাণ করেছেন আব্দুল গণি চৌধুরী। এটি গণি মিয়া চৌধুরীবাড়ি নামেই পরিচিত। কথিত আছে সিলেটের প্রভাবশালী জমিদার আলী আমজদ খানও এখানে প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি আব্দুল গণি চৌধুরীর কারণে। পালকি রাখার জন্য আব্দুল গণি চৌধুরীর কাছে জায়গা চেয়েও পাননি আলী আমজদ।
বাড়ির সৌন্দর্যে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে বাহারি ফুল ও ফলের গাছ। পুরো বাড়িটিতে অদ্ভুত ছাতা মেলে ধরেছে বেশ কয়েকটি বয়সী লিচুগাছ। গাছগুলোর বয়স নাকি প্রায় দু’শ বছর! এই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন লিচুগাছটিও রয়েছে এখানে। প্রাকৃতিক পরিবেশ থাকায় ভোর হতেই বিভিন্ন ধরনের পাখির কলকাকলীতে মুখর হয়ে ওঠে বাড়িটি। শাহনেওয়াজ চৌধুরী বললেন, ‘হাওরলাগোয়া হওয়াতে শীতে এখানে পরিযায়ী পাখিরাও আসে। আমরা নিজেরা কখনোই পাখিকে বিরক্ত করি না। কোনো শিকারিকেও এই গ্রামে প্রবেশ করতে দিই না। আবার এ বাড়িতে কোনো যৌতুক দেওয়া-নেওয়ারও নিয়ম নেই।’
বাড়িটি আধেক পাকা দেয়ালের ওপরের অংশ কাঠ-বাঁশের ব্যাটনে গড়া। বাঁশের তরজা নির্মাণ করে তাতে দেওয়া হয়েছে মাটির প্রলেপ। পরবর্তী সময়ে তা কাঠের ফ্রেমে আটকে দেওয়া হয়েছে। চুন-সুরকির আস্তরণ, খোলা বারান্দার সিলিংয়ে বাঁশের নানা রকম দেশজ নকশা, গরাদের জানালা, টিনের চালা আর কালো রঙের ব্যাটন। সাদামাটা বাড়িটিও যেন অদ্ভুত সৌন্দর্য নিয়ে বছরের পর বছর টিকে আছে।
হাওর এলাকা হলেও এখানকার বাড়িগুলো সব টিলার ওপরে। নিচে জলাভূমি ওপরে টিলা। ভরা বর্ষায় যখন থই থই পানি, টিলাবাড়ি থেকে তখন হাওরের আসল রূপটি প্রত্যক্ষ করা যায়। গল্প-কথায় যুক্ত হলেন প্রতিবেশী স্কুলশিক্ষক নূর মাহমুদ চৌধুরী। বললেন, ‘এ ধরনের ঘর সিলেটের ঐতিহ্য। আমরা আস্ত গাছ দিয়ে বারান্দার খুঁটি নির্মাণ করতে দেখেছি। এখন এসব দেখা যায় না। পরবর্তী প্রজন্মকে ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত করাতে হলে এ বাড়িগুলো সংরক্ষণ করা জরুরি।’
২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে শামছুল মজিদ চৌধুরী সাকির ‘আসাম টাইপ ইউনিক হেরিটেজ হাউজেস ইন সিলেট’ শীর্ষক গ্রন্থে স্থপতি আনোয়ার ইকবালের ‘আসামবাড়ি’ শিরোনামের নিবন্ধ থেকে জানা যায়, ঔপনিবেশিক আমলে স্থানীয় উপকরণে, স্থানীয় প্রযুক্তিতে নতুন এক স্থাপত্যধারার প্রচলন হয়। গবেষণালব্ধ জ্ঞান ব্যবহার করে ইংরেজরা আসামের প্রকৃতি, পরিবেশ ও আবহাওয়া অনুকূল একটি নতুন স্থাপত্যধারা প্রস্তাব করে; যা পরবর্তীকালে সিলেটসহ এই রাজ্যের বরাক উপত্যকায় ‘আসাম টাইপ হাউস’ হিসেবে পরিচিতি পায়। এ ধরনের ঘর নির্মাণে উপাদান হিসেবে বেছে নেওয়া হলো বাঁশ, কাঠ, নলখাগড়া। জানালার চৌকাঠ পর্যন্ত পাকা দেয়াল। তার ওপরের অংশ ব্যাটন। উল্লিখিত গ্রন্থে শামছুল মজিদ চৌধুরী সাকি আরও জানিয়েছেন, বাড়িগুলো শীতে উষ্ণ ও গ্রীষ্মে শীতল থাকে। বাড়িগুলো একই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব ও আরামপ্রদ। পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশনের জন্য বায়ু চলাচলের সুযোগ থাকে। ফলে কখনও দেয়াল ভেজা বা স্যাঁতসেঁতে হয় না, যদিও উপমহাদেশের অন্যতম বৃষ্টিবহুল এলাকায় সিলেটের অবস্থান। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হয়। এ ধরনের ঘরের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, রান্নাঘর থেকে কোনো কারণে আগুন ছড়িয়ে গেলে তা যেন সহজে শোয়ারঘরে পৌঁছাতে না পারে, সে জন্য মাঝখানে রাখা হতো একটি খোলা বারান্দা। ১৮৯৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর বৈভবশালী প্রাসাদগুলো মুখ থুবড়ে পড়লেও আসাম টাইপ ব্যাটন বাড়িগুলো টিকে ছিল সগর্বে। ফলে রাতারাতি এই রীতির নির্মাণপদ্ধতি সমাজের সকল স্তরে জনপ্রিয় হয়ে উঠল। এই ধারায় নির্মিত হতে লাগল বনেদি বাড়িগুলোও।
তবে কালের পরিক্রমায় আসাম টাইপের এই বাড়িগুলো হারিয়ে যাচ্ছে– একথা মানতেই হয়। নতুন বাড়ি নির্মাণের তাগিদে ভেঙে ফেলা হচ্ছে শত বছরের ঐতিহ্যিক নির্মাণ। শাহনেওয়াজ চৌধুরী ও দেওয়ান আশরাফি দম্পতি জানান, সামর্থ্য থাকলেও এ বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি করার কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। এ দম্পতির ছেলেমেয়েরাও ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রয়োজনীয় সংস্কার করে বাড়িটি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে রেখে যেতে চান স্থাপত্য ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে। v
লেখক: ঐতিহ্য সংগ্রাহক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র ব য টন এ ধরন র পরবর ত পর চ ত
এছাড়াও পড়ুন:
জাবিতে ইমাম-মুয়াজ্জিনদের জন্য সরকারি নীতিমালা বাস্তবায়নের দাবি
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল ও অভ্যন্তরীণ মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনরা দীর্ঘদিন ধরে বেতন ও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছেন।
দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মসজিদ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা’ কার্যকর থাকলেও জাবি তা অনুসরণ না করে নিজস্ব নীতিমালায় বেতন-নিয়োগ পরিচালনা করছে বলে জানা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা বৈষম্যমূলক দাবি করে সরকারি নীতিমালা বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আবাসিক হল এবং অভ্যন্তরীণ তিনটিসহ মোট ১৩টি মসজিদ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সাতটি হল মসজিদে একজন মুয়াজ্জিন নিয়োগ দিয়ে তাকে ইমামতি, মুয়াজ্জিন, জুমার নামাজ পড়ানো ও মসজিদ পরিষ্কার করাসহ সব কাজ করানো হচ্ছে।
আরো পড়ুন:
জাবিতে নির্মাণ শ্রমিক নিহতের ঘটনায় তদন্ত কমিটি
‘বিচার প্রক্রিয়া ও সংস্কারের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হবে’
২০০৬ সালের ৩০ নভেম্বর ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত ‘মসজিদ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা’ অনুযায়ী গেজেটে ইমামদের বেতন নবম গ্রেড থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২ গ্রেড, পেশ ইমাম পদে ষষ্ঠ গ্রেড থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ১১ গ্রেড এবং সিনিয়র পেশ ইমাম পদে পঞ্চম গ্রেড থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ষষ্ঠ গ্রেড কার্যকর আছে।
অন্যদিকে, মুয়াজ্জিনদের জন্য ১১তম গ্রেডের বেতন স্কেল নির্ধারিত রয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ১৬ গ্রেডে তাদের বেতন দেওয়া হচ্ছে। আবার নতুন তিনটা হলে ১৮ গ্রেডে দেওয়া হচ্ছে বেতন, যা গেজেটের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে এসেও এমন বৈষম্য কখনোই প্রত্যাশিত ছিল না। সরকারি গেজেটের নির্দেশনা মেনে মুয়াজ্জিনদের বেতন স্কেল যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না হলে ধর্মীয় কাজের প্রতি মানুষের আস্থা কমতে পারে এবং মুয়াজ্জিনদের কর্মপ্রেরণাও হ্রাস পাবে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররক হোসেন হল মসজিদের ইমাম মোহাম্মদ আবু সাইদ বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন থেকেই এ বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আবেদন জানিয়ে আসছি। এ পর্যন্ত ছয়বার আমরা প্রশাসনের কাছে আবেদন জানিয়েছি। কিন্তু প্রত্যেকবারই আমাদের নানা অজুহাত দেখিয়ে এ বিষয়টি বিলম্বিত করা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “ঢাবি, বুয়েট, চবি, শাবিপ্রবি, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইমাম-মুয়াজ্জিনদের বেতন কাঠামো ২০০৬ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবরই এটি নিয়ে উদাসীনতা প্রদর্শন করে আসছে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পেশ ইমাম ড. মাহমুদুল ইসলাম ইউসুফ বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্থগিত স্থবিরতা বিদ্যমান ছিল। এক ইমামের পদে একজন সহকারী ইমামকে নিয়োগ দিয়ে তাকে দিয়েই ইমামতি, মুয়াজ্জিন ও মসজিদ পরিষ্কার করাসহ সব কাজ করানো হচ্ছিল। আমরা চাচ্ছি, আমাদের জন্য ২০০৬ সালের গেজেট অনুসারে নিয়োগ এবং বেতন কাঠামো নির্ধারণ করে দেওয়া হলে আমাদের সঙ্গে হওয়া বৈষম্য দূর হবে।”
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান বলেন, “মুয়াজ্জিনদের বেতন কাঠামো ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আমরা সচেতন। বিষয়টি আমরা পরবর্তী সিন্ডিকেট সভায় উত্থাপন করব এবং সরকারি গেজেট অনুযায়ী বেতন কাঠামো পুনর্বিবেচনার চেষ্টা করব। তবে এবারের সিন্ডিকেট সভার এজেন্ডায় এটি অন্তর্ভুক্ত হয়নি।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদগুলোতে ইমাম নিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, “আমরা ইতোমধ্যে ইমাম নিয়োগসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ে জনবল নিয়োগের জন্য একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছি।”
ঢাকা/আহসান/মেহেদী