পূর্ববর্তী নবীরা কি মুসলিম ছিলেন?
Published: 26th, June 2025 GMT
নবী মুহাম্মদ (সা.) তাঁর আগের সব নবীর সঙ্গে এক গভীর আধ্যাত্মিক বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। আদম (আ.) থেকে ঈসা (আ.) পর্যন্ত সব নবী একই বার্তা বহন করেছেন—এক আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ।
নবী মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন এই পবিত্র নবুয়তের শৃঙ্খলের শেষ ও চূড়ান্ত সংযোগ। কোরআন ও নবীর জীবনীতে এই বন্ধনকে একটি সাধারণ মিশন, ভালোবাসা এবং সম্মানের বন্ধন হিসেবে বারবার জোর দেওয়া হয়েছে।
নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য একমাত্র দীন হল ইসলাম।সুরা আল-ইমরান, আয়াত: ১৯এক বার্তা: আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণকোরআন স্পষ্টভাবে বলে, নবী মুহাম্মদ (সা.
ইমাম রাজি (রহ.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, নবী এখানে নিজেকে আগের সব নবীর মতো একজন মানুষ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের সকলের মূল বার্তা ছিল একই, এক আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ, যা আরবি ‘ইসলাম’ শব্দে প্রকাশিত। ‘ইসলাম’ শব্দের আভিধানিক অর্থ আত্মসমর্পণ বা নিজেকে সমর্পণ করা। কোরআন বলে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য একমাত্র দীন হল ইসলাম।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৯)
এই আয়াত থেকে স্পষ্ট যে ইসলাম—অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ—হল সেই মূল মিশন, যা আল্লাহ তাঁর বান্দাদের কাছে গ্রহণ করেন। কোরআনের অন্যান্য আয়াতে নিশ্চিত করা হয়েছে যে, প্রত্যেক নবী এই ইসলামের বার্তা নিয়েই প্রেরিত হয়েছিলেন।
আরও পড়ুননবী ইবরাহিম (আ.) ও চারটি পাখি১৭ জুন ২০২৫এক আল্লাহর উপাসনা: নবীদের সাধারণ মিশনআল্লাহ সূরা আল-আম্বিয়ায় নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে বলেন, ‘আপনার আগে আমি যত রসুল প্রেরণ করেছি, তাদের প্রত্যেকের কাছে এই ওহি পাঠিয়েছি যে, আমি ছাড়া কোন উপাস্য নেই, অতএব তোমরা আমারই ইবাদত কর।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ২৫)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, আদম (আ.) থেকে মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত সকল নবীর মিশন ছিল এক আল্লাহর উপাসনা প্রতিষ্ঠা করা। নবীদের জীবন থেকে আমরা এই বার্তার প্রতিফলন দেখতে পাই।
আয়াত থেকে স্পষ্ট যে ইসলাম—অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ—হল সেই মূল মিশন, যা আল্লাহ তাঁর বান্দাদের কাছে গ্রহণ করেন। কোরআনের অন্যান্য আয়াতে নিশ্চিত করা হয়েছে যে, প্রত্যেক নবী এই ইসলামের বার্তা নিয়েই প্রেরিত হয়েছিলেন।নুহ (আ.): ইসলামের ঘোষণানবী নুহ (আ.) তাঁর সম্প্রদায়কে স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো ইলাহ নেই। আমি তোমাদের জন্য এক মহা দিবসের শাস্তির আশঙ্কা করি।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৫৯)
তিনি নিজেকে মুসলিম হিসেবে ঘোষণা করে বলেন, ‘যদি তোমরা আমার বার্তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে আমি তোমাদের কাছে কোনো পারিশ্রমিক চাইনি। আমার পারিশ্রমিক আল্লাহর কাছে। আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে আমি মুসলিম হব।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত: ৭২)
ইবরাহিম (আ.): নবীদের পিতানবীদের পিতা ইবরাহিম (আ.) ছিলেন একজন মুসলিম, যিনি এক আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেছিলেন। কোরআন বলে, ‘ইবরাহিম ইহুদি বা খ্রিষ্টান ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত মুসলিম। তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৬৭)
ইবরাহিম (আ.)-এর এই ইসলামের বার্তা তাঁর জীবন ও কাজের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
আরও পড়ুননবী প্রেমের প্রতিদান কী২৭ এপ্রিল ২০২৫ইয়াকুব (আ.) ও তাঁর সন্তানরাইয়াকুব (আ.) তাঁর মৃত্যুর সময় তাঁর সন্তানদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘তোমরা আমার পরে কার ইবাদত করবে?’ তারা বলল, ‘আমরা আপনার ইলাহ এবং আপনার পূর্বপুরুষ ইবরাহিম, ইসমাইল ও ইসহাকের ইলাহ, এক আল্লাহর ইবাদত করব এবং তাঁর কাছে আমরা আত্মসমর্পণ করেছি।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৩৩)
এই আয়াতে স্পষ্ট যে ইয়াকুব (আ.) ও তাঁর সন্তানরা ইসলামের পথে ছিলেন এবং এক আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
মুসা (আ.) ও ঈসা (আ.)নবী মুসা (আ.) তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছেন, ‘হে আমার সম্প্রদায়! যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনে থাকো, তবে তাঁর উপর ভরসা করো, যদি তোমরা সত্যিকারের মুসলিম হও।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত: ৮৪)
একইভাবে, নবী ঈসা (আ.) যখন দেখলেন যে বনি ইসরাইলের অধিকাংশ মানুষ ঈমান আনছে না, তখন তিনি বললেন, ‘আল্লাহর পথে আমার সাহায্যকারী কে হবে?’ তাঁর হাওয়ারিরা বললেন, ‘আমরা আল্লাহর পথে আপনার সাহায্যকারী। আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি। আপনি সাক্ষী থাকুন যে, আমরা মুসলিম।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৫২)
এই আয়াতগুলো প্রমাণ করে যে, মুসা (আ.) ও ইসা (আ.)-সহ সকল নবী ইসলামের বার্তা—এক আল্লাহর উপাসনা ও আত্মসমর্পণ—বহন করেছিলেন।
ইবরাহিম ইহুদি বা খ্রিষ্টান ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত মুসলিম। তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৬৭নবুওয়াতের বন্ধন: এক সাধারণ মিশননবী মুহাম্মদ (সা.) এবং পূর্ববর্তী নবীদের মধ্যে বন্ধন ছিল একটি সাধারণ মিশনের—আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং কেবল তাঁরই ইবাদত করতে হবে। এই বার্তা ছিল সকল নবীর দাওয়াতের মূল। নবী মুহাম্মদ (সা.) এই শৃঙ্খলের শেষ নবী হিসেবে এই বার্তাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য সর্বজনীন করে তুলেছেন। তিনি বলেছেন:
‘সকল নবী ভাই ভাই।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩,৪৪৩)
এই হাদিসে নবী সকল নবীর মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কের উপর জোর দিয়েছেন। তাঁরা সকলেই এক আল্লাহর বার্তাবাহক ছিলেন এবং তাঁদের মিশন ছিল মানুষকে তাওহিদের পথে আহ্বান করা।
আরও পড়ুনএক বৃদ্ধ নবী যেভাবে বাবা হলেন০৪ জুন ২০২৫মুসলিম হিসেবে নবীদের পরিচয়কোরআনের আলোকে দেখা যায়, পূর্ববর্তী নবীরা নিজেদের ‘মুসলিম’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন, কারণ তাঁরা আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেছিলেন। ‘মুসলিম’ শব্দটি কোনো নির্দিষ্ট সময় বা সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে বোঝায়, যিনি এক আল্লাহর প্রতি নিজেকে সমর্পণ করেন। এই অর্থে, আদম, নূহ, ইবরাহিম, মূসা, ঈসা (আ.)—সকল নবীই মুসলিম ছিলেন। তাঁদের বার্তা ছিল একই: তাওহিদ, ইবাদত এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্য।
নবী মুহাম্মদ (সা.) এই বার্তাকে সর্বজনীন করে সমগ্র মানবজাতির জন্য পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। তিনি শুধু পূর্ববর্তী নবীদের বার্তার উত্তরাধিকারীই ছিলেন না, বরং তাঁদের সঙ্গে এক গভীর ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন।
নবুওয়াতের বন্ধন একটি পবিত্র শৃঙ্খল, যা আদম (আ.) থেকে মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত বিস্তৃত। ইসলাম বা আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ—এই একই বার্তা নিয়ে সব নবী এসেছেন।
নুহ, ইবরাহিম, মুসা, ঈসা (আ.) এবং অন্যান্য নবী নিজেদের মুসলিম হিসেবে ঘোষণা করেছেন, কারণ তাঁরা এক আল্লাহর উপাসনায় নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। নবী মুহাম্মদ (সা.) এই বার্তাকে চূড়ান্ত রূপ দিয়ে মানবজাতির জন্য রহমত হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন।
আরও পড়ুননবী (সা.) যুগের ঐতিহাসিক ইবাদতগাহ০২ মে ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইসল ম র ব র ত প র ববর ত কর ছ ল ন ম হ ম মদ এই ব র ত ইবর হ ম র জ বন ছ ল এক কর ছ ন ইমর ন আপন র ক রআন
এছাড়াও পড়ুন:
শুল্ক আরোপ: ট্রাম্প আসলে ভারতকে ততটা গুরুত্বই দেয়নি
ভারতীয়রা ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে বিস্মিত হয়েছে। ট্রাম্প তাদের দেশের ওপর মোট ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন, যা এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ, সম্ভবত বিশ্বের মধ্যেও সর্বোচ্চ হার। তাহলে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের কূটনৈতিক জমকালো আয়োজনগুলো, যেগুলো ‘হাউডি মোদি’ এবং ‘নমস্তে ট্রাম্প’ নামে পরিচিত ছিল, সেই বহুল আলোচিত সৌহার্দ্যের কী হলো? ফেব্রুয়ারিতে যে আন্তরিকতা দেখা গিয়েছিল, যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম দিকের বিদেশি অতিথিদের একজন হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ওয়াশিংটনে স্বাগত জানিয়েছিলেন, তারই-বা কী হলো? ভারত এই প্রকাশ্য অবজ্ঞাকে কীভাবে বুঝবে?
এটি আসলে খুবই সহজ: এভাবেই ট্রাম্প কাজ করেন। প্রতিটি যোগাযোগই তাঁর কাছে ক্ষমতার প্রদর্শন, প্রতিটি নীতি সিদ্ধান্তই ব্যক্তিগত খেয়ালের বহিঃপ্রকাশ। ভারত (তার প্রতিবেশীদের বিপরীতে) তাঁর চাওয়া একতরফা বাণিজ্যচুক্তিতে নতিস্বীকার করতে রাজি হয়নি, তাই তিনি রাগের বশে শুল্ক বসিয়েছেন। ট্রাম্প এটি করেছেন, কারণ সেটিই তাঁর স্বভাব।
সাম্প্রতিক এই টানাপোড়েনের আগে ভারত ছিল পৃথিবীর কয়েকটি দেশের একটি, যেখানে ট্রাম্পের প্রতি গভীর বিরূপ মনোভাব গড়ে ওঠেনি। চলতি মেয়াদের প্রথম চার মাসে পিউ রিসার্চ ২৪টি দেশের ২৮ হাজার ৩৩৩ জনের কাছে জানতে চেয়েছিল, তাঁরা কি বিশ্বাস করেন যে ট্রাম্প ‘বিশ্ব নিয়ে সঠিক কাজ করবেন’। অধিকাংশের (যেমন, তুরস্কে ৮০ শতাংশ, জার্মানিতে ৮১ শতাংশ, মেক্সিকোতে ৯১ শতাংশ) উত্তর ছিল না। কিন্তু ভারতীয়দের অর্ধেকের কিছু বেশি ট্রাম্পের প্রতি আস্থা প্রকাশ করেছিলেন—যে পাঁচটি দেশের মধ্যে তিনি অন্তত সমান জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পেরেছিলেন, ভারত তাদের একটি (অন্যগুলো ছিল হাঙ্গেরি, ইসরায়েল, নাইজেরিয়া ও কেনিয়া)।
যেকোনো সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া বিশ্বাসঘাতকতার মতো মনে হতে পারে। কী ভুল হলো, তা বিশ্লেষণ করার সময় ভারতীয়দের মনে রাখা উচিত ভালোবাসায় ব্যর্থদের জন্য প্রচলিত দুটি পরামর্শ। প্রথমত, সমস্যা আপনার নয়, তার। দ্বিতীয়ত, সে কারও সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক রাখতে সক্ষম নয়।
ভারতীয়রা ট্রাম্পের প্রতি যে উষ্ণ অনুভূতি পোষণ করেছিল, তা সব সময়ই একপক্ষীয় ছিল। ২০২০ সালে আহমেদাবাদের ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ১ লাখ ২৫ হাজার মানুষ তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিলেন—এটি ট্রাম্প উপভোগ করলেও ভারতীয়রা হয়তো এই অভ্যর্থনার গুরুত্ব অতিরিক্তভাবে ব্যাখ্যা করেছিল। ট্রাম্প ও মোদির কথিত বন্ধুত্ব কখনোই কোনো তাৎপর্যপূর্ণ নীতি-উদ্যোগে রূপ নেয়নি—বরং ট্রাম্প নিয়মিতভাবে নিজের সহকারীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় মোদির উচ্চারণ নিয়ে ব্যঙ্গ করতেন।
ভারতের ডানপন্থার কিছু অংশ ট্রাম্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল আরও অশুভ কারণে: তাঁর মুসলিমবিরোধী বক্তব্য ও পদক্ষেপের প্রতি ঝোঁকের জন্য। প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণার সময় দিল্লিতে হিন্দুত্ববাদীরা তাঁর [ট্রাম্প] অনুপস্থিতিতেই জন্মদিন উদ্যাপন করেছিলেন। ট্রাম্প যখন মুসলিম-অধ্যুষিত দেশগুলোর নাগরিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে বিস্তৃত মুসলিমবিরোধী নীতি কার্যকর করেন, তখন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে হিন্দুত্ববাদী ডানপন্থার কিছু অংশ তাকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছিল।
তবে ট্রাম্পকে কোনো বৃহৎ ‘সভ্যতাগত অভিযানে’ তালিকাভুক্ত করার আশা সব সময়ই এক মূর্খতার কাজ ছিল—ট্রাম্পের গভীর পক্ষপাত আছে, কিন্তু কোনো প্রকৃত মতাদর্শ নেই। তাঁর কাছে কোনো স্থায়ী মিত্র বা শত্রুর ধারণা নেই—ব্যক্তিগত সম্পর্ক হোক বা ভূরাজনীতি, সম্পর্কের ধারণাই তাঁর কাছে অজানা।
একটি সম্পর্ক সব সময় উভয় পক্ষের চেয়ে বড় কিছু। সেটা বিবাহ হোক, বন্ধুত্ব হোক বা দুই জাতির মধ্যে জোট—এটি নিরন্তর যত্ন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং আপসের দাবি করে। এর কোনোটিই ট্রাম্পের ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক চরিত্রের অংশ নয়। তাঁর কাছে প্রতিটি মিথস্ক্রিয়া মানে একজন বিজয়ী আর একজন পরাজিত। ‘উভয় পক্ষের জয়’—এ ধারণা তাঁর কাছে বোধগম্য নয়। ভারত এখানে ব্যতিক্রম নয়—তিনি [ট্রাম্প] একইভাবে আচরণ করেছেন নিজের ব্যবসায়িক অংশীদারদের সঙ্গে, রাজনৈতিক সহযোগীদের সঙ্গে, তাঁর [ট্রাম্প] তিনজন স্ত্রী এবং (একটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ছাড়া) বিশ্বের প্রায় সব দেশের নেতাদের সঙ্গে।
ট্রাম্প তেল কেনা নিয়ে কিছুই ভাবেন না, ইউক্রেন নিয়েও না। যা তাঁকে ক্ষুব্ধ করছে, তা হলো—ভারত নিজের অবস্থানে অটল রয়েছে। ট্রাম্প পৃথিবীর প্রতিটি দেশকে জোর করে বোঝাতে চেয়েছেন যে তাঁর প্রকাশ্য অন্যায্য শুল্কই হবে বাণিজ্যচুক্তির ভিত্তি এবং তাদের অনেকেই অনিচ্ছাসত্ত্বেও তা মেনে নিয়েছে।ওই একমাত্র ব্যতিক্রম হলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, যাঁর প্রতি ট্রাম্প বহু দশক ধরে এক রহস্যময় আসক্তি পোষণ করে আসছেন। কিছু বিশ্লেষকের ধারণা, ট্রাম্প আশঙ্কা করেন যে পুতিন তাঁর [ট্রাম্পের] বিরুদ্ধে কোনো ব্ল্যাকমেল-যোগ্য তথ্য হাতে রেখেছেন। কিন্তু এই আশঙ্কা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না, মার্কিন প্রেসিডেন্ট যেভাবে একেবারে বশীভূত কুকুরছানার মতো তাঁর রুশ প্রেসিডেন্টকে তুষ্ট করার চেষ্টা করেন।
কারণ যা-ই হোক না কেন, ভারতের ওপর শুল্ক আরোপের জন্য ট্রাম্প যে যুক্তি দিয়েছেন, তা আরও অযৌক্তিক শোনায়—তাঁর ‘ট্রুথ সোশ্যাল’ প্ল্যাটফর্মে তিনি লিখেছেন, ‘ভারত বিশাল পরিমাণে রাশিয়া থেকে তেল কিনছে… তারা পাত্তা দেয় না, রাশিয়া ইউক্রেনে কত মানুষ হত্যা করছে। এ কারণে, আমি ভারতের শুল্ক বাড়িয়ে দেব।’
ভারতীয়দের বিভ্রান্ত হওয়াটা স্বাভাবিক: রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকে ট্রাম্প ধারাবাহিকভাবে পুতিনের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক সমর্থক ছিলেন। ফেব্রুয়ারিতে—ওভাল অফিসের ভেতরে, সাংবাদিকদের ক্যামেরা চলমান অবস্থায়—তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে অপমানজনকভাবে বক্তৃতা শুনিয়েছিলেন এবং রাশিয়ার দাবির কাছে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর এখন তিনি ক্ষুব্ধ, কারণ ভারত রুশ তেল কিনছে?
আসলে তা নয়। ট্রাম্প তেল কেনা নিয়ে কিছুই ভাবেন না, ইউক্রেন নিয়েও না। যা তাঁকে ক্ষুব্ধ করছে, তা হলো—ভারত নিজের অবস্থানে অটল রয়েছে। ট্রাম্প পৃথিবীর প্রতিটি দেশকে জোর করে বোঝাতে চেয়েছেন যে তাঁর প্রকাশ্য অন্যায্য শুল্কই হবে বাণিজ্যচুক্তির ভিত্তি এবং তাদের অনেকেই অনিচ্ছাসত্ত্বেও তা মেনে নিয়েছে।
পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন এবং অন্যান্য দেশ অনানুষ্ঠানিক ‘চুক্তি’ মেনে নিয়েছে, যার অধীনে তাদের রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রে গেলে তা শুল্কের কঠোর শাস্তিমূলক হারের মুখে পড়ে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তাদের দেশে পণ্য রপ্তানি করতে পারে শুল্কমুক্তভাবে। বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্যগোষ্ঠী ইউরোপীয় ইউনিয়নও ভীতভাবে একই ধরনের দাবিতে সায় দিয়েছে। কিন্তু ভারত এমন নির্দেশ মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এটাই ট্রাম্পের রোষের আসল কারণ।
তাহলে কেন এই দেশগুলো নতি স্বীকার করেছে? তারা সবাই ট্রাম্পকে ধোঁকা দেওয়ার আশায় আছে: এসব ‘চুক্তি’র কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই আর ট্রাম্প প্রায় প্রতিদিনই নিজের সিদ্ধান্ত বদলান। তাঁর ভয় দেখানো নীতির কাছে নতি স্বীকার করা অনেক প্রতিষ্ঠান যেমন করেছে, তারাও বাজি ধরছে যে একবার শিরোনামে জয়ের খবর তুলে নিলে ট্রাম্প আর তা কার্যকর করার প্রতি আগ্রহী হবেন না। যদি প্রকাশ্যে কিছুটা অপমান সহ্য করলেই ২৫ শতাংশের বদলে ১৫ শতাংশ শুল্কে রপ্তানি করা যায়, তাহলে এই গ্লানি মেনে নিতে সমস্যা কোথায়?
ভারত কয়েক শতাংশ শুল্ক রেহাইয়ের জন্য জাতীয় মর্যাদা বিসর্জন দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই: ইতিহাসজুড়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের অধিকারের বিষয়ে ভারত সব সময়ই ব্যতিক্রমীভাবে সংবেদনশীল থেকেছে। অধিকাংশ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে ওয়াশিংটনসহ অন্যান্য জায়গায় অত্যধিক খুঁতখুঁতে এবং জাতীয় সম্মান নিয়ে অতিসংবেদনশীল হিসেবে দেখা হয়েছে, বিশেষ করে যেকোনো ছাড়, যা জাতীয় অপমান হিসেবে ব্যাখ্যা হতে পারে। কিন্তু বিজেপি, কংগ্রেস বা জনতা—সব ধরনের ভারতীয় নেতাই যখন এভাবে আচরণ করেছেন, তখন তা স্পষ্ট যে তারা তাদের জনগণেরই ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।
যা-ই হোক না কেন, আমি আশা করি ভারত তার অধিকার রক্ষায় অবিচল থাকবে। যে দেশই ট্রাম্পের অবৈধ দাবির কাছে মাথা নোয়ায়, পরবর্তী দেশের জন্য প্রতিরোধ করা ততটাই কঠিন হয়ে ওঠে। ভারত আসলে ভালো সঙ্গেই আছে: চীন, ব্রাজিল ও কানাডা এরই মধ্যে প্রতিরোধ করেছে আর যারা আত্মসমর্পণ করেছে, তারা সম্ভবত নিজেদের নাগরিকদের ক্ষোভের মুখোমুখি হবে, যখন সম্পূর্ণ একতরফা শুল্ক কার্যকর হতে শুরু করবে।
ট্রাম্প কখনো ভারতের বন্ধু ছিল না। তিনি কারোরই বন্ধু ছিলেন না। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে, সম্পর্ক কেবল ‘বোকার’ জন্য। ট্রাম্প কখনোই ভারতকে সত্যিকারের বন্ধু হিসেবে চায়নি। ‘বন্ধুত্ব’ বলে কোনো কিছু ট্রাম্পের প্রাপ্য নয়।
জোনাহ ব্ল্যাঙ্ক লেখক ও বিশ্লেষক
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে নেওয়া
*মতামত লেখকের নিজস্ব