শ্রেণিকক্ষে ফিল্ম: একটি শক্তিশালী শিখন মাধ্যম
Published: 27th, June 2025 GMT
আদিকালের জগ এবং মগতত্ত্ব অনুশীলনের অবসান হলেও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে পাঠ্যবই ও মুখস্থনির্ভর, সেই সঙ্গে পরীক্ষামুখী। কিন্তু বর্তমান বিশ্বের দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে শিক্ষা শুধু পঠন-পাঠন নয়; বরং অনুভব, বিশ্লেষণ, নৈতিকতা ও জীবনদক্ষতা অর্জনের মাধ্যম হয়ে উঠছে। এই পরিবর্তিত চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন নতুন শিখন কৌশল অনুসন্ধানের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, যার একটি শক্তিশালী মাধ্যম হতে পারে ফিল্ম বা চলচ্চিত্র। ফিল্ম তার অন্তর্নিহিত ন্যারেটিভ কাঠামো, ভিজুয়াল উপস্থাপন এবং আবেগপূর্ণ অনুষঙ্গের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞান, মানসিকতা ও সহানুভূতির বিকাশে ব্যাপক অবদান রাখতে পারে।
চলচ্চিত্র একটি বহুমাত্রিক মাধ্যম, যা শ্রবণ ও দৃষ্টির সমন্বয়ে শিক্ষার্থীর মনে গভীর প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, ভাষা ও পরিবেশ শিক্ষা, এমনকি গণিত ও বিজ্ঞানের কিছু জটিল ধারণাকেও সিনেমার মাধ্যমে উপস্থাপন করলে শিক্ষার্থীরা সহজে অনুধাবন করতে পারে। কানাডীয় আমেরিকান মনস্তত্ত্ববিদ অ্যালবার্ট বান্দুরার সামাজিক শিখনতত্ত্ব অনুযায়ী, মানুষ পর্যবেক্ষণ, অনুকরণ ও মডেলিংয়ের মাধ্যমে শেখে। ফিল্ম সেই পর্যবেক্ষণের বাস্তব উদাহরণ দেয়।
চলচ্চিত্র শুধু বিনোদন বা অবসরের খোরাক নয়, বরং এটি শক্তিশালী ‘মাল্টি সেন্সরি’ শিখন মাধ্যম। আবার আমেরিকান শিক্ষাবিদ এডগার ডেইলের অভিমত, মানুষ যা কেবল পড়ে তার ১০ শতাংশ মনে রাখে। কিন্তু যা দেখে ও শোনে তা প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত মনে রাখে। অর্থাৎ শ্রেণিকক্ষে সিনেমা অন্তর্ভুক্ত করলে শিক্ষার্থীর শেখার ক্ষমতা অর্জিত হয় বহু গুণ।
সব শিক্ষার্থীর বুদ্ধিমত্তা এক রকম নয়। কেউ ভিজুয়াল, কেউ ভাষানির্ভর, কেউবা আন্তঃব্যক্তিক বা অন্তর্ব্যক্তিক। সিনেমা এই বহুবিধ বুদ্ধিমত্তাকে একসঙ্গে উদ্দীপিত করে। সামাজিক শিখনতাত্ত্বিকরা মনে করেন, যেহেতু কোমলমতি শিক্ষার্থীরা আশপাশের পরিবেশ থেকে, একে অন্যকে দেখে ও অনুকরণ করে শিখে, তাই চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলো যখন সাহস, সততা বা সহানুভূতি প্রদর্শন করে, শিক্ষার্থীরাও এসব গুণ আত্মস্থ করে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীরা একা যা পারে না, তা সহায়তা পেলে করতে পারে। সিনেমা দেখার পর দলগত আলোচনা বা নির্দেশিত কার্যকলাপ তাদের চিন্তা ও উপলব্ধির পরিসর বৃদ্ধি করে। তবে শ্রেণিকক্ষ যেহেতু প্রেক্ষাগৃহ নয়, তাই ফিল্ম শুধু চালিয়ে দেখানো যথেষ্ট নয়। এটি হতে হবে শিখন উদ্দেশ্যভিত্তিক ও কাঠামোবদ্ধ। কার্যকরভাবে সিনেমা ব্যবহার করতে কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করা যেতে পারে। প্রথম ধাপ অর্থাৎ প্রদর্শনীর আগে প্রাক-দর্শন কার্যক্রমে শিক্ষক কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন তুলতে পারেন। যেমন ‘আজকের পাঠের শিখন উদ্দেশ্যের সঙ্গে ফিল্মের চরিত্রের সম্পর্ক কী? এই চরিত্র কীভাবে সমস্যা সমাধান করবে বলে তুমি মনে কর?’ অথবা ‘তুমি কী ধরনের পরিস্থিতিতে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পার?’ যা শিক্ষার্থীদের কৌতূহল ও মনোযোগ বৃদ্ধি করবে। দ্বিতীয় ধাপে দর্শনকালীন নির্দেশনা পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট বিষয়ে মনোনিবেশ করাতে, যেমন চরিত্রটি কীভাবে পরিবর্তিত হলো, কীভাবে এ ঘটনা ঘটল, কেন ঘটল, এ ঘটনা কোন সামাজিক সমস্যার দিকনির্দেশ করে– এমন ফোকাস প্রশ্ন দিয়ে সিনেমা দেখার নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে। সব শেষ ধাপে অর্থাৎ প্রদর্শন-পরবর্তী কার্যক্রম/কৌশলের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীদের সিনেমা দেখে নিজের মতামত প্রকাশের জন্য যা তারা বুঝল তা লেখার জন্য উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। পাঠসংশ্লিষ্ট ফিল্মের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোর ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক বা ভূমিকা অভিনয় করতে বলা যেতে পারে। এ ছাড়াও প্রকল্পভিত্তিক শিখনের মাধ্যমে সিনেমার বিষয়ে একটি গবেষণামূলক পোস্টার, রিভিউ আর্টিকেল বা ভিডিও তৈরি করতে দেওয়া যেতে পারে। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষার্থী শিখন উদ্দেশ্য অর্জনে যেমন সক্ষম হবে তেমনি ডিজিটাল দক্ষতা, সৃজনশীল দক্ষতা, সমস্যা সমাধান দক্ষতাসহ অন্যান্য সফটস্কিল উন্নয়ন করতে পারবে।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় সর্বস্তরের শ্রেণিকক্ষে বিশেষত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে একটি বড় সমস্যা হলো, শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীর আগ্রহের অভাব ও শেখার একঘেয়েমি। এমন পরিস্থিতিতে ফিল্ম হতে পারে একটি গেম চেঞ্জার। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে পরিবেশ, স্বাস্থ্য, নৈতিকতা বা ইতিহাসভিত্তিক স্বল্পদৈর্ঘ্য অ্যানিমেশন শিশুদের শেখার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। ‘মীনা’, ‘আর ইউ লিসনিং’, ‘সংযোগ’ বা ‘বন্ধু’ সিরিজের মতো উদ্যোগ এ ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত। উচ্চশিক্ষায় গবেষণাধর্মী ডকুমেন্টারি ও সমাজ-সংবেদনশীল নাট্য-চলচ্চিত্র শিক্ষার্থীদের সমালোচনামূলক চিন্তন, নৈতিক সচেতনতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধ গঠনে কার্যকর। একইভাবে জাতীয় পাঠ্যসূচির বিভিন্ন বিষয়ের জন্য নির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ও তথ্যচিত্র নির্মাণ করলে তা শিক্ষার্থীদের শেখার প্রতি আগ্রহ বাড়াতে পারে।
যদিও শিক্ষায় সিনেমা একটি শক্তিশালী মাধ্যম, তবে তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন উপযুক্ত কনটেন্টের অভাব, শিক্ষক প্রশিক্ষণের ঘাটতি ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা। তবে এসব চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করলে সিনেমা শিক্ষাক্ষেত্রে উদ্ভাবনী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার পথ খুলে দিতে পারে। সম্ভাবনার কথা, প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে এখন মোবাইল ফোন, ট্যাব, স্মার্টবোর্ড এমনকি ইউটিউব বা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমেও শিক্ষামূলক সিনেমা সহজলভ্য। ফলে শহর, গ্রাম সবখানে এ উদ্যোগ সম্ভব। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করে ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্থানীয় ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতানির্ভর শিক্ষায়তন গড়ে তুলতে পারে। তবে শক্তিশালী এই শিখন মাধ্যমের পরিপূর্ণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে শিক্ষার নির্দিষ্ট লক্ষ্য, শ্রেণিকক্ষ কৌশল ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় না আনলে এর প্রভাব সীমিতই থাকবে। তাই শিখন উদ্দেশ্যভিত্তিক ফিল্ম বা চলচ্চিত্রকে পাঠ্যক্রমের সাংগঠনিক অংশ এবং শ্রেণিকক্ষে সহযোগী শিক্ষা উপকরণ হিসেবে ভাবার এখনই উপযুক্ত সময়।
শারীফ অনির্বাণ: স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিক্ষক ও পিএইচডি গবেষক, দোকুজ এয়লুল ইউনিভার্সিটি, ইজমির, তুরস্ক
sharifulislam@primeuniversity.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: চলচ চ ত র র জন য চর ত র সমস য
এছাড়াও পড়ুন:
সরকার বলছে সম্ভাবনা দলগুলোর সন্দেহ
চট্টগ্রাম বন্দরে চালু থাকা চারটি কনটেইনার টার্মিনালের মধ্যে সবচেয়ে বড় নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)। ৯৫০ মিটার দীর্ঘ এই টার্মিনালেই গত বছর বন্দরের মোট কনটেইনারের ৪৪ শতাংশ ওঠানামা হয়েছে এককভাবে। একসঙ্গে এতে চারটি সমুদ্রগামী কনটেইনার জাহাজ ও অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচল উপযোগী একটি ছোট জাহাজ নোঙর করা যায়। বন্দরের অন্য কোনো টার্মিনালে নেই এত সুবিধা।
জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানামার জন্য এ টার্মিনালে বিশ্বের সবচেয়ে অত্যধুনিক যন্ত্র ‘গ্যান্ট্রি ক্রেন’ রয়েছে ১৪টি। অন্যান্য টার্মিনালে এ সংখ্যা অর্ধেকেরও কম। বছরে ১০ লাখ একক কনটেইনার ওঠানামার সক্ষমতা থাকা এই টার্মিনাল গত বছরও হ্যান্ডল করেছে ১২ লাখ ৮১ হাজার কনটেইনার। এই টার্মিনাল থেকে প্রতি বছর এক হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্বও পাচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
‘সোনার হরিণ’ হিসেবে পরিচিত এই টার্মিনাল ঘিরেই এসেছে বিদেশি বিনিয়োগের প্রস্তাব। এনসিটি ব্যবস্থাপনায় বিদেশি কোম্পানিকে যুক্ত করতে সরকারের পরিকল্পনায় পক্ষে-বিপক্ষে সরব হয়েছে বন্দর ব্যবহারকারীসহ বিভিন্ন মহল। বিদেশি বিনিয়োগে নতুন সম্ভাবনা দেখছে সরকার। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো এতে পাচ্ছে ‘ষড়যন্ত্রের গন্ধ’।
বিদেশি কোম্পানিকে বন্দর ব্যবস্থাপনায় যুক্ত করার উদ্যোগের প্রতিবাদে গতকাল শুক্রবার ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে রোডমার্চ শুরু করেছে বিভিন্ন বাম ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল-সংগঠন। আজ বিকেলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। আগামী সোমবার চট্টগ্রাম বন্দর গেটে বৃহত্তর শ্রমিক সমাবেশের ডাক দিয়েছে শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ)।
কোন টার্মিনালের কত অবদান
বন্দরের কনটেইনারের ৪৪ শতাংশ এনসিটিতে ওঠানামা হলেও তার পাশে থাকা চিটাগং কনটেইনার টার্মিনালে (সিসিটি) গত বছর ১৯ শতাংশ এবং জেনারেল কার্গো বার্থ-জিসিবিতে ৩৬ শতাংশ কনটেইনার ওঠানামা করেছে। সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনালের হাতে ছেড়ে দেওয়া পতেঙ্গা টার্মিনাল প্রথম ১০ মাসে তাদের টার্গেটের মাত্র ১২ শতাংশ কনটেইনার হ্যান্ডল করেছে। ২০২৪ সালের জুন থেকে বিদেশি প্রতিষ্ঠান নবনির্মিত এই টার্মিনাল পরিচালনা করলেও পুরোদমে চালু হয়নি এটি।
বন্দরের তত্ত্বাবধানে ২০০৭ সাল থেকে আংশিক চালু ছিল এনসিটি। পরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। ২০১৫ সাল থেকে পুরোদমে এই টার্মিনালে জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানামার কাজ শুরু হয়। এর পরে কমতে থাকে জাহাজের অপেক্ষমাণ সময়ও। আগে একটি জাহাজ ১২ থেকে ১৫ দিন পণ্য নিয়ে অপেক্ষায় থাকলেও এখন সেটি নেমে এসেছে দুই থেকে তিন দিনে।
২০০৭ সালে আংশিক চালু হওয়ার প্রথম বছরে এনসিটিতে বাণিজ্যিক জাহাজ আসে ৪৩৬টি। ২০২৪ সালে এনসিটিতে জাহাজ এসেছে ১ হাজার ২৫০টি। ১৭ বছরের ব্যবধানে জাহাজ আসার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ। জিসিবি, সিসিটি, এনসিটি এবং বহির্নোঙর মিলিয়ে ২০২৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে বাণিজ্যিক জাহাজ এসেছে ৪ হাজার ৩০০টি।
সবচেয়ে বেশি আয় এনসিটিতে
চারটি টার্মিনালের মধ্যে এনসিটিতেই সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ১৪টি গ্যান্ট্রি ক্রেনের পাশাপাশি ৩৩টি রাবার টায়ার্ড গ্যান্ট্রি ক্রেনও স্থাপন করা হয়েছে এই টার্মিনালে। প্রতি বছর গড়ে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা আয় হয় এখান থেকে। এই টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দিলে বন্দরের আয় নির্ভর করবে বিদেশিদের সঙ্গে দরকষাকষির ওপর। এই টার্মিনাল পরিচালনা করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড থেকে বন্দর কর্তৃপক্ষ সর্বশেষ দুই বছরে কনটেইনারপ্রতি বিল পেয়েছে ৭০০ টাকা বা প্রায় সাড়ে ৬ ডলার। সব খরচ বাদ দিয়ে গত দুই বছরে তাদের প্রকৃত আয় হয়েছে সাড়ে ৫০০ কোটি টাকার বেশি। এ হিসাবে কনটেইনারপ্রতি বন্দরের প্রকৃত আয় দাঁড়ায় প্রায় ৪৭ ডলার। সৌদি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেওয়া পতেঙ্গা টার্মিনাল থেকে বন্দর পাচ্ছে কনটেইনারপ্রতি মাত্র ১৮ ডলার। সেখানে অবশ্য বন্দর কর্তৃপক্ষ শুধু জেটি নির্মাণে বিনিয়োগ করেছে।
চার কারণে বিতর্ক
এনসিটি ঘিরে সরকারের তৎপরতা, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ না করা, বন্দরের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় টার্মিনাল বিদেশিদের দেওয়ার চিন্তা এবং সবচেয়ে বেশি আয় আসা টার্মিনালের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কা তৈরি হওয়ায় এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন– যে টার্মিনালটি ১৭ বছর ধরে সক্ষমতার চেয়ে বেশি কনটেইনার হ্যান্ডল, সবচেয়ে বেশি আয় এবং কর্মসংস্থান করেছে, সেটি কেন দিতে হবে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে। ৭০০ কোটি টাকা দিয়ে ২০ বছর আগে এই টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতিও কেনা হয়েছে এই টার্মিনালের জন্য। বিদেশি প্রতিষ্ঠান নতুন আর কী বিনিয়োগ করবে এই টার্মিনালে– এই প্রশ্ন সামনে এনেছে রাজনৈতিক দলগুলোও। নতুন কোনো স্থানে নতুন করে টার্মিনাল করে বিদেশি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করলে আপত্তি নেই তাদের।
সম্ভাবনা দেখছে সরকার
তবে সরকার বলছে, এনসিটির বর্তমান সক্ষমতা ও দক্ষতা আমূল পাল্টে দেবে বিদেশি প্রতিষ্ঠান। কীভাবে তারা এটা করবে– সেই পরিকল্পনাই তাদের কাছ থেকে চেয়েছে সরকার। যে প্রতিষ্ঠানকে তারা ভাবছে, তারা বিশ্বের সেরা বন্দরগুলোতে কাজ করছে। তাদের কর্মদক্ষতার কারণেই ওইসব বন্দর আছে বিশ্বসেরার তালিকায়। বিদেশি প্রতিষ্ঠান এলে কারও চাকরি যাবে না। উল্টো কর্মক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা বাড়বে। বাড়বে সুযোগ-সুবিধা। এমনই মত এই সরকারের।
চট্টগ্রাম বন্দর পরিদর্শনে এসে গত ১৪ মে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড হলো চট্টগ্রাম বন্দর। কিন্তু যে সাইজে এই হৃৎপিণ্ড আছে, তাতে চলে না। এই হৃৎপিণ্ডকে বিশ্ব সাইজের হৃৎপিণ্ড বানাতে হবে। কাজেই আমরা বললাম যে, পৃথিবীর সেরা বন্দর ব্যবস্থাপক যারা আছে, তাদের ডাকো। দেখলাম যে, আগেই ডাকা হয়েছে; কিন্তু কাজটা ঠিকমতো এগোচ্ছে না। বারবার সবার কাছে আবেদন করছি– এটা তাড়াতাড়ি করে দাও। যতই দিন যাবে, এই হৃৎপিণ্ডকে আর ওইভাবে স্থাপন করতে পারব না। এটা পরিবর্তন না করে বাংলাদেশের অর্থনীতি পরিবর্তন সম্ভব নয়।’
ওই অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা জানান, তিনি নৌপরিবহন উপদেষ্টাকে বলেছেন, যারা বন্দরের ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ, পৃথিবীর সেরা, তাদের দিয়ে এই কাজ করাতে হবে; যেভাবেই হোক।
এর আগে বন্দর পরিদর্শনে এসে অভিন্ন ইচ্ছার কথা বলেছেন বিডার চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তারা বিশ্বে ৭০-৮০টি বন্দর পরিচালনা করা দুবাইয়ের প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ডকে এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার ইঙ্গিত দেন। সেপ্টেম্বরের মধ্যেই তারা এটি শেষ করতে চান। এমন বক্তব্য ও তৎপরতার কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি টার্মিনাল ইস্যুটি সবার সামনে চলে আসে।
যে পথে হাঁটছে সরকার
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এনসিটি টার্মিনাল বিদেশিদের দেওয়ার ব্যাপারে কাজ শুরু হয়। ২০২৩ সালের মার্চে নিউমুরিং টার্মিনালটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের আওতায় পরিচালনার জন্য অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে অনুমোদন পায়। প্রকল্পের জন্য ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার নিয়োগ করা হয় ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনকে (আইএফসি)। কিন্তু রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে এটি আর বেশি দূর এগোতে পারেনি।
পরে এ কাজ এগিয়ে নিতে থাকে অন্তর্বর্তী সরকার। গত বছরের ৫ নভেম্বর পিপিপি কর্তৃপক্ষ, আইএফসি ও বন্দর কর্তৃপক্ষের যৌথ সভা ডাকার উদ্যোগ নেয় তারা। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, মে মাসের মধ্যে আইএফসি এ প্রকল্পের ট্রানজেকশন স্ট্রাকচারিং রিপোর্ট-টিএসআর প্রদান করবে। এ প্রতিবেদন অনুমোদনের পর দুবাইয়ের প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ডকে আরএফপি (রিকোয়েস্ট ফর প্রপোজাল) দেওয়া হবে। সেপ্টেম্বরে এ ব্যাপারে কনসেশন চুক্তি করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। চুক্তির পর টার্মিনালটি পুরোপুরি ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে চলে যাবে। তারাই মাশুল আদায় করবে, লোকবল নিয়োগ দেবে। চুক্তি অনুযায়ী, বন্দরকে এককালীন, বার্ষিক ও কনটেইনারপ্রতি অর্থ দেবে ডিপি ওয়ার্ল্ড।
যা বলছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা
বন্দরের জেটি পরিচালনাকারী বার্থ অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বার্থ অপারেটরস, শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরস ও টার্মিনাল অপারেটরস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফজলে একরাম চৌধুরী বলেন, এনসিটি ভালো করছে; লোকসানেও নেই। বন্দর কর্তৃপক্ষ সবচেয়ে বেশি আয় করছে এই টার্মিনাল দিয়ে। এর মাধ্যমে দক্ষও হয়ে উঠছে তারা। সক্ষমতার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থাপনার সুযোগ না পেলে ভবিষ্যতে বিদেশিরা ছেড়ে দিলে পরিচালনায় সংকট তৈরি হবে।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) সহসভাপতি খায়রুল আলম সুজন বলেন, বন্দরে বিদেশি বিনিয়োগকে স্বাগত জানাই। তবে খেয়াল রাখতে হবে, তাদের মাধ্যমে আমাদের আয়, সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির যে হিসাব দেওয়া হচ্ছে, সেটি যাতে সত্য হয়। সরকারকে এ ব্যাপারে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, আমাদের অপারেটরদের তুলনায় বাইরের অপারেটররা অনেক বেশি দক্ষ– তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আবার বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কও জোরালো হবে। তবে চুক্তির সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সবার সঙ্গে কথা বললে আর বিতর্ক থাকত না।
রাজনৈতিক দলগুলোর অভিমত
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যৌথ উদ্যোগে গঠিত ‘দেশ বাঁচাও বন্দর বাঁচাও’ কমিটির সদস্য এবং ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিম সমকালকে বলেন, এনসিটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হলে সরকারকে অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আগে আলোচনা করতে হবে। সেটি না করাতে এখানে বিতর্ক হচ্ছে; সন্দেহ বাড়ছে। এই বন্দরই আমাদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। ইচ্ছা হলেই কেউ এটা বিদেশিদের দিয়ে দিতে পারে না। এনসিটি না দিয়ে অন্য যেখানে বিদেশিদের বিনিয়োগ করার সুযোগ রয়েছে, সেই টার্মিনাল দেওয়ার প্রস্তাব করেন তিনি।
সরকারের পদক্ষেপের প্রতিবাদে সম্প্রতি ঢাকায় সমাবেশ করেছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। তারা বলেছে, দেশের টাকায় সবকিছু করে এখন বিদেশিদের হাতে টার্মিনাল তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত রহস্যজনক ও চক্রান্তমূলক।
বন্দর-পতেঙ্গা আসনের সাবেক এমপি ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা না করে এনসিটি টার্মিনাল বিদেশিদের দেওয়ার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার সমালোচনা করেন।
এনসিটি বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার পরিকল্পনার প্রতিবাদে গত ২০ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও। সংগঠনটির চট্টগ্রাম নগর শাখার আমির শাহজাহান চৌধুরী বলেন, আমরা বিদেশি বিনিয়োগ চাই। দেশের উন্নয়নের জন্য বিদেশি বিনিয়োগ অপরিহার্য। কিন্তু সেই বিনিয়োগ হোক তাদের নিজেদের তৈরি করা টার্মিনালে; আমাদের তৈরি টার্মিনালে নয়।