সন্তানকে কেড়ে নিয়ে স্বামী তালাক দিয়েছিলেন। সন্তান হারানোর শোকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। এরপর তাঁকে পাওয়া যায় ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকায়। অনুপ্রবেশ সন্দেহে আটক করেন বিজিবির সদস্যরা। পরিচয় জানতে চাইলেও কিছু বলতে পারেন না। বিজিবি সোপর্দ করে পুলিশের কাছে। পুলিশেরও কোনো প্রশ্নের উত্তর দেননি। বাবার নাম, মায়ের নাম ও ঠিকানা—সবকিছুর স্থানেই লেখা হয় ‘অজ্ঞাত’।
দেড় মাস আগে ভারতীয় নাগরিক সন্দেহে অনুপ্রবেশের মামলায় রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। কারা কর্তৃপক্ষের চেষ্টায় তিনি কথা বলতে শুরু করেন। বলেন, ভারতে নয়; তাঁর বাড়ি নওগাঁয়। বলতে পারেন বাবার নাম-ঠিকানাও। ডাকা হয় বাবাকে। বাবা-মেয়ের কান্নায় উপস্থিত সবাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। এরপর গতকাল বুধবার বিকেলে মুক্তি মেলে তাঁর।
আশা বানু জানান, স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। তাঁদের ১০ বছরের একটি ছেলে রয়েছে। ছেলেকে কেড়ে নিয়ে ২০২২ সালে স্বামী তাঁকে তালাক দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেন। শৈশবে মাকে হারিয়েছেন।মেয়েটির নাম আশা বানু (২৩)। বাবার নাম মীর মোস্তাফিজুর রহমান, মা ফরিদা বেগম। বাড়ি নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার হাকিমপুর গ্রামে। গত ১৬ মে রাত পৌনে আটটার দিকে রাজশাহীর গোদাগাড়ী গহোমাবোনা সীমান্তে পদ্মা নদীর ধারে তাঁকে পাওয়া যায়।
আশা বানুর কাছ থেকে কোনো প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে পুলিশ ধারণা করে, তিনি ভারতীয় নাগরিক। অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছেন। আচরণ দেখে মানসিক ভারসাম্যহীন কি না, তা যাচাই করতে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে লিখে দেয় ‘অ্যাপারেন্টলি হেলথি ফিজিক’ (দৃশ্যত স্বাস্থ্যগত কোনো সমস্যা নেই)।
চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র পাওয়ার পর পুলিশ আশা বানুকে ভারতীয় গুপ্তচর সন্দেহে তাঁকে জেলহাজতে আটক রাখা একান্ত প্রয়োজন বলে আদালতকে জানায়। আদালতের মাধ্যমে তাঁকে রাজশাহী নগরের দামকুড়া থানার মামলায় ১৭ মে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়।
আইনি প্রক্রিয়ায় এই মামলা শেষ হবে। এ জন্য আশা বানুকে আদালতে হাজিরা দিতে হবে।সিনিয়র জেল সুপার শাহ আলম খানরাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার শাহ আলম খান জানান, কারাগারে আসার পর আশা যাতে কথা বলেন, তাঁরা আন্তরিকভাবে সেই চেষ্টা চালাতে থাকেন। একদিন তিনি কথা বলতে শুরু করেন। নাম-ঠিকানা জানান। দাম্পত্য জীবনে দুঃসহ স্মৃতির কথাও জানান তাঁদের।
আশা বানু জানান, স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। তাঁদের ১০ বছরের একটি ছেলে রয়েছে। ছেলেকে কেড়ে নিয়ে ২০২২ সালে স্বামী তাঁকে তালাক দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেন। শৈশবে মাকে হারিয়েছেন।
এ ঘটনা জানার পর কারা কর্তৃপক্ষ আশা বানুর বাড়িতে যোগাযোগ করে। নিয়ে আসা হয় তাঁর বাবাকে। তবে প্রথমেই তাঁদের সাক্ষাৎ না করিয়ে বাবার ছবি তুলে আশা বানুকে দেখানো হয়। বাবাকে চিনতে পারেন তিনি। এরপর আশাকে আরও কয়েকজন মেয়েসহ বাবার সামনে আনা হয়। বাবা তাঁদের ভেতরে থেকেই মেয়েকে শনাক্ত করেন।
হামি মনে করেছিনু ঢাকায় যামু। একটা চাকরি পাওয়া যায় কি না দেখমু। পরে কোথায় গেছুনু আর মনে করতে পারিনি।আশা বানুএরপর জেল সুপার ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। মেয়েটিকে জামিন দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেন তিনি। সব প্রক্রিয়া শেষ হলে গতকাল তাঁর বাবাকে আসতে খবর দেন। সকালেই বাবা কারাগারে চলে আসেন। তবে আদালতে গিয়ে দেখা যায়, আগের ম্যাজিস্ট্রেটের বদলি হয়েছে। তাঁর মাধ্যমে বর্তমান ম্যাজিস্ট্রেটকে ফোন করানো হয়। এরপর সব জামিন ও সব প্রক্রিয়া শেষে গতকাল বিকেলে আশা বানু কারামুক্ত হন।
সিনিয়র জেল সুপার শাহ আলম খান বলেন, ‘আইনি প্রক্রিয়ায় এই মামলা শেষ হবে। এ জন্য আশা বানুকে আদালতে হাজিরা দিতে হবে।’
এর আগেও আশা বানু বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন বলে জানান আশা বানুর বাবা। বলেন, এবার হারানোর পর তিনি থানায় জিডি করেন। অনেক জায়গায় খুঁজেও মেয়েকে পাননি।
কেন বাড়ি থেকে একাই বের হন, জানতে চাইলে আশা বানু বলেন, ‘হামি মনে করেছিনু ঢাকায় যামু। একটা চাকরি পাওয়া যায় কি না দেখমু। পরে কোথায় গেছুনু আর মনে করতে পারিনি।’ বিজিবি বা পুলিশের প্রশ্নের উত্তর কেন দেননি জানতে চাইলে উত্তর আসে, ‘হামার কিচ্চু মনে আসেনি।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রক র য়
এছাড়াও পড়ুন:
বাঁশির সুরে বিরহের কষ্ট ভুলতে চান রিকশাচালক শফিকুল
বাঁশির সঙ্গে সখ্য সেই শৈশবে। গ্রামে যাত্রাপালায় গান করতেন আর বাঁশির সুরে ছড়াতেন মুগ্ধতা। জীবন-জীবিকার তাগিদে একসময় বেছে নেন রিকশাচালকের পেশা। গ্রাম ছেড়ে থিতু হন ব্যস্ত শহরে। তবে বাঁশের বাঁশিকে হাতছাড়া করেননি শফিকুল ইসলাম (৪৫)।
যানজটে গতি থামতেই রিকশার হ্যান্ডেল ছেড়ে শফিকুল কোমর থেকে হাতে নেন প্রিয় বাঁশি। হর্নের কর্কশ ধ্বনি এড়িয়ে তখন বাতাসে ভাসে সুরের মূর্ছনা। বেখেয়ালি যাত্রী আর পথচারীরা হঠাৎ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকেন বাঁশিওয়ালার দিকে।
দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে বাঁশির সঙ্গে মিতালি গড়েছেন শফিকুল। সেই বাঁশির সুরেই যেন তাঁর জীবন বাঁধা। অভাব, দুর্দশা আর দারিদ্র্যও এ বন্ধন থেকে তাঁকে আলাদা করতে পারেনি। রিকশার প্যাডেলের ছন্দে তাঁর ঠোঁটে বিমূর্ত হয়ে বাঁশির করুণ সুর। বগুড়া শহরের পথচারীদের কাছে তিনি ‘বাঁশিওয়ালা রিকশাওয়ালা’ হিসেবে পরিচিত।
শফিকুলের পৈতৃক ভিটা বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার শালিখা গ্রামে। তবে জীবিকার তাগিদে থাকেন বগুড়া শহরের মালতীনগর এলাকার একটি গ্যারেজে। গত রোববার বিকেলে তাঁর দেখা মেলে বগুড়া শহরের কোর্ট হাউস স্ট্রিটের ব্যস্ত সড়কে। শেষ বিকেলে যানজটে যখন পথচারীরা বিরক্ত, তখন বাতাসে ভেসে আসে ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’ ভাওয়াইয়া গানটির সুর।
দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে বাঁশির সঙ্গে মিতালি গড়েছেন শফিকুল। রিকশার প্যাডেলের ছন্দে তাঁর ঠোঁটে বিমূর্ত হয়ে বাঁশির করুণ সুর। বগুড়া শহরের পথচারীদের কাছে তিনি ‘বাঁশিওয়ালা রিকশাওয়ালা’ হিসেবে পরিচিত।এরই একফাঁকে আলাপ হয় শফিকুল ইসলামের সঙ্গে। কথায় কথায় তিনি জানান, দারিদ্র্যের কারণে পঞ্চম শ্রেণির গণ্ডি পেরোতে না পেরোতেই পড়ালেখা বন্ধ করতে হয়। এরপর জড়িয়ে পড়েন গ্রামের একটি যাত্রাপালার দলে। ‘কাজলরেখা’, ‘সাগরভাসা’, ‘গুনাইবিবি’, ‘রাখালবন্ধু’, ‘রূপবান’সহ নানা লোককাহিনিনির্ভর যাত্রাপালায় অভিনয় ও গান করেছেন। শুধু তা–ই নয়, গানের সুরে হারমোনিয়ামও বাজাতেন। এসবের ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক রিকশা চালাতেন তখন।
পরিবারের বিষয়ে জানতে চাইলে শফিকুল বলেন, ২০০০ সালে বিয়ে করেন। স্ত্রী মোর্শেদা গৃহিণী। তাঁদের তিন মেয়ে—শরীফা, শম্পা ও শাকিলা। এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। স্ত্রী ও দুই মেয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকেন। মাসে দুবার তিনি বাড়িতে যান। শফিকুলের দাবি, বগুড়া শহরে রিকশা চালিয়ে দিনে পান ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। থাকা-খাওয়া ও রিকশার জমা খরচ ছাড়া ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা থেকে যায়। সেই টাকায় চলে সংসার।
শুরুতে শহুরে জীবন শফিকুলের একদম ভালো লাগত না, মন পড়ে থাকত সেই গ্রামে। মন ভালো রাখতে রিকশা চালানোর সময় গুনগুন করে গাইতেন। এর মধ্যে শহরের রাস্তায় একদিন এক বাঁশিওয়ালার সঙ্গে তাঁর দেখা। তাঁর কাছ থেকে উপার্জনের ৮০ টাকা দিয়ে একটি বাঁশি কেনেন তিনি। এরপর রাতে গ্যারেজে শুয়ে সেই বাঁশিতে সুর তোলেন। এখন বাঁশি তাঁর নিত্যসঙ্গী।
বাঁশি বাজাতে বাজাতে রিকশা চালানো অভ্যাস হয়ে গেছে জানিয়ে শফিকুল বলেন, যানজটে আটকা পড়লে বাঁশিতে সুর তোলেন। যাত্রী না পেলে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে একমনে বাঁশি বাজান। সুর শুনে যাত্রীরা ১০-২০ টাকা বেশি ভাড়া দেন কখনো কখনো।
গরিব হওয়ার কারণে মেয়ের পরিবারের লোকজন প্রেমে বাধা হয়। বড়লোকের ছলের লগে বিয়ে হয় মেয়েটার। সেই থাকে গান আর সুর সঙ্গী।শফিকুল ইসলামস্মৃতি হাতড়ে শফিকুল বলেন, একবার ঢাকায় রিকশা চালাতে গিয়েছিলেন। দৈনিক বাংলার মোড়ে রিকশা থামিয়ে একমনে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। হঠাৎ একটি ২০ তলা ভবন থেকে মধ্যবয়সী এক ব্যক্তির চিৎকার শুনতে পান। ওপরে তাকাতেই ৫০ টাকার একটা নোট নিচে ফেলে দেন ওই ব্যক্তি। প্রশংসা করেন বাঁশির সুরের।
আলাপচারিতা একসময় আনমনে হয়ে পড়েন শফিকুল। বলেন, ‘মন তো (মনে) না পাওয়ার কষ্ট আচে। ১৬ বছর বয়সে এলাকার এক মেয়ের প্রেমে পড়চিনু। ৬ মাস ভালোই চলিচ্চিল সেই প্রেম। গরিব হওয়ার কারণে মেয়ের পরিবারের লোকজন প্রেমে বাধা হয়। বড়লোকের ছলের লগে বিয়ে হয় মেয়েটার। সেই থাকে গান আর সুর সঙ্গী। আরও পরে সঙ্গী হয় বাঁশি। এহন বাঁশির সুরে বিরহের কষ্ট ভুলে থাকপার চেষ্টা করি।’