বালুচদের আন্দোলন ইসরায়েল যেভাবে ছিনতাই করছে...
Published: 27th, July 2025 GMT
ইসরায়েল যখন ইরানের ওপর কোনো ধরনের উসকানি ছাড়াই আকস্মিকভাবে হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল এবং যুদ্ধের ডঙ্কা বাজাচ্ছিল, তখন একটি ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ খবর প্রায় সবার নজর এড়িয়ে গেছে। খবরটি ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক একটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত নতুন একটি প্রকল্পের ঘোষণাসংক্রান্ত। গত ১২ জুন মিডল ইস্ট মিডিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট (মেমরি) নামের থিঙ্কট্যাংক ঘোষণা দেয়, তারা বেলুচিস্তান স্টাডিজ প্রজেক্ট (বিএসপি) নামে একটি নতুন গবেষণা উদ্যোগ শুরু করছে।
এ ঘোষণায় মেমরি বলেছে, বেলুচিস্তানে তেল, গ্যাস, ইউরেনিয়াম, তামা, কয়লা, বিরল খনিজসহ বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। এ ছাড়া গাদর ও চাবাহার নামের দুটি গভীর সমুদ্রবন্দর আছে। তারা বলছে, এই অঞ্চল এমন একটি জায়গা, যেখান থেকে ইরান কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র পেতে পারে। এ কারণে এসব নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির জন্য এখানে একটি ঘাঁটি গড়া যেতে পারে। এ যুক্তিতেই তারা প্রকল্পটি চালুর যৌক্তিকতা তুলে ধরেছে।
মেমরি এমন একটি সংস্থা, যারা আরবি, ফারসি ও তুর্কি ভাষার মিডিয়ার বিশেষ কিছু অংশ বেছে বেছে অনুবাদ করে। সেগুলোর স্ক্রিনশট পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিম আকারে ঘুরে বেড়ায়। এটি ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং শুরু থেকেই এটি ইসরায়েলপন্থী অবস্থান গ্রহণ করে। এ প্রেক্ষাপটে মেমরি যে বেলুচিস্তান স্টাডিজ প্রজেক্ট চালু করেছে, তা আসলে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বালুচদের জাতীয় আন্দোলনকে নিজেদের কৌশলগত স্বার্থে ব্যবহার করার একটি চেষ্টা বলে মনে হয়।
যদি তারা বালুচদের এই সংগ্রামকে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়, তাহলে এর মাধ্যমে ইসরায়েল একদিকে রাজনৈতিক সুবিধা পাবে, অন্যদিকে এই অঞ্চলের ‘রাষ্ট্রহীন’ জনগণের (যেমন বালুচ ও ফিলিস্তিনিদের) বিচারভিত্তিক প্রতিরোধ আন্দোলনের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারবে। বিষয়টি মাথায় রেখে স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যে ভূরাজনীতির চিন্তার সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা জরুরি।
মেমরি যে বিএসপি চালু করেছে, তার ঘোষণায় বহু অসংগতি ও ভুল তথ্য আছে। বিশেষ করে বেলুচিস্তানে শোষণ ও প্রতিরোধের বাস্তবতা নিয়ে বহু ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে। যেমন মেমরির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, যেহেতু ইরান ও পাকিস্তান উভয়ই এখন বেলুচিস্তানে বিদ্রোহ দমনের জন্য সামরিক অভিযান চালাচ্ছে, তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বোঝা উচিত, বেলুচিস্তান আসলে পশ্চিমা বিশ্বের স্বাভাবিক মিত্র। কিন্তু মেমরি ইচ্ছাকৃতভাবে এই সত্য চেপে যাচ্ছে যে বারিক গোল্ড ও বিএইচপি বিলিটনের মতো পশ্চিমা বিশ্বের বড় বড় কোম্পানি এই অঞ্চলেই ঔপনিবেশিক ধরনের সম্পদ লুট ও পরিবেশ ধ্বংসে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।
এ প্রকল্পে যাঁরা যুক্ত হয়েছেন, তাঁদের নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। মেমরির ওয়েবসাইটে বিএসপি নিয়ে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে ‘বিখ্যাত বালুচ লেখক, পণ্ডিত ও রাজনৈতিক বিজ্ঞানী’ হিসেবে মির ইয়ার বালুচ নামের একজনকে ‘বিশেষ উপদেষ্টা’ হিসেবে স্বাগত জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, উপমহাদেশে তাঁর এক্স অ্যাকাউন্ট সবচেয়ে প্রভাবশালী অ্যাকাউন্টগুলোর একটি।
এ বছরের মে মাসে এই মির ইয়ার বালুচ একের পর এক পোস্টে একতরফাভাবে বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে জানান, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পক্ষে ছয় কোটি বালুচ দেশপ্রেমিক ভারতের পাশে আছে। এই ঘটনাগুলোর মাধ্যমেই তিনি প্রথমবারের মতো আলোচনায় উঠে আসেন।
পরিচিত বালুচ কর্মীরা মির ইয়ার বালুচকে প্রকাশ্যে প্রত্যাখ্যান করেছেন। উদাহরণ হিসেবে বালুচ ন্যাশনাল মুভমেন্টের নিয়াজ বালুচ এক্সে পোস্ট করে জানান, বালুচ নেতাদের মধ্যে স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে কোনো ঐক্য নেই। তিনি চারটি ‘ভুয়া অ্যাকাউন্ট’-এর তালিকা দেন। এর মধ্যে মির ইয়ার বালুচের অ্যাকাউন্টও ছিল। তিনি বলেন, এই অ্যাকাউন্টগুলো ‘তাৎক্ষণিকভাবে রিপোর্ট ও আনফলো করা উচিত’। এ কারণে অনেক বালুচ কর্মীর সন্দেহ, মির ইয়ার বালুচ আদতে একটি তৈরি করা ছদ্মচরিত্র, যা কোনো রাষ্ট্রের স্বার্থে তৈরি হয়েছে। আর তা করা হয়েছে ওই রাষ্ট্রের বিশেষ কৌশলগত লক্ষ্য বাস্তবায়নে সাহায্য করার জন্য।
বেলুচিস্তান এমন একটি অঞ্চল, যা ইরান ও পাকিস্তানের সীমান্তজুড়ে বিস্তৃত। এ দুই রাষ্ট্রই সেখানে বিদ্রোহ দমন করছে। এর ফলে তাদের মধ্যে প্রায়ই উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। উভয় পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে, সীমান্ত পেরিয়ে তারা একে অপরের বিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয় দিচ্ছে।
অথচ বাস্তবতা হলো, ইরান ও পাকিস্তানের উভয় পাশের অনেক বালুচ মনে করেন, তাঁরা রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের শিকার এবং সমাজের মূলধারা থেকে বাদ পড়া জনগোষ্ঠী।
এ প্রেক্ষাপটে বালুচদের সংগ্রামের প্রতি ইসরায়েলের প্রকাশ্য সমর্থন তাদের পশ্চিম এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের নতুন পথ খুলে দেয়। ইরানের নিরাপত্তাব্যবস্থা ভেদ করার ক্ষেত্রে ইসরায়েল কতটা কার্যকরভাবে অনুপ্রবেশ করতে পেরেছে, তা ১৩ জুনের ঘটনাগুলোয় দেখা গেছে। এখন তারা বালুচদের সমর্থন জানিয়ে ইরান ও পাকিস্তানের সেই সব বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে চাইছে, যাদের ওপর ওই দুই রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দুর্বল। এর ফলে ইসরায়েল ওই অঞ্চলগুলোয় নিজের অবস্থান আরও মজবুত করতে পারবে।
আরও পড়ুনবেলুচিস্তানে সশস্ত্র আন্দোলন গোপনে কারা, কেন উসকে দিচ্ছে২৪ জুলাই ২০২৫আরও গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায়, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনকে দমন ও বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার ব্যাপারে ইসরায়েলের যে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য, তা অর্জনের ক্ষেত্রেও এই কৌশল সহায়ক। কারণ, বালুচ ও অন্যান্য রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের যে আন্ত–আন্তর্জাতিক সংহতি গড়ে উঠতে পারত, ইসরায়েল চাইছে তা ভেঙে দিতে। এভাবে বালুচদের আন্দোলনের ভেতরে ঢুকে পড়ে ইসরায়েল শুধু ইরান ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় না, বরং ফিলিস্তিনসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রহীন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সংহতির সম্ভাবনাও দুর্বল করে দেয়।
ইসরায়েল যদি বেলুচিস্তানের প্রতি কোনো সমর্থন দেখায়, তাহলে সেটা ভারতের সঙ্গে তাদের কৌশলগত জোটের অংশ হিসেবেই দেখা যেতে পারে। ভারত অনেক দিন ধরেই বালুচ স্বার্থ বা বালুচদের আন্দোলনের একধরনের সমর্থক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে আসছে। কিন্তু এর ফলে একটি বড় সমস্যা হয়েছে। সেটি হলো ভারতের অধীন থাকা নিরাষ্ট্র জনগোষ্ঠী, যেমন কাশ্মীরিদের সঙ্গে বালুচদের সংহতি গড়ে তোলার চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
এমন প্রেক্ষাপটে লক্ষ করা যায়, মির ইয়ার বালুচ, যিনি এক্স হ্যান্ডলে ইসরায়েল ও ভারতের পক্ষে লেখেন, তাঁর পরিচিতি মূলত ভারতীয় গণমাধ্যম থেকেই তৈরি হয়েছে। তাঁর সব বক্তব্যই মূলত ভারতীয় জনগণের উদ্দেশে দেওয়া। সুতরাং বেলুচিস্তান স্টাডিজ প্রজেক্ট বা বিএসপি আসলে ভারত ও ইসরায়েলের কৌশলগত সম্পর্কেরই একটি প্রকাশ, যা কিনা এক অঞ্চলের প্রভাব অন্য অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়ার এক চর্চা।
● আবদুল্লাহ মোয়াসওয়েস ফিলিস্তিনি লেখক, গবেষক, শিক্ষক ও অনুবাদক
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অ য ক উন ট ইসর য় ল র ক শলগত র জন ত প রক শ ব এসপ ন একট
এছাড়াও পড়ুন:
প্রতিষ্ঠার দেড় যুগ পর ইতিহাসের সাক্ষী হতে যাচ্ছে বেরোবি
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ব্রাকসু) নিয়ে অপেক্ষার প্রহর শেষ হতে চলেছে শিক্ষার্থীদের। গত ২৮ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের মাধ্যমে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের গেজেট প্রকাশ হয়ছে গঠনতন্ত্র।
এরই মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১৭ বছর পর হতে যাচ্ছে কাঙিক্ষত কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ তথা ব্যাকসু নির্বাচন। তবে এর জন্য আমরণ অনশন থেকে শুরু করে সব ধরনের কর্মসুচিই পালন করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
আরো পড়ুন:
‘আমরা একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন করতে চাই’
বেরোবিতে শহীদ আবু সাঈদ স্মৃতিস্তম্ভের মডেল প্রদর্শন
জুলাই অভ্যুত্থান পর গণরুম ও গেস্ট রুমের যে সাংস্কৃতি ছিল, তা এখন বন্ধ হয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দলের কমকাণ্ডে সামিল হওয়াও বাধ্যতামুলক নয়।
তাই শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এ ছাত্র সংসদ। যাতে শিক্ষার্থীদের অধিকার ও স্বার্থ সুরক্ষিত হবে।
কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বেরোবির বিধিমালা অনুযায়ী, ১৩টি পদে সরাসরি নির্বাচন ও হল সংসদে নয়টি পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে সব ধরনের কথা তুলে ধরতে পারবেন।
পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী শেখর রায় বলেন, “সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও লেজুরবিত্তিক রাজনীতি ব্যতীত একটি নির্বাচন হোক। যোগ্য, আদর্শ, উত্তম চরিত্র ও মনের প্রার্থী বিজয়ী হোক। নির্বাচিত হয়ে তারা হয়ে উঠুক বেরোবির একেকজন যোগ্য প্রতিনিধি। তারা ন্যায়ের পক্ষে থাকুক । তাদের হাত ধরেই এগিয়ে যাক বেরোবি।”
গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী জাওয়াদ সাজিদ বলেন, “ছাত্র সংসদ শিক্ষার্থীদের দাবি, অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার প্রধান মঞ্চ। এটি প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে, যাতে প্রতিটি শিক্ষার্থীর কণ্ঠ পৌঁছে যায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের টেবিলে। কিন্তু এজন্য সংসদকে দলীয় প্রভাবমুক্ত, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হতে হবে। প্রকৃত অর্থে ছাত্র সংসদ তখনই সফল, যখন তা শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হয়ে তাদের সমস্যার সমাধান ও কল্যাণে কাজ করে।”
অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী আতিকুর রহমান বলেন, “আমরা এমন ছাত্র সংসদ চাই, যেখানে যোগ্য নেতৃত্ব আসবে এবং সব শিক্ষার্থীর সমস্যা সমাধানের হাতিয়ার হয়ে কাজ করবে। সবমিলিয়ে সবার বিশ্বস্ত জায়গা হবে এই ছাত্র সংসদ।”
ঢাকা/সাজ্জাদ/মেহেদী