পাচারকারীসহ আরও কিছু কারণে হুমকির মুখে সুন্দরবনের বাঘ
Published: 29th, July 2025 GMT
সুন্দরবনে পাচারকারীদের হাতে বেশি মারা পড়ছে বাঘ। হরিণ শিকার বন্ধ না হওয়ায় বাঘের খাদ্যসংকট তৈরি হচ্ছে, যা পরোক্ষভাবে তাদের জন্য বড় হুমকি। পাশাপাশি শিল্পদূষণ, লবণাক্ততা ও অপরিকল্পিত পর্যটনের চাপে বাঘ ক্রমে বিপন্ন হচ্ছে। সুন্দরবন ও বাঘ সুরক্ষা নিয়ে কাজ করেন এমন পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
২০১৮ সালে ক্যামেরা ট্র্যাপিং–পদ্ধতিতে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ১১৪। ২০২৪ সালে নতুন জরিপে এই সংখ্যা বেড়ে ১২৫টিতে দাঁড়িয়েছে। সংখ্যায় কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও বাঘের জীবনের হুমকি আগের চেয়ে কমেনি, বরং বেড়েছে বহুগুণ।
বন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত আড়াই দশকে সব মিলিয়ে মারা যাওয়া বাঘের সংখ্যা ৬২। এর মধ্যে পাচারকারীদের হাতে মারা পড়েছে ২৬টি। স্বাভাবিক মৃত্যু ২১, গ্রামবাসীর হাতে মৃত্যু ১৪ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ১টি বাঘ মারা পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব বাঘ দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি, সুন্দরবনের সমৃদ্ধি’।
এ সম্পর্কে সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল কাদির বলেন, ‘বাঘ হত্যার ঘটনা বর্তমানে কিছুটা কমলেও হুমকি বহুগুণ বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীর পানি লবণাক্ত হয়ে পড়ায় বাঘ বাধ্য হচ্ছে সেই লোনাপানি পান করতে, যা তাদের অসুস্থ করে তুলছে। ঘূর্ণিঝড়, অস্বাভাবিক জোয়ার কিংবা নিম্নচাপের সময় বাঘের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের অভাব তাদের টিকে থাকার লড়াইকে আরও কঠিন করে তুলছে।’
বাঘ বিপন্ন হওয়ার বেশ কিছু কারণ জানালেন সুন্দরবন সুরক্ষা আন্দোলনের সভাপতি হারুন অর রশীদ। তিনি বলেন, হরিণ শিকার বন্ধ না হওয়ায় বাঘের খাদ্যসংকট তৈরি হচ্ছে, যা পরোক্ষভাবে তাদের জন্য বড় হুমকি। পাশাপাশি বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গোপন বেচাকেনা, শিল্পদূষণ, লবণাক্ততা ও অপরিকল্পিত পর্যটনের চাপে বাঘ ক্রমেই বিপন্ন হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কথায় সচেতন; কিন্তু কার্যক্রমে দুর্বল। বাঘ না থাকলে সুন্দরবন থাকবে না, আর সুন্দরবন না থাকলে বাংলাদেশ ভয়াবহ পরিবেশ–সংকটে পড়বে।’
মানবসৃষ্ট পরিবেশদূষণও বাঘের অস্তিত্ব হুমকিতে ফেলছে। এ সম্পর্কে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, ‘বনের চারপাশে অসংখ্য শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে, যেগুলোর বর্জ্য পশুর নদ হয়ে জোয়ারে বনভূমিতে ছড়িয়ে পড়ছে। এতে বাঘসহ অন্যান্য প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জাহাজের আলো, শব্দ ও কিছু জেলের বিষ দিয়ে মাছ ধরা—এসব কিছুর সম্মিলিত প্রভাব বাঘের জীবনে ভয়ংকর ছন্দপতন ঘটাচ্ছে।’
আরও গভীর আশঙ্কার কথা বলেন উপকূল ও সুন্দরবন সংরক্ষণ আন্দোলনের সদস্যসচিব সাইফুল ইসলাম। তাঁর ভাষায়, ‘বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচার করে আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করতে একটি চক্র সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। ইন্টারপোলের দেওয়া ১৫৩ জনের তালিকা থাকা সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। গণনার নামে কোটি কোটি টাকা ব্যয় না করে এই চক্রকে নির্মূল করলেই হয়তো বাঘকে রক্ষা করা সম্ভব।’
এ সম্পর্কে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, ‘বাঘ হত্যা বন্ধে আমরা তথ্যদাতাদের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছি। বনের ভেতরে অপরাধী শনাক্ত করতে পারলে ৫০ হাজার, লোকালয়ে হলে ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়। তবে শুধু আইন দিয়ে কাজ হবে না, প্রয়োজন মানুষের সদিচ্ছা ও সচেতনতা।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, বাঘ হচ্ছে সুন্দরবনের কিস্টোন প্রজাতি। এই প্রাণী টিকে থাকলে টিকে থাকবে বন। আর বন টিকলে টিকে থাকবে এই দেশের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, এমনকি মানুষও। তাঁর মতে, হরিণ শিকার বন্ধ না হলে বাঘ দুর্বল হয়ে পড়বে, খুঁজবে সহজ শিকার, আর তখনই বাড়বে মানুষ-বাঘ সংঘাত। তাই শুধু বন বিভাগ নয়, সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ন দরবন র জন য পর ব শ
এছাড়াও পড়ুন:
এক দশকে ১ লাখ হেক্টর বনভূমি কমেছে
দেশে এক দশকে বনভূমি হ্রাস পেয়েছে ১ লাখ ১ হাজার হেক্টর, যা ঢাকা শহরের আয়তনের প্রায় সাড়ে তিন গুণ। গত এক দশকে দেশ থেকে হারিয়ে গেছে ৬৪ প্রজাতির গাছ।
সারা দেশে বনাঞ্চলে যে পরিমাণ গাছ আছে, গ্রামাঞ্চলে গাছের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। তবে গ্রামে গাছের ঘনত্ব কম। আর বন উজাড় বেশি হয়েছে পার্বত্যাঞ্চলে। সেখানে একমুখী প্রজাতির ফসল চাষের প্রসার ও সড়ক সম্প্রসারণের কারণে বন উজাড় হচ্ছে।
বনের সার্বিক চিত্র জানতে ২০২৪ সালে বন অধিদপ্তরের করা জাতীয় বন জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। জরিপটি প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।
পার্বত্য অঞ্চলে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। সেটাকে মাথায় রেখে আমরা একটা পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছি। বান্দরবানের লামা অঞ্চল দিয়ে ফরেস্ট রিস্টোরেশনের (বন পুনরুদ্ধার) কাজ শুরু করব আমরা।সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, উপদেষ্টা, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়২০১৫ সালে জাতীয় বন জরিপে বন আচ্ছাদনের পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ৭৬ শতাংশ, সেটি এখন কিছুটা হ্রাস পেয়ে ১২ দশমিক ১১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক বন জরিপে দেশে বনভূমি আছে ১৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর। আগের বন জরিপে যেটির পরিমাণ ১৮ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর।
জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পার্বত্য অঞ্চলে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। সেটাকে মাথায় রেখে আমরা একটা পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছি। বান্দরবানের লামা অঞ্চল দিয়ে ফরেস্ট রিস্টোরেশনের (বন পুনরুদ্ধার) কাজ শুরু করব আমরা।’
‘জীববৈচিত্র্য রক্ষা, অবক্ষয়িত বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা’র আহ্বান জানিয়ে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৭২ সালে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক দিবসের মর্যাদা দেয়।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ফাওয়ের তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিকভাবে বন উজাড়ীকরণের হার ১ দশমিক ১ শতাংশ হলেও বাংলাদেশে সেটি ২ দশমিক ৬ শতাংশ।
বন অধিদপ্তরের ২০টি দল মাঠপর্যায়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ শুরু করে ২০২৪ সালের মার্চে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তাদের তথ্য সংগ্রহ শেষ হয়। উপকূলীয় বন, শালবন, সুন্দরবন, পার্বত্যাঞ্চল ও গ্রামীণ এলাকায় মোট ১ হাজার ৮৫৮টি নমুনা প্লটের ভিত্তিতে এ জরিপের ফলাফল নির্ধারণ করা হয়েছে।
জরিপে দেশে প্রতি হেক্টরে গাছের ঘনত্ব পাওয়া গেছে ১১৭টি। সবচেয়ে বেশি গাছের ঘনত্ব আছে সুন্দরবনে। এখানে গাছের ঘনত্ব প্রতি হেক্টরে ৭০২টি। বনাঞ্চলের চেয়ে গ্রামীণ এলাকায় গাছের ঘনত্ব কম হলেও মোট গাছের পরিমাণ বেশি। গ্রামীণ এলাকায় মোট গাছের সংখ্যা প্রায় ৯০ কোটি।
২০১৫ সালের বন জরিপে গাছের সংখ্যা ছিল ১৬৯ কোটি। সাম্প্রতিক জরিপে সেটা কিছুটা কমে হয়েছে ১৫৭ কোটি। গত এক দশকে হ্রাস পাওয়া গাছের সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি। জরিপে সারা দেশে ৩২৬টি গাছের প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২৪২টি প্রজাতি পাওয়া গেছে পার্বত্যাঞ্চলে। সুন্দরবনে পাওয়া গেছে ২২ প্রজাতির গাছ। এর আগে বন জরিপে (২০১৫) ৩৯০ প্রজাতির গাছ শনাক্ত করেছিল বন অধিদপ্তর। গত এক দশকে হারিয়ে গেছে ৬৪ প্রজাতির বৃক্ষ।
কেন কমছে পার্বত্যাঞ্চলের বন
২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ডারউইন ইউনিভার্সিটি পরিচালিত এক গবেষণায় পার্বত্যাঞ্চল বাংলাদেশের মোট বন আচ্ছাদনের ৪০ শতাংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে দ্রুত প্রসার ঘটছে অর্থকরি ফলের চাষ (হর্টিকালচার) ও একমুখী প্রজাতির বনায়ন (মনোকালচার), যেমন রাবারবাগান।
জানতে চাইলে জাতীয় বন জরিপের সঙ্গে যুক্ত থাকা বন অধিদপ্তরের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (সদ্য অবসরপ্রাপ্ত) জহির ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে বৈধ ও অবৈধভাবে বন উজাড় হয়ে আসছে। এখানে একদিকে বন উজাড় হচ্ছে, অন্যদিকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কারণে বনায়ন করা যায় না। যার কারণে এখানে বনভূমি হ্রাস পাওয়ার পরিমাণ বেশি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক কামাল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে বন বিভাগ কিছু করতে পারে না। পাহাড়িরা কিছু গামার আর সেগুনগাছের বাগান করেন। পুরো পার্বত্য অঞ্চলে সড়ক সম্প্রসারণ হয়েছে গত কয়েক দশকে। যেমন সীমান্ত রোড হয়েছে।
কামাল হোসাইন বলেন, এ ছাড়া এখানে বিনোদনকেন্দ্র ও রিসোর্টের সংখ্যা বাড়ছে। এটা একটা দিক। অন্যদিকে অনেক প্রভাবশালী এখন ড্রাগন, কাজু ও আমের চাষ করছেন প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে। এ অঞ্চলের বনের ওপর বহুমুখী চাপের কারণে এখানে বনাঞ্চল হ্রাস পাওয়ার হার অন্যান্য অঞ্চল থেকে বেশি।
কামাল হোসাইন আক্ষেপ করে বলেন, ‘কেউ বনকে ভালোবাসে না। মানুষের লোভের শিকার হয়েছে এখানকার প্রাকৃতিক বন। এটাই আমাদের সর্বনাশ করেছে।’