সুন্দরবনে পাচারকারীদের হাতে বেশি মারা পড়ছে বাঘ। হরিণ শিকার বন্ধ না হওয়ায় বাঘের খাদ্যসংকট তৈরি হচ্ছে, যা পরোক্ষভাবে তাদের জন্য বড় হুমকি। পাশাপাশি শিল্পদূষণ, লবণাক্ততা ও অপরিকল্পিত পর্যটনের চাপে বাঘ ক্রমে বিপন্ন হচ্ছে। সুন্দরবন ও বাঘ সুরক্ষা নিয়ে কাজ করেন এমন পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।  

২০১৮ সালে ক্যামেরা ট্র্যাপিং–পদ্ধতিতে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ১১৪। ২০২৪ সালে নতুন জরিপে এই সংখ্যা বেড়ে ১২৫টিতে দাঁড়িয়েছে। সংখ্যায় কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও বাঘের জীবনের হুমকি আগের চেয়ে কমেনি, বরং বেড়েছে বহুগুণ।

বন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত আড়াই দশকে সব মিলিয়ে মারা যাওয়া বাঘের সংখ্যা ৬২। এর মধ্যে পাচারকারীদের হাতে মারা পড়েছে ২৬টি। স্বাভাবিক মৃত্যু ২১, গ্রামবাসীর হাতে মৃত্যু ১৪ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ১টি বাঘ মারা পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব বাঘ দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি, সুন্দরবনের সমৃদ্ধি’।

এ সম্পর্কে সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল কাদির বলেন, ‘বাঘ হত্যার ঘটনা বর্তমানে কিছুটা কমলেও হুমকি বহুগুণ বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীর পানি লবণাক্ত হয়ে পড়ায় বাঘ বাধ্য হচ্ছে সেই লোনাপানি পান করতে, যা তাদের অসুস্থ করে তুলছে। ঘূর্ণিঝড়, অস্বাভাবিক জোয়ার কিংবা নিম্নচাপের সময় বাঘের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের অভাব তাদের টিকে থাকার লড়াইকে আরও কঠিন করে তুলছে।’

বাঘ বিপন্ন হওয়ার বেশ কিছু কারণ জানালেন সুন্দরবন সুরক্ষা আন্দোলনের সভাপতি হারুন অর রশীদ। তিনি বলেন, হরিণ শিকার বন্ধ না হওয়ায় বাঘের খাদ্যসংকট তৈরি হচ্ছে, যা পরোক্ষভাবে তাদের জন্য বড় হুমকি। পাশাপাশি বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গোপন বেচাকেনা, শিল্পদূষণ, লবণাক্ততা ও অপরিকল্পিত পর্যটনের চাপে বাঘ ক্রমেই বিপন্ন হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কথায় সচেতন; কিন্তু কার্যক্রমে দুর্বল। বাঘ না থাকলে সুন্দরবন থাকবে না, আর সুন্দরবন না থাকলে বাংলাদেশ ভয়াবহ পরিবেশ–সংকটে পড়বে।’

মানবসৃষ্ট পরিবেশদূষণও বাঘের অস্তিত্ব হুমকিতে ফেলছে। এ সম্পর্কে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, ‘বনের চারপাশে অসংখ্য শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে, যেগুলোর বর্জ্য পশুর নদ হয়ে জোয়ারে বনভূমিতে ছড়িয়ে পড়ছে। এতে বাঘসহ অন্যান্য প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জাহাজের আলো, শব্দ ও কিছু জেলের বিষ দিয়ে মাছ ধরা—এসব কিছুর সম্মিলিত প্রভাব বাঘের জীবনে ভয়ংকর ছন্দপতন ঘটাচ্ছে।’

আরও গভীর আশঙ্কার কথা বলেন উপকূল ও সুন্দরবন সংরক্ষণ আন্দোলনের সদস্যসচিব সাইফুল ইসলাম। তাঁর ভাষায়, ‘বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচার করে আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করতে একটি চক্র সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। ইন্টারপোলের দেওয়া ১৫৩ জনের তালিকা থাকা সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। গণনার নামে কোটি কোটি টাকা ব্যয় না করে এই চক্রকে নির্মূল করলেই হয়তো বাঘকে রক্ষা করা সম্ভব।’

এ সম্পর্কে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, ‘বাঘ হত্যা বন্ধে আমরা তথ্যদাতাদের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছি। বনের ভেতরে অপরাধী শনাক্ত করতে পারলে ৫০ হাজার, লোকালয়ে হলে ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়। তবে শুধু আইন দিয়ে কাজ হবে না, প্রয়োজন মানুষের সদিচ্ছা ও সচেতনতা।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, বাঘ হচ্ছে সুন্দরবনের কিস্টোন প্রজাতি। এই প্রাণী টিকে থাকলে টিকে থাকবে বন। আর বন টিকলে টিকে থাকবে এই দেশের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, এমনকি মানুষও। তাঁর মতে, হরিণ শিকার বন্ধ না হলে বাঘ দুর্বল হয়ে পড়বে, খুঁজবে সহজ শিকার, আর তখনই বাড়বে মানুষ-বাঘ সংঘাত। তাই শুধু বন বিভাগ নয়, সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ন দরবন র জন য পর ব শ

এছাড়াও পড়ুন:

সুন্দরবনের ভারতীয় অংশের বিএসএফের হাতে আটক ১৯ বাংলাদেশি মৎস্যজীবী

অবৈধভাবে ভারতীয় জলসীমায় প্রবেশের অভিযোগে ১৯ জন বাংলাদেশি মৎস্যজীবীকে গ্রেপ্তার করেছে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ।

বিএসএফ সূত্রে জানানো হয়েছে, সুন্দরবনের ভারতীয় অংশের উত্তাল নদীতে দীর্ঘক্ষণ ধাওয়া করে তাদের আটক করা হয়।  ধৃত মৎসজীবীরা বাংলাদেশের বরিশাল বিভাগের ভোলা জেলার পুরালিয়া গ্রামের বাসিন্দা। মাছ ধরার ট্রলার ও জালসহ তাদেরকে আটক করা হয়। 

আরো পড়ুন:

কলকাতায় সম্মিলিত সেনা সম্মেলন উদ্বোধন নরেন্দ্র মোদির

অবৈধ অভিবাসীদের প্রতি নরম হওয়ার দিন শেষ: ট্রাম্প

বিএসএফ জানায়, রবিবার সীমান্তের সুন্দরবন অংশে রুটিন টহল দেয়ার সময় গোসাবা রেঞ্জের বাঘমারি জঙ্গল এলাকায় বাংলাদেশি অবৈধ ট্রলারের উপস্থিতি নজরে আসে বিএসএফ জওয়ানদের। বিএসএফ জওয়ানদের পেট্রোল বোট ট্রলারটির কাছে যাওয়ার চেষ্টা করতেই ট্রলারটি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। দ্রুততার সঙ্গে ট্রলারের পিছু ধাওয়া করা হয়। দীর্ঘক্ষণ ধাওয়া করে পরবর্তীতে পাকড়াও করা হয় বাংলাদেশি ট্রলারটিকে। অবৈধ অনুপ্রবেশ এর অভিযোগে আটক করা হয় এতে থাকা ১৯ জন বাংলাদেশি মৎস্যজীবীকে। বাজেয়াপ্ত করা হয় ট্রলারটি।

বিএসএফ আরো জানায়, আটকের পর দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদে অভিযুক্তরা অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগের বিপরীতে কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখাতে পারেনি। ফলে জিজ্ঞাসাবাদের পরে তাদের স্থানীয় সুন্দরবন কোস্টাল থানার পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। আজ সোমবার তাদের আলিপুর আদালতে তোলা হবে।

ঢাকা/সুচরিতা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘ছুটে গিয়ে দেখি, একটি হরিণ ঝুলছে শিকারির ফাঁদে’
  • সুন্দরবনের ভারতীয় অংশের বিএসএফের হাতে আটক ১৯ বাংলাদেশি মৎস্যজীবী