মাটির তৈরি খেলনা বাংলার গ্রামীণ ঐতিহ্যের এক অমূল্য সম্পদ। দুর্গাপূজার মৌসুমে একসময় কুমারপল্লীগুলো থাকত আনন্দ ও কর্মচাঞ্চল্যে ভরা। কিন্তু আধুনিকতার কাছে আজ সেই শিল্প হারাচ্ছে আলো। উৎসবের দিনে যেখানে থাকার কথা ব্যস্ততা, সেখানে ঠাকুরগাঁওয়ের কুমারপল্লীতে নেমে এসেছে বিষাদের ছায়া ও নিস্তব্ধ হতাশা।

শিশুর মুখে হাসি ফোটাতে যে হাতে তৈরি হতো রঙিন খেলনা, সেই হাতগুলো আজ ব্যস্ত শুধুই টিকে থাকার লড়াইয়ে। প্লাস্টিক ও বাজারি সামগ্রীর দাপটে কুমারদের তৈরি শিল্পকর্ম হারাচ্ছে ক্রেতা।

ঠাকুরগাঁওয়ের কুমারপল্লী ঘুরে জানা যায়, দুর্গাপূজাকে ঘিরে একসময় মাটির হাতি–ঘোড়া, গরু, হাড়ি-পাতিল কিংবা ফুলের টব নিয়ে মুখর থাকত কুমারপল্লী। শিশুদের জন্য সাজানো হতো রঙিন খেলনার ভাণ্ডার। কিন্তু এখন সেই দৃশ্য এখন আর তেমন চোখে পড়ছে না। উৎসবের আনন্দ কুমারদের জীবনে রূপ নিয়েছে দুঃখ আর অনিশ্চয়তায়।

স্থানীয় কুমাররা জানান, আগে পূজার সময় প্রচুর খেলনা বানানো হতো। এখন প্লাস্টিকের দাপটে চাহিদা কমে গেছে। যেখানে একসময় শুধু সদর উপজেলার আকচা ইউনিয়নের পালপাড়ায় ২০০ পরিবার মৃৎশিল্পে যুক্ত ছিলেন, সেখানে আজ কাজ করছেন মাত্র ১৫–২০টি পরিবার। তাদেরও সংসার চলছে অনিশ্চয়তায়। 

কুমাররা বলছেন, উৎসবের দিনে আনন্দ ছড়িয়ে দেওয়ার বদলে তাদের জীবনে নেমে এসেছে বিষাদের ছায়া। এই শিল্প বাঁচাতে সরকারি সহযোগিতা, সহজ ঋণ আর বাজার তৈরির দাবি জানান তারা।

ঠাকুরগাঁও পালপাড়া কুমার পল্লীর কুমার সুবল পাল বলেন, “আস্তে আস্তে আমাদের এলাকার কুমাররা অন্য পেশায় ঝুঁকে যাচ্ছে। আমরা কয়েকটি পরিবার এই পেশার সাথে যুক্ত। তবুও আমাদের তৈরি মাটির সামগ্রীর তেমন চাহিদা নেই। এই পেশায় থেকে সংসার চালানো হিমসিম হয়ে যাচ্ছে।”

অপর কুমার নিখিল চন্দ্র পাল বলেন, “পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য নিয়ে আমরা চলছি। তবে আমার সন্তান হয়তো আর আমার এই পেশায় থাকবে না। সারাদিনের কঠোর পরিশ্রম করে যদি সংসারের চাহিদার যোগান দিতে না পারি, তাহলে কীভাবেই বা টিকে থাকব। পরবর্তী প্রজন্মে এই এলাকায় কোনো কুমার খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হয়ে যাবে।”

নিখিলের স্ত্রী লিমা রাণী বলেন, “সংসারের বিভিন্ন কাজ করে আবার এই মাটির সামগ্রী বানাতে বসে পড়ছি। কিন্তু এতো পরিশ্রমের কোনো ফলাফল নেই। একটা সময় ছিলো যখন কাজের মাঝে আনন্দ খুঁজে পেতাম। সেইকাজে সার্থকতা ছিল। পণ্য বাজারজাত করে হাতে অনেক টাকা আসতো। কিন্তু সেসব দিন এখন শুধু সোনালী অতীত।”

সুবাস নামের আরেক কুমার বলেন, “আগে পূজা আমাদের জন্যে ছিলো আশীর্বাদ। পূজার সময় হরেক রকম মাটির জিনিস বানিয়ে বাজারে বিক্রি করতাম। বাসার সবার জন্যে কাপড়চোপড়সহ অনেক কিছু কেনাকাটা করে হাসিমুখে বাসায় ফিরতাম। কিন্তু এখন পূজা আসলেই বাসার সবার মনখারাপ থাকে। কারণ পূজায় বাসার সবার চাহিদা মিটিয়ে কাপড়চোপড় কেনাকাটাও করতে পারি না।”

এই বিষয়ে ঠাকুরগাঁও বিসিক জেলা সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আরমান আলী বলেন, “ঠাকুরগাঁওয়ের কুমারপল্লী যেন জীবন্ত ইতিহাসের মতো এক নিদর্শন, যা রক্ষা করা জরুরি। নইলে মুছে যাবে বাংলার এক অমূল্য সংস্কৃতি। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সমন্বিত উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতা এখন সময়ের দাবি।”

তিনি আরো বলেন, “কুটির শিল্পের উন্নয়নে প্রশিক্ষণ, ঋণ সহায়তা এবং প্রদর্শনীতে কুমারদের তৈরি পণ্য বাজারজাত করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।”

ঢাকা/এস

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ক ম রপল ল ঠ ক রগ আনন দ

এছাড়াও পড়ুন:

ঘূর্ণির জাদুতে বিশ্বজয় 

শ্রীলঙ্কার মাঠে সেদিন দুপুরটা ছিল অস্বস্তিকর গরমের। এর সঙ্গে যোগ হলো ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে থাকা দুই লঙ্কান ব্যাটারের তাণ্ডব। দুজনের ভাবভঙ্গিতে যেন ফুটে উঠল না–বলা কথা—‘আমরা থামব না।’ দ্রুত বাউন্ডারি আসছিল, রানের চাকা ঘুরছিল। হতাশায় ডুবে যাচ্ছিলেন বাংলাদেশ দলের বোলাররা।

এরপর হঠাৎ এক তরুণ অফ স্পিনার এসে খেলার রংটাই পাল্টে দিলেন। তুলে নিলেন দিনেশ চান্ডিমালের উইকেট। ঘুরে গেল খেলার মোড়। দেড় শ রানের অটল জুটি ভেঙে দিয়ে খেলার গল্প বদলে দেন যে ছেলেটি—তিনি নাঈম হাসান।

শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে পাঁচ উইকেট নিয়ে নাঈম যেন মাঠে এক ‘ঘূর্ণিঝড়’ বইয়ে দেন। বাংলাদেশের দল হঠাৎ পায় নতুন প্রাণ, নতুন ছন্দ। সেই ম্যাচ ড্র হয়; কিন্তু নাঈমের বোলিংয়ের জাদু থেকে যায় গ্যালারির গুঞ্জনে, ভক্তদের আলোচনায়। এ বছরের জুনে শ্রীলঙ্কার গলে টেস্ট ম্যাচ খেলতে নেমেছিলেন নাঈম। ওই ম্যাচের প্রথম ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ওভার বল করেন তিনি। দেন সবচেয়ে কম রান। 

চট্টগ্রামের আলো–বাতাস গায়ে মেখে বড় হওয়া ছেলে নাঈম। পাড়ার মাঠ থেকে উঠে এসে আপন আলোয় জ্বলে ওঠা অদম্য স্পিনার। স্পটলাইট থেকে দূরে দাঁড়িয়ে নিজের খেলাটাকে নিখুঁত করে তুলতে যাঁরা চেষ্টা করেন—নাঈম তাঁদের একজন। দলে থাকেন, পারফর্ম করেন, আবার নিঃশব্দে সরে যান। আলোচনার কেন্দ্রে তিনি থাকেন না, কিন্তু তাঁর বোলিংয়ের ঘূর্ণি মাঠের বাইরের সব আলো নিজের দিকে টেনে নেয়।

শুরুটা সেই গলির মাঠে

নাঈমের ক্রিকেটে হাতেখড়ি কৈশোরে। টেপ টেনিসের উচ্ছ্বাস, গলির ক্রিকেটের পাগলামি; যেখানেই ব্যাট-বল, সেখানেই ছুটে যাওয়া। খেলাপাগল ছেলেটির ব্যাটে জোর ছিল, বোলিংয়েও তেমন দাপুটে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাট থেকে বলের দিকেই বেশি ঝুঁকে গেলেন তিনি।

পাহাড়-সাগর-হ্রদে ঘেরা বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ফরিদারপাড়া এলাকা। নাঈমের ছোটবেলার পথচলা শুরু হয়েছিল এই এলাকাতেই। তাঁদের বাড়িটি একসময় লোকের কাছে ‘মাহবুব কাউন্সিলরের’ বাড়ি হিসেবে পরিচিত ছিল। সময়ের স্রোতে সেই নাম পাল্টে গেছে। এখন মানুষ চেনে ক্রিকেটার ‘নাঈম হাসানের বাড়ি’ হিসেবে।

জাতীয় দলের খেলা হলে ফরিদারপাড়ার মানুষ বসে যান টিভির সামনে। যখন নাঈম বল হাতে এগিয়ে আসেন, এলাকাবাসীর উচ্ছ্বাস–উত্তেজনা বেড়ে যায়। দরজা-জানালার ফাঁক দিয়ে শুনতে পাওয়া যায় সম্মিলিত ফিসফাস—‘উইকেট চাই নাঈম, উইকেট চাই’।  নাঈমের ছোট সাফল্য-ব্যর্থতাতেও মানুষের অনুভূতির ছায়া লেগে থাকে এ এলাকায়।

সমুদ্রপাড়ে লেখা ইতিহাস

২০১৮ সালের ২২ নভেম্বর। চট্টগ্রামের সমুদ্রঘেঁষা সাগরিকা স্টেডিয়ামের সকালটা যেন একটু উজ্জ্বল ছিল সেদিন। নাঈমের চোখে আলো, মনে উত্তেজনা। হয়তো তার চেয়েও বেশি ছিল একধরনের নীরবতা, যেটা বড় দিনে বড় খেলোয়াড়ের মনেই জন্ম নেয়। জাতীয় টেস্ট দলের জার্সিটি প্রথমবার তাঁর গায়ে ওঠে সেদিন। তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর ২৮৩ দিন। শুরুর দিনেই তিনি ইতিহাস লিখে ফেললেন। প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজের পাঁচ উইকেট তুলে নিয়ে টেস্ট অভিষেকেই রেকর্ড গড়েন চট্টগ্রামের এই সন্তান। মাঠে তখন উৎসব।

স্টেডিয়াম পেরিয়ে উৎসব শুরু হয় ফরিদারপাড়ার বাড়িতেও। নাঈমের মা মমতাজ বেগম পরে বলেছিলেন, ‘চোখে পানি এসে গিয়েছিল। গর্বে, আনন্দে, বিস্ময়ে।’ টিভিতে  তাঁর ছেলেকে বল করতে দেখে নীরবে বলেছিলেন, ‘আমার ছেলেটা জাতীয় দলে খেলছে।’

হঠাৎ এক তরুণ অফ স্পিনার এসে খেলার রংটাই পাল্টে দিলেন। তুলে নিলেন দিনেশ চান্ডিমালের উইকেট। ঘুরে গেল খেলার মোড়।

সাগরিকা স্টেডিয়াম সেই থেকে নাঈমের কাছে শুধু একটা মাঠ নয়, এটাই তাঁর আত্মবিশ্বাসের ঘর। এখানে পাঁচ উইকেটের পর অন্য ম্যাচে ৬ উইকেটও নিয়েছেন। এই মাঠেই তিনি খুঁজে পেয়েছেন নিজের ছন্দ, নিজের সত্তা।

তবু আফসোস

নাঈমের ক্যারিয়ারের দিকে তাকালে একধরনের বৈপরীত্য চোখে পড়ে। সাত বছরে তিনি খেলেছেন মাত্র ১৪ টেস্ট। এর মধ্যে চারবার নিয়েছেন পাঁচ উইকেট। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা ছবি। ৬৯ ম্যাচে ২৭৬ উইকেট। ১৮ বার ৫ উইকেট ও ৩ বার নিয়েছেন ১০ উইকেট।

বিপিএলে নাঈমের নামের পাশে আছে ৩০ উইকেট। চিটাগং ভাইকিংস, কুমিল্লা ভিকটোরিয়ানস, ফরচুন বরিশাল, সিলেট থান্ডার্স—এসব দলে খেলে তিনি হয়ে উঠেছেন পরের প্রজন্মের অফস্পিনের প্রতিশ্রুতি।

প্রতিটি ম্যাচেই দেখা যায়—নাঈম নিজের খেলা নিয়ে কতটা মনোযোগী। তিনি নিজের স্পেল নিয়ে ভাবেন, চক্র ভেঙে কীভাবে ব্যাটসম্যানকে ভুল করানো যায়, তা নিয়েই থাকেন।

যে স্পিনার এতটা ধারাবাহিক, তাঁকে আরও বেশি সুযোগ না দেওয়ার আক্ষেপ থেকেই যায়। নাঈমের বাবা মাহবুবুল আলমের চোখের কোণে সেই আক্ষেপ জমে আছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নাঈমকে নিয়ে আমাদের গর্ব আছে। কিন্তু সে সুযোগ পায় কম। আরও সুযোগ পেলে নামের পাশে উইকেটের সংখ্যা ভিন্ন হতো।’

নাঈম হাসান

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ইবিতে অভয়ারণ্যের মেহেদি উৎসব
  • জানা গেল রাজামৌলির ছবির নাম, থাকছেন মহেশ বাবু-প্রিয়াঙ্কা
  • দেশের প্রথম নারী এভারেস্টজয়ী নিশাত মজুমদারের জয়ের গল্প আসছে
  • নানা আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘আদি নববর্ষ’ উদ্‌যাপন
  • মুগ্ধ করল নবান্ন উৎসবে ধান কাটার প্রতিযোগিতা
  • হোয়াটসঅ্যাপ আসার আগে মায়ের সঙ্গে কথা বলার জন্য অ্যাপ বানিয়েছিলাম
  • ঝিনাইদহে ৩২ বছর পর ছেলে পেলেন পিতৃপরিচয়, মা পেলেন স্ত্রীর স্বীকৃতি
  • নবান্নের পিঠায় সুবাসিত রাবি
  • ঘূর্ণির জাদুতে বিশ্বজয় 
  • ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তারুণ্যের উৎসব রোববার