মেট্রোরেলের কাঠামো ভেঙে পড়ার ভিডিওটি এআই দিয়ে তৈরি
Published: 27th, October 2025 GMT
রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে একজন পথচারীর মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত করে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।
ভিডিওটিতে দেখা যায়, মেট্রোরেল চলন্ত অবস্থায় উড়াল রেলপথের কাঠামোর একটি অংশ ধসে পড়ছে। পোস্টে দাবি করা হয়, এটি ফার্মগেট এলাকায় বিয়ারিং প্যাড খুলে যাওয়ার দৃশ্য।
ভিডিওটি টিকটক ব্যবহারকারী @mdmohibulla09 নামের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে ‘হঠাৎ করে মেট্রোরেল ভেঙে পড়ে একজনের মৃত্যু হলো ফার্মগেট’ ক্যাপশনসহ পোস্ট করা হয়।
লিংক: এখানে
আর্কাইভ লিংক: এখানে
এরপর Swapon Ahmed নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকেও একই ভিডিও শেয়ার করা হয়। ভিডিওটির ক্যাপশন ছিল, ‘ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড কীভাবে খুলে পড়ছে।’
লিংক: এখানে
আর্কাইভ লিংক: এখানে
ভিডিওটির নিচে লেখা মন্তব্যে রাজনীতিবিদদের ‘লুটপাটের’ কথা উল্লেখ করে মৃত্যুর ঘটনাকে রাজনৈতিক দুর্নীতির ফল বলেও দাবি করা হয়।
ভিডিওতে আশপাশের দৃশ্য দেখে তা ঢাকার বলে মনে হওয়ায় অনেকে বিভ্রান্ত হন। প্রথম আলো ফ্যাক্ট চেক ডেস্ক যাচাই করে দেখতে পেয়েছে, ভাইরাল ভিডিওটি বাস্তব নয়, এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি একটি ডিপফেক (Deepfake) ভিডিও।
ভিডিওটি মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে বেশ কিছু অসংগতি স্পষ্ট বোঝা যায়। প্রথমত, ঢাকা মেট্রোরেলের ট্র্যাকে স্টিলের কোনো রেলিং নেই, যেটি ভিডিওতে দেখা গেছে। দ্বিতীয়ত, মেট্রোরেলের প্রতিটি ট্রেনে ছয়টি বগি থাকে, অথচ ভিডিওতে দেখা যায়, মেট্রোরেলটি মাত্র একটি বগি নিয়ে চলছে।
এ ছাড়া ধসে পড়া স্লাবের দৃশ্যটি বাস্তবের সঙ্গে বেমানান এবং কৃত্রিমভাবে যুক্ত করা বলে মনে হয়। ভিডিওর দৃশ্যের প্রতিটি ফ্রেমে ছায়া, প্রতিফলন ও গতিবিধির অসামঞ্জস্যতাও লক্ষ করা যায়, যা কোনো বাস্তব দৃশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এসব উপাদান স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে ভিডিওটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি।
ভিডিওটি Deep Fake O Meter নামের অনলাইন টুলে বিশ্লেষণ করলে এর ১০০ শতাংশই এআই জেনারেটেড হিসেবে শনাক্ত হয়েছে।
গতকাল রোববার (২৬ অক্টোবর) মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড পড়ে যুবকের মৃত্যু নিয়ে সব জাতীয় গণমাধ্যমেই সংবাদ, ছবি, ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে। এসব প্রতিবেদনে মেট্রোরেলের একটি বিয়ারিং প্যাড নিচে পড়ে একজন পথচারী নিহত হওয়ার কথা রয়েছে। কোনো কাঠামো ধসে পড়ার কোনো খবর বা ছবি আসেনি।
লিংক: এখানে,এখানে,এখানে
মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড রাবার ও ইস্পাতের মিশ্রণে তৈরি আয়তাকার এক ধরনের প্যাড, যা অনেকটা বিছানার ম্যাট্রেসের মতো করে ব্যবহৃত হয়। মেট্রোরেলের উড়ালপথ, যেটিকে ভায়াডাক্ট বলা হয়, তার সঙ্গে স্তম্ভ বা পিলারের সংযোগস্থলে বিয়ারিং প্যাড দেওয়া হয়। ওই বিয়ারিং প্যাডের একটি গতকাল খসে পড়েছিল। তার ছবিও গণমাধ্যমে এসেছে।
সুতরাং ফার্মগেটের মেট্রোরেল স্তম্ভ থেকে বিয়ারিং প্যাড খসে পড়ার সঙ্গে ভাইরাল ভিডিওটির কোনো সম্পর্ক নেই। ভিডিওটি সম্পূর্ণভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা তৈরি একটি কাল্পনিক দৃশ্য।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
নিম্নবিত্তের জীবনে সুখের সংজ্ঞা
সুখ এমন একটি শব্দ, যার পেছনে পৃথিবীর সব মানুষ নিরন্তর ছুটে চলে। তবে এই শব্দের অর্থ সবার কাছে এক নয়। জীবনের অবস্থান, আর্থিক অবস্থা, পারিবারিক পরিবেশ এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সুখের সংজ্ঞাও বদলে যায়। ধনীদের কাছে যেখানে সুখ মানে আরাম-আয়েশ, বিলাসিতা ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা, সেখানে নিম্নবিত্ত মানুষের কাছে সুখের অর্থ অনেক সহজ, অনেক বাস্তব এবং অনেক বেশি অনুভবের। তারা সুখ খোঁজে বড় স্বপ্নে নয়; বরং দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট প্রাপ্তির মধে৵।
নিম্নবিত্ত মানুষ প্রতিদিন সংগ্রাম করে জীবনযাপন করেন। তাঁদের জীবনের প্রতিটি দিন যেন নতুন একটি যুদ্ধ। সকাল শুরু হয় জীবিকার চিন্তায়, আর রাত শেষ হয় পরের দিনের ভাবনায়। তবু এই কঠিন বাস্তবতার মাঝেও তারা সুখ খুঁজে নিতে জানে। এক বেলা পেট ভরে খেতে পারা, কাজ শেষে ক্লান্ত দেহে শান্তির ঘুম, সন্তানদের হাসিমুখ—এই সাধারণ বিষয়গুলোই তাদের কাছে অমূল্য সুখ। যেখানে ধনী মানুষ অনেক কিছু পেয়েও তৃপ্ত না, সেখানে এই মানুষগুলো অল্পে সন্তুষ্ট থাকতে পারে।
নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনে সুখের সবচেয়ে বড় উৎস হলো পরিবার। পরিবারের সদস্যরা একে অপরের শক্তি, সাহস ও অনুপ্রেরণা। একজন বাবা সারা দিন কঠোর পরিশ্রম করেন শুধু এই আশায় যে সন্তানেরা দুই বেলা খেতে পারবে। একজন মা নিজের কষ্ট লুকিয়ে সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে চান। ভাই-বোনের মধ্যে ভালোবাসা, দুঃখ ভাগ করে নেওয়া, একসঙ্গে বসে সাধারণ খাবার খাওয়া—এই ছোট ছোট মুহূর্তই তাদের কাছে জীবনের বড় সুখ হয়ে ওঠে।
তা ছাড়া নিম্নবিত্ত মানুষের চাওয়ার পরিধি খুব বড় নয়। তাঁরা আকাশচুম্বী স্বপ্ন দেখেন না, বিলাসী জীবনের কল্পনায় বিভোর হন না। তাঁদের চাওয়া খুব সাধারণ—একটু নিশ্চয়তা, একটু শান্তি আর পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি। এ কারণে তাঁরা ছোট সুখে বড় আনন্দ পান। কেউ নতুন জামা কিনতে না পারলে সন্তানের পুরোনো জামা সেলাই করে নতুন করে পরাতে পেরে আনন্দ পান। আবার কোনো দিন সন্তানের ভালো ফল দেখে ভুলে যান নিজের সব কষ্ট।
নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনে সুখের আরেকটি দিক হলো সহনশীলতা। তাঁরা কষ্ট সহ্য করতে জানেন, অভাবের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন। অনেক সময় প্রতিকূলতার মধে৵ও তাঁদের মুখে হাসি লেগে থাকে। এই হাসি তাঁদের চরিত্রের শক্তি প্রকাশ করে। তাঁরা জানেন জীবনের পথ সহজ নয়, তবুও জীবনের প্রতি তাঁদের ভালোবাসা কমে না; বরং কষ্টের মধে৵ও তাঁরা হাসতে শেখেন, আনন্দ খোঁজেন।
এই ব্যস্ত শহরে এমন সুখের চিত্র অহরহ। যেমন একজন রিকশাচালক সারা দিন রোদ-বৃষ্টিতে মানুষের বোঝা টেনে নিয়ে বেড়ান। শরীর ভেঙে গেলেও রাতে ঘরে ফিরে যখন সন্তান তাঁর কাছে ছুটে আসে, তখন সে সব কষ্ট ভুলে যায়। সন্তানের সেই নিষ্পাপ হাসিই হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় সুখ।
একজন পোশাকশ্রমিক সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কারখানায় কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তবু মাসের শেষে যখন তিনি বেতন পান এবং সেই টাকা দিয়ে পরিবারের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আনেন, তখন তাঁর মনে গভীর তৃপ্তি অনুভব হয়। পরিবারের মুখে হাসি ফুটলেই তিনি নিজেকে ধন্য মনে করেন।
নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনে সুখ ক্ষণস্থায়ী হলেও গভীর। হয়তো আজ ভালো খেতে পেলেন, কাল পেলেন না; আজ কাজ আছে, কাল নেই। তবুও যখন সুযোগ আসে, তাঁরা সেই সুখ পুরো হৃদয় দিয়ে উপভোগ করেন। তাঁরা ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা জানেন, তবুও বর্তমানকে উপভোগ করতে শেখেন। এটাই তাঁদের জীবনের বিশেষ দিক।
আমরা অনেক সময় সুখকে বড় বড় জিনিসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখি—বড় বাড়ি, দামি গাড়ি, প্রচুর টাকা; কিন্তু নিম্নবিত্ত মানুষের জীবন আমাদের শেখায় সুখ আসলে মানুষের মনের অবস্থার ওপর নির্ভর করে। যাঁর মন তৃপ্ত, সেই মানুষই সুখী। টাকা সুখ কিনতে পারে; কিন্তু শান্তি কিনতে পারে না। নিম্নবিত্ত মানুষ হয়তো ধনী নয়; কিন্তু অনেক সময় তাঁরা শান্তির দিক দিয়ে ধনীদের থেকেও ধনী।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনে কষ্ট বেশি; কিন্তু সেই কষ্টের মধে৵ই তাঁরা জীবনের প্রকৃত অর্থ খুঁজে পান। তাঁরা মানুষকে মানুষ হিসেবে ভালোবাসতে জানেন। সাহায্যের হাত বাড়ান, সহানুভূতি বোঝেন, অন্যের দুঃখে কাঁদতে পারেন। এই মানবিক গুণাবলিই তাঁদের সুখকে অর্থবহ করে তোলে।
পরিশেষে বলা যায়, নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনে সুখের সংজ্ঞা বইয়ের পাতায় লেখা কোনো তত্ত্ব নয়; বরং জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে গড়ে ওঠা এক অনুভূতি। তাঁদের সুখ বড় না হলেও সত্যিকারের। তাঁদের আনন্দ অল্প হলেও গভীর। তাঁরা আমাদের শেখায়—জীবন মানে শুধু পাওয়ার হিসাব নয়; বরং যা আছে তা নিয়ে আনন্দ খুঁজে নেওয়ার ক্ষমতাই প্রকৃত সুখ। তাই বলা যায়, সুখের সংজ্ঞা শিখতে চাইলে আমাদের উচিত নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনকে কাছ থেকে দেখা, বোঝা ও সম্মান করা।
তাসনিম জাহান শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়