২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। সেই একই দিনে সংবিধান সংস্কার বিষয়ে গণভোট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। চারটি বিষয়ের ওপর একটিমাত্র প্রশ্নে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে জনগণকে মতপ্রকাশের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

প্রশ্নটি যেহেতু সংবিধান সংস্কারবিষয়ক এবং প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের যেহেতু সংস্কারের সব বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি, সেহেতু এ গণভোটের গুরুত্ব বেড়ে গেছে। কিন্তু এ জন্য যে দীর্ঘ প্রশ্ন নির্ধারণ করা হয়েছে, তার ভাষা সব মানুষের কাছে যথেষ্ট বোধগম্য হচ্ছে কি না, সেটিও ভাবা দরকার।

আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত শতকরা ২২ ভাগ মানুষ নিরক্ষর, অর্থাৎ তাঁরা পড়তেও পারেন না। সাক্ষরতার হার হিসাব করা হয় সাত বছরের বেশি বয়সী জনগোষ্ঠীর ওপর। তার মানে নিরক্ষর মানুষের বেশির ভাগই প্রাপ্তবয়স্ক ভোটার, যাঁরা গণভোটের প্রশ্নগুলো পড়তেই পারবেন না। আবার যাঁরা পড়তে পারেন, তাঁদের সবাই উত্থাপিত প্রশ্নগুলো যে বুঝতে পারবেন, এমন নয়। কেবল ভাষাগত কারণেই সংস্কারমূলক প্রস্তাবটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কাছে অস্পষ্ট রয়ে যাবে, এমনকি এ জন্য ভোট প্রদানে অনাগ্রহও তৈরি হতে পারে।

আমাদের দেশের হতদরিদ্র মানুষের কাছে সংবিধান বাস্তবে ‘কাগুজে দলিল’ ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ, তাঁরা রাষ্ট্রকে দেখতে চান নির্বিঘ্ন ও সচ্ছল জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত করে। সরকার যখন মানুষের খেয়েপরে নিরাপদে বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও দিতে পারে না, তখন মানুষের কাছে সংবিধানের ধারাগুলো গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।

গণভোটের প্রশ্নে নতুন যেসব প্রস্তাব করা হচ্ছে, তাতে শাসনপ্রক্রিয়ায় নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন আসবে। কিন্তু তাতে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন ও অধিকারের প্রশ্নে কতটুকু বদল আনবে, সেটি বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে না গেলে বোঝা সম্ভব নয়।

গণভোটের প্রশ্নে ‘দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ’, ‘উচ্চকক্ষ’ ইত্যাদি এমন কিছু সরকার ও রাজনীতিবিষয়ক পরিভাষা আছে, যেগুলো আমাদের দেশে একেবারেই নতুন। তবে শুধু পরিভাষাগত কারণে গণভোটের প্রশ্নটি জটিল হয়েছে, তা নয়। প্রশ্নের কোনো কোনো জায়গা পূর্ণ ধারণাও প্রকাশ করতে পারছে না। যেমন গণভোটের প্রশ্নের একটি বিষয় এমন: ‘আগামী সংসদ হবে দুই কক্ষবিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে।’ বিদ্যমান কাঠামোর ৩০০ সংসদ সদস্যের বাইরে উচ্চকক্ষের এ অতিরিক্ত ১০০ সদস্যের কাজ ও ভূমিকা কী হবে, তা মোটেও এখানে স্পষ্ট নয়।

এবার জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে গণভোট হওয়ার কারণে ভোটারের উপস্থিতি অনেক বেশি হবে বলেই ধারণা করা যায়। কিন্তু ভাষাগত ও ধারণাগত অস্পষ্টতার কারণে জনগণকে হয়তো ভোটদানে বিরত থাকতে হবে কিংবা রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে তাকিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

তা ছাড়া বর্তমান পদ্ধতিতে সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন করা সহজ নয়; তাতে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনের প্রয়োজন হয়। নতুন প্রস্তাবে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন চাওয়া হয়েছে, তার মানে অর্ধেকের বেশি সদস্যের সমর্থনেই সংবিধান পরিবর্তন করে ফেলা সম্ভব হবে।

গণভোটের প্রশ্ন দেখে মনে হচ্ছে, নতুন প্রস্তাবে সংবিধান সংশোধনের কাজটি আগের চেয়ে সহজ হয়ে গেল। কারণ, সরকার গঠনকারী দল তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে উচ্চকক্ষেও সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকবে। উচ্চকক্ষের সদস্যরা দলীয় মতের বাইরে গিয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন কি না, সেটিও বোঝা যাচ্ছে না। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে উচ্চকক্ষ ‘জুলাই জাতীয় সনদ’-এর অন্যান্য ধারা, যেমন বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ ইত্যাদি বিষয় বদলে ফেলতে পারবে কি না, সেটি নিয়েও দ্বিধা থেকে যাচ্ছে।

সরকারব্যবস্থা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সর্বশেষ ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশে গণভোট হয়েছিল। তখন গণভোটের প্রশ্ন ছিল: ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান (দ্বাদশ সংশোধন) বিল, ১৯৯১-এ রাষ্ট্রপতির সম্মতি দেওয়া উচিত কি না?’ সেই গণভোটে মোট ভোটারের শতকরা মাত্র ৩৫ ভাগ অংশ নেন। অথচ তার কয়েক মাস আগে ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে ৫৫ ভাগের বেশি ভোটার ভোট দেন।

আরও পড়ুনযাঁরা গণভোট দেবেন তাঁরা গণভোট নিয়ে কতটা জানেন১০ অক্টোবর ২০২৫

এবার জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে গণভোট হওয়ার কারণে ভোটারের উপস্থিতি অনেক বেশি হবে বলেই ধারণা করা যায়। কিন্তু ভাষাগত ও ধারণাগত অস্পষ্টতার কারণে জনগণকে হয়তো ভোটদানে বিরত থাকতে হবে কিংবা রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে তাকিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আগের গণভোটের প্রশ্নের ভাষাও জটিল ছিল, কিন্তু প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল অভিন্ন মত প্রকাশ করার কারণে সাধারণ মানুষকে সিদ্ধান্ত নিতে বেগ পেতে হয়নি।

কেউ কেউ বলছেন, পদ্ধতিগতভাবেও এবারের গণভোটে সমস্যা আছে। চারটি বিষয়ের জন্য একটি প্রশ্নে হ্যাঁ বা না ভোট দেওয়ার ব্যাপারটি যথেষ্ট যৌক্তিক নয়। কারণ, প্রতিটি প্রশ্নের জন্য ব্যক্তির আলাদা সিদ্ধান্ত থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি প্রশ্নের ডানে আলাদা করে হ্যাঁ/না ভোট দেওয়ার জন্য চারটি বাক্স বা ঘর রাখা যেতে পারে, যাতে একজন ভোটার প্রশ্ন অনুযায়ী আলাদাভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। দ্রুত ফল গণনার জন্য এ প্রশ্নের কাগজটিও মেশিন রিডেবল বা যন্ত্রে পাঠযোগ্য করতে হবে। তবে বিপুলসংখ্যক ভোটার নিরক্ষর ও স্বল্পশিক্ষিত হওয়ার কারণে এই পদ্ধতিও ঠিকমতো কাজ করবে না।

সাধারণ মানুষের কাছে পুরো বিষয় স্পষ্ট ও বোধগম্য করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে গণভোটের প্রশ্নের এবং জুলাই জাতীয় সনদের ব্যাখ্যামূলক প্রচারণা চালানো উচিত। রাজনৈতিক দলগুলোরও দায়িত্ব নির্বাচনী প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নের বিষয় এবং জুলাই সনদের ব্যাপারে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করা। সাধারণ মানুষ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত হয়তো দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত হবেন, কিন্তু তাঁরা অন্তত আশ্বস্ত হতে পারবেন, সংবিধান সংশোধনে তাঁদের মতামত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত ক দল প রস ত ব হওয় র ক সদস য র প রব ন ন র জন ভ ষ গত র জন য দলগ ল সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ধনী ও ক্ষমতাবানেরা কেন কুখ্যাত এপস্টেইনকে এড়িয়ে চলতে পারতেন না

২০১৯ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাবেক আইনজীবী মাইকেল কোহেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে পর্নো তারকাকে অবৈধভাবে অর্থ দেওয়ার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের একটি কমিটির সামনে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। সে বছর এটি ছিল ব্যাপক আলোচিত এক ঘটনা।

মাইকেল কোহেন যখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছিলেন, তখন সবার নজর ছিল তাঁর দিকে।

ওই কমিটির ডেমোক্র্যাট সদস্য স্টেসি প্লাস্কেট আইনজীবী কোহেনকে প্রশ্ন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময় একটি ক্যামেরায় দেখা যায়, প্লাস্কেট ফোনে কাউকে খুদে বার্তা পাঠাচ্ছেন।

সেদিন প্লাস্কেট আসলে কাকে খুদে বার্তা পাঠিয়েছিলেন? চলতি সপ্তাহে সেই সত্য সামনে এল। অপর প্রান্তের সেই মানুষটি ছিলেন যৌন নিপীড়নের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত জেফরি এপস্টেইন।

আদালতের নির্দেশে জনসমক্ষে আনা ই–মেইলগুলো থেকে জানা যায়, স্টেসি প্লাস্কেটকে এপস্টেইন বলেছিলেন, তিনি যাতে কোহেনকে ট্রাম্পের প্রতিষ্ঠানের এক কর্মীর ব্যাপারে প্রশ্ন করেন। কথামতো সেই প্রশ্নই করেন প্লাস্কেট। এরপর এপস্টেইন তাঁকে আরেকটি বার্তায় লিখেন, ‘দারুণ!’

এপস্টেইনের প্রভাব কত দূর বিস্তৃত ছিল

এই ঘটনা ইঙ্গিত দেয়, যুক্তরাষ্ট্রের অভিজাত মহলে এপস্টেইনের প্রভাব কতটা বেশি ছিল।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জের প্রতিনিধি প্লাস্কেট এপস্টেইনের কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়ার কথা অস্বীকার করে বলেছেন, সেদিন তিনি অনেক মানুষকে খুদে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। এপস্টেইনও তাঁদের একজন। এপস্টেইন প্লাস্কেটের নির্বাচনী এলাকার ভোটার ছিলেন।

সাবেক আইনজীবী হিসেবে স্টেসি প্লাস্কেট বলেন, তিনি সব সূত্র থেকেই তথ্য নেন, এমনকি যাঁদের তিনি পছন্দ করেন না, তাঁদের কাছ থেকেও।

প্লাস্কেট বিবিসিকে বলেন, ‘এপস্টেইনের বিকৃত আচরণের কারণে আমি তাঁকে ঘৃণা করি। তাঁর অপকর্মের ভুক্তভোগীদের প্রতি আমি দৃঢ় সমর্থন জানাই ও তাঁদের সাহসের প্রশংসা করি। এপস্টেইনের সম্পূর্ণ নথি প্রকাশ করার বিষয়টিকে আমি দীর্ঘদিন ধরেই সমর্থন দিয়ে আসছি।

যৌন নিপীড়ক ও নারী পাচারকারী জেফরি এপস্টেইনের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালে ফ্লোরিডা পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন এক নারী। এরপর গোয়েন্দারা তদন্ত করতে গিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে আরও অনেক নারীকে যৌন হয়রানি করার তথ্য পান। এপস্টেইন ২০০৮ সালে পতিতাবৃত্তির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন এবং তাঁকে সাজা দেওয়া হয়।

মিয়ামি হেরাল্ডের এক বছর আগের অনুসন্ধানে এপস্টেইনের যুক্তরাষ্ট্রের ব্যক্তিগত দ্বীপটির কথা উল্লেখ ছিল, যেখানে তিনি বহু অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীকে যৌন নির্যাতন করেছিলেন।

স্টেসি প্লাস্কেটের সঙ্গে ওই বার্তালাপের মাত্র ছয় মাস পর ২০১৯ সালের ১০ আগস্ট এপস্টেইন কারাগারে মারা যান। স্বাস্থ্য পরীক্ষকদের মতে, তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন।

এপস্টেইনের মৃত্যু ও তাঁকে নিয়ে ছড়ানো নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ওয়াশিংটন ও ওয়াল স্ট্রিটে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। এর ফলে তাঁর বহু পুরোনো প্রভাবশালী বন্ধু রাজনৈতিক-সামাজিকভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়েন।

যৌন নিপীড়ক ও নারী পাচারকারী জেফরি এপস্টেইনের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালে ফ্লোরিডা পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন এক নারী। এরপর গোয়েন্দারা তদন্ত করতে গিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে আরও অনেক নারীকে যৌন হয়রানি করার তথ্য পান। এপস্টেইন ২০০৮ সালে পতিতাবৃত্তির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন এবং তাঁকে সাজা দেওয়া হয়।

সম্প্রতি এপস্টেইনের প্রায় ২০ হাজার পৃষ্ঠার ব্যক্তিগত নথি প্রকাশ করা হয়। ওই নথিতে বহু ঘটনার মধ্যে স্টেসি প্লাস্কেটের সঙ্গে ওই বার্তালাপের কথাও উল্লেখ ছিল। এ থেকে আরও ভালোভাবে বোঝা যায়, অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়া এবং হেরাল্ডে প্রতিবেদন প্রকাশের পরও এপস্টেইনের অভিজাত মহলে সম্পর্ক বজায় রাখার সক্ষমতা কত বেশি ছিল।

অভিজাত সমাজে এপস্টেইনের এই সম্পর্কগুলো কেন ও কীভাবে টিকে ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ‘দ্য স্পাইডার: ইনসাইড দ্য ক্রিমিনাল ওয়েব অব জেফরি এপস্টেইন অ্যান্ড গিসলেইন ম্যাক্সওয়েল’ বইয়ের লেখক ব্যারি লেভিন বলেন, এপস্টেইন ছিলেন একজন পৈশাচিক দানব। তবে অসাধারণ মেধার কারণে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর কিছু মানুষের সঙ্গে তিনি অবিশ্বাস্য নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পেরেছিলেন।

মানুষকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট ও বিমোহিত করার এক অসাধারণ ক্ষমতা ছিল এপস্টেইনের।

আরও পড়ুনএপস্টেইনের যৌন কেলেঙ্কারির নথিতে স্টিফেন হকিংয়ের নামও আছে০৭ জানুয়ারি ২০২৪

তথ্য যখন হাতিয়ার

লেখক ব্যারি লেভিন বলেন, এপস্টেইন নিজেকে একজন ‘মানুষ সংগ্রাহক’ বলে মনে করতেন। তিনি আর্থিক লেনদেনের উদ্দেশ্যে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক করতেন। তিনি যাঁদের সম্পর্কে তথ্য পেতেন, তাঁদের অনুগ্রহ লাভ, অর্থ আদায় এমনকি ব্ল্যাকমেল করতে সেসব তথ্য ব্যবহার করতেন।

যুক্তরাষ্ট্রে যুক্তরাজ্যের সদ্য সাবেক রাষ্ট্রদূত পিটার ম্যান্ডেলসনের সঙ্গে এপস্টেইনের সম্পর্কের বিষয়টি বিশেষভাবে খতিয়ে দেখছে কিয়ার স্টারমার সরকার। এপস্টেইনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার তথ্য সামনে আনা কিছু ই–মেইল ফাঁস হওয়ার পর তাঁকে গত সেপ্টেম্বরে বরখাস্ত করা হয়েছে।

ই–মেইলগুলোয় দেখা গেছে, ম্যান্ডেলসন ২০১৬ সালের শেষ পর্যন্ত এপস্টেইনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন, যা মায়ামি হেরাল্ডের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের আগে ও এপস্টেইন দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরের ঘটনা।

মানুষকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট ও বিমোহিত করার এক অসাধারণ ক্ষমতা ছিল এপস্টেইনের।

২০১৫ সালের নভেম্বরে ম্যান্ডেলসনকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে একটি ই–মেইল করেন এপস্টেইন। ম্যান্ডেলসন ৯০ মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে সেই ই–মেইলের উত্তর দেন।

তবে ম্যান্ডেলসন দাবি করেছেন, তিনি এপস্টেইনের কোনো অপরাধের ব্যাপারে জানতেন না। তাঁর সঙ্গে অব্যাহত যোগাযোগ রাখায় তিনি অনুতাপও প্রকাশ করেছেন।

আরও পড়ুনজেফরি এপস্টেইনের ব্যক্তিগত ইমেইলে একাধিকবার ট্রাম্পের নাম১২ নভেম্বর ২০২৫

পণ্ডিত, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সম্পর্ক

এপস্টেইনের ব্যক্তিগত নথিগুলোয় দেখা গেছে, তিনি কীভাবে পণ্ডিত, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সুসম্পর্কের মাধ্যমে বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন।

ব্যারি লেভিন বলেছেন, এটা বললে ভুল হবে না যে এপস্টেইনের সঙ্গে যেসব সাধারণ মানুষের পরিচয় ছিল, তাঁরা তাঁর যৌন নিপীড়ন কিংবা অপরাধের বিষয়ে জানতেন না। অথবা প্রভাবশালী মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় তাঁর প্রতি এতটাই মুগ্ধ ছিলেন, বিষয়টি পুরোপুরি এড়িয়ে গেছেন।

ব্যারি লেভিন আরও বলেন, মানুষ অনেক কিছুই ভুলে যায়। ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের কাছে তিনি অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য মানুষ ছিলেন। অনেকে সম্ভবত তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সত্য নয় বলেই ধরে নিয়েছিলেন। এ ছাড়া যাঁরা তাঁকে চিনতেন, তাঁরা ইঙ্গিত দিয়েছেন, কেউ কেউ হয়তো তাঁর প্রাচুর্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক অর্থমন্ত্রী ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি ল্যারি সামারস পর্যন্ত এপস্টেইনের কাছে প্রেম-সম্পর্কিত পরামর্শ চাইতেন। এমনকি ২০১৮ সালের নভেম্বরেও তিনি এক নারীর পাঠানো ই–মেইল এপস্টেইনের কাছে ফরওয়ার্ড করে জানতে চেয়েছিলেন, কীভাবে ওই ই–মেইলের উত্তর দেওয়া উচিত।

জবাবে এপস্টেইন বলেছিলেন, ‘মেয়েটি ইতিমধ্যেই আপনার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে, এটা ভালো।’

এপস্টেইনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা সামারসের জন্য এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। গত সপ্তাহে তিনি ঘোষণা দেন, হার্ভার্ডে ক্লাস নেওয়া ও জনসমক্ষে অন্যান্য কার্যক্রম থেকে বিরত থাকবেন তিনি।

আরও পড়ুনকুখ্যাত যৌন নিপীড়ক এপস্টেইন-সম্পর্কিত নথি প্রকাশের বিলে কংগ্রেসের অনুমোদন১৯ নভেম্বর ২০২৫

ল্যারি সামারস বলেন, ‘আমি আমার কাজের জন্য গভীরভাবে লজ্জিত এবং স্বীকার করছি যে এগুলো বহু মানুষের কষ্টের কারণ হয়েছে।’

এপস্টেইনের অর্থসম্পদ ব্যবস্থাপনার দক্ষতার মধ্য দিয়ে নোয়াম চমস্কিকেও সাহায্য করেছিলেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে। বিখ্যাত এই ভাষাতাত্ত্বিকের সঙ্গে বহু বছর ধরে তাঁর বার্তা আদান-প্রদান হয়েছিল। এমনকি এপস্টেইন তাঁকে নিজের বাড়িতেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এমনকি একজন আরেকজনের প্রশংসাও করেছিলেন।

প্রকাশিত নথিতে দেখা গেছে, এক ই–মেইলে নোয়াম চমস্কি লিখেছিলেন, তাঁর সঙ্গে এপস্টেইনের অনেক দীর্ঘ ও গভীর আলাপ হয়েছে।

চমস্কি পরে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে জানান, এপস্টেইন তাঁকে কয়েকটি অ্যাকাউন্টে অর্থ স্থানান্তরে সাহায্য করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি তাঁকে চিনতাম এবং মাঝেমধ্যে দেখা হতো।’

এপস্টেইনের মৃত্যু ও তাঁকে নিয়ে ছড়ানো নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ওয়াশিংটন ও ওয়াল স্ট্রিটে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। এর ফলে তাঁর বহু পুরোনো প্রভাবশালী বন্ধু রাজনৈতিক-সামাজিকভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়েন।

চমস্কি আরও বলেন, জেফরি এপস্টেইনের সম্পর্কে যেসব তথ্য তাঁর জানা ছিল, তা হলো তিনি একটি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন এবং শাস্তি ভোগ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের আইন ও প্রচলিত মানদণ্ড অনুযায়ী, এরপর একজন মানুষকে নতুনভাবে জীবন শুরু করার সুযোগ দেওয়া হয়।

তবে এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য বিবিসির অনুরোধে সাড়া দেননি চমস্কি।

ব্যারি লেভিনের মতে, চমস্কি এপস্টেইনের বিখ্যাত আর্থিক পরিষেবা গ্রাহকদের একজন ছিলেন। এপস্টেইন তাঁর অনেক ক্লায়েন্টকে এমনভাবে সাহায্য করেছিলেন যে তাঁরা কয়েক বিলিয়ন ডলার সঞ্চয় করতে পেরেছিলেন। এ ধরনের অর্থনৈতিক পরামর্শ ও সাহায্য দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

লেভিন আরও বলেন, এপস্টেইন সফলভাবে এটি করতে পারতেন। কারণ, তিনি করনীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে এমন গভীর জ্ঞান রাখতেন, যা হয়তো ওয়াল স্ট্রিটের সবচেয়ে বেশি বেতনভোগী পেশাজীবীদের চেয়েও ভালো ছিল।

যিনি সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন

এপস্টেইনের প্রায় ২৩ হাজার পৃষ্ঠার নথিতে এক ব্যক্তির নাম বারবার উঠে এসেছে, তিনি হলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে ট্রাম্প ও এপস্টেইনের মধ্যে কোনো বার্তা আদান-প্রদানের তথ্য পাওয়া যায়নি। কারণ, তিনি অনেক আগেই এপস্টেইনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন।

২০০২ সালে ট্রাম্প এপস্টেইনকে ‘একজন চমৎকার মানুষ’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। এপস্টেইনও পরে মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমার সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ১০ বছরের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল।’

তবে দুজনের এই সম্পর্ক দ্রুতই তিক্ত হয়ে ওঠে। ট্রাম্প বলেছেন, এপস্টেইন গ্রেপ্তার হওয়ার দুই বছর আগেই তাঁর সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল ধরে। ২০০৮ সালে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আমি তাঁর ভক্ত ছিলাম না।’

ডোনাল্ড ট্রাম্প স্পষ্টভাবে বলেছেন, তিনি এপস্টেইনের যৌন নিপীড়নের বিষয়ে কিছুই জানতেন না। হোয়াইট হাউসও জানিয়েছে, ট্রাম্প বহু বছর আগে এপস্টেইনকে তাঁর ক্লাব থেকে বের করে দিয়েছিলেন। কারণ, তিনি নারী কর্মীদের সঙ্গে বাজে আচরণ করতেন।

আরও পড়ুনএপস্টেইনের নথি প্রকাশের পক্ষে হঠাৎ কেন অবস্থান নিলেন ট্রাম্প১৭ নভেম্বর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ