—এখন বাজারের হালকা প্রকৌশল পণ্যের অর্ধেকের বেশি দেশি
— বর্তমানে ১ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি, ২০৩০ সালে লক্ষ্য ১২ বিলয়নের
— খাতের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশ
— চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি লক্ষ্য অর্জনে দ্রুত নীতি বাস্তবায়ন প্রয়োজন

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে চিহ্নিত সম্ভাবনাময় খাত হালকা প্রকৌশলশিল্প। বিনিয়োগ ও রপ্তানিবৈচিত্র্যের জন্য খাতটিকে সরকারও অগ্রাধিকার দিচ্ছে। একসময় কৃষি, প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন খাতের যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশের বড় অংশই আমদানিনির্ভর ছিল। এখন অর্ধেকের বেশি উৎপাদিত হচ্ছে দেশেই। নতুন নতুন বিনিয়োগ করছে বড় বড় প্রতিষ্ঠানও।

খাত–সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা জানান, দেশে হালকা প্রকৌশল খাতের বার্ষিক বাজার ৮২০ কোটি মার্কিন ডলারের। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক সরবরাহ করছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। এ খাতে ছোট-মাঝারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৮০ হাজারের বেশি। এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন ১০ লাখ মানুষ। তারা ৩ হাজার ৮০০টির বেশি যন্ত্রপাতি, খুচরা যন্ত্রাংশ ও আনুষঙ্গিক পণ্য তৈরি করছে।

জানা যায়, দেশে তৈরি পণ্যের মধ্যে অটোমোবাইল ও রেলওয়ের খুচরা যন্ত্রাংশ, কৃষি যন্ত্রপাতি, সামুদ্রিক ও নৌপরিবহনের উপকরণ, বাতি-ফ্যানসহ বৈদ্যুতিক পণ্য, ইলেকট্রনিকস, চিকিৎসা সরঞ্জাম, গৃহস্থালি সামগ্রী, পানির পাম্পসহ স্যানিটারি সরঞ্জাম ও ফিটিংস, হার্ডওয়্যার সরঞ্জাম, টেক্সটাইল, প্লাস্টিক, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও রাসায়নিক শিল্পের সরঞ্জাম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি মো.

আবদুর রাজ্জাক বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে হালকা প্রকৌশল খাত ধীরগতিতে এগোচ্ছে। নির্বাচনের পর স্থিতিশীলতা ফিরলে এই খাতের গতিও ফিরবে বলে প্রত্যাশা তাঁর। তিনি আরও বলেন, এই খাতকে সরকার অগ্রাধিকার খাত হিসেবে ঘোষণা দিলেও সুযোগ-সুবিধা সেভাবে দেয়নি। খাতটি যত দূর এগিয়েছে, তার পুরোটাই দেশি উদ্যোক্তাদের প্রচেষ্টায়। সরকার হালকা প্রকৌশল খাত উন্নয়নে নীতি করলেও তা বাস্তবায়ন করেনি। এই নীতি বাস্তবায়িত হলে খাতটির রপ্তানি বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

রপ্তানির বড় সম্ভাবনা
হালকা প্রকৌশল খাতের বৈশ্বিক বাজার ৮ লাখ কোটি মার্কিন ডলার। এই বাজারে বাংলাদেশের হিস্যা খুবই কম। গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে হালকা প্রকৌশল খাতের রপ্তানি ছিল ৫৪ কোটি ডলারের। এই রপ্তানি তার আগের অর্থবছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি। সামনের দিনগুলোতে রপ্তানি আরও বাড়বে—এমনটাই বলছেন উদ্যোক্তারা।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১৭ কোটি ডলারের বৈদ্যুতিক পণ্য, ১২ কোটি ডলারের বাইসাইকেল, ৭ কোটি ডলারের ইস্পাত, ৫ কোটি ডলারের প্রকৌশল সরঞ্জাম, ৬ কোটি ডলারের কপার তার ইত্যাদি পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এসব পণ্যের মধ্যে বাইসাইকেল রপ্তানিতে ৪১ ও বৈদ্যুতিক পণ্যে ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

হালকা প্রকৌশল খাত নিয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের হালকা প্রকৌশল পণ্য জাপান, নেদারল্যান্ডস, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, যুক্তরাজ্য, থাইল্যান্ড, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। অধিকাংশ দেশে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার, কম উৎপাদন খরচ, নগদ প্রণোদনা, কর অবকাশ ও অবকাঠামোগত সহায়তার মতো প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা থাকায় এই খাত অন্যতম রপ্তানি শক্তি হিসেবে গড়ে উঠছে।

দ্রুত বর্ধনশীল অভ্যন্তরীণ ভিত্তি ও ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধির কারেণ এই শিল্প থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ১২ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার—এমনটাই বলা হয়েছে বিডার প্রতিবেদনে।

তৃতীয় শীর্ষ সম্ভাবনা
চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিডার করা এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ২৯টি খাতের মধ্যে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ সম্ভাবনা রয়েছে কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যে। দ্বিতীয় তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি)। আর তৃতীয় স্থানে রয়েছে হালকা প্রকৌশল ও ইলেকট্রনিক পণ্য। চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে হোম টেক্সটাইল।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হালকা প্রকৌশল খাতে বিদেশি বিনিয়োগ ন্যূনতম পর্যায়ে। বড় অংশই স্থানীয় বিনিয়োগ। দেশি বিনিয়োগে সেরা এই খাত তুলনামূলক সুবিধা পাওয়ার দিক থেকে সব খাতের চেয়ে পিছিয়ে আছে। তুলনামূলক সুবিধা পাওয়ার মান সূচকে শূন্য এই খাত। এ ছাড়া অগ্রগামী সংযোগে খাতটি তলানিতে। যদিও পশ্চাৎ সংযোগশিল্পে বেশ অগ্রগতি আছে। এই খাতে এসএমই অংশগ্রহণ অনেকটা ভালো অবস্থানে থাকেলেও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে পিছিয়ে আছে।

বিডার গবেষণার তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে এই খাতে বিনিয়োগ আছে শত বিলিয়ন ডলারের বেশি। দেশি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১১ হাজার ৬৮৪ কোটি ডলার, যা দেশি মুদ্রায় ৯ লাখ ৭ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকার বেশি। ২০১৫ থেকে পরবর্তী ৫ বছর এই খাতে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ।

গড়ে উঠছে শক্তিশালী ভিত্তি
ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, যশোর, গাজীপুর ও কিশোরগঞ্জে হালকা প্রকৌশল শিল্পের মূল কেন্দ্রবিন্দু। এসব এলাকাসহ ১৮টি জেলাজুড়ে ৩৪টি ক্লাস্টার নিয়ে গড়ে উঠছে হালকা প্রকৌশল খাত। এ ছাড়া মুন্সিগঞ্জে ৫০ একর এলাকা নিয়ে একটি নতুন শিল্পনগরী এবং নরসিংদী, ময়মনসিংহ, মদারীপুরসহ আরও পাঁচটি শিল্পপার্কের সক্ষমতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। এর বাইরে আকিজ রিসোর্সসহ কয়েকটি কোম্পানি বেসরকারি খাতেও শিল্প স্থাপন করছে।

এই খাতে দেশের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানির মধ্যে ওয়ালটন, ট্রান্সকম, এসিআই মটরস, রহিমআফরোজ, স্যামসাং, আরএফএল, পান্না, এলজি, সিঙ্গার বাংলাদেশ, অপোসহ বেশ কিছু কোম্পানি সুনামের সঙ্গে অর্জন করেছে। স্থানীয় বাজার চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি কিছু কোম্পানি রপ্তানিতে অবদান রাখছে।

নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদনে যাচ্ছে আকিজ রিসোর্স। প্রতিষ্ঠানটির জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক রাকিব আহসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগামী দুই বছরের মধ্যে দেশের হালকা প্রকৌশল খাতের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিগুলোর একটি হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে আকিজ রিসোর্স। এরই অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হিসেবে আকিজ লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের ব্র্যান্ড ‘ইনোভার’–এর মাধ্যমে ইলেকট্রিক্যাল খাতের আধুনিক প্রযুক্তির নতুন সব পণ্য উৎপাদনের প্রক্রিয়া চলছে।’

রাকিব আহসান আরও বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে ইলেক্ট্রিক্যাল সেক্টর নিয়ে বাজারে এলেও শিগগিরই ইলেকট্রনিক্স, হার্ডওয়্যার টুলস অ্যান্ড ওয়াটার পাম্প নিয়ে দেশব্যাপী যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছি আমরা। পাশাপাশি কারখানা স্থাপন করা হচ্ছে। কারখানা চালু হলে বছরে এক হাজার কোটি টাকার বেশি পণ্য বাজারে সরবরাহ করা সম্ভব হবে। আমাদের বিশ্বাস, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মিশেলে তৈরি ইনোভারের পণ্য ভোক্তাদের জন্যে এই ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন এক অভিজ্ঞতা নিয়ে আসবে।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: উদ য ক ত সরঞ জ ম এই খ ত লক ষ য র হ লক উৎপ দ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

১০ মাসে সাড়ে ২৮ লাখ কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করেছে চট্টগ্রাম বন্দর

চট্টগ্রাম বন্দর চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে সাড়ে ২৮ লাখের বেশি কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করেছে। পাশাপাশি বন্দরে কার্গো ও জাহাজ হ্যান্ডলিং বেড়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক।

বন্দর সূত্র জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে ২৮ লাখ ৪৯ হাজার ৫৪২ টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। কার্গো হ্যান্ডলিং হয়েছে ১১ কোটি ৫০ লাখ ৬৭ হাজার ২০০ মেট্রিক টন। একই সময়ে জাহাজ হ্যান্ডলিং হয়েছে ৩ হাজার ৫৫২টি। 

আরো পড়ুন:

‘চট্টগ্রাম বন্দরের বর্ধিত ৪১ শতাংশ মাশুল স্থগিত করুন’

হিলি বন্দরে কাঁচা মরিচ আমদানিতে ১৯ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়

সূত্রটি জানায়, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় কন্টেইনার বেড়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩২৮ টিইইউএস। কার্গো বেড়েছে এক কোটি ২৯ লাখ ৮ হাজার ১৭৪ মেট্রিক টন। জাহাজ বেড়েছে ৩৫১টি। কনটেইনার হ্যান্ডলিং প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ। কার্গো প্রবৃদ্ধি ১২ দশমিক ৬৪ শতাংশ। জাহাজ প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ৯৭ শতাংশ।

বন্দরের পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত হ্যান্ডলিং হয়েছে ১২ লাখ ১৩ হাজার ৮০৫ টিইইউএস কন্টেইনার। কার্গো হ্যান্ডলিং হয়েছে চার কোটি ৫২ লাখ ৮২ হাজার ৯০৭ মেট্রিক টন। হ্যান্ডলিং হয়েছে এক হাজার ৪২২টি জাহাজ। 

আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কন্টেইনার বেড়েছে এক লাখ ১১ হাজার ৮৮৮ টিইইউএস। কার্গো বেড়েছে ৬১ লাখ ৬৬ হাজার ৪০৫ মেট্রিক টন। জাহাজ বেড়েছে ১৪১টি। প্রবৃদ্ধি হয়েছে কন্টেইনারে ১০ দশমিক ১৫ শতাংশ। কার্গোতে ১৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ। জাহাজে ১১ শতাংশ।

চট্টগ্রাম বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, “জাহাজের ওয়েটিং টাইম এখন উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। সেপ্টেম্বরে ৯ দিন, অক্টোবরে ১৮ দিন ও নভেম্বরে ১৯ দিন বন্দরে কোনো ওয়েটিং টাইম ছিল না। জাহাজ অন অ্যারাইভাল বার্থ পাচ্ছে। ফলে আমদানিকারকরা দ্রুত সময়ের মধ্যে পণ্য ডেলিভারি নিতে পারছেন। রপ্তানি পণ্যও সময়মতো জাহাজীকরণ হচ্ছে। ফলে পোর্ট লিড টাইম কমেছে।”

তিনি বলেন, “আধুনিক কার্গো কন্টেইনার হ্যান্ডলিং সরঞ্জাম যোগ হয়েছে। ইয়ার্ড ক্যাপাসিটি বেড়েছে। তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের পরিশ্রম এবং ব্যবহারকারীদের সহযোগিতায় কন্টেইনার হ্যান্ডলিং কার্যক্রমে প্রবৃদ্ধি বজায় আছে।”

ঢাকা/রেজাউল/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ১০ মাসে সাড়ে ২৮ লাখ কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করেছে চট্টগ্রাম বন্দর
  • বেতন-ভাতায় সরকারের খরচ বেড়েছে, উন্নয়নে কমেছে
  • নির্বাচনের খরচের ব্যাপারে চিন্তার কিছু নেই: অর্থ উপদেষ্টা
  • ৪ মাসে প্রকল্পের ১% টাকা খরচ করতে পারেনি ৫ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ
  • যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রপ্তানি কমলেও চীনে বেড়েছে, ট্রাম্পের শুল্কের প্রভাব