হতাশায় ডুবে থাকলে সম্ভাবনা দেখা যায় না
Published: 26th, November 2025 GMT
দৃঢ় মনোবল আর প্রচেষ্টা থাকলে কোনো বাধা পেরোনোই কঠিন নয়। দরকার ইচ্ছাশক্তি, আত্মবিশ্বাস আর কঠোর পরিশ্রম। আমাদের আশপাশে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নিজেদের জীবনগাথায় লিখে চলেছেন অদম্য জয়ের গল্প। তাঁদের সেই সাফল্য ব্যক্তিগত অর্জনের সীমানা পেরিয়ে সমাজের নানাবিধ প্রতিবন্ধকতাকেও চ্যালেঞ্জ করেছে। তেমনই কয়েকজনের গল্প নিয়ে ধারাবাহিক এ আয়োজন। আজ জানব ময়মনসিংহের অজপাড়াগাঁয়ের বাসিন্দা মাজিদা বেগম–এর জীবনগল্প।
আমি মাজিদা বেগম। আমার জন্ম ময়মনসিংহের একটি অজপাড়ায়। দরিদ্র পরিবারে বেড়ে উঠেছি। সংসারে অভাব থাকলেও মা-বাবা আমার লেখাপড়া বন্ধ করেননি। মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করার পর প্রতিবেশীরা আমার বাবাকে বলেছিলেন, ‘মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন।’ বাবা শোনেননি তাঁদের কথা।
এরপর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করার পর পড়শিরা আমাকে উৎসাহ দেওয়া তো দূরে থাক, উল্টো আমার বাবাকে নানা নেতিবাচক কথা বলতে শুরু করেন। যেমন মেয়েদের এত লেখাপড়া করে কী হবে? এখনই বিয়ের উপযুক্ত সময়, মেয়ের বিয়ে দিয়ে ভারমুক্ত থাকেন ইত্যাদি। তবে এসব কথায় বাবা কখনো দমে যাননি। সবাইকে তিনি শুধু একটা কথাই বলতেন, ‘মেয়েরাও অনেক দূর যেতে পারে। যতটুকু সামর্থ্য হয়, আমি আমার মেয়েকে লেখাপড়া করাব।’
আমি ময়মনসিংহের গৌরিপুর সরকারি কলেজ থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করি। রেজাল্ট ভালোই হয়। কিন্তু লেখাপড়া শেষ করে কোনো চাকরি পাচ্ছিলাম না। পরিবার থেকে হাতখরচ নিতে ইচ্ছা করত না। তাই স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য টিউশনি শুরু করি। এরই মধ্যে আমার বিয়ে হয়।
জীবনের নতুন অধ্যায়ের আড়ালেও আমি স্বপ্ন দেখতে ভুলিনি। কিছু একটা করার সংকল্পে সব সময় বিভোর থাকতাম। কিন্তু কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সত্যি বলতে, মফস্সল এলাকায় নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ অনেক কম। নানা রকম হতাশা এসে ভিড় করে। আমি বিকল্প পথের সন্ধানে সচেষ্ট থাকি। অবশেষে স্বামীর কর্মসূত্রে গাজীপুর চলে আসি। এখানেও চাকরির সুযোগ খুঁজি, পাই না।
গাজীপুর এলাকায় অনেক রপ্তানিমুখী পোশাকের কারখানা। স্বামীসহ অনেকেই আমাকে গার্মেন্টসের কাজে যোগ দিতে বলে। আমি রাজি হইনি। এত দূর লেখাপড়া করে গার্মেন্টসে চাকরি করব? মন থেকে মেনে নিতে পারছিলাম না। এ ছাড়া এই সেক্টর নিয়ে আমার কোনো ধারণা ছিল না।
তৈরি পোশাক কারখানায় নারীদের জন্য সেলাই ছাড়াও যে বৈচিত্র্যময় নানা কাজ আছে, তা আমার জানা ছিল না। শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি আইরিশ গার্মেন্টস লিমিটেডে ‘কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর’ হিসেবে যোগদান করি।
কিছুদিন যাওয়ার পরই আমি কাজটাকে ভালোবাসতে শুরু করি। কোয়ালিটি বিভাগের দায়িত্ব বুঝতে শুরু করি। একটি পোশাক রপ্তানির পেছনে অনেক ধাপ কাজ করে। প্রতিটি ধাপে কোয়ালিটি চেক জরুরি, যেখানে দেশ ও প্রতিষ্ঠানের সুনাম জড়িত। ধীরে ধীরে কাজের প্রতি আমার মনোযোগ বাড়তে থাকে।
কিন্তু আবার ভেতরে ভেতরে পরিবর্তনের পথও খুঁজতে থাকি। বিষয়টা আমার সিনিয়রদের নজরে আসে। অবশেষে আলোর বার্তা এল। ব্র্যাকের ‘লিডারশিপ অ্যান্ড সফট স্কিলস প্রোগ্রামে’ প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত হলাম। তখনো আমি এই প্রশিক্ষণ বিষয়ে কিছুই জানতাম না। কিন্তু কয়েকটা সেশন যাওয়ার পর আমার ভেতর বিশাল পরিবর্তন এল। যেন নিজেকে খুঁজে পেলাম। নিজের হারানো কণ্ঠস্বর ফিরে পেলাম। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে শিখলাম। আমি কাজের বা দায়িত্বের নতুন ভাষা শিখলাম। আমার সব সংকোচ আর জড়তা কেটে গেল। সহকর্মীদের সঙ্গে অনেক সহমর্মিতা নিয়ে কথা বলতে লাগলাম।
আমাদের কাজে ডেডলাইনের (সময়সীমা) কারণে অনেক চাপ থাকে। কিন্তু কীভাবে নিজেকে শান্ত রেখে চাপমুক্ত রাখতে হয়, তা শিখলাম এবং কাজের ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করা শুরু করলাম। কর্মক্ষেত্রে চাপমুক্ত থাকতে শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম শেখানো হয়। রেগে গেলে কীভাবে নিজেকে শান্ত রাখতে হয়, তা শিখলাম। অনেক সময় অনেকগুলো কাজ চলে আসে, কিন্তু কোনটা আগে গুরুত্ব দেব, তা বুঝতে পারতাম না। এখন সহজেই বুঝি।
সিনিয়রদের সঙ্গে কথা বলতে ভয় লাগত, সেটিও এখন কেটে গেছে। সহকর্মীদের সঙ্গেও কথা গুছিয়ে বলতে পারতাম না। প্রশিক্ষণের পর সেটাও পারলাম। বুঝলাম, স্পষ্ট করে কথা বলা একজন মানুষের অনেক বড় শক্তি। সহকর্মীদের সঙ্গে একটু দরদ দিয়ে কথা বললে ফলাফল অনেক ভালো হয়। সব মিলিয়ে ব্র্যাক থেকে নেওয়া প্রশিক্ষণ আমার মধ্যে জাদুর মতো কাজ করল, বলতে গেলে আমার জীবন বদলে দিল।
একসময় প্রমোশন পেয়ে আমি ‘কোয়ালিটি অডিটর’ হই। হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস ফিরে পাই। আমার সহকর্মী আর সিনিয়রদের সঙ্গে আগের চেয়ে পেশাগত সম্পর্ক অনেক মজবুত হয়, যা আমার পারিবারিক জীবনেও প্রভাব ফেলে। এখন সংসারটাকে আগের চেয়ে অনেক গুছিয়ে রাখার চেষ্টা করি।
মাজিদা বেগম এখন গাজীপুরের আইরিশ গার্মেন্টস লিমিটেডে কোয়ালিটি অডিটর হিসেবে কাজ করছেন.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ র ম ন টস সহকর ম
এছাড়াও পড়ুন:
সম–অধিকারের ভিত্তিতে রাজনৈতিক সমঝোতা করতে চাইলে স্বাগত জানাই: মামুনুল হক
খেলাফত মজলিসের আমির মামুনুল হক বলেছেন, ‘আমাদের অনেকে অফার করেছিল যে তোমরা লভ্যাংশ নিয়ে যাও; মালিকানা দাবি কইরো না। আমরা বলেছি, লভ্যাংশ নয়; আমরা বাংলাদেশের মানুষের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রের মালিকানা চাই। তারা আমাদের লভ্যাংশ দিতে চায়। আমরা বলেছি, ২৫ শতাংশ লভ্যাংশ চাই না; ১০ শতাংশের মালিকানা চাই।’
ময়মনসিংহ নগরের রেলওয়ে কৃষ্ণচূড়া চত্বরে গতকাল মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে দলটির ময়মনসিংহ মহানগর ও সদর উপজেলা শাখার উদ্যোগে নির্বাচনী গণসমাবেশে এ কথা বলেন মামুনুল হক।
ভিক্ষার নয়, অংশীদারত্ব ও মালিকানার রাজনীতি করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে খেলাফত মজলিসের আমির বলেন, ‘অনেকেই মনে করেছিলেন, আমরা হয়তো বড় বড় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব, সংসদ সদস্যপদ বা রাষ্ট্রীয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্তি নিশ্চিত করব। আমরা সে পথে না হাঁটায় অনেকে মর্মাহত ও বিস্মিত হয়েছেন। আমি বলতে চাই, বাংলাদেশে ইসলামপন্থীরা অন্যের ওপর নির্ভর করে রাজনীতি করতে চায় না।’
মামুনুল হক আরও বলেন, ‘আমরা চাই নিজের পায়ে স্বাধীন বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে মালিকানাসূত্রে রাজনীতি করব। যদি কেউ সম–অধিকারের ভিত্তিতে আমাদের সঙ্গে আলাপ–আলোচনা করে, রাজনৈতিক সমঝোতা করতে চায়, তাহলে স্বাগত জানাই। ভিক্ষার থলি ধরে কেউ আমাদের দিকে হাত বাড়ালে ধিক্কার জানাই, ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি।’
শেখ হাসিনার পরিণাম থেকে শিক্ষা নেওয়ার তাগিদ জানিয়ে মামুনুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশে যদি কেউ ফ্যাসিবাদের মতো চলতে চেষ্টা করে, তাঁর পরিণাম শেখ হাসিনার থেকেও ভয়াবহ হবে ইনশা আল্লাহ। সবাইকে হুঁশিয়ার করি, বাংলার মাটিতে ফ্যাসিবাদী সাজতে যাইয়েন না। মানুষ যদি একবার ক্ষিপ্ত হয়, তাহলে খুব খতরনাক হয়ে যায়। ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন যে কেউ দেখতে পারেন, কিন্তু ফ্যাসিবাদী হওয়ার চিন্তাও করবেন না, স্বপ্নও দেখবেন না, খবরদার!’
মামুনুল হক বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশে প্রতিটি রাজনৈতিক পক্ষকে আহ্বান জানাই, যারা বিগত ফ্যাসিবাদী আমলে নিগৃহীত হয়েছেন, জুলুমের শিকার হয়েছেন, জুলাই বিপ্লবের অংশীজন, আসুন এক টেবিলে বসি; অংশীদারত্বের ভিত্তিতে বাংলাদেশকে পরিচালিত করি। অন্য সবাইকে বাদ দিয়ে যদি শুধু একদলীয় কায়দায় আবার বাকশালি ব্যবস্থা বাস্তবায়নের চেষ্টা চলে, তাহলে আবার জুলাই হবে, শাপলা চত্বর হবে।’
গণসমাবেশে সভাপতিত্ব করেন খেলাফত মজলিসের ময়মনসিংহ মহানগর শাখার সভাপতি মুফতি আবদুস সালাম। এ ছাড়া বক্তব্য দেন ময়মনসিংহ-৪ (সদর) আসনে দলটির প্রার্থী মুফতি কাজী মোশতাক আহমাদ ফারুকী, দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব আতাউল্লাহ আমীন, যুগ্ম মহাসচিব আবদুল আজিজ, কেন্দ্রীয় বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হেদায়েতুল্লাহ হাদী, কেন্দ্রীয় বায়তুলমাল সম্পাদক ফজলুর রহমান প্রমুখ। এর আগে জেলার নান্দাইল ও গৌরীপুরের নির্বাচনী গণসমাবেশে বক্তব্য দেন মামুনুল হক।