আদমশুমারি করতে গিয়ে হামলার শিকার- ২০২৪ সালে এমন পরিস্থিতিই দেখা গেছে মিয়ানমারে। গত বছর অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে বারংবার বিদ্রোহীদের কবলে পড়েন আদমশুমারি কর্মী এবং তাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সেনা কর্মীরা। শেষমেশ এই আদমশুমারি অনেকাংশেই ব্যর্থ হয় বলে দাবি করেন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মিয়ানমার উপদেষ্টা রিচার্ড হর্সি। তবে আদমশুমারির সাফল্য দাবিতে পঞ্চমুখ জান্তা সরকার। 

বিশ্বের যে কোনো রাষ্ট্রের জন্য আদমশুমারি খুবই সাদামাটা একটি ঘটনা। রাষ্ট্র সচল রাখতে একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর আদমশুমারি করতেই হয়, এর তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই। কিন্তু বছরের পর বছর গৃহযুদ্ধে পর্যদুস্ত মিয়ানমারের জন্য এই আদমশুমারির অন্যরকম একটা গুরুত্ব রয়েছে। মূলত দেশে একটি নির্বাচন পরিচালনা করার আগের ধাপ হিসেবে এই আদমশুমারি করায় জান্তা সরকার। 
চার বছর আগে মিয়ানমারের নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসে জান্তা সরকার। এর মাধ্যমে দেশজুড়ে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। জান্তা সরকারের বিরোধীপক্ষ আশঙ্কা করছে, আগামী এই নির্বাচনের মাধ্যমে পাকাপোক্তভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টা করবে সামরিক জান্তা। 

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে যে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক জান্তা, তাদের একাংশ নিয়ে তৈরি হয়েছে ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট। তাদের মুখপাত্র জ কিঅ বলেন, "এই নির্বাচন হবে একটা প্রহসন, শুধুই লোক দেখানো।" 

আল জাজিরাকে তিনি বলেন, "সেনাবাহিনী আশা করছে এই প্রহসনের নির্বাচন করে কিছু দেশের চোখে তারা বৈধতা পাবে।.

.. কিন্তু এই নির্বাচন করে দেশে কোনো স্থিতিশীল পরিস্থিতি আসবে না। বরং আরও অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে, আরও বাড়বে সহিংসতা।"

নেই নির্ভরযোগ্য তথ্য
মিয়ানমারের জান্তা সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয় এবং বার বার জরুরি অবস্থার মেয়াদ বাড়ানো হয়। গত শুক্রবারে আবারও জরুরি অবস্থার মেয়াদ বাড়ানো হয়ে জুলাই ৩১ পর্যন্ত। সেনাবাহিনীর দাবি, দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার জন্য শান্তি ও স্থিতিশীলতা দরকার, তাই জরুরি অবস্থার মেয়াদ বাড়াচ্ছে তারা। 

শুধু তাই নয়, জান্তা সরকার দাবি করেছে ২০২০ সালে যে নির্বাচনের মাধ্যমে আগের সরকার ক্ষমতায় এসেছিল, সেই নির্বাচনের ভোটার তালিকা সঠিক ছিল না। ২০২৪ সালে আদমশুমারির মাধ্যমে তারা সঠি ভোটার তালিকা তৈরি করবে। 

মিয়ানমারের গনতন্ত্র ও মানবাধিকারভিত্তিক সংস্থা প্রগ্রেসিভ ভয়েজের প্রতিষ্ঠাতা খিন ওমার বলেন, "জান্তা কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য দেয়নি।... এই প্রহসনের আদমশুমারিতে বাদ গেছে বিপুল এলাকা, জনসংখ্যার বিশাল অংশ।" 

বিশেষ করে বিদ্রোহীদের কব্জায় থাকা এলাকাগুলো আদমশুমারি থেকে পুরোই বাদ গেছে। 

দেশটির অভিবাসন এবং জনসংখ্যা সংক্রান্ত মন্ত্রণালয় স্বীকার করেছে, মায়ানমারের মোট ৩৩০টি টাউনশিপের মাঝে মাত্র ১৪৫টি টাউনশিপের সম্পূর্ণ জনসংখ্যার আদমশুমারি করা সম্ভব হয়েছে। এ থেকে ধারণা করে নেওয়া যায়, বর্তমানে দেশটির অর্ধেকেরও কম অংশ শাসন করছে জান্তা সরকার। 

জান্তা সরকার দাবি করেছে আদমশুমারি সফল হয়েছে, দেশের মানুষ খুশিমনে এতে অংশ নিয়েছে, কিন্তু খিন ওমার বলেন, বাস্তব চিত্র পুরোই উল্টো। আদমশুমারি চলাকালীন কর্মীদের সাথে ছিল সশস্ত্র সেনা। অনেক সময়েই নাগরিকদের থেকে জোরপূর্বক ব্যক্তিগত তথ্য আদায় করা হয়েছে। 

এ বিষয়ে বারবার যোগাযোগ করা হলেও আল জাজিরাকে কোনো তথ্য দেয়নি মিয়ানমারের সেনা সরকার। 

অভূতপূর্ব সংকটে সেনাবাহিনী
জান্তা সরকার যতই গলাবাজি করুক না কেন, লাগাতার গৃহযুদ্ধে ইতোমধ্যেই দুর্বল হয়ে এসেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। বিশেষ করে ২০২৩ সালের শেষ থেকে বেশ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে সেনা সরকার। বিদ্রোহীদের হাতে চলে গেছে ৯১টি শহর এবং ১৬৭টি সেনা ঘাঁটি। 

শুধু তাই নয়, বিপুল পরিমাণ সেনা মনোবল হারিয়ে বাহিনী ত্যাগ করেছে। 

ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট মুখপাত্র জ কিঅ বলেন, মিয়ানমারের ইতিহাসে সেনাবাহিনী এখন সর্বোচ্চ দুর্বল অবস্থায় আছে।.... আমাদের প্রধান লক্ষ্য [২০২৫ সালে] হলো সেনাবাহিনীর একনায়কতন্ত্র নির্মূল করা।" 

এমন অবস্থায় নির্বাচনের চিন্তাকে আকাশকুসুম স্বপ্ন মনে করছেন জান্তা সরকারের সমালোচকরা।

তবে এ সরকার নির্বাচন দিয়েই ছাড়বে, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মিয়ানমার উপদেষ্টা রিচার্ড হর্সি মন্তব্য করেন। সরকারের ভেতর থেকেই ক্ষমতায় পটপরিবর্তনের চাপ আসছে। বর্তমান সরকারপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইংকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্ষমতায় চায় না কেউই। 

এদিকে নির্বাচন সামনে রেখে রদবদল আসছে মিয়ানমারের সরকারেও, জানা গেছে দেশটির সংবাদ সংস্থা ইরাবতি সূত্রে। তিনজন মন্ত্রীকে পদচ্যুত করা হয়েছে সম্প্রতিই। এছাড়া দপ্তর পাল্টেছেন আরও কয়েকজন। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মাঝেও রদবদল এসেছে। যেসব এলাকায় বিদ্রোহীরা তেমন সুবিধা করতে পারেনি, এমন কিছু এলাকার সেন কর্মকর্তাদের হয়েছে পদোন্নতি। অর্থাৎ কর্মকর্তাদের খুশি রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মিন অং হ্লাইং। 

এছাড়া জান্তা সরকারের পৃষ্ঠপোষক, চীনের পক্ষ থেকেও নির্বাচনের চাপ আসছে। 

"গণতান্ত্রিক নির্বাচন নিয়ে চীনের কোনো মাথাব্যথা নেই। তবে তারা  মিন অং হ্লাইংকে পছন্দ করে না। নির্বাচনের মাধ্যমে তার ক্ষমতার পরিধি কমে আসবে বলে আশা করছে চীন," হর্সি বলেন। 

এই নির্বাচনের বিরোধিতা করছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সংস্থা আসিয়ান। ১০টি দেশ নিয়ে গঠিত এই সংস্থার মতে, ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন নিয়ে দেশটির মাথা ঘামানো ঠিক হচ্ছে না। 

সংঘাতের সমূহ সম্ভাবনা
মিয়ানমারের আইন অনুযায়ী, একটি সরকারের পতনের পর জরুরি অবস্থা দেওয়া যেতে পারে। তবে জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়ার ছয় মাসের মধ্যে অবশ্যই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। অন্যদিকে, সাধারনত নভেম্বর মাসে মিয়ানমারের নির্বাচন হয়। যেহেতু বর্তমানে জুলাই ৩১ পর্যন্ত জরুরি অবস্থা জারি করার কথা বলা হয়েছে, এ বছরের নভেম্বরের নির্বাচন হওয়ার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। 

তবে যে সময়েই নির্বাচন হোক না কেন, দেশের জনগণ তা প্রতিহত করার চেষ্টা করবে, হর্সি মনে করেন। তার মতে, জান্তা সরকারের বৈধতা দেওয়ার এই নির্বাচনে প্রচুর সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে। 
এমনকি এই প্রক্রিয়াকে নির্বাচন বলে দেখা হবে কিনা তা নিয়েও তিনি শঙ্কা ব্যক্ত করেন। 

নির্বাচন নিয়ে জান্তা সরকার সামনে অগ্রসর হলে নিঃসন্দেহে তাদের ওপর হামলা করবে বিদ্রোহী দল পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ), মনে করেন জ কিঅ। বেসামরিক নাগরিকদের ওপর কোনো হামলা হবে না বলেও দাবি করেন তিনি। 

তবে তানিনথারি অঞ্চলে পিডিএফের এক মুখপাত্র বো সি আল জাজিরাকে বলেন, যেসব বেসামরিক নাগরিক জান্তা সরকারকে সহায়তা করছে বলে সন্দেহ করা হয়, তাদের শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। 

মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমে সাগাইং অঞ্চলে পিডিএফের মুখপাত্র কো অং কিঅ হেইন বলেন, যারা জান্তা সরকারের এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে সহায়তা করবে, তাদেরকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় আনা হবে।"

মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা মনে করছে নিঃসন্দেহে সেনাবাহিনীর দিন শেষ হয়ে আসছে। এই নির্বাচন হলো তাদের খড়কুটো আঁকড়ে ভেসে থাকার শেষ প্রচেষ্টা। 

"তাদের পতন কখন হবে তার ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারছি না। কাল হতে পারে। কয়েক মাস পর হতে পারে। এক বছরের মাথায় হতে পারে। তবে সেনাবাহিনীর পতন অনিবার্য। কেউ এই পতন ঠেকাতে পারবে না," বলেন জ কিঅ। 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: জ ন ত সরক র ক ষমত য় সরক র র র জন য অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

অমর একুশে বইমেলা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক

অমর একুশে বইমেলা বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের মেলা। মূলত প্রকাশকদের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধ উত্তর বাংলাদেশে এই বইমেলার সূত্রপাত। সম্প্রতি এই বইমেলা নানা কারণে-অকারণে ডিসেম্বরে করার কথা শোনা যাচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে সুস্পষ্টভাবে বলতেই হচ্ছে -ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলা করা যাবে না। কারণ সেসময় সারাদেশে শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা চলবে।

বইমেলার প্রধান পাঠক আমাদের শিক্ষার্থী। তারা ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলায় আসতে পারবে না। প্রধান পাঠকই যদি মেলায় আসতে না পারে তাহলে মেলা প্রাণহীন হয়ে পড়বে। বইমেলায় অংশগ্রহণকারি প্রকাশকরাও ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে। তাছাড়া একুশের চেতনাকে ধারণ করে যে অমর একুশে বইমেলা, সেটা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক। ভাষা শহীদদরর প্রতি বইমেলার মাধ্যমে আমাদের যে শ্রদ্ধাঞ্জলি, তা অক্ষুন্ন থাকুক। 

আরো পড়ুন:

রাজশাহীতে বইপড়ায় কৃতিত্বের পুরস্কার পেল ২৩০৩ শিক্ষার্থী

‘গল্পকারের পছন্দের ৫০ গল্প’ গ্রন্থ প্রকাশিত

সর্বোপরি ৫ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, এই সময়ে বইমেলা হতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অথবা তারিখ দুই একদিন এদিক-সেদিক করে নেয়া যেতে পারে। এ সময়ে রোজা নেই, নির্বাচনও নেই। নির্বাচনী ক্যাম্পেইন চলবে। এই মাঠে বইমেলা চলাকালীন সর্বদলীয় সিদ্ধান্তে কেউ সভা-সমাবেশ না করার সিদ্ধান্ত নিলে অনায়াসে এই সময়টাতে বইমেলা করা যেতে পারে। আমার বিশ্বাস- সব দলই অমর একুশে বইমেলার জন্য এই ছাড়টুকু দেবেন।

প্রায় পঞ্চাশ বছরের অধিক সময়ের  প্রচেষ্টায় অমর একুশে বইমেলা মহিরুহ হয়ে আমাদের কাছে আবির্ভূত, হঠকারি কোন সিদ্ধান্তে তা যেনো ধ্বংস হওয়ার উপক্রম না হয়। জেনে শুনে বাঙালির এতো বড় একটি সাংস্কৃতিক উৎসবকে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্থ না করে বরং তা যে কোন মূল্যে আমাদের রক্ষা করা উচিত।

জানুয়ারিতে বাণিজ্যমেলায়ও হয়ে থাকে। এতে অমর একুশে বইমেলার ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আমি তা মনে করি না। বইমেলার প্রধান পাঠক শিক্ষার্থী। তারা বইমেলায় আসার জন্য মুখিয়ে থাকে। বাণিজ্য মেলায় যাওয়ার লোকজন বেশির ভাগই আলাদা। তবে অনেকেই বইমেলা এবং বাণিজ্যমেলা দুটোতেই যান। এটা তারা ম্যানেজ করে নিতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।

আমি বলেছি শুধুমাত্র মেলার মাঠ প্রাঙ্গনে সভা-সমাবেশ না করার মাধ্যমে যদি সর্বদলীয় একটা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তাহলে জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারি মিলিয়ে  বইমেলা করা সম্ভব।আমার মনে হয়, বইমেলা চলাকালীন এই মাঠ কোন দলকে সভা-সমাবেশের জন্য সরকার বরাদ্দ না দিলে, অথবা বইমেলা চলাকালীন দলগুলো নিজের থেকেই এই মাঠের বরাদ্দ না চাইলে সমস্যা আর থাকে না।

লেখক: প্রকাশক পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড

ঢাকা/লিপি

সম্পর্কিত নিবন্ধ