লেট ক্যাপিটালিস্ট এই দুনিয়ায় নয়া-উদারবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পোস্ট-মডার্নিস্ট চিন্তাচর্চা ও ডিসকোর্স এখনো দোর্দণ্ড প্রতাপে রাজত্ব করছে। মডার্নিস্ট বিশ্বদৃষ্টির ব্যাপারে পোস্ট-মডার্নিস্ট, বিনির্মাণবাদী তত্ত্বের ক্রিটিক্যাল অবস্থান থাকা সত্ত্বেও নয়া-উদারবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তার আপন উদরে এসব ক্রিটিক গ্রাস করে নেয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে পিঠ চাপড়ানি দিয়ে উৎসাহিত করে, নানান ফর্মে জোর-জুলুম-জবরদস্তি জারি রেখেই।

এ পরিস্থিতিতে নানান কিসিমের মতাদর্শিক পর্দা মানবেতিহাসের দিগন্তকে অস্পষ্ট ও ঝাপসা করে তোলে। সত্য-অসত্য, মিথ-ইতিহাস, বর্তমান-ভবিষ্যৎ বাদেও মানবিক কর্তাসত্তাকে ঝাপসা করে ফেলার মধ্য দিয়ে বিদ্যমান আইনি-রাজনৈতিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখে এবং জুলুমিয়াতের পুনরুৎপাদন জারি রাখে। ‘কাশফ’ আমার পড়া পারভেজ আলমের তৃতীয় বই। ‘জিহাদ ও খেলাফতের সিলসিলা’ এবং ‘মদিনা’ যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা পারভেজ আলমের চিন্তা ও তৎপরতার এলাকা সম্পর্কে অবহিত আছেন। ‘কাশফ’কে সেই তৎপরতার ধারাবাহিকতা আকারে পড়া সুবিধাজনক।

পারভেজ আলমের বরাতেই এই বইয়ের মোটাদাগে দুইটা প্রস্তাবনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

কাশফ
পারভেজ আলম

প্রকাশক: আদর্শ
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
প্রচ্ছদ: দেবাশিস চক্রবর্তী
পৃষ্ঠা: ২৪৮
মূল্য: ৬০০ টাকা

১.

সাব-অল্টার্ন, সর্বহারা কিংবা প্রলেতারিয়েতের আপন ঘর হলো শূন্যতার ঘর। তবে তিনি সতর্ক করে দেন, এই ঘর বিনির্মাণবাদীদের প্রচারিত নিরন্তন অনুপস্থিত কোনো ধারণা নয়। বরং, এ হলো নিওলিবারাল আইনি-রাজনৈতিক ব্যবস্থার—নেতির সম্পর্কে বাঁধা অবস্থা।

২. আধুনিক জাতিরাষ্ট্র কেবল মানুষের বলিকে শাহাদাতের বয়ানের মাধ্যমে পবিত্রায়ন ও রহস্যায়নের পলিটিক্যাল থিওলজির ওপর দাঁড়ায় নাই। বরং জাতিরাষ্ট্রের আইনি-রাজনৈতিক পাটাতনে মানবিক জবানের কোরবানির শাহাদাতও এতে সম্পৃক্ত।

পারভেজ আলম দেখান কীভাবে ধর্মতত্ত্বের আইডিয়া পপুলার কালচারে নিহিত থাকে এবং তা বিদ্যমান আইনি-রাজনৈতিক-মতাদর্শিক পর্দা ভেদ করে চিন্তা, কল্পনা ও রাজনীতির ময়দানে কার্যকরী হয়ে ওঠে। তিনি দাবি করেন, দিন শেষে পপুলার কালচারের শিল্পগুলোকে জনগণের যৌথ অজ্ঞানকে ধারণ করতে হয়।

আরবি ‘কাশফ’ শব্দের অর্থ পর্দা উন্মোচন। সত্যের নানাস্তরীয় প্রকাশের ঘটনা ও অভিজ্ঞতা উন্মোচন করতে গিয়ে লেখক পপুলার কালচার, ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের সহায়তা নিয়েছেন। ইতালীয় দার্শনিক জর্জিও আগামবেনের বরাতে আমরা জানি, ফরাসি দার্শনিক দেরিদার তরিকায় বিনির্মাণবাদী ক্রিটিক মতাদর্শিক পর্দা উন্মোচনে কার্যকর কিন্তু তৎসৃষ্ট নিরন্তর শূন্যতা মজলুমকে কোনো দিশা বাতলাতে অপারগ। পারভেজ আলম আগামবেনের তরিকায় আমাদের দিশা বাতলানোর কোশেশ করেন।

‘দ্য বিগ লেবস্কি’, ‘ম্যাড ম্যাক্স; ফিউরি রোড’–এর মতো পপুলার সিনেমার অভিনব বিশ্লেষণ করে পারভেজ আলম দেখান কীভাবে ধর্মতত্ত্বের আইডিয়া পপুলার কালচারে নিহিত থাকে এবং তা বিদ্যমান আইনি-রাজনৈতিক-মতাদর্শিক পর্দা ভেদ করে চিন্তা, কল্পনা ও রাজনীতির ময়দানে কার্যকরী হয়ে ওঠে নতুন দিশা বাতলানোর প্রচেষ্টায়। তিনি দাবি করেন, দিন শেষে পপুলার কালচারের শিল্পগুলোকে জনগণের যৌথ অজ্ঞানকে ধারণ করতে হয়, সচেতনভাবে না হলেও।

পলিটিক্যাল স্পিরিচুয়ালিটির পরিভাষা তালাশ করতে গিয়ে এই শব্দবন্ধের মূলগত ও ব্যবহারিক অর্থের বিবর্তন ও জটিলতা নিয়ে লিখিত প্রবন্ধ ‘রাজনৈতিক রুহানিয়াত প্রসঙ্গে’ ফুকোডিয়ান তরিকায় শব্দের মূলগত অর্থ ও তার বৈপ্লবিক রূপান্তর বিশ্লেষণ করে নতুন দিশা বাতলানোর সফল এক প্রয়োগ বলা যায়। নৃতাত্ত্বিক এদুয়ার্দো কোনের ‘হাউ ফরেস্ট থিঙ্ক’ গ্রন্থের মূল প্রস্তাবনা ও পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটিয়ে সুন্দরবনের মুখের ভাষা ও ছফা প্রণীত ‘ওঙ্কার’–এ বোবা বউয়ের ভাষাকে রিপ্রেজেন্টেশনের আওতায় আনার যে প্রচেষ্টা আমরা শেষের দিকের প্রবন্ধগুলোয় দেখি, তা বাংলা ভাষায় মনে হয় প্রথম। এই প্রস্তাবকে একই সাথে গায়ত্রী স্পিভাকের ‘ক্যান দ্য সাব–অল্টার্ন স্পিক?’ প্রবন্ধের ক্রিটিক হিসেবেও পড়া যায়, যে প্রবন্ধে গায়ত্রী সাব-অল্টার্নের কর্তাসত্তাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছিলেন।

আখেরি পুঁজিবাদের এই জমানায় যখন পুঁজিই একমাত্র সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, যখন মার্ক ফিশার তাঁর ‘ক্যাপিটালিস্ট রিয়ালিজম’ বইতে একটা চ্যাপ্টারের যেমন শিরোনাম রেখেছেন ‘ইটস ইজিয়ার টু ইমাজিন দ্য এন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড দ্যান দ্য এন্ড অব ক্যাপিটালিজম’, তখন ‘কাশফ’ বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে বাংলার ভাবসম্পদ নিয়ে পাশ্চাত্য দর্শনের সাথে মোকাবিলা ও মোলাকাত করে আমাদের সামনে ভাবাদর্শের নানাস্তরীয় পর্দা উন্মোচন করে দেখায় বাস্তবতার বীভৎসতা। এবং সেই বীভৎসতা কাটিয়ে ওঠার ইঙ্গিত।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ত ক ব যবস থ র জন ত ক প রবন ধ

এছাড়াও পড়ুন:

২৩ বছর ধরে প্রেম, হুট করে বিয়ে

ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে

সম্পর্কিত নিবন্ধ