জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে আগে জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে
Published: 14th, March 2025 GMT
জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে চাইলে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মত অনুযায়ী আগে জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে। আগে জাতীয় নির্বাচন দিলে ক্ষমতায় যাওয়া দল স্বৈরাচারী হয়ে উঠবে—এমন ভাবলে নির্বাচন পিছিয়ে দিয়েও তা ঠেকানো যাবে না।
‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন গণতন্ত্রকে টেকসই করবে’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বক্তারা এ কথা বলেন। রাজধানীর উত্তরায় উত্তরা কমিউনিটি সেন্টারে নাগরিক ঐক্য, ঢাকা মহানগর উত্তর শাখা এই আলোচনা সভা ও ইফতারের আয়োজন করে।
এই আয়োজনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে অন্তত দুই বছর তো লাগবে। এই সময়ে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে, সেটা সামাল দিতে পারবেন? কত মানুষ মারা যাবে, বলতে পারেন? আবেগে অনেক কিছু বলা যায়; কিন্তু আবেগ দিয়ে রাষ্ট্র চলে না, রাজনীতি চলে না।’ তিনি আরও বলেন, গায়ের জোরে কেউ ক্ষমতায় যেতেও পারবে না, থাকতেও পারবে না। কেউ যদি মনে করে, নির্বাচন দিলে যারা ক্ষমতায় যাবে, তারা স্বৈরাচারী হয়ে উঠবে, নির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে তো সেটা ঠেকানো যাবে না। সেটা ঠেকাতে হলে রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। সেই লড়াই জারি রাখতে হবে।
মাগুরার শিশুটির মৃত্যুতে গভীর শোক এবং ধর্ষক–হত্যাকারীদের প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করেন মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেন, গত ৫ আগস্টের পর লক্ষ্য ছিল নতুন বাংলাদেশের। যে নতুন বাংলাদেশ মানে, মাগুরার ওই শিশুটি বা অন্য শিশুরা নিরাপদ থাকবে, মানুষ না খেয়ে থাকবে না, বিনা চিকিৎসায় কেউ মারা যাবে না, মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, ভোট দেওয়ার অধিকার থাকবে।
আলোচনা সভায় ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আগে জাতীয় নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছে। যদি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে চান, তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকে প্রাধান্য দিতে হবে।’ তিনি বলেন, আগে স্থানীয় নির্বাচন আয়োজন মানে স্বৈরাচার হাসিনার ফ্যাসিবাদী দল আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন, পতিত আওয়ামী লীগের টাকার খেলা। এর মধ্য দিয়ে আবারও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা সারা দেশ দাপিয়ে বেড়াবে।
আমজনতার দলের আহ্বায়ক মিয়া মশিউজ্জামান বলেন, ‘স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই হয়েছে হাসিনার পতনের পর একটা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের লক্ষ্যে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য নয়। নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে এমন কোনো দাবি নিয়ে হাজির হবেন না, যাতে দেশে আবারও বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়।’
অনুষ্ঠানে নাগরিক ঐক্যের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং ঢাকা মহানগর উত্তরের সংগঠক মাহবুব আলীর সভাপতিত্বে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার, ডাকসুর সাবেক জিএস মোস্তাক আহমেদসহ গণতন্ত্র মঞ্চ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত
এছাড়াও পড়ুন:
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে সুষ্ঠু ভোটে বাধা হতে পারে
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেখানে এআইয়ের (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ব্যবহার এক নতুন ধরনের হুমকি নিয়ে এসেছে। এটি শুধু প্রচলিত কারচুপির পদ্ধতিগুলোকেই আরও সফিসটিকেটেড বা কৌশলী করে তুলবে না; বরং আমাদের গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি যে জনগণের বিশ্বাস, সেটিই নষ্ট করে দিতে পারে।
নির্বাচনে এআইয়ের প্রভাব কোনো কাল্পনিক গল্প নয়, এটি একটি বাস্তব ঝুঁকি। এআই-চালিত টুলগুলো ব্যবহার করে রাজনৈতিক নেতা বা কর্মকর্তাদের অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য ‘ডিপফেক’ (ভুয়া অডিও, ভিডিও এবং ছবি) তৈরি করা সম্ভব।
এই ডিপফেকগুলো সহজেই মিথ্যা কেলেঙ্কারি ছড়াতে পারে, যা ভোটারদের বিভ্রান্ত করে তাঁদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এআই-চালিত বটগুলো সেকেন্ডের মধ্যে এমন সব মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দিতে পারে, যা একটি রাজনৈতিক দলের জন্য ব্যাপক জনসমর্থনে বা বিরোধিতায় ভূমিকা রাখতে পারে।
যখন জনগণ দেখতে পাবে, তারা যা দেখছে বা শুনছে, তার মধ্যে কোনটা আসল আর কোনটা নকল, তা বোঝা কঠিন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে সংবাদমাধ্যম, নির্বাচন কর্তৃপক্ষ এবং পুরো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিষয়ে সন্দেহ ঢুকে যাবে। এটি একটি দেশের স্থিতিশীলতার জন্য দীর্ঘমেয়াদি হুমকি।
এআই অ্যালগরিদমগুলো বিশাল পরিমাণ ডেটা বিশ্লেষণ করে নির্দিষ্ট ভোটারদের লক্ষ করে তাদের ব্যক্তিগত আগ্রহ ও দুর্বলতা অনুযায়ী রাজনৈতিক বার্তা পাঠাতে পারে। এই ‘মাইক্রো টার্গেটিং’-এর মাধ্যমে ভোটারদের মনোভাবকে প্রভাবিত করা বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে ভোটদানের সময় বা স্থান সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে তাদের ভোটদান থেকে বিরত রাখাও সম্ভব।
আমাদের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এই নতুন প্রযুক্তির ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবেএআই শুধু মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এটি নির্বাচনী পরিকাঠামোর ওপর সাইবার হামলাও জোরদার করতে পারে। এআই-চালিত টুলগুলো আরও সফিসটিকেটেড ফিশিং আক্রমণ তৈরি করে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করতে বা এমন ম্যালওয়্যার তৈরি করতে পারে, যা প্রচলিত নিরাপত্তাব্যবস্থা এড়িয়ে যেতে সক্ষম। এ ধরনের আক্রমণ ভোটার ডেটাবেজ বা ভোটিং মেশিনকে লক্ষ্য করে করা যেতে পারে। সেটি নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তন বা পুরো প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিপত্তির সমাধান কী? এ প্রশ্নের জবাব হিসেবে প্রথমেই মনে রাখা দরকার, এই গুরুতর চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় একটি সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। এখানে এক্সপ্লেইনেবল এআই (এক্সএআই) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এআই মডেলের সিদ্ধান্তগুলো মানুষের কাছে বোধগম্য করে তোলে এক্সএআই। এটি এআইয়ের স্বচ্ছতা বাড়ায়।
ডিপফেক শনাক্তকরণ: এক্সএআই ব্যবহার করে এমন টুল তৈরি করা সম্ভব, যা কেবল ডিপফেক শনাক্ত করে না; বরং কেন একটি বিষয়বস্তু জাল বলে চিহ্নিত হয়েছে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দেয়। এর ফলে মানব ফ্যাক্ট-চেকাররা বিশ্লেষণ যাচাই করতে পারেন এবং জনগণের আস্থা তৈরি হয়।
প্রচারণার নিরীক্ষা: এক্সএআই রাজনৈতিক প্রচারণায় এআই ব্যবহারের নিরীক্ষা করতে পারে। এটি বিশ্লেষণ করে দেখাতে পারে, কীভাবে একটি অ্যালগরিদম তার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা পক্ষপাতদুষ্ট বা কারসাজিমূলক টার্গেটিং কৌশলগুলো প্রকাশ করতে সাহায্য করে।
নিরাপত্তা বৃদ্ধি: সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এক্সএআই হুমকির শনাক্তকরণ সিস্টেমকে উন্নত করতে পারে। এটি ব্যাখ্যা করতে পারে, কেন একটি নির্দিষ্ট কার্যকলাপকে ক্ষতিকর বলে মনে করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের দ্রুত এবং কার্যকরভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে সাহায্য করে।
অংশগ্রহণকারীদের করণীয়: এআইয়ের হুমকি মোকাবিলায় সব গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণকারীকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলো এবং নেতাদের প্রকাশ্যে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, তাঁরা প্রতারণামূলক এআই জেনারেটেড কনটেন্ট বা ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রচারে জড়িত হবেন না। তাঁদের উচিত এআইয়ের যেকোনো বৈধ ব্যবহার সম্পর্কে স্বচ্ছ থাকা এবং এআই জেনারেটেড কনটেন্টে সুস্পষ্ট লেবেল ব্যবহার করা। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক প্রচারে এআই ব্যবহারের বিষয়ে সুস্পষ্ট নিয়ম ও প্রবিধান তৈরি এবং প্রয়োগ করতে হবে। তাদের উচিত এআই-চালিত টুলগুলোতে বিনিয়োগ করা এবং ভোটারদের সচেতন করার জন্য বড় আকারের প্রচার চালানো।
এ ছাড়া একটি যৌথ গবেষণা ও উন্নয়ন দল গঠন করা প্রয়োজন, যারা নির্বাচনের আগপর্যন্ত কমিশনকে এআই এবং সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে নিরবচ্ছিন্ন সহায়তা দেবে। তৃতীয়ত, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজকে এআইয়ের হুমকি সম্পর্কে তথ্য আদান-প্রদান করতে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়লে তা দ্রুত মোকাবিলা করার জন্য একটি সুস্পষ্ট প্রটোকল স্থাপন করা জরুরি। সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজের উচিত ফ্যাক্ট-চেকিং এবং জনগণের মধ্যে মিডিয়া লিটারেসি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা।
আমাদের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এই নতুন প্রযুক্তির ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। এআইয়ের ক্ষমতা যেমন বিশাল, তেমনি এর অপব্যবহারের বিপদও কম নয়।
জনগণের বিশ্বাস এবং একটি ন্যায্য নির্বাচনের অধিকার নিশ্চিত করতে এখনই আমাদের সবাইকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো, বাংলাদেশ সরকারের একটি সম্মিলিত গবেষণা ও উন্নয়ন (আরএনডি) দল গঠন করা। এই বিশেষজ্ঞ দল এআই-সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলো ক্রমাগত বিশ্লেষণ ও অনুমান করবে এবং দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করবে।
অধ্যাপক ড. আলমগীর হোসেন এআইয়ের সাবেক অধ্যাপক, যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজে অবস্থিত এআরআইটিআইয়ের সাবেক পরিচালক