ভারত–যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য চুক্তি কত দূর এগোল, কী কী করেছে ভারত
Published: 21st, April 2025 GMT
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার প্রস্তাবিত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনায় গতি এসেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প যে বিশ্বের সব দেশের পণ্যে পাল্টা শুল্ক আরোপ করতে পারেন, সেই সম্ভাবনা মাথায় রেখে বেশ আগে থেকেই কূটনীতি শুরু করেছে ভারত। ২৩ এপ্রিল ওয়াশিংটনে দুই দেশের শীর্ষ কর্মকর্তা পর্যায়ে প্রথম সরাসরি তিন দিনের আলোচনা শুরু হওয়ার কথা। ভারতের একটি প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছে।
এ সফরের গুরুত্ব আছে বলেই মনে করা হচ্ছে। ট্রাম্প যে ৯০ দিনের জন্য শুল্ক স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন, এ সময়ের মধ্যেই ভারত প্রাথমিক পর্যায়ের চুক্তি নিষ্পত্তির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে। ইতিমধ্যে চুক্তির টার্মস অব রেফারেন্স বা কার্যপরিধি নির্ধারিত হয়েছে।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক্সপ্লেইনারে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি করতে চায়, যা একধরনের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি। দেশ দুটি এই প্রস্তাবিত বাণিজ্য চুক্তি দুটি ধাপে সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা এ বছরের শরৎকালের (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) মধ্যে প্রাথমিক চুক্তি করার সময়সীমা নির্ধারণ করেছে।
এই প্রাথমিক চুক্তির লক্ষ্যে উভয় পক্ষ সীমিতসংখ্যক পণ্যের বাজারসুবিধা বৃদ্ধি এবং অশুল্ক বাধা হ্রাসের মতো বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারে। সেটা হলে পরবর্তী পর্যায়ে আরও জটিল আলোচনার (যেমন সরকারি ক্রয় ও ডিজিটাল বাণিজ্যের মতো বিষয়) ভিত্তি তৈরি হতে পারে। তবে উভয় পক্ষের জন্যই লাভজনক হলেই কেবল আগেভাগে চুক্তি করা সম্ভব হবে।
ইতিমধ্যে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ভারত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করেছে। ভারত-অস্ট্রেলিয়া অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বাণিজ্য চুক্তি (ইসিটিএ) ২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বর কার্যকর হয়। এখন তারা ইসিটিএর পরিসর সম্প্রসারণ করে আরও বৃহৎ বাণিজ্য চুক্তি করা যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা করছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২ এপ্রিল ভারত, চীনসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশের পণ্যে পারস্পরিক শুল্ক (বা আমদানি শুল্ক) আরোপ করেন। যদিও ৯ এপ্রিল তিনি এই শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন, যার মেয়াদ চলতি বছরের ৯ জুলাই পর্যন্ত। তবে এই স্থগিতের আদেশ চীন ও হংকংয়ের জন্য প্রযোজ্য নয়। এর মধ্যে প্রায় ৭৫টি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির বিষয়ে আগ্রহ জানিয়েছে। চীনের পণ্যে ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। তবে এর মধ্যে ২ এপ্রিল ঘোষিত ১০ শতাংশ ন্যূনতম শুল্ক কার্যকর থাকবে। এ ছাড়া ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম ও গাড়ির সামগ্রীতে ২৫ শতাংশ শুল্ক আছে।
২০৩০ সালের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ৫০০ বিলিয়ন বা ৫০ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত করতে চায় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। যদিও বর্তমানে দেশটির মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য মাত্র ১৯১ বিলিয়ন বা ১৯ হাজার ১০০ কোটি ডলারের।
মোট ১৯টি অধ্যায় নিয়ে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি করা হবে। পণ্য, সেবা, শুল্ক সহজীকরণ, বিনিয়োগসহ আরও নানা বিষয় থাকবে এতে। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে শুল্ক উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে ভারতের বাজারে তাদের উৎপাদিত বৈদ্যুতিক গাড়ি, বিভিন্ন শিল্প পণ্য, মদ, দুগ্ধজাত পণ্য, পেট্রোকেমিক্যাল, আপেলসহ বিভিন্ন পণ্যের শুল্ক হ্রাস করা হোক। এর বদলে ভারত চায় টেক্সটাইল, পোশাক, গয়না, রত্ন, চামড়াজাত পণ্য, রাসায়নিক, চিংড়ি, তেলবীজ ও হর্টিকালচার পণ্যের প্রবেশাধিকার।
২০২১-২২ অর্থবছর থেকে শুরু করে ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার ছিল যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের পণ্য বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত ছিল ৪১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ১৮০ কোটি ডলার; আগের কয়েক বছরের তুলনায় যা বেশি। এই ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যঘাটতি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওয়াশিংটন সফরের সময় প্রথম এ নিয়ে আলোচনা হয়। এরপর দেশটির বাণিজ্যমন্ত্রী পিয়ুষ গয়াল ৪-৬ মার্চ ওয়াশিংটন সফর করেন। ওই সফরে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি ও বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেন।
এরপর যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া–বিষয়ক সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডন লিঞ্চ ২৫-২৯ মার্চ ভারত সফর করেন। তখনো এ নিয়ে আরেক দফা আলোচনা হয়। সেই সফরের পর এখন ভারতীয় দল যুক্তরাষ্ট্র সফর করছে।
২০২১-২২ অর্থবছর থেকে শুরু করে ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার ছিল যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের পণ্য বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত ছিল ৪১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ১৮০ কোটি ডলার; আগের কয়েক বছরের তুলনায় যা বেশি। এই ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যঘাটতি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আরও যা যা করেছে ভারত
ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের হাত থেকে বাঁচতে ভারত শুরু থেকেই তৎপর। তারা জানত, মার্কিন পণ্যে শুল্ক কমানো না হলে তাদের অবস্থাও চীনের মতো হতে পারত। সে জন্য তারা আগে থেকেই কর হ্রাসসহ নানাবিধ উদ্যোগ নেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য যেমন কাঠবাদাম ও ক্র্যানবেরিতে তারা আগেও শুল্ক কমিয়েছে। চলতি বছরের মার্চে তারা এসব পণ্যে আরও শুল্ক হ্রাসের প্রস্তাব দেয়। রয়টার্সের আরেক সাংবাদে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা ২৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্যের মধ্যে ৫৫ শতাংশের ওপর শুল্ক কমাতে রাজি হয়েছে ভারত।
৬ মার্চ লোকসভায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ভারতের গড় আমদানি শুল্ক কমিয়ে ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ করা হয়েছে। দেশটির বাণিজ্য ও শিল্প প্রতিমন্ত্রী জিতিন প্রসাদ এক প্রশ্নের জবাবে জানান, ২০২৩ সালে ভারতের সরল গড় শুল্কহার ছিল ১৭ শতাংশ। ২০২৫-২৬ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটের পর সরল গড় শিল্প শুল্ক ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।
সম্প্রতি লোকসভায় অর্থ বিল পাসের সময়ে ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য যে ৬ শতাংশ করারোপ করা হতো, সেটাও তুলে নেওয়া হয়েছে। মূলত ইলন মাস্কের এক্স, গুগল ও মেটার ওপর এই শুল্ক আরোপ করা হতো। বার্তা পরিষ্কার, সুর নরম করেছে নয়াদিল্লি।
এ ছাড়া চলতি বছরের বাজেটে মার্কিন মোটরসাইকেলে শুল্ক হ্রাস করে ভারত। তখন মার্কিন ব্র্যান্ড হারলে ডেভিডসনের আমদানিতে ভারত আরও ১০ শতাংশ শুল্ক হ্রাস করে। এর আগে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারত হারলে ডেভিডসনের ওপরে ৫০ শতাংশ শুল্ক কমিয়েছিল। এবারের বাজেটে যা আরও কিছুটা কমানো হয়।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শ ল ক কম র প কর মন ত র র জন য দশম ক আমদ ন বছর র
এছাড়াও পড়ুন:
সঠিক বরাদ্দ ও বাস্তবায়নই কৃষির ভবিষ্যৎ
আগামী ২ জুন অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছে। ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বাজেটের ধরন নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চললেও বাস্তবতা হলো, বাজেট একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে এতে মৌলিক পরিবর্তন আনা প্রায় অসম্ভব। তবে সরকার ইতোমধ্যে সংকুচিত বাজেট প্রণয়ন ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ইঙ্গিত দিয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে কৃষি বাজেটের পরিমাণ ও এর কার্যকর ব্যবহার নিয়ে একটি সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হলো।
বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি কৃষি খাত। দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪০ শতাংশের বেশি মানুষ সরাসরি কৃষির ওপর নির্ভরশীল এবং জিডিপিতে এ খাতের অবদান ১১.০২ শতাংশ। স্বাধীনতার পর জনসংখ্যা প্রায় আড়াই গুণ হলেও খাদ্য ঘাটতি বাড়েনি, বরং কমেছে। এর পেছনে রয়েছে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং সরকার-গবেষক-কৃষকের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। ফলে দারিদ্র্যের হার কমে এসেছে ১৮.৭ শতাংশে। এই অর্জনে কৃষি বাজেট ও দীর্ঘমেয়াদি কৃষিনীতির ভূমিকা অপরিসীম।
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের মোট বাজেটের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জাতীয় বাজেট ছিল ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা, যা ২০২৪-২৫ এ দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকায়; প্রায় ২.৭ গুণ। একই সঙ্গে কৃষি বাজেটও বেড়েছে, তবে কোনো বছরেই কৃষিকে বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়ে বরাদ্দ বাড়ানো হয়নি। ২০১৫-১৬তে কৃষিতে বরাদ্দ ছিল ১৪ হাজার কোটি টাকা (৪.৭৫ শতাংশ) এবং ২০২৪-২৫ এ তা দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ৪০ কোটি টাকায় (৫.০৮ শতাংশ)। সরকার মোট বাজেটের সঙ্গে সঙ্গে আনুপাতিক হারে কৃষি বাজেট বাড়িয়েছে ঠিকই, কিন্তু কৃষির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কোনো অর্থবছরে বাজেট বাড়ানো হয়নি।
কোনো একটি খাতের জিডিপিতে অবদান ও বাজেট বরাদ্দের মধ্যে সঠিক অনুপাত বজায় রাখা অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত ও টেকসই উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে। ২০১৫-১৬ সালে কৃষির জিডিপি ছিল প্রায় ২.৪৩ লাখ কোটি টাকা, যা ২০২৩-২৪ এ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৫.৫ লাখ কোটি টাকায় (চলতি মূল্যে)। অথচ কৃষির গড় প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৩.৩৫ শতাংশ, যেখানে জাতীয় জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৬ শতাংশ। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ও বিশ্বব্যাংকের নির্দেশনা অনুসারে, কৃষি বাজেট মোট বাজেটের অন্তত ১০ শতাংশ হওয়া উচিত। সে অনুযায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কৃষি খাতে বরাদ্দ হওয়া উচিত ছিল প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা, যা বাস্তবের তুলনায় দ্বিগুণ। কৃষি খাত থেকে জিডিপি বাড়াতে হলে এ খাতে বাজেটের পরিমাণ অবশ্যই বাড়াতে হবে।
গত এক দশকে কৃষির উপখাত বিশ্লেষণে দেখা যায়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপখাতের অবদান বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। ২০১৫ সালে যেখানে মৎস্য উপখাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৫.১ শতাংশ, তা ২০২৩ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৬.৮ শতাংশে। এই উপখাতের বর্তমান জিডিপি প্রায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা, যা জাতীয় জিডিপির ৪.৭ শতাংশ ও কৃষি জিডিপির ২৭.৬ শতাংশ। প্রাণিসম্পদ উপখাতের জিডিপি বর্তমানে ৫৫ হাজার কোটি টাকা (মোট জিডিপির ২.৯ শতাংশ ও কৃষি জিডিপির ১৫.৫ শতাংশ) এবং এর প্রবৃদ্ধি একই সময়ে ৩.৩ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬.৩ শতাংশ। বিপরীতে ফসল উপখাতের প্রবৃদ্ধি তুলনামূলক স্থির– ২.৫ থেকে ৩.৩ শতাংশের মধ্যে অবস্থান করছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ফসল উপখাতের জিডিপি ছিল ১.৮ লাখ কোটি টাকা, যা কৃষি জিডিপির ৫০.৭ শতাংশ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুসারে দেখা যায়, কৃষি উপখাতের সঙ্গে সংযুক্ত তিনটি মন্ত্রণালয় যথা কৃষি মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেট ছিল প্রায় ৩০ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা। যার মধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ে ৮১.০৪ শতাংশ, মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ে ১৩.৬৮ শতাংশ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ে ৫.২৮ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ে জিডিপির অবদানের তুলনায় বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ খুবই কম। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ খাতের জিডিপি বাড়ার অন্যতম কারণের মধ্যে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ, নতুন শিক্ষিত উদ্যোক্তাদের প্রবেশ এবং প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও ব্যবহার উল্লেখযোগ্য।
দেশে প্রাণিজ প্রোটিনের প্রধান উৎস মাছ, মাংস, দুধ ও ডিম। এই প্রেক্ষাপটে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের উন্নয়নে সরকারি বাজেট বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বাজেট বৃদ্ধি হলে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, খামার পর্যায়ে উন্নয়ন, পুষ্টিবিষয়ক সেবা বিস্তার এবং গবেষণা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম জোরদার করা সম্ভব হবে। সুতরাং জনগণের পুষ্টি নিরাপত্তা ও টেকসই উন্নয়নে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে অধিক বরাদ্দ প্রদান সরকারের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।
শিল্পায়ন ও বসতবাড়ি তৈরির জন্য কৃষিজমির পরিমাণ প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য হারে কমছে। অন্যদিকে কৃষিতে এখনও আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। দেশের ৬০ শতাংশের বেশি খামারি প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র। বাংলাদেশে ফসল খাত থেকে জিডিপি বাড়াতে হলে এই ক্ষুদ্র চাষিদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের আওতায় আনতে হবে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ও অধিক উৎপাদনশীল বীজ ব্যবহার ছাড়া উৎপাদনশীলতা বাড়ানো সম্ভব নয়। এ দুটি কাজের জন্যই দরকার প্রচুর গবেষণা। বাংলাদেশে কৃষি গবেষণায় সরকারি বাজেট সামান্য। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট কৃষি গবেষণায় ব্যবহৃত ফান্ডের পরিমাণ কৃষি জিডিপির মাত্র ০.৩ শতাংশ, যার বেশির ভাগ আসে বিদেশি সংস্থা থেকে।
দীর্ঘ মেয়াদে কৃষি গবেষণায় বাজেট বাড়ানোর মাধ্যমে কৃষির প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও আধুনিকীকরণ করা না গেলে কৃষি জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়ানো সম্ভব নয়। কিন্তু এই গবেষণা বাজেটের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশি ঋণের মাধ্যমে যত বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে বা হচ্ছে, এর বেশির ভাগ টাকা প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও কৃষকের দক্ষতা বৃদ্ধির চেয়ে প্রকল্পে নিযুক্ত ব্যক্তিদের বেতন, পরামর্শ ফি, মূলধনি সামগ্রী ক্রয় (গাড়ি, রুম সৌন্দর্যকরণ ইত্যাদি) ও মিটিংয়ে খরচ হয়। অতএব, বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে।
একদিকে নিরবচ্ছিন্ন উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, অন্যদিকে একটানা ডলারের বিপরীতে টাকার নিম্নমানের ফলে আমদানিকৃত কৃষি উপকরণ/উপাদানের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ফলে কৃষির উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে। যার জন্য বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মাঝারি ও ক্ষুদ্র কৃষক। মাঝারি ও ক্ষুদ্র কৃষককে বাঁচাতে হলে কৃষি উপকরণের ওপর ভর্তুকির পরিমাণ বাড়াতে হবে।
অনেক সময় লক্ষ্য করা যায়, দাতা সংস্থাগুলো যেমন বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত জুড়ে দেয়– কৃষিক্ষেত্রে ভর্তুকি দেওয়া যাবে না। অথচ খোদ আমেরিকা ২০২৩ অর্থবছরে কৃষিতে ভর্তুকি দিয়েছে ৩০.৬ বিলিয়ন ডলার। দেশের কৃষিকে বাঁচাতে হলে দাতা সংস্থাগুলোর এ ধরনের শর্তের ক্ষেত্রে কিছুটা কৌশলী হতে হবে।
উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, কৃষি উপকরণের উচ্চমূল্য, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ও উৎপাদনশীলতার কথা বিবেচনা করে কৃষি বাজেট বাড়ানো প্রয়োজন। শুধু বাজেট বাড়ালেই হবে না; এর ব্যবহার নিশ্চিত করতে সঠিক তদারকি ও নীতির প্রয়োগ জরুরি।
ড. মো. আক্তারুজ্জামান খান: অধ্যাপক,
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ