ভারত–যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য চুক্তি কত দূর এগোল, কী কী করেছে ভারত
Published: 21st, April 2025 GMT
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার প্রস্তাবিত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনায় গতি এসেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প যে বিশ্বের সব দেশের পণ্যে পাল্টা শুল্ক আরোপ করতে পারেন, সেই সম্ভাবনা মাথায় রেখে বেশ আগে থেকেই কূটনীতি শুরু করেছে ভারত। ২৩ এপ্রিল ওয়াশিংটনে দুই দেশের শীর্ষ কর্মকর্তা পর্যায়ে প্রথম সরাসরি তিন দিনের আলোচনা শুরু হওয়ার কথা। ভারতের একটি প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছে।
এ সফরের গুরুত্ব আছে বলেই মনে করা হচ্ছে। ট্রাম্প যে ৯০ দিনের জন্য শুল্ক স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন, এ সময়ের মধ্যেই ভারত প্রাথমিক পর্যায়ের চুক্তি নিষ্পত্তির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে। ইতিমধ্যে চুক্তির টার্মস অব রেফারেন্স বা কার্যপরিধি নির্ধারিত হয়েছে।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক্সপ্লেইনারে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি করতে চায়, যা একধরনের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি। দেশ দুটি এই প্রস্তাবিত বাণিজ্য চুক্তি দুটি ধাপে সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা এ বছরের শরৎকালের (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) মধ্যে প্রাথমিক চুক্তি করার সময়সীমা নির্ধারণ করেছে।
এই প্রাথমিক চুক্তির লক্ষ্যে উভয় পক্ষ সীমিতসংখ্যক পণ্যের বাজারসুবিধা বৃদ্ধি এবং অশুল্ক বাধা হ্রাসের মতো বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারে। সেটা হলে পরবর্তী পর্যায়ে আরও জটিল আলোচনার (যেমন সরকারি ক্রয় ও ডিজিটাল বাণিজ্যের মতো বিষয়) ভিত্তি তৈরি হতে পারে। তবে উভয় পক্ষের জন্যই লাভজনক হলেই কেবল আগেভাগে চুক্তি করা সম্ভব হবে।
ইতিমধ্যে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ভারত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করেছে। ভারত-অস্ট্রেলিয়া অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বাণিজ্য চুক্তি (ইসিটিএ) ২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বর কার্যকর হয়। এখন তারা ইসিটিএর পরিসর সম্প্রসারণ করে আরও বৃহৎ বাণিজ্য চুক্তি করা যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা করছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২ এপ্রিল ভারত, চীনসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশের পণ্যে পারস্পরিক শুল্ক (বা আমদানি শুল্ক) আরোপ করেন। যদিও ৯ এপ্রিল তিনি এই শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন, যার মেয়াদ চলতি বছরের ৯ জুলাই পর্যন্ত। তবে এই স্থগিতের আদেশ চীন ও হংকংয়ের জন্য প্রযোজ্য নয়। এর মধ্যে প্রায় ৭৫টি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির বিষয়ে আগ্রহ জানিয়েছে। চীনের পণ্যে ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। তবে এর মধ্যে ২ এপ্রিল ঘোষিত ১০ শতাংশ ন্যূনতম শুল্ক কার্যকর থাকবে। এ ছাড়া ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম ও গাড়ির সামগ্রীতে ২৫ শতাংশ শুল্ক আছে।
২০৩০ সালের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ৫০০ বিলিয়ন বা ৫০ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত করতে চায় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। যদিও বর্তমানে দেশটির মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য মাত্র ১৯১ বিলিয়ন বা ১৯ হাজার ১০০ কোটি ডলারের।
মোট ১৯টি অধ্যায় নিয়ে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি করা হবে। পণ্য, সেবা, শুল্ক সহজীকরণ, বিনিয়োগসহ আরও নানা বিষয় থাকবে এতে। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে শুল্ক উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে ভারতের বাজারে তাদের উৎপাদিত বৈদ্যুতিক গাড়ি, বিভিন্ন শিল্প পণ্য, মদ, দুগ্ধজাত পণ্য, পেট্রোকেমিক্যাল, আপেলসহ বিভিন্ন পণ্যের শুল্ক হ্রাস করা হোক। এর বদলে ভারত চায় টেক্সটাইল, পোশাক, গয়না, রত্ন, চামড়াজাত পণ্য, রাসায়নিক, চিংড়ি, তেলবীজ ও হর্টিকালচার পণ্যের প্রবেশাধিকার।
২০২১-২২ অর্থবছর থেকে শুরু করে ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার ছিল যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের পণ্য বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত ছিল ৪১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ১৮০ কোটি ডলার; আগের কয়েক বছরের তুলনায় যা বেশি। এই ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যঘাটতি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওয়াশিংটন সফরের সময় প্রথম এ নিয়ে আলোচনা হয়। এরপর দেশটির বাণিজ্যমন্ত্রী পিয়ুষ গয়াল ৪-৬ মার্চ ওয়াশিংটন সফর করেন। ওই সফরে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি ও বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেন।
এরপর যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া–বিষয়ক সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডন লিঞ্চ ২৫-২৯ মার্চ ভারত সফর করেন। তখনো এ নিয়ে আরেক দফা আলোচনা হয়। সেই সফরের পর এখন ভারতীয় দল যুক্তরাষ্ট্র সফর করছে।
২০২১-২২ অর্থবছর থেকে শুরু করে ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার ছিল যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের পণ্য বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত ছিল ৪১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ১৮০ কোটি ডলার; আগের কয়েক বছরের তুলনায় যা বেশি। এই ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যঘাটতি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আরও যা যা করেছে ভারত
ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের হাত থেকে বাঁচতে ভারত শুরু থেকেই তৎপর। তারা জানত, মার্কিন পণ্যে শুল্ক কমানো না হলে তাদের অবস্থাও চীনের মতো হতে পারত। সে জন্য তারা আগে থেকেই কর হ্রাসসহ নানাবিধ উদ্যোগ নেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য যেমন কাঠবাদাম ও ক্র্যানবেরিতে তারা আগেও শুল্ক কমিয়েছে। চলতি বছরের মার্চে তারা এসব পণ্যে আরও শুল্ক হ্রাসের প্রস্তাব দেয়। রয়টার্সের আরেক সাংবাদে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা ২৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্যের মধ্যে ৫৫ শতাংশের ওপর শুল্ক কমাতে রাজি হয়েছে ভারত।
৬ মার্চ লোকসভায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ভারতের গড় আমদানি শুল্ক কমিয়ে ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ করা হয়েছে। দেশটির বাণিজ্য ও শিল্প প্রতিমন্ত্রী জিতিন প্রসাদ এক প্রশ্নের জবাবে জানান, ২০২৩ সালে ভারতের সরল গড় শুল্কহার ছিল ১৭ শতাংশ। ২০২৫-২৬ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটের পর সরল গড় শিল্প শুল্ক ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।
সম্প্রতি লোকসভায় অর্থ বিল পাসের সময়ে ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য যে ৬ শতাংশ করারোপ করা হতো, সেটাও তুলে নেওয়া হয়েছে। মূলত ইলন মাস্কের এক্স, গুগল ও মেটার ওপর এই শুল্ক আরোপ করা হতো। বার্তা পরিষ্কার, সুর নরম করেছে নয়াদিল্লি।
এ ছাড়া চলতি বছরের বাজেটে মার্কিন মোটরসাইকেলে শুল্ক হ্রাস করে ভারত। তখন মার্কিন ব্র্যান্ড হারলে ডেভিডসনের আমদানিতে ভারত আরও ১০ শতাংশ শুল্ক হ্রাস করে। এর আগে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারত হারলে ডেভিডসনের ওপরে ৫০ শতাংশ শুল্ক কমিয়েছিল। এবারের বাজেটে যা আরও কিছুটা কমানো হয়।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শ ল ক কম র প কর মন ত র র জন য দশম ক আমদ ন বছর র
এছাড়াও পড়ুন:
সোনালী ও রূপালী মুনাফায়, অগ্রণী ও জনতা লোকসানে
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে গত বছরের শেষে রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংকের মধ্যে দুটিই বড় ধরনের লোকসানে পড়েছে। বেক্সিমকো, এস আলম গ্রুপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপি হয়ে যাওয়ায় দেশের শীর্ষ লোকসানি ব্যাংকে পরিণত হয়েছে জনতা ব্যাংক। ব্যাংকটি গত বছর শেষে একাই লোকসান করেছে ৩ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। অন্যদিকে অগ্রণী ব্যাংক লোকসান করেছে ৯৮২ কোটি টাকা।
তবে হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর ঘুরে দাঁড়িয়েছে সোনালী ব্যাংক, গত বছর শেষে ব্যাংকটি মুনাফা করেছে ৯৮৮ কোটি টাকা; আর রূপালী ব্যাংক মুনাফা করেছে ১১ কোটি টাকা।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংকের মধ্যে অগ্রণী ও জনতা মিলে গত বছর শেষে লোকসান করেছে ৪ হাজার ৪৮ কোটি টাকা। আর সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংক মিলে মুনাফা করেছে ৯৯৯ কোটি টাকা। তবে চার ব্যাংকই মন্দঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে নিজেদের চাহিদামতো ছাড় পেয়েছে। এ কারণে কাগজে–কলমে জনতা ও অগ্রণী লোকসান কিছুটা কম দেখাতে পেরেছে; আর সোনালী ও রূপালীর মুনাফা বেড়েছে। কারণ, নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হয় মুনাফা থেকে। নিয়ম অনুযায়ী, মন্দঋণের বিপরীতে যথাযথ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখলে ব্যাংকগুলোর আর্থিক চিত্র আরও খারাপ হতো। ব্যাংক চারটির নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। দেশে রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক মোট ছয়টি। উল্লেখিত চারটির বাইরে বাকি দুটি হচ্ছে–বেসিক ব্যাংক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড বা বিডিবিএল।
নানা অনিয়ম–দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রমালিকানাধীন এসব ব্যাংক আর্থিক সংকটে পড়লে বিভিন্ন সময় সরকার জনগণের করের টাকায় মূলধন জোগান দিয়েছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদকালে এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে আওয়ামী লীগ নেতাদের পাশাপাশি সরকারঘনিষ্ঠ আমলাদের নিয়োগ দেওয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। ফলে ব্যাংকগুলোতে বন্ধ হয়নি অনিয়ম–দুর্নীতি। এখন লোকসানে থাকা জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক একীভূত করা নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে।
মুনাফায় শীর্ষে সোনালী ব্যাংক
রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোনালী ব্যাংক কয়েক বছর ধরে তাদের মুনাফার ধারা অব্যাহত রেখেছে। ২০২২ সালে ব্যাংকটি ৩৭১ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল, যা ২০২৩ সালে বেড়ে হয় ৬৫১ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০২৪ সালে সোনালী ব্যাংকের মুনাফা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৯৮৮ কোটি টাকায়। ২০১২ সালে হল-মার্ক গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারিতে ব্যাংকটি বড় ধরনের সংকটে পড়েছিল। সেই ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে সোনালী ব্যাংক।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সোনালী ব্যাংক থেকে নানা কৌশলে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছিল হল–মার্ক গ্রুপ। এ ঘটনা ছিল সে সময় দেশের ব্যাংক খাতে ঋণ অনিয়মের সবচেয়ে বড় ঘটনা। তাই দেশজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করেছিল হল–মার্ক কেলেঙ্কারি। শেষ পর্যন্ত ঋণগ্রহীতাকে জেলে যেতে হয়েছিল। এই ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনার পর ব্যাংকটি পুনর্গঠন শুরু হয়। তাতে ধীরে ধীরে দেশের সবচেয়ে বড় এই ব্যাংকের প্রতি আবারও আস্থা ফিরতে শুরু করে আমানতকারীদের।
বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে ব্যাংকটির আমানত ছিল ৬০ হাজার কোটি টাকা। গত জুন শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকায়। ২০১২ সালে ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৪ হাজার কোটি টাকা। গত জুন শেষে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের ঋণের ৩৩ শতাংশই সরকারি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া।
হল-মার্কের ঘটনার পর সোনালী ব্যাংক তাদের ঋণের গতি কমিয়ে দেয়। কৌশলও পাল্টে ফেলে। আগ্রাসী ঋণ না দিয়ে ব্যাংকটি সরকারি বিভিন্ন পণ্যে বিনিয়োগ করতে থাকে। পাশাপাশি বেসরকারি খাতে বিভিন্ন শিল্প গ্রুপকে বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়ার বদলে অন্য ব্যাংককে টাকা ধার দিয়ে সুদ আয়ের পথ বেছে নেয়। আর তাতে ব্যাংকটির আর্থিক ভিত্তি মজবুত হয়। বেড়েছে গ্রাহকও। এক যুগ আগে ব্যাংকটির গ্রাহক ছিল এক কোটির ঘরে। এখন সেই সংখ্যা দুই কোটি ছাড়িয়েছে।
জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শওকত আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঋণের সুদ ও ট্রেজারি খাত থেকে গত বছর আমাদের ভালো আয় হয়েছে। তবে আয়ের ক্ষেত্রে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ট্রেজারি খাতে। আবার অবলোপন করা ঋণ থেকেও ভালো আদায় হয়েছে, যা মুনাফায় যুক্ত হয়েছে। বেসরকারি ঋণের পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের বিপরীতে চাহিদামতো নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়েছে। এরপর মুনাফা এক হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছেছে।’
রূপালী ব্যাংকের মুনাফা কমেছে
রূপালী ব্যাংক ২০২২ সালে ২৮ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল। ২০২৩ সালে সেই মুনাফা বেড়ে দাঁড়ায় ৬২ কোটি টাকায়। তবে ২০২৪ সালে তাদের মুনাফা কমে ১১ কোটি টাকায় নেমে আসে। গত বছরের শেষে ব্যাংকটির আমানত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকায়, যা আগের বছর ছিল ৬৬ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। গত বছরের শেষে ব্যাংকটির ৪১ শতাংশের বেশি ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে। এর ফলে যে পরিমাণ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার কথা, তা সংরক্ষণ করতে হলে ব্যাংকটি লোকসানে পড়ত। তবে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ায় নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে ব্যাংকটিকে ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ কারণে গত বছরের শেষে ব্যাংকটি ১১ কোটি টাকা মুনাফা দেখানোর সুযোগ পায়।
এ নিয়ে রূপালী ব্যাংকের এমডি কাজী মো. ওয়াহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় মুনাফা কমে গেছে। এসব ঋণ আদায়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। ব্যাংকটির আর্থিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য এখন কম সুদের আমানত এনে ভালো ঋণ দেওয়ার চেষ্টা করছি।
রেকর্ড লোকসানে জনতা ব্যাংক
রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা জনতা ব্যাংকের। ২০২২ সালে ১১৩ কোটি টাকা এবং ২০২৩ সালে ৬২ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল ব্যাংকটি। আর ২০২৪ সাল শেষে ব্যাংকটি রেকর্ড ৩ হাজার ৬৬ কোটি টাকা লোকসান করেছে। এই লোকসান রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক খাতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় লোকসানের রেকর্ড হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ব্যাংকটি প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে ছাড় নিয়েছে। যদিও খেলাপিঋণের বিপরীতে ওই পরিমাণ নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হতো, তাহলে লোকসানও কয়েক গুণ বেড়ে যেত। ব্যাংকটি এই চরম দুর্দশায় পড়েছে বিদায়ী সরকারের মেয়াদে লাগামহীন ঋণ দেওয়ার কারণে, যেসব ঋণ এখন খেলাপি হতে শুরু করেছে।
গত মেয়াদে ব্যবসায়ীদের কয়েকজন ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ব্যাংকটি থেকে সবচেয়ে বেশি ঋণ পেয়েছেন। ফলে ১০টি শিল্প গ্রুপের কাছে ব্যাংকটির ৫৫ শতাংশ ঋণ আটকা পড়েছে। প্রভাবশালী এসব গ্রাহকের দেওয়া বেশির ভাগ ঋণ ফেরত আসছে না, এতে গত বছরের শেষে ব্যাংকটির ৬৬ দশমিক ৮ শতাংশ ঋণখেলাপি হয়ে গেছে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৬৭ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। ব্যাংকটির পরিস্থিতি এমন নাজুক অবস্থায় পৌঁছেছে যে সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো বেশ কঠিন। কারণ, এসব ঋণ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আদায় হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আবার গ্রাহকদের অনেকেই লাপাত্তা, কেউ জেলে আবার কারও কারখানা বন্ধ।
জনতা ব্যাংক একসময় ছিল দেশের ভালো ব্যাংকগুলোর মধ্যে অন্যতম। ব্যাংকটির অর্থায়নে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন দেশের অনেক শিল্পোদ্যোক্তা। রপ্তানি বাণিজ্যতেও শীর্ষ পর্যায়ে ছিল। সেই ব্যাংক এখন নাজুক পরিস্থিতিতে। কারণ, গত ১৫ বছরে বড় ধরনের ঋণ অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে ব্যাংকটিতে। যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন ব্যাংকটির কিছু কর্মকর্তা ও বিভিন্ন সময়ে পর্ষদে থাকা আওয়ামীপন্থী পরিচালকেরা। যদিও এসব অনিয়মে জড়িত ব্যক্তিদের কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি।
২০২৪ সাল শেষে জনতা ব্যাংকের আমানত কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৯ হাজার ৮০৯ কোটি টাকা, ২০২৩ সালে যা ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা। ২০২৩ সাল শেষে ঋণ ছিল ৯৮ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা, যা গত বছর শেষে বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৮০০ কোটি টাকা। তবে চলতি বছর ব্যাংকটির আমানত বেড়েছে। তবে গত জুন শেষে ব্যাংকটির আমানত বেড়ে আবার ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
জনতা ব্যাংকের শীর্ষ পাঁচ খেলাপি গ্রাহকের কাছেই আটকে আছে খেলাপি ঋণের প্রায় ৭০ শতাংশ অর্থ। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় খেলাপি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ। জনতা ব্যাংকে বেক্সিমকো গ্রুপের মোট ঋণের পরিমাণ ২৩ হাজার কোটি টাকা। এরপর শেখ হাসিনা ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা। শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচয় দেওয়া অ্যাননটেক্স গ্রুপের খেলাপি ঋণ ৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ক্রিসেন্টের খেলাপি ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। থার্মেক্স গ্রুপের খেলাপি ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। সিকদার গ্রুপের খেলাপির পরিমাণ ৮৫০ কোটি টাকা।
অগ্রণী ব্যাংকও লোকসানে
মুনাফার দিক থেকে অগ্রণী ব্যাংক একসময় ভালো অবস্থানে থাকলেও ২০২৪ সালে ব্যাংকটি বড় ধরনের লোকসান করেছে। ২০২২ সালে ১১০ কোটি টাকা, ২০২৩ সালে ৬৯ কোটি টাকা মুনাফা করা ব্যাংকটি ২০২৪ সালে ৯৮২ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া, নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশনিং ঘাটতি এবং অদক্ষতাই এই লোকসানের অন্যতম কারণ। গত বছরের শেষে ব্যাংকটির আমানত ছিল ৯৯ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা, ঋণ ছিল ৭৯ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪১ শতাংশ ঋণই খেলাপি হয়ে গেছে। গত জুন শেষে ব্যাংকটির আমানত বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। আর এ সময়ে ঋণ বেড়ে হয়েছে প্রায় ৭৮ হাজার কোটি টাকা। জনতা ব্যাংকের মতো অগ্রণী ব্যাংকও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীদের ঋণ দিয়ে এখন সংকটে পড়েছে।
ব্যাংকটির সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবু নাসের বখতিয়ার প্রথম আলোকে বলেন, গত ১৫ বছরে নিয়মের বাইরে যেভাবে ঋণ দেওয়া হয়েছে, এখন তা বেরিয়ে আসছে। নিরাপত্তা সঞ্চিত সংরক্ষণে ছাড় না নিলে ব্যাংকটির লোকসান আরও অনেক বেশি হতো। যদি প্রকৃত লোকসানের চিত্র সবাই জানত, তাহলেই ভালো হতো। এই ব্যাংকের ঋণের অনেক টাকা বাইরে চলে গেছে। এ জন্য ঘুরে দাঁড়াতে বেশ সময় লাগবে। ব্যাংকটির গ্রাহকদের মধ্যে যাঁরা এখন দেশে আছেন, ব্যবসা চালাচ্ছেন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছেন, তাঁদের আরও সহায়তা দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখতে হবে। তাহলে ব্যাংকটি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াবে।