ছবি: সংগৃহীত

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

শৈশবের এক অন্ধ জানালা

‘দরজার ওপাশে তুমি কী দেখতে পাও?’

‘আরেকটি দরজা।’

‘আর সেই দরজার ওপাশে?’

‘একটি বাড়ি।’

‘বাড়িটির ভেতরে কী আছে?’

‘উঠোনে একটি বড় গাছ।’

‘গাছের পরে?’

‘দূরে একটি পাহাড়।’

‘পাহাড়ের চূড়ায় কী আছে?’

‘ভাঙাচোরা এক দুর্গ।’

‘যোদ্ধারা কি পাহাড় থেকে নেমে এসেছে?’

‘আমি কোনো যোদ্ধা দেখতে পাচ্ছি না।’

‘তারা কি তাদের রাইফেলগুলো ইতিহাসের ডাস্টবিনে ফেলে রেখে গেছে?’

‘আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।’

‘দুর্গের পেছনে কী আছে?’

‘একটি কামান।’

‘আর তারপর?’

‘তারপর সবকিছু অস্পষ্ট। আমি আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। এত দূরে কেউ দেখতে পায় না।’

‘কিন্তু আমি তোমাকে পুরো দৃশ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিনি, শুধু দরজার ওপাশে কী আছে, তা জানতে চেয়েছিলাম।’

‘এটা ঠিক না! তুমি আমাকে এই সব প্রশ্ন করে করে এত দূরে টেনে নিয়ে গিয়েছ।’

‘তুমি কি গল্প আর দৃশ্যের খেলায় প্রশ্নগুলোকে একটা ফাঁদ বলে মনে করো? তুমি কি তোমার সীমিত কল্পনাশক্তিকে পুষ্ট করার জন্য এমন একটি দৃশ্য খুঁজছ? যাক, সেসব কথা থাক। এগুলো এখন একপাশে রাখো। চলো, আমাদের চিন্তাগুলো নতুন করে সাজাই। যদিও আমি স্পষ্ট দেখি না, অথবা হয়তো আমি সেগুলো একেবারেই দেখতে পাই না। সত্যি বলতে, আমি চাই না কোনো কিছু এত সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো থাকুক। এখানে আমি মেহরাবের পাশে বসে আছি, আমার গায়ে আলো পড়ছে তা অনুভব করছি। বছরের পর বছর ধরে, আমি আলো নিয়েই ভাবছি। মনে হচ্ছে আলোটা পূর্ব দিক থেকে আসছে, কিন্তু আমি তোমার কাছ থেকে নিশ্চিত হতে চাই। তুমি এখন স্কুলে যাও, তাই দিকদিশা খুব ভালো করে জানো। আমি ততটা নিশ্চিত নই। পথটা কি তুমি চেনো?’

‘কোন পথের কথা বলছ, দাদু?’

‘ভালো প্রশ্ন। এখন কিছুক্ষণের জন্য পথ এবং তোমার প্রশ্নগুলো একপাশে রাখি। বরং চলো, দৃশ্যগুলো গুছিয়ে নিই এবং দৃশ্যের বিস্তারিত অংশগুলোতে এক ভিন্ন পথে যাই। আমি যে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, তা হলো ১৯৭৯ সালে নির্মিত আমার ছোট্ট মসজিদের পশ্চিম দিক। তখন কোনো দেয়াল ছিল না। এই জায়গাটি আমাদের আত্মার মতোই খোলা ছিল; বিশাল, পাহাড়ে ঘেরা, এখানে-সেখানে খেজুরপাতার তাঁবু খাটানো থাকত। তখনো বিদ্যুৎ আসেনি। সন্তানদের নিয়ে আমি এখানে নামাজ পড়তাম। তারপর, সবকিছু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেল। সময় আর শৈশব উড়ে গেল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বিদেশে চলে গেল, আবার কেউ যুদ্ধে গিয়ে আর কখনো ফিরে এল না। দেয়ালগুলো বাড়তে লাগল আর ঘর হয়ে গেল, যার ফলে আরও দেয়াল এবং আরও গোপন রহস্যের জন্ম হলো। শৈশবের জানালাগুলো অকালেই বন্ধ হয়ে গেল। আমি একটি ঘর পেয়েছিলাম, দক্ষিণ দিকে একটা ছোট খামার আর বিদ্যুতের সংযোগসহ। ১৯৮৯ সালে প্রথম বৈদ্যুতিক পাখার বাতাস অনুভব করেছিলাম, কিন্তু আমি কখনো আলো জ্বলতে দেখিনি। বৎস, অন্ধরা দৃষ্টিসম্পন্নদের পাণ্ডুলিপিতে বিস্মৃত এক পাদটীকা মাত্র, তাদের তাড়াহুড়োর অন্ধকারে পরিত্যক্ত এক ক্র্যাচের মতো।’

‘কিন্তু দাদু, এই দেয়ালের সঙ্গে ওই দরজা আর প্রশ্নের ফাঁদের কী সম্পর্ক?’

‘বিষয়ের শুরুটা বুঝতে হলে, তোমাকে অবশ্যই তাদের স্মৃতি আর ইতিহাস গড়তে হবে। তাই চলো আবার দৃশ্যপটটা সাজাই: তোমার সামনে কী আছে? আমাকে বিস্তারিত বলো।’

‘একটি সাদা দরজা, খোলা।’

‘খোলা সাদা দরজার ওপাশে কী আছে?’

‘আরেকটি দরজা, লোহার তৈরি এবং সবুজ।’

‘আর সবুজ লোহার দরজার ওপাশে কী আছে?’

‘একটি সাদা বাড়ি, পাশে একটি নীল পানির ট্যাংক রাখা।’

‘সাদা বাড়ির দেয়ালে তুমি কী দেখতে পাচ্ছ?’

‘একটি কালো দাগ, নর্দমা থেকে নেমে এসে ছোট একটি সাইকেলের কাছে থেমে গেছে।’

‘ওই দাগটি বাড়ির গভীর একটি দুঃখ, যা এর বাসিন্দাদের আত্মা ও হৃদয়ে গেঁথে আছে।’

‘তুমি কীভাবে জানো, দাদু?’

সবকিছুরই নিজস্ব দুঃখ বা আনন্দ আছে, তবে শর্ত হলো মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে, বিনা চাপে ধৈর্য নিয়ে তাদের বেদনা বুঝতে হবে। কারণ, জিনিসগুলো তাদের স্মৃতি, আবেগ এবং উন্মাদনা কেবল তাদের বন্ধুদের কাছেই প্রকাশ করে, যারা তাদের ছায়াকেও পর্যন্ত চেনে।

‘অন্ধরা তোমার চেয়ে বেশি বোধসম্পন্ন, বাছা। তোমার প্রশ্নগুলো একপাশে রেখে দাও। চলো গল্পটা আবার শুরু করা যাক। মনে রেখো, তাড়াহুড়ো কথা বলার আনন্দ নষ্ট করে। আমাদের কি গল্পের ভঙ্গুর শরীরকে তিরের মতো প্রশ্ন দিয়ে আঘাত করা উচিত? তাহলে তো বলার মতো আর কিছুই থাকবে না। তুমি শুধু তোমার স্মৃতিতে অস্পষ্ট এক দৃশ্যের বিবরণ পুনরুদ্ধার করছ, প্রশ্নের শিকড় ধরে ভঙ্গুর ও ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা গল্প তৈরি করার চেষ্টা করছো। প্রশ্নই আসলে গল্পের খুঁটি, যারা ভাষার শিকড় আঁকড়ে থাকে। তুমি শুধু সামনে যা দেখো তাই দেখো, অথচ আমি আমার স্মৃতিতে তাদের ইতিহাস তৈরি করি। ইতিহাস ছাড়া কোনো গল্প নেই, অনুভূতি ছাড়া কোনো ইতিহাস নেই, ব্যথা ছাড়া কোনো অনুভূতি নেই। কেবল অন্ধ, নারী এবং পাগলরাই সত্যিকারের গল্প আর তার শিকড় ছুঁতে পারে।’

‘দাদু, তুমি অন্ধ হয়েও অনেক দূরের জিনিস দেখতে পাও। দুঃখিত, কিন্তু আমি কেবল চোখের সামনে যা আছে, সেটাই দেখতে পাই। অথবা আমি যা কল্পনা করতে পারি, শুধু সেটুকুই।’

‘খুব ভালো। তাহলে আমরা আবার বাড়িটির দিকে ফিরে যাই, বিশেষ করে দেয়ালটার দিকে। দেয়ালে তুমি কী দেখতে পাও?’

‘যেমনটা আমি বলেছিলাম, ওপর থেকে নেমে আসা একটি কালো দাগ।’

‘দাগটি ওপর থেকে নেমে আসছে নাকি নিচ থেকে ওপরে উঠছে, তাতে কিছু আসে যায় না। উভয় ক্ষেত্রেই, এটি বাড়িটির দুঃখকে নির্দেশ করে। যদি নেমে আসে, তাহলে দুঃখ বাড়িটির শিকড় কুরে কুরে খাচ্ছে। আর যদি ওঠে, তাহলে দুঃখ ছড়িয়ে পড়ছে বাড়িটির কোণে-কোণে, যুগে-যুগে।

‘দেয়ালও কি দুঃখী হতে পারে, দাদু?’

‘সবকিছুরই নিজস্ব দুঃখ বা আনন্দ আছে, তবে শর্ত হলো মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে, বিনা চাপে ধৈর্য নিয়ে তাদের বেদনা বুঝতে হবে। কারণ, জিনিসগুলো তাদের স্মৃতি, আবেগ এবং উন্মাদনা কেবল তাদের বন্ধুদের কাছেই প্রকাশ করে, যারা তাদের ছায়াকেও পর্যন্ত চেনে। বৎস, জিনিসগুলো হলো এক মায়ের কোমল হৃদয়ের মতো, কিংবা মৃত্যুপথযাত্রী দাদির স্নেহের মতো।’

‘দাদু, তুমি যদি অন্ধ হও, তাহলে জিনিসগুলোর দুঃখ কীভাবে অনুভব করো? যখন তুমি দেখতে পাও না, তখন ছায়া কীভাবে পড়বে?’

‘এটা সত্য যে আমি দেখতে পাই না, কিন্তু অনুভব করতে পারি। এমনকি সময়কেও—যা তুমি অনুভব করতে পারো না—আমি তার দুঃখ অনুভব করি, ভোরবেলায় তাদের ভেতরে জেগে ওঠা নির্মল আনন্দ, মধ্যরাতে তাদের নীরবতাও অনুভব করি।’

‘কিন্তু তুমি কীভাবে অনুভব করো, দাদু?’

‘বৎস, অন্ধ মানুষকে জিজ্ঞাসা করো না কীভাবে সে তার আত্মা দিয়ে বস্তুর গভীরতা ভেদ করতে পারে, কারণ, তার উপলব্ধির এমন এক ক্ষমতা আছে, যা দৃষ্টিসম্পন্নরা বুঝতে পারে না। পাহাড়কে তাদের মহিমা এবং একাকিত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করো না, বিধবাদের কাছে তাদের দুঃখ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করো না, পাখিদের জিজ্ঞাসা করো না বসন্তের আনন্দ। কারণ, এ সবকিছুই শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা ছাড়াই তার সারসত্য প্রকাশ করে।’

‘তাহলে কেন বলো সেই সাদা বাড়ির দেয়ালটা দুঃখী? হতে পারে সেই কালো দাগটা তার চোখে সুখের কাজল।’

‘বাছা, যখনই তুমি সাদা দেয়ালে কালো কিছু দেখবে, সেই বাড়ির মানুষের দুঃখের কথা ভাববে।’

‘কিন্তু দাদু, একই বাড়িতে কি দুঃখ আর আনন্দ একসঙ্গে মিশে থাকতে পারে না?’

‘অবশ্যই পারে, বাছা। আচ্ছা, বাড়ির পাশে ওই নীল রঙের পানির ট্যাংকটা কী করছে? মানুষ কি তৃষ্ণার্ত? সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে আমি যে কুয়োটা খুঁড়েছিলাম, তা কি শুকিয়ে গেছে?’

‘দাদু, নীল পানির ট্যাংক দেখলেই কি বোঝা যায় মানুষ তৃষ্ণার্ত? তুমি কি গল্প বানাচ্ছ নাকি আসল ঘটনা বলছ? সাদা দেয়ালে কালো দাগ কি সত্যিই দুঃখের চিহ্ন? যদি নীল রঙের ট্যাংকের পরিবর্তে অন্য গাড়ি থাকত? তাতে তোমার অনেক দিন আগে খনন করা কুয়োর কী সম্পর্ক থাকতে পারে?’

‘এগুলো নিয়ে ভেবো না। শিশুরা সব সময় বিরক্ত থাকে অথবা তাড়াহুড়ো করে, গভীর কিছু বোঝে না। হয়তো তুমি আমাদের গল্পের সম্ভাবনার খেলা একদিন বুঝতে পারবে। সম্ভাবনার সুরক্ষা দড়ি ছাড়া এই খেলায় তাড়াহুড়ো করো না, যাতে বাস্তবতার ফাঁদে পড়ে না যাও।’

‘আমি বুঝতে পারছি না তুমি কী বলছ। কিন্তু আমি সাদা দেয়ালের পাশে একটি নীল রঙের পানির ট্যাংক দেখতে পাচ্ছি।’

‘ট্যাংকটা যেখানে আছে, সেখানেই থাকতে দাও। এখন, ড্যাশবোর্ডে ড্রাইভাররা সাধারণত কিছু জিনিস রেখে যায়। তুমি কি সেগুলো আনতে যেতে পারো?’

‘দাদু, এই জিনিসগুলো কি তোমার গল্পের জন্য দরকার? এটা কি তোমার কল্পনার কোনো খেলা?’

‘বৎস, গল্পের শিকড় থাকে ছোটখাটো খুঁটিনাটি বিবরণে। এই বিবরণগুলো লবণের মতো। এগুলো ছাড়া তুমি গল্পের আসল স্বাদ নিতে পারবে না।’

অন্ধ মানুষকে জিজ্ঞাসা করো না কীভাবে সে তার আত্মা দিয়ে বস্তুর গভীরতা ভেদ করতে পারে, কারণ, তার উপলব্ধির এমন এক ক্ষমতা আছে, যা দৃষ্টিসম্পন্নরা বুঝতে পারে না। পাহাড়কে তাদের একাকিত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করো না, বিধবাদের কাছে তাদের দুঃখ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করো না, পাখিদের জিজ্ঞাসা করো না বসন্তের আনন্দ।

শিশুটি সাদা দরজা দিয়ে বের হয়ে দৌড়ে গেল নীল ট্যাংকের দিকে। আর অন্ধ বৃদ্ধের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল তার সাদা দাড়িতে। সে হাত দিয়ে ছুঁয়ে আর্দ্রতা অনুভব করল।

কালের শুভ্রতা এবং স্মৃতির অন্ধকারে মিশে গেল চোখের জল। শিশুটি যেসব জিনিস ও জায়গার কথা জিজ্ঞেস করেছিল, সেগুলো সম্পর্কে অবগত সেই মানুষটির ওপর স্মৃতির বন্যা নেমে এল। যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, পর্বত, গল্প এবং খরার বছরগুলো অন্ধ লোকটির জীবনের মধ্য দিয়ে কেটে গেল, যখন যুদ্ধের দামামা বাজতে থাকল, গোত্রগুলোর মধ্যে সংঘাত শুরু হলো। লোকটির স্মৃতি সুদূর অতীতে ছড়িয়ে পড়ার আগেই, শিশুটি কাগজপত্রের একটি গুচ্ছ এবং একটি নীল নোটবুক নিয়ে ফিরে এল। সে আবার বসে পড়ল তার অন্ধ দাদুর পাশে।

শিশুটি যখন নীল নোটবুকটি খুলল, তখন ভাঁজ হয়ে থাকা পাতা, পুরোনো বিদ্যুৎ বিল এবং একটি নীল কলম পড়ে গেল। অন্ধ মানুষটি শব্দে চমকে উঠলেন। শিশুটি একটি কাগজ তুলে নিয়ে জোরে জোরে কিছু অপরিচিত নাম এবং সংখ্যা পড়তে লাগল।

নাসের বিন আবদুল্লাহ, ১৫ রিয়াল। সালেম বিন মোহাম্মদ, ২০ রিয়াল। আল-শারকি সন্স, ১০। মালাবারি রেস্তোরাঁ, ১০।

অন্ধ বৃদ্ধ অধৈর্য হয়ে উঠলেন। তিনি শিশুটিকে বললেন, ‘নোটবুকটা ভালো করে দেখো। পানি বিক্রেতারা তাদের রহস্য নোটবুকে লুকিয়ে রাখে, বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার আগে।’

শিশুটি নীল নোটবুকটির পাতা ওল্টাতে লাগল, মাঝেমধ্যে থেমে আরও নাম এবং সংখ্যা পড়তে লাগল। নোটবুকের মাঝামাঝি কোথাও সে মাকড়সার জালের মতো আঁকাবাঁকা হাতের লেখায় একটি চিঠি দেখতে পেল। সে শব্দগুলো বানান করে পড়ার চেষ্টা করল। দাদু চুপ করে শুনতে থাকলেন।

‘প্রিয় বাবা ও মা, আমি তোমাদের কাছে এই চিঠি পৌঁছাতে চাই, যদিও আমি আজ পর্যন্ত কাউকে চিঠি পাঠাইনি। এমনকি যখন আরবি শিক্ষক আমাদের ক্লাসে বন্ধুকে চিঠি লিখতে বলেছিলেন, আমি বন্ধুত্বের কথা লিখেছিলাম। তিনি রেগে গিয়ে আমাকে পাঁচবার চিঠি লিখতে বাধ্য করেছিলেন। আমি কোনো প্রেমপত্র, বিদায়পত্র বা সরকারের কাছে কিছু চাওয়ার জন্যও চিঠি লিখিনি। আমি সরকারের কাছে কিছু চাইতে পছন্দ করি না, যদিও আমাদের সরকার যারা কিছু চায়, তাদের ভালোবাসে। তাই আমি আমার জীবনে কখনো চিঠি লিখিনি।

রাস্তা মানুষকে তাদের বাড়ি এবং গন্তব্যে নিয়ে যায়। আর আমি এখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি তোমাদের অপেক্ষায় ক্ষয়ে যাওয়া, ব্যাকুল হয়ে ওঠা হৃদয় নিয়ে। খুব চেষ্টা করছি, যেন কেউ আমার চোখের জল দেখতে না পায়। আমি তোমাদের দুজনকেই খুব মিস করি। মা, ভোরবেলায় তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে মন চায়। বাবা, ফজরের নামাজের পর কফি হাতে নেওয়ার আগে তোমাকে ভীষণ মনে পড়ে। তোমাদের ছাড়া জীবনের মানে কী, আমি বুঝি না। তোমাদের হারানোর ব্যথা যখন আমার আত্মাকে বিদ্ধ করে, সবকিছু তখন ধূসর মনে হয়। তোমাদের অবর্তমানে সবকিছু ম্লান লাগে। আমাদের বাড়ির উঠানের গাছটিও এখন প্রাণহীন। তোমাদের ভীষণ মিস করছি।’

অন্ধ দাদু তার চোখের জল লুকানোর চেষ্টা করলেন শিশুটির কাছ থেকে, যে কিনা এই অশ্রুর কারণ কিংবা চিঠি ও পানির ট্যাংকের সঙ্গে তার দাদুর সম্পর্ক কিছুই বুঝতে পারছিল না। নীরবতা ঘিরে রেখেছিল চারপাশ। শিশুটি তার দাদুর সাদা দাড়িতে ঝরে পড়া অশ্রুগুলোর দিকে তাকিয়ে বুঝতে চাইছিল কেন তিনি কাঁদছেন। সে কিছু জিজ্ঞাসা করতে গেলে দাদু আরও কেঁদে ফেলতে পারে, এই ভয়ে কোনো প্রশ্ন করতে ভরসা পেল না। সে আবার দরজাগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার কথা ভাবল।

‘দাদু, এই দরজাগুলো সাদা বাড়ির দিকে খোলা কেন? দ্বিতীয় দরজাটি সবুজ হলো কেন? তুমি কি এখন পুরো গল্পটা বলবে?’

দাদু কিছুক্ষণ দাড়িতে হাত বুলিয়ে অশ্রুর আর্দ্রতা অনুভব করলেন। তারপর বললেন: ‘ক্ষতি আর দুঃখ দিয়ে কখনো কোনো গল্প দাঁড় করানো যায় না, বাছা। বরং সেগুলো গল্পকে টুকরো টুকরো করে দেয়, এর সংযোগগুলো ছিন্ন করে। দরজাগুলো খোলা আছে, যাতে তুমি দেখতে পাও কীভাবে সময়ের তির সবকিছু ছিন্নভিন্ন করে দেয়।

দাদু কিছুক্ষণ দাড়িতে হাত বুলিয়ে অশ্রুর আর্দ্রতা অনুভব করলেন। তারপর বললেন: ‘ক্ষতি আর দুঃখ দিয়ে কখনো কোনো গল্প দাঁড় করানো যায় না, বাছা। বরং সেগুলো গল্পকে টুকরো টুকরো করে দেয়, এর সংযোগগুলো ছিন্ন করে। দরজাগুলো খোলা আছে, যাতে তুমি দেখতে পাও কীভাবে সময়ের তির সবকিছু ছিন্নভিন্ন করে দেয়। আর দ্বিতীয় দরজার সবুজ রঙের ব্যাপারে, তোমার কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত যে এটি সিমেন্টের বর্বরতাকে প্রশমিত করে।’

কান্না থামানোর পর নীল পানির ট্যাংকের পাশের যে লোকটি তার মৃত বাবা-মাকে সাদা বাড়িতে চিঠি লিখেছিল, সে মসজিদের ভেতরে এল। নিঃশব্দে সে নামাজ পড়ল, আর অন্ধ দাদু ও শিশুটি তার পেছনে দাঁড়িয়ে রইল।

পাহাড়ের পাদদেশে শিকড় গেড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি গাছ বিষণ্নভাবে শিশু ও তার অন্ধ দাদুর কথোপকথন শুনছিল, পুরো গল্পটি না বুঝেও দাদুর অশ্রু ও বেদনায় কাতর হয়ে সে শুনছিল। সে গাছ দাদুকে চিনত সেই সময় থেকে, যখন সে নিজে ছিল একটি চারাগাছ, ভোরবেলা সে দাদুকে পথে হাঁটতে দেখেছে, শীতে চুল্লির উষ্ণতায় তার গল্প শুনেছে। অন্ধ দাদু ও তার নাতির গল্প পুনর্গঠন করতে সে সাদা বাড়ির উঠোনের বড় গাছটিকে ডাক দিল, যে গাছ সম্পর্কে দাদু আগে জিজ্ঞাসা করেছিলেন।

‘প্রিয় গাছ, তুমি তো এই বাড়ির আনন্দ আর দুঃখের পাহারাদার। দাদু এত কাঁদলেন কেন, যেন তিনি এক শিশু?’

‘আহ, দূরের গাছ, ভোরের বন্ধু, দুপুরের সাথি: প্রতিটি বাড়িরই নিজস্ব গোপন কথা ও ক্ষত আছে। তুমি দাদুকে আমার চেয়ে ভালো করে জানো। তুমি তাকে যুবক বয়সে দেখেছ, অথচ আমি সব সময় এই সিমেন্টের বাড়িতে বাঁধা পড়ে আছি। কিন্তু আমি তোমাকে এটুকু বলতে পারি: জীবনের সন্ধ্যাবেলায় কোনো মানুষই তার সন্তানকে নিজের আগে চলে যেতে দেখার কষ্ট সহ্য করতে পারে না। মসজিদে নামাজ পড়া মানুষটির সঙ্গে কী ঘটেছিল, তা আমি বুঝতে পারি। মৃত্যুর মুখোমুখি হলে মানুষ শিশুর মতোই হয়ে যায়, বয়স যতই হোক না কেন। নামাজ পড়া মানুষটি এক দিনে তার মা–বাবা দুজনকেই হারিয়েছে। এখন তার মনে হয় সে সবকিছুই হারিয়ে ফেলেছে। তার স্বপ্নে সে দেখে তার মা তাকে ডাকছে। ইয়াকুবের মতো তার চোখ সাদা হয়ে গেছে শোকে।’

মানুষটি নামাজের শেষ সিজদাহ দেওয়ার আগেই বাড়ির গাছটি চুপ হয়ে গেল।

কখনো পাঠানো হবে না, এমন একটি চিঠি যে মানুষটি লিখেছিল, সে তার নীল নোটবুক নিয়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে এল।

সম্পর্কিত নিবন্ধ