নারী ও পুরুষদের আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এমন দৃশ্য কখনও দেখা যায়নি, এক ইনিংসে ১০ জন ব্যাটার রিটায়ার্ড আউট! শনিবার ব্যাংককে অনুষ্ঠিত নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এশিয়া বাছাইপর্বে কাতারের বিপক্ষে এমন বিরল রেকর্ড গড়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত নারী দল।

টস জিতে প্রথমে ব্যাট করে আরব আমিরাত ১৬ ওভারে তোলে ১৯২ রানের বিশাল সংগ্রহ। ওপেনার ইশা ওঝা খেলেন ৬৭ বলে ১১৩ রানের দুর্দান্ত ইনিংস, অধিনায়ক থিরথা সাতিশের ব্যাট থেকে আসে ৪৩ বলে ৭৪ রান। তবে এরপর হঠাৎ করেই ম্যাচে নামে বৃষ্টি। সময় বাঁচাতে দ্রুত ইনিংস শেষ করার প্রয়োজন দেখা দেয়।

কিন্তু আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ইনিংস ঘোষণার নিয়ম না থাকায় ভিন্ন কৌশল নেয় আমিরাত.

দুজন ওপেনারকে ‘রিটায়ার্ড আউট’ ঘোষণা করার পর বাকি ১০ ব্যাটারকে কোনো বল না খেলেই রিটায়ার্ড আউট দেখিয়ে ইনিংস সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। এদের মধ্যে ৮ জন ব্যাটারই শূন্য রানে রিটায়ার্ড আউট হন।

এর জবাবে ব্যাট করতে নেমে পুরোপুরি ব্যর্থ কাতার। ২৯ রানে অলআউট হয়ে তারা হার মানে ১৬৩ রানের বড় ব্যবধানে। কাতারের ৭ ব্যাটার রান খাতাও খুলতে পারেননি, যা নারী টি-টোয়েন্টিতে আরেকটি নেতিবাচক রেকর্ড।

বাছাইপর্বের ‘বি’ গ্রুপে টানা জয় নিয়ে শীর্ষে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। এখান থেকে সেরা তিন দল খেলবে সুপার থ্রি রাউন্ডে, যেখান থেকে দুটি দল পাবে ২০২৬ নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলার টিকিট।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র ট য় র ড আউট আম র ত

এছাড়াও পড়ুন:

চূড়ান্ত পরাজয়ের আগে বুদ্ধিজীবী হত্যা

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর শিক্ষাবিদ ও নাট্যকার মুনীর চৌধুরীকে দুপুরে খেতে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তাঁর মা আফিয়া বেগম। দরজার কাছে একদল লোক এসে বলল, ‘আমাদের সঙ্গে একটু যেতে হবে।’ তিনি আর ফিরে আসেননি। একই দিনে আড়াই মাসের সন্তান কোলে নিয়ে বসে ছিলেন তরুণ বিজ্ঞানী মো. আমিনউদ্দিন। তিনি বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (সায়েন্স ল্যাবরেটরি) ঊর্ধ্বতন গবেষণা কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁকে নেওয়া হলো তাঁরই গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে। আমিনউদ্দিনও আর ফেরেননি। সাংবাদিক নিজামুদ্দীন আহমদকেও এভাবেই তুলে নেওয়া হয়েছিল সন্তানদের সামনে থেকে। রশীদ হায়দার সম্পাদিত এবং বাংলা একাডেমি প্রকাশিত স্মৃতি: ১৯৭১ বইয়ে জানা যায় তাঁদের মতো আরও বহু শহীদ বুদ্ধিজীবীর শেষ সময়ের ঘটনার স্মৃতি। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্বজনদের লেখায় মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত

বিজয়ের সঙ্গে একাকার হয়ে যায় বেদনাময় স্মৃতির আরেক ইতিহাস।

বুদ্ধিজীবীদের যে বেছে বেছে ঘর থেকে তুলে নিয়ে পাকিস্তানিরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে, তা জানা গিয়েছিল বিজয় অর্জনের পরপরই। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় ছিলেন মার্কিন সাংবাদিক পিটার আর কান। তাঁর সে সময়ের দিনপঞ্জি পরে ছাপা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল পত্রিকায়। তাতে ১৮ ডিসেম্বর পিটার লিখেছিলেন, ‘আজকের দিনের প্রথম ভাগে মুক্তিরা বিখ্যাত বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের গণকবর খুঁজে পান, যাঁদের স্থানীয় সামরিক বাহিনীর সদস্যরা জিম্মি করেছিল এবং গত দিনের আগের রাতে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ঐতিহ্যগতভাবে এটি একটি রক্তরঞ্জিত সমাজ, যেটি সদ্যই ৯ মাসের রক্তগঙ্গার মধ্য দিয়ে গেছে।’

মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহর থেকে বিজয়ের আগমুহূর্ত পর্যন্ত বহু বরেণ্য বুদ্ধিজীবীকে এভাবে আমরা হারিয়েছি। বহুল পরিচিতদের মধ্যে আছেন গোবিন্দচন্দ্র দেব, মুনীর চৌধুরী, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, রাশীদুল হাসান, আবুল খায়ের, আনোয়ার পাশা, সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, আলতাফ মাহমুদ, নিজামুদ্দীন আহমদ, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, ফজলে রাব্বী, আলীম চৌধুরী, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, সেলিনা পারভীন প্রমুখ। তাঁদের বাইরেও আছেন অনেকে। বুদ্ধিজীবীদের এই হত্যাযজ্ঞে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করে আলবদর বাহিনীসহ বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী একটি গোষ্ঠী।

ডিসেম্বরে বাংলাদেশের বিজয় যখন আসন্ন, তখন অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। তবে মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাস ধরেই দেশের প্রতিটি অঞ্চলে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়।

দেশজুড়ে হত্যাযজ্ঞ

পিরোজপুরে সাঈফ মীজানুর রহমানকে জিপের পেছনে বেঁধে গোটা পিরোজপুর শহর ঘুরিয়েছিল পাকিস্তানি সেনারা। পরে তাঁকে গুলি করে বলেশ্বর নদে ফেলে দেওয়া হয়। ম্যাজিস্ট্রেট ও ট্রেজারি কর্মকর্তা সাঈফ ট্রেজারি থেকে টাকা আর অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। ছাত্র অবস্থায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফজলুল হক ছাত্র সংসদের সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক।

সিলেটের লাক্কাতুরা চা-বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক ছিলেন সৈয়দ সিরাজুল আব্দাল। তাঁর শরীর থেকে রক্ত টেনে বের করে নেওয়া হয়েছিল। এর সাক্ষী ছিলেন সিলেটের পুরোনো পত্রিকা যুগভেরীর সম্পাদক আমিনূর রশীদ চৌধুরী। সিরাজুল আব্দালের পরিবার ফেরত পেয়েছিল একটি কঙ্কাল। আবদাল পাকিস্তানি সেনাদের কাছে প্রথম রোষে পড়েছিলেন বাংলা বর্ণমালার ছোট্ট একটা বই ছাপার সূত্র ধরে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মীর আবদুল কাইয়্যুমের বাড়িতে কিছু লোক এসে বলেছিল, ‘স্যার, একটু বাইরে আসবেন?’ স্ত্রী মাসতুরা খানমের নিষেধ অমান্য করে তিনি দরজার বাইরে গিয়েছিলেন। আর ফিরে আসেননি।

এভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনা ঘটেছে মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাসজুড়ে। প্রথমা প্রকাশনের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী: স্মৃতি জীবন যুদ্ধ বইয়ে সংকলিত হয়েছে ৩৫৪ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর পরিচিতি ও মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের অবদানের কথা। এই সংকলন থেকে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় যে ঢাকার বাইরেও সমানভাবে চলেছে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। মানিকগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁসহ আরও কয়েকটি জেলায় প্রাণহারানো বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা অনেক।

দেশব্যাপী পরিচালিত ৯ মাসের গণহত্যায় অগণিত মানুষের প্রাণদানের সীমাহীন ট্র্যাজেডিতে ভয়াবহ মাত্রা যোগ করেছিল বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড। এর কোনো সামরিক কার্যকারণ ছিল না, ছিল বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে প্রবল আক্রোশ। যাঁরা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাঁদের হত্যা করে দেশটির ভবিষ্যৎকে মেধাশূন্য করে দিতে চেয়েছিল পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা।

তাঁরা কতজন

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত চার পর্বে ৫৬০ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম প্রকাশ করেছে। প্রথম দফায় ১৯১, দ্বিতীয় তালিকায় ১৪৩, তৃতীয় দফায় ১০৮ জন এবং চতুর্থ দফায় ১১৮ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নামের গেজেট প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তবে গবেষকেরা বলেন, এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি। গত বছরের মার্চে চতুর্থ দফার পর আর কোনো তালিকা প্রকাশিত হয়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের মধ্যে কতজন বুদ্ধিজীবী ছিলেন, তার সঠিক সংখ্যা এখনো পাওয়া যায় না। তালিকায় যাঁদের নাম জানা যায়, তাঁদের অধিকাংশই শহরকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী শ্রেণির মানুষ।

২০১৩ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের মামলায় জবানবন্দিতে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সাক্ষ্য দিয়ে বলেছিলেন, ‘একাত্তরের আগস্টে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। ডিসেম্বরে আলবদর বাহিনী এই পরিকল্পনা কার্যকর করতে শুরু করে। প্রকাশিত তথ্যমতে, মঈনুদ্দীন এই হত্যাকাণ্ড পরিচালনার দায়িত্বে এবং আশরাফুজ্জামান এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন।’

এ প্রসঙ্গে বারবার উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের প্রধান জেনারেল রাও ফরমান আলীর একটি তালিকার কথা। স্বাধীনতার পর বঙ্গভবন থেকে রাও ফরমান আলীর যে ডায়েরি পাওয়া যায়, তাতে নিহত ও জীবিত বুদ্ধিজীবীদের একটি তালিকা ছিল। স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ওয়েবসাইট ‘সংগ্রামের নোটবুক’-এর একটি অনলাইন পেজের ছবিতে দেখা যায়, রাও ফরমান আলীর হাতে লেখা বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকায় আছে মুনীর চৌধুরীসহ আরও বহু বুদ্ধিজীবীর নাম।

তাঁদের অবদান

আনোয়ার পাশার রাইফেল রোটি আওরাত উপন্যাস, মুনীর চৌধুরীর কবর নাটক কিংবা আলতাফ মাহমুদের ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানের সুর বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্রটির সঙ্গে মিলেমিশে আছে।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী: স্মৃতি জীবন যুদ্ধ বইয়ের ভূমিকায় লেখা হয়েছে, ‘আমাদের বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন মেধাবী। মেধার চেয়েও বড় আরেকটা বিপজ্জনক অস্ত্র তাঁদের ছিল: বিবেক। বিবেকের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন তাঁরা। নিজেরাই হয়ে উঠেছিলেন জাতির বিবেকের কণ্ঠস্বর। তাঁরা অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যমুক্ত আধুনিক প্রগতিশীল দেশ চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন মানুষের অধিকারের প্রতিষ্ঠা।’

সেই যে আমাদের শ্রেষ্ঠ মানুষদের আমরা হারালাম, সেই ক্ষতি আজও পোহাতে হচ্ছে জাতিকে। এ ক্ষতি কোনো দিন পূরণ হবে না, হবেও না।

তথ্যসূত্র

১. স্মৃতি: ১৯৭১ (প্রথম খণ্ড), সম্পাদক: রশীদ হায়দার, বাংলা একাডেমি, ২০১৭

২. ‘মার্কিন সাংবাদিকের মুক্তিযুদ্ধের ঢাকা ডায়েরি’, প্রথম আলো, ১৬ ডিসেম্বর ২০২১

৩. মুক্তিযুদ্ধের ১০টি তারিখ, সম্পাদক: সাজ্জাদ শরিফ, প্রথমা প্রকাশন, ২০২০

৪. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী: স্মৃতি জীবন যুদ্ধ, সম্পাদক: আনিসুল হক, প্রথমা প্রকাশন, ২০২৪

৫. ‘বাবাকে ওরা তুলে নিয়ে গেল’, মেজর (অব.) সৈয়দ জামিল আব্দাল, প্রথম আলো, ১৫ এপ্রিল ২০২৩

৬. ‘স্যার, একটু বাইরে আসবেন’, মাহবুবা কানিজ, দ্য ডেইলি স্টার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২০

সম্পর্কিত নিবন্ধ