‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ ট্যাগিং কিংবা নিপীড়নের নতুন হাতিয়ার
Published: 18th, May 2025 GMT
দেশে সম্প্রতি ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ ট্যাগিং খুব ‘জনপ্রিয়’ হয়ে উঠেছে। এখানে বিভিন্ন ট্যাগিং ব্যবহার করা হয় প্রতিপক্ষ, অপছন্দের লোকের ওপর। ইংরেজিতে একটা কথা আছে– ‘গিভ এ ডগ এ ব্যাড নেম অ্যান্ড হ্যাং হিম’। কাউকে কোনো নাম দাগিয়ে দিলে তাকে বধ করা বা তার ক্ষতি করা সহজ হয়ে ওঠে। গত দেড় দশক এখানে ‘রাজাকার’ বা ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ ট্যাগ দেওয়া হতো প্রতিপক্ষকে বধ করতে।
এখন ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ ট্যাগ দিয়ে যাকে তাকে, যখন তখন হেনস্তা করা যাচ্ছে। রাস্তায় লোক জড়ো করে পেটানো যাচ্ছে। এমনকি পিটিয়ে মেরেও ফেলা যাচ্ছে। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রায় নীরবে এসব দেখছে। তারা বেতনের দাবিতে জড়ো হওয়া কারখানার শ্রমিকদের পিটিয়ে ছত্রভঙ্গ করতে পারলেও কোনো এক আশ্চর্য কারণে এদের সঙ্গে ঠিক পেরে উঠছে না।
এরা ইভটিজারকে ছাড়িয়ে নিতে থানায় ঢুকে হুমকি-ধমকি দিতে পারে। গুলশানের মতো এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনে, টিভি ক্যামেরার সামনে অন্যের বাড়ি লুট করে বীরদর্পে বেরিয়ে যেতে পারে। কেউ এদের টিকিটি ছুঁতে পারে না। এরা ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে আজ অমুককে পেটায়, কাল তমুককে পেটায়, পরশু চাকরি খায়, তরশু সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করে।
বাংলাদেশে গত ১৫ বছর ছিল দুঃস্বপ্নের। আপস করতে করতে মানুষ একসময় সয়েও গিয়েছিল। কিন্তু সহ্যেরও শেষ আছে। সেটা অতিক্রমের পর মানুষ প্রতিবাদ করেছে। রাস্তায় যারা নেমেছিল তারা প্রাণের মায়া করেনি। বরং প্রাণ দিয়েছে অকাতরে। অন্ধ হয়েছে, পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। এক ভয়ংকর স্বৈরশাসকের কবল থেকে অনেক প্রাণের বিনিময়ে মুক্তি পেয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু তারপর থেকে যেন সব শাসনের বেড়ি টুটে গেছে। কয়েকজন লোক জোগাড় করতে পারলে এখন বেআইনি সব করা যাচ্ছে।
এরা ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ কথাটা খুব গ্রহণ করেছে। কারও সম্পত্তি দখল করতে হবে– নাম দাও ফ্যাসিবাদের দোসর। কারও চাকরি খেতে হবে– নাম দাও ফ্যাসিবাদের দোসর। কারও প্রেমিকাকে হেনস্তা করতে হবে। ফ্যাসিবাদের দোসর নাম দিয়ে যাকে খুশি পুলিশে দিয়ে দাও। পুলিশ অন্যদের সামলাতে না পারলেও ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ পাকড়াও করতে বেশ সফলতার পরিচয় দিয়েছে।
গত দেড় দশকে প্রতিটি মানুষকে কোনো না কোনোভাবে আপস করে বসবাস করতে হয়েছে। সরকারি চাকরিজীবীদের বাধ্যতামূলকভাবে দেখাতে হয়েছে তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছে। নইলে তাদের পদোন্নতি তো দূরের কথা, চাকরি বাঁচানোই মুশকিল হতো। ব্যবসায়ীদের দেখাতে হয়েছে তাদের চেয়ে বড় আওয়ামী লীগ নেই। নইলে তারা ব্যবসা করতে পারত না। বুদ্ধিজীবীদের উনিশবার বলতে হয়েছে তাদের পরিবার আওয়ামী সমর্থক তবু নেহাতই যৌক্তিক কারণে সমালোচনাটা করতেই হচ্ছে। এসব না করলে রেহাই ছিল না কারও, সমালোচনা করতে হলেও প্রচুর গুণগান গেয়ে নিতে হতো প্রথমে। সেটাই ছিল তখনকার সমালোচনার কৌশল। বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে থেকে কোনো কৌশলের আশ্রয় না নিয়ে স্পষ্টভাবে সরকারের বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা করতে পেরেছেন এমন মানুষ দশজনও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। তারপরও কখন কাকে সাদা পোশাকের লোক এসে তুলে নিয়ে যায় সেই ভয়ে সর্বদা তটস্থ থেকেছে মানুষ। মানুষ আর মানুষ থাকেনি, হয়ে উঠেছিল মানবেতর। সরকার সমর্থিত একদল লুটেরা ছাড়া দৃশ্যত এখানে সবাই যাপন করছিল প্রজার জীবন।
শেখ হাসিনা তাঁর জমিদারিতে কাউকে নাগরিক ভাবতেন না, সবাই ছিল তাঁর প্রজা। এখানে কৌশলে বাঁচতে হয়েছিল মানুষকে। সুতরাং কোনো না কোনো যুক্তিতে প্রায় সবাইকেই ফ্যাসিবাদের দোসর নাম দিয়ে দেওয়া যাবে এখন। কেননা, সবাইকেই আপস করে চলতে হয়েছে। এমনকি যে সমন্বয়কদের নেতৃত্বে মানুষ পথে নামল এদেরও অনেকেই সরাসরি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল গণআন্দোলনের আগেও। আন্দোলন শুরু হলে অনেক মানুষ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের পদ ত্যাগ করে সাধারণের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছিল। শেখ হাসিনার পুলিশ ছাত্রদের গুলি করার পরপরই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগের ছেলেরা পদত্যাগ করছিলেন। তখনকার পত্রপত্রিকা নিয়মিত পড়েছেন যারা তাদের মনে থাকার কথা ঘটনাগুলো। সুতরাং, ফ্যাসিবাদের দোসর নাম দিতে চাইলে সম্ভবত যে কাউকে এই নাম দিয়ে দেওয়া যাবে। তাহলে গত ১৫ বছরে যারা সরাসরি নির্যাতিত হয়েছেন, তারা বাদে এই দেশে কি সবাই নির্যাতনযোগ্য এখন?
বিগত আমলে রাজাকার নাম দিয়ে মানুষকে হেনস্তা করা হয়েছে, এখন নাম দেওয়া হচ্ছে ফ্যাসিবাদের দোসর। এই নামে ডেকে যে কাউকে সামাজিক, শারীরিক, মানসিক আক্রমণ করা যাচ্ছে। ব্যক্তিগত রাগ-ক্ষোভ চরিতার্থ করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের প্রধান দুই দলের একটি। স্বভাবতই এই দলের সমর্থন করেন এমন মানুষের সংখ্যা এখনও কম নয়। শুধু দলটিকে সমর্থন করার কারণে এমন অনেক মানুষ নিগৃহীত হচ্ছেন যারা কোনো অপরাধের সঙ্গে সরাসরি জড়িত নন। এমন অনেক মানুষ যারা এমনকি কোনো দলের সমর্থক নন, তারাও আখ্যা পাচ্ছেন ফ্যাসিবাদের দোসর। শত্রুতাবশত বা লুটপাটের জন্য এই বিশেষণ দেওয়া হচ্ছে যাকে তাকে।
আওয়ামী লীগের আমল থেকেই এখানে ‘মামলা বাণিজ্য’ নামে একটি কথা চালু হয়েছে। মামলার ভয় দেখিয়ে অথবা মামলায় নাম দিয়ে পরবর্তী সময়ে সেই নাম কাটানোর কথা বলে নিরীহ মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা নেওয়া হয়। ৫ আগস্টের পর মামলা বাণিজ্য শুরু হয়েছে আরও জোরেশোরে।
কোনো অবস্থাতেই সাধারণ মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারে না। এটা কোনো নতুন বন্দোবস্ত নয়। এটা পুরোনো স্বৈরাচারী মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ। এটা জুলাই আন্দোলনের চেতনার সঙ্গে স্পষ্টভাবে সাংঘর্ষিক। মানুষ একটি উন্নতর ব্যবস্থার জন্য রাস্তায় নেমেছিল। এমন স্বৈরাচারী ব্যবস্থা পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নয়।
মেহেদি রাসেল: কবি ও প্রাবন্ধিক
mehedirasel32@gmail.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আওয় ম সমর থ সরক র ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
ইউরোপের সবচেয়ে বাজে ক্লাব তারা, ৩৫ ম্যাচের একটিও জেতেনি
ইউরোপিয়ান ফুটবলে অপরাজিত থেকে মৌসুম শেষ করার অনেক দৃষ্টান্ত আছে। গত মৌসুমে জার্মান চ্যাম্পিয়ন বায়ার লেভারকুসেন যখন অপরাজিত মৌসুম শেষ করার অপেক্ষায় ছিল, তখন এই রেকর্ড নিয়ে অনেক মাতামাতিও হয়েছে।
তবে এবার লেভারকুসেনের উল্টো চিত্রই উপহার দিচ্ছে চেক প্রজাতন্ত্রের ক্লাব এসকে দিনামো চেস্কে বুদেয়োভিৎসে, যারা এখন পর্যন্ত চলতি মৌসুমে ৩৫ ম্যাচ খেলে কোনোটিতেই জিততে পারেনি। এখনো মৌসুমে ২ ম্যাচ বাকি আছে তাদের। এই দুই ম্যাচে জিততে না পারার ধারা বদলাতে পারে কি না, সেটাই দেখার অপেক্ষা।
চেক ফুটবলের শীর্ষ স্তরের লিগে চেস্কে বুদেয়োভিৎসের অবস্থান স্বাভাবিকভাবেই এখন সবার নিচে। ৩৩ ম্যাচে তাদের পয়েন্ট মাত্র ৬। পুরো মৌসুমে এখন পর্যন্ত একটা ম্যাচও জিততে পারেনি তারা। এমনকি ২৬ এপ্রিল ম্লাদা বোলেস্লাভের কাছে ২-১ গোলের হারের পর অবনমনও নিশ্চিত হয়ে যায় তাদের।
এরপরও অবশ্য থামেনি হারের ধারা। এমনকি গত বছরের জুনে সিলোন তাবোরস্কোর বিপক্ষে রেলিগেশন প্লে-অফে জয়ের পর এখন পর্যন্ত কোনো লিগ ম্যাচে জেতেনি চেস্কে বুদেয়োভিৎসে। লিগে ৩৩ ম্যাচে জয়হীন থাকার পাশাপাশি চেক কাপেও ২ ম্যাচ খেলে কোনোটিতে জিততে পারেনি তারা।
আরও পড়ুনআর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ফ্রান্স, ইংল্যান্ডের কোচরা কে কত টাকা বেতন পান১৫ মে ২০২৫এমন পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় ফুটবলে জয়হীন ধারার কথা উঠলে চেক প্রজাতন্ত্রের এই ক্লাবের দুর্দশার সঙ্গে তুলনা টানার মতো আর কোনো ক্লাব নেই। একুশ শতকে শীর্ষ স্তরের ফুটবলে আর কোনো দলের এত বেশি ম্যাচ জয়হীন থাকার রেকর্ডও খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, কোথায় ভুল করেছে তারা?
চেক ফুটবলের ইতিহাসে এই মৌসুম নিঃসন্দেহে চেস্কে বুদেয়োভিৎসের জন্য অন্যতম ভয়াবহ এক মৌসুম হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ক্লাবটির জয়হীন মৌসুমের পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। ট্রান্সফারমার্কেট-এর তথ্যবিশ্লেষক ও চেক ফুটবলবিশেষজ্ঞ আন্তোনিন শ্রায়ের বলেন, ‘গত মৌসুমে দিনামো কোনোমতে অবনমন প্লে-অফ জিতে লিগে টিকে ছিল। আর ট্রান্সফার উইন্ডোতে দলটি তাদের স্কোয়াড অনেকটাই দুর্বল করে ফেলে। তাই মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই তাদের অবনমন হওয়ার একটা আশঙ্কা ছিল। কিন্তু কেউই ভাবেনি যে তারা পুরো মৌসুমে একটা ম্যাচও জিততে পারবে না, এমন কিছু ঘটে যাওয়ার শঙ্কা সামান্যই ছিল।’
অনুশীলনে চেস্কে বুদেয়োভিৎসের খেলোয়াড়রা