বার্ট্রান্ড রাসেল বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নামে একটি পুস্তক রচনা করেছিলেন ১৯৩১ সালে। সেটা ছিল প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী কাল। পৃথিবী তখন যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ইতিমধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানেরও প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছিল। তা যে মানুষের শুভবুদ্ধিকে জাগ্রত করেনি, বরং তার ধ্বংসস্পৃহাকে উপ্ত করে রেখেছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধই তার প্রমাণ। কিন্তু এরই মধ্যে বিবেকবান, প্রগতিশীল, শান্তিবাদী মানুষদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিরও প্রসার ঘটেছিল; সেই দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা ঘটেছিল গ্যালিলিওর মাধ্যমে। তারপর কেপলার, নিউটন, ডারউইন, আইনস্টাইন, পাভলভের মতো বড় একদল বৈজ্ঞানিকের আবিষ্কার ও দর্শনের মধ্য দিয়ে সেই মনোভাব মূর্ত রূপ পেয়েছিল।
রাসেল ছিলেন সেই মনোভাবের অন্যতম প্রবক্তা। তিনি বলেছেন, ‘বিজ্ঞান নামটি যা বোঝায়, তা প্রাথমিকভাবে হলো জ্ঞান; প্রথাগতভাবে তা নির্দিষ্ট কিছু ধরনের জ্ঞান; যা হলো সুনির্দিষ্ট কিছু ফ্যাক্টের সঙ্গে সম্পর্কিত করে সাধারণ সূত্রের অনুসন্ধান।’ কিন্তু সেই জ্ঞান যে মানুষকে শান্তি ও সুখের কাছে নিয়ে যায় না, তার কথা বলেন রাসেল। তিনি তাই বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রজ্ঞার যোগের কথা বলেন। রাসেল তাঁর বিভিন্ন রচনা ও উল্লিখিত বইটিতেও যৌক্তিক তথা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি যখন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেন, অন্তিম বিশ্লেষণে তা দাঁড়ায় জ্ঞানসমৃদ্ধ প্রজ্ঞাময় দৃষ্টিভঙ্গিতে। এই বইতে রাসেল আমাদের সেই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির দিশা দেন, কিন্তু আমাদের আরও এগিয়ে যেতে বলেন। ‘একটি বৈজ্ঞানিক সভ্যতাকে যদি উত্তম সভ্যতা হয়ে উঠতে হয়, তাহলে জ্ঞানের বৃদ্ধিকে প্রজ্ঞার বৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয়। প্রজ্ঞা বলতে জীবনের লক্ষ্যের সঠিক ধারণাকে বোঝায়। এটি এমন কিছু যা খোদ বিজ্ঞান প্রদান করে না। ফলে বিজ্ঞান যদিও প্রগতির প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহ করে, তবু খোদ বিজ্ঞানের অগ্রগতি নির্ভেজাল প্রগতি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়।’ এমনই ঘটছে বৈজ্ঞানিক পৃথিবীতে। তাই আমাদের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে প্রজ্ঞাময় জীবন অনুসরণ করতে হবে, এমন ‘বাণীই’ এই পুস্তকের মূল বক্তব্য।
বার্ট্রান্ড রাসেল (১৮ মে ১৮৭২-২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭০) ব্রিটিশ দার্শনিক, প্রভূত গ্রন্থ ও প্রবন্ধের রচয়িতা, শান্তিবাদী ‘অ্যাকটিভিস্ট’, গণবক্তা, গণবুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও নোবেল পুরস্কারে ভূষিত সাহিত্যিক হিসেবে বিশ্ব পরিচিত। তিনি ৬০টির অধিক পুস্তক এবং হাজার দুয়েকের মতো প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তিনি ছিলেন বিশ্লেষণী দর্শনের একজন প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর দর্শন, গণিত, যুক্তি, সেট তত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জ্ঞানতত্ত্ব ও অধিবিদ্যায় মৌলিক অবদান রেখেছে। এখনো দর্শন, রাজনীতি ও সমাজতত্ত্বে তাঁর প্রভাব কার্যকর। রাসেল এখনো বাংলাদেশে বা বাংলাভাষী অঞ্চলে জনপ্রিয় দার্শনিক। তাঁর যুক্তিবাদী, শান্তিবাদী এবং সেই সূত্রে মানবতাবাদী দর্শন সবাইকে প্রবলভাবে মুগ্ধ ও প্রভাবিত করে। তিনি সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি ইন্ডিয়া লিগের সভাপতি হিসেবে শান্তিবাদী মতবাদের জন্য প্রথম মহাযুদ্ধের সময় জেল খেটেছিলেন। তিনি যুদ্ধের অবসান ঘটানো এবং বিশ্বে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ‘বিশ্ব সরকার’ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।
প্রথমে বলা যাক শান্তির কথা, যুদ্ধবিরোধিতার কথা। রাসেল ছিলেন স্তালিনবাদী সর্বনিয়ন্ত্রণবাদের সর্বাত্মক বিরোধী ব্যক্তিত্ব এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার কট্টর সমালোচক। পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে তাঁর মতবাদ যেমন তাঁকে নন্দিত করেছে, তেমনই কায়েমি স্বার্থ কর্তৃক নিন্দিতও করেছে। তিনি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ শান্তিপ্রিয় মানুষ, যেমন আইনস্টাইন, লিওপোল্ড ইনফেল্ড, ফ্রেডারিক, জুলিও কুরিসহ ১১ জন বিশ্বখ্যাত মানুষের সঙ্গে যুদ্ধবিরোধী ‘রাসেল-আইনস্টাইন’ মেনিফেস্টো প্রণয়ন করেছিলেন। কিন্তু আজ যখন আমরা মধ্যপ্রাচ্যে, গাজায়, ইউক্রেনে, এমনকি আমাদের ঘরের দুয়ারে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের দামামা শুনি, তখন রাসেলের যুক্তিবাদিতাকে, শান্তিপ্রিয়তাকে, তার জন্য সংগ্রাম করাকে প্রভূতভাবে প্রাসঙ্গিক মনে হয়।
গোঁড়া মতবাদের বিরুদ্ধে যুক্তিবাদী বার্ট্রান্ড রাসেল সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন। বুদ্ধিবৃত্তিক জঞ্জাল নামে একটি পুস্তকে তিনি লিখেছেন, ‘বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধগুলো কোনো না কোনোভাবে ডান অথবা বামের গোঁড়া মতবাদের বিকাশকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে রচিত; এই গোঁড়া মতবাদই আমাদের এই ট্র্যাজিক শতাব্দীর বৈশিষ্ট্য।’ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, চিন্তাচেতনার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এমনটিই প্রত্যাশিত ছিল; মানুষের মধ্যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটবে, তথা মানুষ অধিক যৌক্তিক মনোভাবাপন্ন হবে, সেই সঙ্গে শান্তিপ্রিয়ও হয়ে উঠবে।
গোঁড়া ধর্মমত (ডগমা), কুসংস্কার, কট্টরপন্থী রাজনৈতিক বিশ্বাস, বিভিন্ন ‘কাল্ট’, গুরুবাদ, প্রাচীন সত্যের দোহাই দিয়ে আত্মতুষ্টিমূলক বিশ্বাসের লালন, ‘জনতার জঘন্য মিতালি’তে গড়ে ওঠা বিশ্বাস ও কৃত্য, সর্বোপরি অবৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণা যখন চারদিকে জেঁকে বসে, তখন বৈজ্ঞানিক চিন্তার বিকাশ দুরূহ হয়ে পড়ে। অধিকতর বিপজ্জনক ব্যাপার হলো, একসময়ের প্রাসঙ্গিক ও বর্তমানে অচল হয়ে পড়া পুরোনো ধ্যানধারণা, যার সঙ্গে রাজনৈতিক ভাবধারা ও শক্তির মিশেল ঘটে, যখন তথাকথিত প্রাজ্ঞ বুদ্ধিজীবীরা সেই ধ্যানধারণার ধারক ও বাহক হিসেবে তার প্রচার-প্রসারে নিয়োজিত থাকেন, তখন তার বিমোচন অধিকতর কঠিন হয়ে দেখা দেয়। এমন কিছু চিন্তাধারা হচ্ছে ঐতিহাসিক নিয়তিবাদ, যা বিশ্বাস করে যে ইতিহাসের নির্ধারিত গতিপথ আছে, তার একটি ছন্দ বা প্যাটার্ন আছে, যার অন্যতম হলো হেগেলবাদ, মার্ক্সবাদ, রামরাজত্বের পুনরাগমন, ইসলামি স্বর্ণযুগের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। বিজ্ঞানবাদ, গোঁড়া ধর্মীয় মতবাদ ও দর্শন (যাকে ভুলভাবে দর্শন বলা হয়, কারণ, ধর্ম আর দর্শন সত্তাসারে দূরবর্তী দুই প্রত্যয়) ইত্যাদিসহ আরও অনেক অযৌক্তিক মতবাদ আছে, যা মানুষকে অযৌক্তিক পথে পরিচালিত করে। এদের দার্শনিক ভিত্তি যে ভুলে কীর্ণ, এসব তত্ত্ব যে কেবল বিশ্বদৃষ্টিকে ভ্রান্ততায় আচ্ছন্ন করে তা-ই নয়, এদের সঙ্গে সহিংসতার যে যোগ ঘটেছে, তা বিশ্বের বহু প্রাণকে নিরর্থকভাবে কেড়ে নিয়েছে এবং এখনো নিচ্ছে।
বিজ্ঞানবাদ, প্রযুক্তিবাদ বলে কিছু চিন্তাধারা আছে; হালের প্রযুক্তির প্রসারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তা প্রসারিত হয়েছে। তাতে দেখা যায় যে মানুষজন প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা প্রদর্শন করছে, কিন্তু প্রযুক্তির কোনো সত্তাসার নিয়ে তাদের কোনো ভাবনা দেখা দিচ্ছে না। প্রযুক্তির পেছনে যে যুক্তি, উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কাজ করে, তা না জানলেও তাদের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। বরং, অনেকেই তাকে গোঁড়া মতবাদ প্রসারে কাজে লাগাচ্ছে। প্রসঙ্গক্রমে জানানো যায় যে ‘প্রযুক্তির দর্শন’ নামে একপ্রকার দর্শনের প্রসার ঘটছে হাল সময়ে। রাসেল এসব মতবাদকে খণ্ডন করেছেন।
বৈজ্ঞানিক মনোভাবের কথা যখন বলা হয়, তখন তার একটি প্রধান মাত্রা হিসেবে দেখা দেয় যুক্তিবাদ। যুক্তিবাদ সব ধরনের গোঁড়া মতবাদের বিরোধী, অধিকন্তু, যুক্তিবাদের গণতান্ত্রিক না হয়ে উপায় নেই। যুক্তিবাদ আত্মরক্ষামূলক সহিংসতা ভিন্ন সব রকম সহিংসতার বিরোধিতা করে। কিন্তু এমন দেখা যাচ্ছে যে গণতন্ত্রও (বিশেষত গণতান্ত্রিক ভেকধারী রাষ্ট্র) এখন সহিংসতা চালাচ্ছে। তাই তথাকথিত মার্ক্সবাদী, সমাজতন্ত্রীরা যখন সাম্রাজ্যবাদরূপী গণতন্ত্রীদের গণতন্ত্রের প্রতিনিধি হিসেবে চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে যুক্তি তুলে ধরেন, তখন গণতান্ত্রিক ভাবধারা যেমন পরাজিত হয়, বৈজ্ঞানিক ভাবধারাও মার খায়।
রাসেল তাঁর বিভিন্ন রচনায় ও তাঁর পুস্তক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যৌক্তিক তথা বৈজ্ঞানিক মনোভাবের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি যখন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেন, তখন অন্তিম বিশ্লেষণে তা দাঁড়ায় প্রজ্ঞাময় দৃষ্টিভঙ্গিতে। এই পুস্তকে রাসেল আমাদের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির দিশা দেন, কিন্তু আমাদের আরও এগিয়ে যেতে বলেন। ‘একটি বৈজ্ঞানিক সভ্যতাকে যদি উত্তম সভ্যতা হয়ে উঠতে হয়, তাহলে জ্ঞানের বৃদ্ধিকে প্রজ্ঞার বৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয়। প্রজ্ঞা বলতে জীবনের লক্ষ্যের সঠিক ধারণাকে বোঝায়। এটি এমন কিছু যা খোদ বিজ্ঞান প্রদান করে না। ফলে বিজ্ঞান যদিও প্রগতির প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহ করে, তবু খোদ বিজ্ঞানের অগ্রগতি নির্ভেজাল প্রগতি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়।’ এমনই ঘটছে বৈজ্ঞানিক পৃথিবীতে।
রাসেল মানুষ কেন যুদ্ধ করে নামে একটি পুস্তক রচনা করেছেন, যা আমাদের অশুভ প্রবণতার কারণ বর্ণনা করে। তিনি সেখানেই থেমে থাকেননি বরং পথ নির্ণয় করেছেন কীভাবে যুদ্ধ রোধ করা যায়। ‘অধিকাংশ আবেগগত তাড়নাকেই দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে: একটি হলো দখলি মনোভাবাপন্ন এবং আরেকটি হলো সৃজনধর্মী; তদনুসারে একটির লক্ষ্য থাকে কোনো কিছু অর্জন করা বা রক্ষা করার, যা অন্যের সঙ্গে ভাগ করা যায় না; আর দ্বিতীয়টিতে থাকে পৃথিবীর কোনো মূল্যবান জিনিস, যেমন জ্ঞান অথবা শিল্প অথবা শুভেচ্ছা আনয়ন করা, যাতে কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তির মাত্রা থাকে না।’
রাসেল স্পষ্টতই দখলি মনোভাবাপন্ন প্রবণতাকে ক্ষতিকর বলে মনে করেন। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি যে পৃথিবী সেই দর্শনেই ডুবে আছে, সবাইকে তাতে প্রবুদ্ধ করার উদ্যোগ নিচ্ছে। তাই আমরা কি এমন বলব না, রাসেল যে সৃজনধর্মী তাড়না আর শান্তির আকাঙ্ক্ষার কথা বলেন, তা বাস্তবায়ন করার জন্যই আমাদের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। এই পুস্তকের শেষ অধ্যায়ে, যেখানে তিনি ‘আমাদের করণীয়’-এর কথা বলেন, সেখানে বলেছেন, ‘পৃথিবীর যা প্রয়োজন তা হলো প্রজ্ঞা ও আশা; যদিও এটি তার বিরুদ্ধে লড়াই করে, তবু পরিশেষে এটি তাদেরই সম্মান করে।’
রাসেল লিখেছেন, ‘১.
মানুষের প্রকৃতিতে তার আবেগের তাড়না সত্য বটে, কিন্তু তারও অধিক তার আছে যুক্তিবোধ। রাসেল মানুষের সেই যুক্তিবোধের মধ্যে মুক্তি খোঁজেন। সেটি যেমন রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে প্রাসঙ্গিক, তেমনই ধর্মীয়, সামাজিক ও ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলেও প্রাসঙ্গিক। তাই তিনি ধর্মের ক্ষেত্রে অজ্ঞেয়বাদী, রাজনীতির ক্ষেত্রে শান্তিবাদী, দর্শনের ক্ষেত্রে যুক্তিবাদী, অভিজ্ঞতাবাদী এবং সামাজিক ক্ষেত্রে মানবতাবাদী ও যুদ্ধবিরোধী এবং পরিশেষে বিশ্ব সরকার প্রতিষ্ঠার প্রবক্তা।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গণতন ত র র প রস র মতব দ র কর ছ ন তত ত ব র জন ত র জন য মন ভ ব আম দ র কর ছ ল প রগত
এছাড়াও পড়ুন:
আরব বসন্ত যে কারণে ব্যর্থ হয়েছিল...
অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার তাগিদেই মানুষ একটি সংগঠিত কাঠামোর সন্ধান করেছে। সেখান থেকেই রাষ্ট্রের উদ্ভব। ইতিহাসের পরিক্রমায় একে একে আমরা দেখেছি রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের মতো শাসন ব্যবস্থা, যেখানে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা সীমাবদ্ধ ছিল একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতে। রেনেসাঁর পর থমাস হবস, জ্যা-জ্যাঁক রুশো, জন লকের মতো দার্শনিকের চিন্তাধারা আধুনিক রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আটলান্টিক রেভল্যুশন থেকে ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব হয়ে লাতিন আমেরিকার বিপ্লবগুলো ছড়িয়ে দেয় স্বাধীনতার মশাল। গড়ে তোলে আধুনিক গণতন্ত্রের কাঠামো।
বিশ শতকের বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালে গণতন্ত্র সব অঞ্চলে শিকড় গাড়তে পারেনি। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের মতো অঞ্চলে পরিবর্তন ও কল্যাণ রাষ্ট্রের বাণী শুনিয়ে সামরিক বা ভিন্ন কৌশলে ক্ষমতা দখলকারী শাসকরা পরিণত হয়েছেন নতুন শোষকে। তাদের দমনপীড়নের ফলস্বরূপ একুশ শতকে আমরা বিশ্বজুড়ে দেখেছি রোজ বিপ্লব, অরেঞ্জ বিপ্লব, টিউলিপ বিপ্লব ও আরব বসন্ত, যার মধ্য দিয়ে ২০১১ সালে সরকারই পাল্টে যায়। এসব আন্দোলন স্বৈরাচারী শাসকদের পতন ঘটাতে প্রাথমিকভাবে সফল হলেও, গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতায় তাদের সাফল্য ছিল অত্যন্ত সীমিত। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আগের চেয়েও খারাপ হয়েছিল।
ঠিক এমনই ঐতিহাসিক বিশ্ব-প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আমরা দেখি বাংলাদেশে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান। কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যে এভাবে একটি দীর্ঘমেয়াদি স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার পতন ঘটাবে, তা ছিল অভাবনীয়। এই অভ্যুত্থান শুধু সরকারের পরিবর্তন নয়। এটি ছিল বৈষম্যহীন একটি সমাজ, জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র এবং জুলুম-নিপীড়নমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন। প্রায় দুই হাজার শহীদের জীবন এবং ১৫ হাজার মানুষের আহতের বিনিময়ে অর্জিত এই পরিবর্তন সেই স্বপ্নকে কতটা বাস্তবায়ন করল?
আট মাস পেরিয়ে যখন আমরা সেই আত্মত্যাগ এবং স্বপ্ন বাস্তবতার নিক্তিতে মাপি, তখন গভীর হতাশা দেখা দেয়। হাজার হাজার আহত প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও পুনর্বাসন সুবিধা না পেয়ে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। দুর্ভাগ্যজনক, শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। জনগণের মৌলিক আকাঙ্ক্ষাগুলো উপেক্ষিতই রয়ে গেছে।
বিপ্লবের মূল লক্ষ্য ছিল শুধু সরকার পরিবর্তন নয়; রাষ্ট্রের কাঠামো এবং বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ খাতে মৌলিক সংস্কার। কিন্তু আট মাস পরও এসব সেক্টরে কাঙ্ক্ষিত ও কার্যকর সংস্কারের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনের পুরোনো সংকটের পুনরাবৃত্তি। নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে ঐক্যের পরিবর্তে পারস্পরিক দোষারোপ, কাদা ছোড়াছুড়ি এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বই মুখ্য হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে বেদনাদায়ক বিষয় হলো, গত ১৫ বছরে যারা সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী ছিল, তাদের বিচারের আওতায় আনার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
আজ আশঙ্কা হচ্ছে, বাংলাদেশের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানও কি তবে ‘আরব বসন্ত’র মতোই ব্যর্থতার পথে হাঁটছে? আরব বসন্তের ব্যর্থতার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে ছিল মূলত নেতৃত্বের অভাব; বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্যের ঘাটতি; শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা; রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনীর প্রভাব; আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ; অর্থনৈতিক সংকট এবং চরমপন্থি গোষ্ঠীর উত্থান। বিভিন্ন গোষ্ঠী একত্র হয়ে শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করলেও তারা ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র গঠন বা শাসনভার পরিচালনার ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি।
যেমনভাবে আরব বসন্তের আন্দোলনের বেশির ভাগই ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং এর পেছনে কোনো একক বা শক্তিশালী সমন্বিত নেতৃত্ব ছিল না। তেমনিভাবে আমাদের গণঅভ্যুত্থানের পেছনে একক কোনো শক্তির ভূমিকা ছিল না। ধর্মনিরপেক্ষ, ইসলামপন্থি, তরুণ আন্দোলনকারী, আদিবাসী একত্র হয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের পর এর কৃতিত্ব নেওয়াকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে নানা বিতর্ক এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য। যদি বাংলাদেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলো জনগণের আকাঙ্ক্ষা ভুলে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকে এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইনসহ মৌলিক সেক্টরগুলোর সংস্কার উপেক্ষিত হয়, তবে জুলাই বিপ্লবের ব্যর্থতা হয়তো অনিবার্য।
রক্ত দিয়ে লেখা যে গণঅভ্যুত্থান এসেছে, সেটা যদি শুধু ক্ষমতার পট পরিবর্তনের দলিল হয়ে থাকে; জনগণের মুক্তির সনদ না হয়, তবে তা হবে শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা। সময় এখনও শেষ হয়ে যায়নি। ঝরে যাওয়া রক্তকে সম্মান জানিয়ে, আত্মত্যাগকারীদের স্বপ্নকে পাথেয় করে রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে অবশ্যই জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে এবং সুস্থ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জবাবদিহিমূলক রাজনীতির পথে ফিরতে হবে। অন্যথায় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে এবং আমাদের গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থতার করুণ অধ্যায় হিসেবেই লিপিবদ্ধ হবে।
আনিসুর রহমান: শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়