আসছে জুলাইয়ে চূড়ান্ত হতে পারে জুলাই সনদ
Published: 29th, May 2025 GMT
জুনের প্রথম সপ্তাহে দ্বিতীয় ধাপের আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরি হলেই জুলাই সনদ তৈরি করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ। তিনি বলেছেন, কমিশন কতগুলো মৌলিক সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। কিছু বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আরও আলাপ-আলোচনা করতে হবে। আশা করি, জুলাইয়ের মধ্যে একটি নাগরিক সনদ করতে পারব।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত এক সংলাপে তিনি এসব কথা বলেন। জনগণের প্রত্যাশা যাচাইয়ের লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘জাতীয় সনদ ও নাগরিক প্রত্যাশা’ শীর্ষক নাগরিক সংলাপের অংশ হিসেবে এ আয়োজন করা হয়।
আলী রীয়াজ বলেন, জাতীয় সনদের প্রধান উদ্দেশ্য হলো নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণ, ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করা। আমরা এ সনদ প্রণয়নের মাধ্যমে নাগরিকদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর একটি চুক্তি সইয়ের চেষ্টা করছি, যাতে নাগরিকরা দলগুলোকে দায়বদ্ধ করতে পারে।
সুজনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বিচারপতি এম এ মতিনের সভাপতিত্বে সংলাপে আরও বক্তব্য দেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, কমিশনের সদস্য ও সুজন সম্পাদক ড.
লিখিত প্রবন্ধ পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আসিফ মোহাম্মদ সাহান। সঞ্চালনায় ছিলেন সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার।
সংলাপে বক্তারা জানান, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে নাগরিক দলগুলোর অঙ্গীকার থাকতে হবে। সব দলের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে এ অঙ্গীকার থাকা জরুরি। প্রয়োজনে জুলাই সনদে একটি ‘গ্যারান্টি ক্লজ’ রাখতে হবে, যেন এই সনদ মানতে সব দল বাধ্য থাকে। তারা আরও জানান, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য দরকার। দল, সরকার, সংসদ– সব স্থানে একই ব্যক্তি শীর্ষ পদে থাকলে ফের ফ্যাসিবাদ জন্ম নেবে। এ ধরনের পদ্ধতি ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরতন্ত্রের জন্ম দেয়। বিশেষ করে, সরকারপ্রধান ও সংসদ নেতা একই ব্যক্তি থাকতে পারবেন না। এতে সংসদের কাছে সরকারের জবাবদিহি কমে যায়।
নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের ধারণা অবমাননাকর জানিয়ে বলা হয়, নারীদের জন্য সংরক্ষিত ১০০ আসন রাখা এবং সত্যিকার ক্ষমতায়নের জন্য আসনগুলোতে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে সরাসরি নির্বাচন আয়োজন দরকার।
বিচারপতি এম এ মতিন বলেন, শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নির্বাচনই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একমাত্র উপাদান নয়। নির্বাচনের মাধ্যমেই জার্মানি ও চেকোস্লোভাকিয়ায় স্বৈরাচারী শাসকরা ক্ষমতায় এসেছিল। জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম আকাঙ্ক্ষা– প্রয়োজনীয় সেই সংস্কার করা, যাতে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা আর ফিরে না আসতে পারে।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম আকাঙ্ক্ষা– সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উত্তরণ ঘটানো। এজন্য নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন হিসেবে নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের কার্যকর ও সোচ্চার ভূমিকা দরকার। নির্বাচন যাতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে হতে পারে, সেজন্য কতগুলো মৌলিক সংস্কারের ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা এবং অধ্যাদেশের মাধ্যমে কতগুলো আইন পাস হওয়া দরকার। একসঙ্গে দরকার রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংস্কার আনা।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কার্যকরভাবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার বলেন, প্রবাসীদের ভোটার করা জরুরি। অর্থনীতিতে বিপুল অবদান রাখে এমন দেড় কোটি মানুষকে ভোটের বাইরে রাখা– এটা হতে পারে না। তবে আপত্তি জানিয়ে ঢাবি অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ভোটার হওয়া আর সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া এক বিষয় নয়। যারা দ্বৈত নাগরিক, তাদের অন্য রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য থাকে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন কমিশনের প্রধান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অনেকেরই দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকার বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: জ ল ই সনদ ক দলগ ল র ঐকমত য র জন য ক ষমত সরক র দরক র সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক নয়, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির পক্ষে বিএনপি
জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক নয়, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পর্যন্ত থাকতে চায় বিএনপি। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, দলটির নীতিনির্ধারণী নেতারা মনে করেন, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী জুলাই সনদ এবং জুলাই ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হলে ভবিষ্যতে বিতর্ক বা জটিলতা তৈরি হতে পারে। কারণ, ভবিষ্যতেও কোনো স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে এ ধরনের গণ-অভ্যুত্থান হলে তখন তারও সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি উঠতে পারে।
গতকাল সোমবার রাতে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভায় নেতারা এ অভিমত জানিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পাঠানো জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫–এর খসড়া এবং জুলাই ঘোষণাপত্রের চূড়ান্ত খসড়া নিয়ে এ সভা হয়। রাত ৮টা থেকে সভা শুরু হয়ে পৌনে ১২টা পর্যন্ত সভা চলে। সভায় জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্রের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত হয়। গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ সভায় সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি লন্ডন থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গতকাল সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, খসড়ার সঙ্গে তাঁরা মোটামুটি একমত। অঙ্গীকারের বিষয়ে বিএনপি একমত। সেখানে শব্দ, বাক্য গঠনসংক্রান্ত বিষয়ে বিএনপি তাদের পর্যবেক্ষণ কমিশনকে জানাবে।
বিএনপির সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার রাতেই জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়ার কিছু সংযোজন-বিয়োজন করে দলীয় মতামত কমিশনে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পাঠানো জুলাই সনদের খসড়ায় ৭ নম্বর দফায় বলা হয়েছে, ‘২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং গণ-অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সংবিধানে যথাযোগ্য স্বীকৃতি দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকব। ৬ নম্বর দফায় বলা হয়েছে, এই সনদ গৃহীত হওয়ার পর এতে যেসব প্রস্তাব/সুপারিশ লিপিবদ্ধ রয়েছে, সেগুলো পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের দুই বছর মেয়াদকালের মধ্যে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতারা মনে করেন, ঐকমত্য হওয়া সংস্কার প্রস্তাব বা সুপারিশগুলো সরকার গঠনের দুই বছর মেয়াদকালের মধ্যে বাস্তবায়ন সম্ভব। তবে জুলাই সনদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে তাঁদের দ্বিমত আছে। এ ছাড়া জুলাই সনদের খসড়ার বাকি ছয় দফা অঙ্গীকারনামার সঙ্গে তাঁরা একমত। জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে বিএনপির অভিমত হচ্ছে, এর সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হলে অতীতের আরও ঘটনা যেমন নব্বইয়ে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী গণ-অভ্যুত্থান এবং ভবিষ্যতেও গণ-অভ্যুত্থান হলে তারও সাংবিধানিক স্বীকৃতির প্রশ্ন আসবে। এতে করে জটিলতা বাড়তে পারে। তা ছাড়া একাত্তরের মহান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাহাত্তরে প্রণীত সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত ছিল না ২০১১ সাল পর্যন্ত। ওই বছর সপ্তম তফসিলে তা যুক্ত করা হয়, যা চ্যালেঞ্জ করে মামলা হয়েছে।
এমতাবস্থায় জুলাই ঘোষণাপত্রও আলাদা করে সংবিধানে যোগ করা অপ্রয়োজনীয় মনে করে বিএনপি। বরং দলটির নীতিনির্ধারণী নেতারা এটিকে ‘রাজনৈতিক দলিল’ হিসেবে রাষ্ট্রের আর্কাইভে ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র সংরক্ষণের পক্ষে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, একটা বিপ্লবকে সংবিধানে নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তাই জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্রের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিতেই থাকতে চায় বিএনপি।
বিএনপি আগেই জানিয়েছিল, জুলাই ঘোষণাপত্রকে সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে যুক্ত করতে চায় তারা। পুরো ঘোষণাপত্র নয়, অভ্যুত্থানের স্বীকৃতি হিসেবে একটি অনুচ্ছেদে ঘোষণাপত্রের উল্লেখ থাকবে। জানা গেছে, ঘোষণাপত্রের চূড়ান্ত খসড়া নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। দলটি সেখানে ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করাসহ কিছু শব্দ ও ভাষাগত পরিবর্তন এনেছে।
জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেকজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের (বিএনপির) পক্ষ থেকে মতামত জানানো শেষ। যা দেওয়ার দিয়ে দিয়েছি, আমরা আর কোনো মতামত দেব না।’
সংশ্লিষ্ট নেতারা জানিয়েছেন, জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে বিএনপি আর আলোচনা করতে চায় না। তবে জুলাই সনদ নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখবে। কারণ, সংস্কারের ব্যাপারে তারা আন্তরিক।