সোমবার সেন্টার ফর মিডিয়া মনিটরিং (সিএফএমএম) গাজা যুদ্ধে বিবিসির ভূমিকা নিয়ে গালিচায় চেপে রাখা গোমর ফাঁস করে দিয়েছে! এবারই প্রথম বিবিসির বিরুদ্ধে এ ধরনের প্রমাণ পাওয়া গেছে, তা কিন্তু নয়। বিবিসি, ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নালসহ একাধিক পাশ্চাত্য ও মার্কিন সংবাদমাধ্যম বিভিন্ন কলাকৌশলে গাজা নিধনের পক্ষে বয়ান তৈরি করেছে। পাশ্চাত্য সংবাদমাধ্যমের এ ধরনের নিন্দনীয় ভূমিকা কেবল মিডিয়ার চরিত্র উদোম করে তা কিন্তু নয়, বরং এরই মধ্য দিয়ে বিশ্বনেতৃত্ব ও চিন্তা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কপটতার খোলসও উন্মোচিত হয়ে পড়ে। 

আমরা অতীতে দেখেছি কীভাবে ঔপনিবেশিক প্রভুরাষ্ট্র পদ্ধতিগতভাবে প্রজারাষ্ট্রগুলোতে লুণ্ঠন ও জাতি নিধনের মতো ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। আধুনিক জমানায় পাশ্চাত্য দেশগুলো এখনও নতুন কায়দায় পুরোনো কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। গাজা ইস্যুতে পাশ্চাত্য মিডিয়া যে ধরনের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, তার সঙ্গে ঔপনিবেশিত প্রভুরাষ্ট্রের তৎপরতার তুলনা চলে। গাজা যুদ্ধে বিবিসির প্রতিবেদন অনেকটা তাই, যেখানে সংবাদমাধ্যমটি গণহত্যার পক্ষে সম্মতি উৎপাদনে চেষ্টা করেছে। সেন্টার ফর মিডিয়া মনিটরিং প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ‘গাজা যুদ্ধ তুলে ধরতে গিয়ে বিবিসি পদ্ধতিগতভাবে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্টের ভূমিকা রেখেছে।’ 

বিবিসিসহ অপরাপর সংবাদমাধ্যমের এই তৎপরতার লক্ষ্য মূলত ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠী নির্মূলের পক্ষে বিশ্বব্যাপী বয়ান ও সম্মতি উৎপাদন করা। সিএফএমএম তাদের প্রতিবেদনটিতে বিবিসির ৩৫ হাজারের বেশি কনটেন্ট বিশ্লেষণ করেছে। এতে প্রতিষ্ঠানটি দেখিয়েছে, বিবিসিতে স্পষ্টত ফিলিস্তিনিদের মৃত্যু সংবাদ হিসেবে কম গুরুত্ব পেয়েছে। যেমন– গাজায় ইসরায়েলের তুলনায় ৩৪ গুণ বেশি হতাহতের ঘটনা সত্ত্বেও বিবিসি একেকটি মৃত্যুতে ফিলিস্তিনি মৃত্যুর তুলনায় ৩৩ গুণ বেশি কাভারেজ দিয়েছে ইসরায়েলের এবং প্রায় সমান সংখ্যক ভুক্তভোগীর মানবিক প্রোফাইল প্রকাশ করেছে, যা ২৭৯ ফিলিস্তিনি বনাম ২০১ ইসরায়েলি।

শুধু তাই নয়; এই বয়ান প্রতিষ্ঠা করতে বিবিসি হাতিয়ার হিসেবে ভাষার রাজনীতিকে ব্যবহার করেছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি সুপরিকল্পিতভাবে আবেগপ্রবণ ভাষার আশ্রয় নিয়েছে, যাতে প্রোপাগান্ডা সহজেই মনে ঢুকিয়ে দিয়ে সম্মতি উৎপাদন করা যায়। প্রতিবেদন মতে, বিবিসি ইসরায়েলি ভুক্তভোগীদের পক্ষে ৪ গুণ বেশি আবেগপূর্ণ শব্দ ব্যবহার করেছে, ইসরায়েলি হতাহতের ক্ষেত্রে ১৮ গুণ বেশি ‘গণহত্যা’ এবং ২২০ বার ‘হত্যা’ শব্দ ব্যবহার করেছে, যেখানে ফিলিস্তিনিদের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে মাত্র একবার! বিবিসির উপস্থাপকরা ১০০টিরও বেশি নথিভুক্ত ঘটনায় গণহত্যার দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন, যদিও নেতানিয়াহুর বাইবেলের আমালেক তথা ইসরায়েলিদের দুশমনের কথা ও ইসরায়েলি নেতাদের গণহত্যার পক্ষে উৎপাদিত বক্তব্যের কোনো উল্লেখ ছিল না। এ ছাড়া বিবিসি তাদের টিভি ও রেডিওতে ইসরায়েলিদের তুলনায় ফিলিস্তিনিদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে কম। যেখানে ফিলিস্তিনিদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৮৫ জনের, সেখানে ইসরায়েলিদের সাক্ষাৎকার এসেছে ২ হাজার ৩৫০ জনের। এ ছাড়া বিবিসির উপস্থাপকরা ফিলিস্তিনিদের মতামতের তুলনায় ১১ গুণ বেশি ইসরায়েলি দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করেছে, যা ২ হাজার ৩৪০ বনাম ২১৭!

এই অভিযোগের সত্যতা কেবল বিবিসির বিরুদ্ধে পাওয়া গেছে এমন কিন্তু নয়। ২০২৪ সালের ৩০ অক্টোবর গবেষক ও লেখক গ্রেগরি শুপাক আলজাজিরাতে এ বিষয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। তিনি সেখানে দেখিয়েছেন কীভাবে পাশ্চাত্য মিডিয়াগুলো গণহত্যার পক্ষে বয়ান তৈরি করেই যাচ্ছে। গত বছরের ৭ অক্টোবর ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত এক লেখায় গাজাবাসীকে ‘উচ্ছৃঙ্খল’ বলে তুলে ধরা হয়েছে। ওয়াশিংটন পোস্টের একটি লেখা দাবি করা হয়েছিল, ইসরায়েলের এই যুদ্ধ ‘বর্বরতার বিরুদ্ধে চালিত’। নভেম্বরে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস এক লেখায় হামাস ‘সন্ত্রাসী ধর্মান্ধ গোষ্ঠী’ বলে উল্লেখ করেছিল। কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম ‘ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার ও কর্তব্য রয়েছে’ বলে গণহত্যাকে বৈধতা দেওয়ারও চেষ্টা করেছে।

এ ধরনের চিন্তা মূলত ঔপনিবেশিক প্রভুরাষ্ট্রগুলো লালন করত এবং সেই চিন্তার পাটাতনে দাঁড়িয়ে প্রজারাষ্ট্রগুলোর ওপর নিপীড়ন ও অর্থনৈতিক শোষণ জারি রাখত। আর সেই ভাষ্য প্রচারে কাজ করত পত্রপত্রিকা ও নাগরিক সমাজের সদস্যরা। এভাবে যুগে যুগে নিপীড়ক, শোষক ও জালিমের পক্ষে সংবাদমাধ্যমগুলো তৎপরতা চালিয়েছে। গত বছর থেকে যখন ইসরায়েল হাজার হাজার শিশু, নারী ও বেসামরিক লোকদের অনবরত হত্যা করছে, তখন পাশ্চাত্য মিডিয়াগুলো তার পক্ষে সম্মতি উৎপাদনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মিডিয়ার এই তৎপরতা মূলত বিশ্বনেতৃত্বের দ্বিচারিতা, ভণ্ডামি ও মিথ্যাকেই স্পষ্ট করে।

সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্য সংকটে আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোর খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল, যেমনটা গ্রেগরি শুপাক বলেছেন। তাঁর মতে, মিডিয়া ‘ঐতিহাসিক প্যালেস্টাইনজুড়ে কীভাবে শান্তি, ন্যায়বিচার ও মুক্তি নিশ্চিত করা যায়, সে সম্পর্কে আরও গভীর চিন্তাভাবনার স্থান দিতে পারত। এর পরিবর্তে সংবাদমাধ্যমগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, তাতে উস্কানি দিতে সাহায্য করেছে।’ পাশ্চাত্যের যে কয়েকটি সংবাদমাধ্যম বিশ্বজুড়ে আস্থা কুড়িয়েছিল তার মধ্যে বিবিসি একটি। আজ গণহত্যার মতো প্রশ্নে সেই প্রতিষ্ঠানটির এমন পক্ষপাত বিশ্বজুড়ে পুরো মিডিয়া নিয়েই সন্দেহ ও অনাস্থাকেই ইন্ধন জোগাবে। এতে সমাজের বাস্তব চিত্র, সত্য উদ্ঘাটনের মতো জরুরি বিষয়গুলো তুলে ধরতে দ্বিতীয় কোনো ভরসার জায়গা বলে কিছু থাকল না।

মধ্যপ্রাচ্য সংকটে অচিরেই সমাধানের কোনো পথ আছে বলে মনে হয় না! শুধু পাশ্চাত্য ও মার্কিন মুল্লুকে কেন, মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যে শ্রেণি নেতৃত্ব দিচ্ছে তাদের ওপরও এখন আস্থা রাখার কোনো পরিস্থিতি নেই। মূলত বিশ্বব্যাপী পুঁজিতান্ত্রিক যেসব বলয় গড়ে উঠেছে, তাতে মানবিকতা, ন্যায়নীতি এখন প্রায় সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত; যেখানে জায়গা করে নিয়েছে ক্ষমতা ও অর্থের প্রতিযোগিতা। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী জনগণ ক্ষমতা কাঠামোর বলয়গুলোর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। জাতীয় রাজনীতিতে যেমন ভয়াবহ সংকট তৈরি হয়েছে, তেমনিভাবে আন্তর্জাতিক নেতৃত্বে দেখা দিয়েছে চরম অস্থিতিশীলতা– যার চূড়ান্ত নজির মধ্যপ্রাচ্য সংকট। এর বাইরে আন্তর্জাতিক বলয়ও একাধিক জোটে বিভক্ত। সুতরাং চলমান সংকটে আন্তর্জাতিক বলয়গুলোর বিভিন্ন প্রতিযোগিতার কারণে গাজায় পরিচালিত গণহত্যাও এখন তাদের কাছে স্বার্থের লড়াইয়ে রূপ নিয়েছে! 

ইফতেখারুল ইসলাম: সহসম্পাদক, সমকাল 
iftekarulbd@gmail.

com

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল গণহত য র ব শ বব য ইসর য় ল র কর ছ উৎপ দ ধরন র ব যবহ ইসর য

এছাড়াও পড়ুন:

হাইতিতে গ্যাং হামলায় ৫০ জনের বেশি নিহত

ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশ হাইতিতে গত সপ্তাহে একাধিক গ্যাং হামলায় ৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের (আরএনডিডিএইচ) তথ্যানুসারে, সংকটে জর্জরিত দেশটিতে সর্বশেষ ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা এটি।

মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বার্তা সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্যারন’স। 

গতকাল সোমবার এএফপিকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে আরএনডিডিএইচ জানায়, গত ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের উত্তর এলাকায় এই হামলাগুলো ঘটে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০২৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিহত হওয়া বহু মানুষের লাশ এখনও পাওয়া যায়নি। লাশগুলো এখনও ঝোপের মধ্যে পড়ে আছে এবং কুকুর লাশগুলো খেয়ে ফেলেছে।’

পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হাইতি। দেশটির একটি অংশ ও রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের বেশিরভাগ এলাকা সশস্ত্র গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকায় সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

২০২৪ সালের শুরুর দিকে গ্যাংগুলোর একটি জোট লাগাতার হামলা শুরু করলে পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। যার ফলে প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরি পদত্যাগ করেন এবং প্রেসিডেন্টের অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।

হাইতির পুলিশকে সমর্থন করার জন্য কেনিয়ার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েন করার পরও সহিংসতা দমন করা সম্ভব হয়নি।

আরএনডিডিএইচ জানিয়েছে, ভিভ আনসানম গ্যাং জোট, যারা ২০২৪ সালের মার্চ মাস থেকে ক্যাবারেট শহরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তারা গত সপ্তাহে নিকটবর্তী ল্যাবোডেরি শহরে বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে অত্যন্ত নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছে। শহরটি রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্স থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।

সংস্থাটি আরো জানায়, ‘তারা ৫০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে এবং বেশ কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।’

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘বেঁচে থাকা কয়েকজন পার্শ্ববর্তী এলাকায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। অন্যান্যরা আক্রমণকারীদের হাত থেকে বাঁচতে নৌকায় করে সমুদ্রে পালিয়ে যায়।’ 

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত মাসে সতর্ক করে বলেছেন, হাইতিতে ‘রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ছে।’

তিনি নিরাপত্তা পরিষদকে সতর্ক করে বলেন, হাইতির রাজধানীর বাইরেও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানকার ৯০ শতাংশ অঞ্চলের ওপর গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।

রবিবার, তিনি ক্যাবারে কমিউনে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন এবং দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় ‘সরবরাহ, কর্মী ও তহবিল দিয়ে বহুজাতিক নিরাপত্তা সহায়তা মিশনকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করার’ আহ্বান জানিয়েছেন।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে হাইতিতে কমপক্ষে ৩ হাজার ১৪১ জন নিহত হয়েছে।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের ‘কঠোরতম ভাষায়’ নিন্দা জানিয়েছে সৌদি আরব
  • পটিয়ায় ব্যবসায়ীকে অপহরণ, দুই ঘণ্টা পর উদ্ধার
  • পুলিশের তৎপরতায় দুটি মোটরসাইকেল উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৪
  • যারা জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলকে নিষিদ্ধ চায়, তারা আদালতে অভিযোগ দিতে পারে: সালাহউদ্দিন আহমদ
  • গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার প্রমাণ পেয়েছে জাতিসংঘের তদন্ত কমিশন
  • হাইতিতে গ্যাং হামলায় ৫০ জনের বেশি নিহত
  • ‘গাজায় গণহত্যা চলছে, আমি সেই গণহত্যার নিন্দা করছি’
  • ফতুল্লার ৫ ইউনিয়নে স্বেচ্ছাসেবক দলের নতুন কমিটি গঠনে তৎপরতা