‘দারুণ লোক’ থেকে ‘প্রতারক’—ট্রাম্প-এপস্টেইন সম্পর্কের উত্থান-পতন কীভাবে
Published: 23rd, July 2025 GMT
একজন ছিলেন নিউইয়র্কের কুখ্যাত ধনকুবের, যাঁর নাম শুনলে আজও কেঁপে ওঠে উচ্চবিত্ত মহল। আরেকজন ওই সময়ের হোটেল ও ক্যাসিনো সাম্রাজ্যের নির্মাতা, এখন বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত প্রেসিডেন্ট। জেফরি এপস্টেইন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প—দুজনের বন্ধুত্ব নিয়ে নতুন করে আলোচনা–সমালোচনা শুরু হয়েছে। নগ্ন চিত্র আঁকা জন্মদিনের চিঠি, পার্টিতে হাস্যোজ্জ্বল দৃশ্য, ব্যক্তিগত জেট ভ্রমণ—সব মিলে তাঁদের বন্ধুত্ব যেন হলিউডি স্ক্রিপ্ট!
তবে গল্পটা এখানেই থেমে নেই। এখন ট্রাম্প বলছেন, সব ভুয়া। সেই সঙ্গে করেছেন হাজার কোটি ডলারের মানহানি মামলা। দুজনের বন্ধুত্বের শুরু কোথায় আর ফাটল ধরল কখন—সব মিলিয়ে এখন এ সম্পর্ক মার্কিন রাজনীতির সবচেয়ে আলোচিত এক বিতর্ক।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ট্রাম্পের সঙ্গে কুখ্যাত নারী নিপীড়নকারী মার্কিন ধনকুবের এপস্টেইনের বন্ধুত্ব নিয়ে বিস্ফোরক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। পত্রিকাটি গত বৃহস্পতিবার প্রকাশ করা এক প্রতিবেদনে বলেছে, ২০০৩ সালে তখনকার আবাসন ব্যবসায়ী ট্রাম্প এপস্টেইনকে তাঁর জন্মদিনে ওই আপত্তিকর চিঠি পাঠিয়েছিলেন। চিঠিতে একজন নগ্ন নারীর অবয়ব আঁকা ছিল। চিঠিতে তাঁদের দুজনের মধ্যে একটি ‘গোপন বিষয়’ থাকার উল্লেখও করা হয়।
এ কারণে মিডিয়া মোগল রুপার্ট মারডক ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের বিরুদ্ধে অন্তত এক হাজার কোটি ডলারের মানহানির মামলা করেছেন বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ট্রাম্প দাবি করেছেন, চিঠিটি তিনি লেখেননি এবং বৃহস্পতিবার অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডিকে নির্দেশ দিয়েছেন, এপস্টেইন মামলার সব গ্র্যান্ড জুরি সাক্ষ্যের লিখিত প্রতিলিপি আদালতের মাধ্যমে প্রকাশের অনুরোধ করতে।
বিগত বছরগুলোতে এই দুজন একে অপরের সঙ্গে কতটা ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন, কীভাবেই–বা তাঁদের সম্পর্কের উত্থান–পতন ঘটল, সেসব বিষয় তুলে ধরা হলো—
ট্রাম্পের পাঠানো জন্মদিনের চিঠিতে কী ছিল
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০০৩ সালে এপস্টেইনের ৫০তম জন্মদিনে তাঁকে একটি চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা চিঠি ও নোটের (ছোট বার্তা) সংগ্রহ উপহার দেওয়া হয়েছিল।
চিঠিগুলো তৈরি করেছিলেন গিলেন ম্যাক্সওয়েল। তিনি এপস্টেইনের সহযোগী ও প্রেমিকা ছিলেন এবং পরে তাঁর যৌন নিপীড়নের সহায়তাকারী হিসেবে অভিযুক্ত হন। ২০২১ সালে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন ও ২০২২ সালে ২০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। তিনি এখন কারাবন্দী।
চিঠিটি তৃতীয় পুরুষে টাইপ করা ছিল (অর্থাৎ চিঠিটিতে নিজেদের কথা বলার সময় ‘আমি’ নয়, ‘ডোনাল্ড’ বা ‘জেফরি’ নাম ব্যবহার করা হয়েছে—যেন নিজেরাই নিজেদের নিয়ে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে কথা বলছেন)। এ ছাড়া মোটা মার্কার দিয়ে একজন নারীর স্তন আঁকা ছিল। এটি হাতে আঁকা বলে মনে হয়। চিঠিতে ‘ডোনাল্ড’ স্বাক্ষর করা ছিল। চিঠির শেষ লাইন ছিল, ‘শুভ জন্মদিন। আর প্রতিদিনই যেন একেকটা চমৎকার রহস্য হয়ে ওঠে।’ তবে আল–জাজিরা এ চিঠির সত্যতা যাচাই করতে পারেনি।
এ চিঠি প্রকাশের পর ট্রাম্প নিজের সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন, ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল একটি ভুয়া চিঠি ছাপিয়েছে, যেটা নাকি এপস্টেইনকে লেখা। এগুলো আমার কথা নয়, আমি এভাবে কথা বলি না। এ ছাড়া আমি কোনো ছবি আঁকি না।’
ট্রাম্প লেখেন, ‘রুপার্ট মারডককে আমি বলেছিলাম, এটা একটা প্রতারণা। তবুও তিনি ছেপেছেন। এখন আমি তাঁকে ও তাঁর তৃতীয় শ্রেণির পত্রিকাকে আদালতে নিয়ে যাব। ধন্যবাদ!’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘এপস্টেইন নিয়ে এই ভাঁওতাবাজি ডেমোক্র্যাটদের ষড়যন্ত্র। এটা এখনই শেষ হওয়া উচিত। আমি অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডিকে সব গ্র্যান্ড জুরির সাক্ষ্য আদালতের অনুমোদন সাপেক্ষে প্রকাশ করতে বলেছি।’
ট্রাম্পের বক্তব্যের পরপরই পাম বন্ডি এক্সে জানিয়েছেন, বিচার বিভাগ গত শুক্রবার আদালতে গ্র্যান্ড জুরি ট্রান্সক্রিপ্ট প্রকাশের আবেদন করবে।
১৯৮০–এর দশক: ট্রাম্প-এপস্টেইনের বন্ধুত্ব শুরু
২০০২ সালে ট্রাম্প নিউইয়র্ক সাময়িকীকে বলেছিলেন, তিনি এপস্টেইনকে ’৮০–এর দশকের শেষ দিক থেকে চিনতেন। সে সময় ট্রাম্প একজন আবাসন ব্যবসায়ী ছিলেন।
ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আমি জেফকে ১৫ বছর ধরে চিনি। দারুণ লোক। তাঁর সঙ্গে থাকতে ভালো লাগে। আমার মতো তাঁরও সুন্দরী নারীর প্রতি দুর্বলতা আছে। সন্দেহ নেই, তাঁদের অনেকেই তরুণী। জেফরি তাঁর সামাজিক জীবন উপভোগ করেন।’
১৯৯০–এর দশক: পার্টি, উড়ান ও ঘনিষ্ঠতা
১৯৯২ সালে ট্রাম্প ফ্লোরিডায় তাঁর মার-এ-লাগো অবকাশযাপনকেন্দ্রে চিয়ার লিডারদের নিয়ে একটি পার্টির আয়োজন করেন। সেখানে এপস্টেইন উপস্থিত ছিলেন। এনবিসিকে অনুষ্ঠানটি রেকর্ড করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ট্রাম্প। ওই পার্টির ভিডিওতে ট্রাম্প ও এপস্টেইনকে একসঙ্গে হাসতে দেখা যায়।
২০১৯ সালে এনবিসি অনলাইনে প্রকাশিত পার্টির ওই ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, ট্রাম্প এপস্টেইনের সঙ্গে হাসছেন। তাঁদের কথোপকথন গানের শব্দে শোনা যাচ্ছে না।
১৯৯৭ সালে নিউইয়র্কে ভিক্টোরিয়া সিক্রেটের ‘অ্যাঞ্জেলস’ পার্টিতেও দুজনকে একসঙ্গে দেখা যায়। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ট্রাম্প এপস্টেইনের প্রাইভেট জেটে মোট সাতবার ভ্রমণ করেছেন। এর মধ্যে ১৯৯৩ সালে চারবার, ১৯৯৪ সালে একবার, ১৯৯৫ সালে একবার ও ১৯৯৭ সালে একবার। ফ্লাইটগুলো পাম বিচ ও নিউইয়র্কের মধ্যে ছিল এবং এর মধ্যে ওয়াশিংটন ডিসিতে একটি স্টপেজ ছিল।
২০০০-এর দশক: একসঙ্গে পার্টি, ফাইলেও ট্রাম্পের নাম
২০০০ সালে মার-এ-লাগোতে একটি পার্টির ছবিতে ট্রাম্প, তাঁর স্ত্রী মেলানিয়া এবং এপস্টেইন ও তাঁর প্রেমিকা গিলেনকে দেখা গেছে।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে যৌন নিপীড়ক এপস্টেইনের সহযোগীদের শনাক্তকারী প্রায় ৯৫০ পৃষ্ঠার আদালতের নথি জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়। তাতে ট্রাম্পের নামও ছিল। তবে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিল না।
এপস্টেইনের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগকারী নারীদের একজন ভার্জিনিয়া জিউফ্রে। তিনি আদালতে বলেন, ১৬ বছর বয়সে ম্যাক্সওয়েল তাঁকে এপস্টেইনের শরীর মাসাজকারী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তখন তিনি মার-এ-লাগোতে কর্মরত ছিলেন। জিউফ্রে বলেন, এপস্টেইন ও ম্যাক্সওয়েল তাঁকে প্রিন্স অ্যান্ড্রুসহ প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে প্ররোচিত করেছিলেন। চলতি বছরের এপ্রিলে জিউফ্রে আত্মহত্যা করেন।
এপস্টেইনের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগকারী আরেক নারী জোহানা শোবার্গ। তিনি ২০০১ সালে ফ্লোরিডা থেকে আসা একটি ফ্লাইটের কথা স্মরণ করেন। সেখানে যাত্রীদের মধ্যে শুধু তিনি ও ভার্জিনিয়া জিউফ্রে অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন। ঝড়ের কারণে ফ্লাইটটি ট্রাম্পের ক্যাসিনোতে নামানো হয়।
মার-এ-লাগো ক্লাবে (বাঁ থেকে) ট্রাম্প, মেলানিয়া, জেফরি এপস্টেইন ও ম্যাক্সওয়েল। ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০০০.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র বন ধ ত ব কর ছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
রাশিয়ায় এক বাঙালি বিপ্লবীর খোঁজে
ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতে উপনিবেশিত সব দেশকেই সর্বোচ্চ মূল্য দিতে হয়েছিল। অনেক ত্যাগ–তিতিক্ষা আর সংগ্রামের বিনিময়ে এসেছিল স্বাধীনতা; কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ‘মুকুটরত্ন’ খ্যাত ভারতের মতো এত বিশাল ও বিস্তৃত পরিসরের দেশে ও দেশের বাইরে বিরাট ক্যানভাসে স্বাধীনতার সংগ্রাম মনে হয় আর কোনো উপনিবেশের স্বাধীনতার জন্য করতে হয়নি।
আমরা সাধারণত ভারতীয় উপমহাদেশে সক্রিয় ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীদের আত্মত্যাগ নিয়ে আলোচনা করি। কিন্তু এমন অনেকে ছিলেন, যাঁরা ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করতে বিদেশের মাটিতে বসে অসংখ্য বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন। বাংলাদেশের জ্ঞানতাত্ত্বিক আলোচনা কিংবা জনপ্রিয় লেখাজোখাতেও তাঁদের আত্মত্যাগের গল্প খুব কমই উঠে আসে।
অথচ এই বিপ্লবীদের রয়েছে এমন এক গৌরবোজ্জ্বল বীরত্বগাথা, যা ভারতীয় উপমহাদেশসহ সারা দুনিয়ায় ন্যায়ের পক্ষে সংগ্রামরত সব মানুষের জন্য নিঃসন্দেহে অনুপ্রেরণার। কল্পনা করুন, পুলিশের চোখ এড়াতে একজন বিপ্লবী সিঙ্গাপুরের উপকূল থেকে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে পাড়ি দিচ্ছেন জেলে নৌকার সাহায্যে। আরেকজন ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের নজর এড়াতে সাঁতরে পাড়ি দিচ্ছেন মিসরের সুয়েজ খাল। এসব ঘটনা থেকে দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের অদম্য প্রচেষ্টার দু–একটি উদাহরণ পাওয়া যায়।
বিদেশে বিপ্লবী কার্যকলাপের জন্য সুভাষ চন্দ্র বসু সুপরিচিত। তবে তাঁরও অনেক আগে একদল ব্যক্তি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ত্বরান্বিত করতে ইউরোপজুড়ে বিভিন্ন প্রচেষ্টায় নিয়োজিত ছিলেন। শুরুতে তাঁরা জার্মানি এবং পরে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে সাহায্য চেয়েছিলেন। তাঁদেরই একজন ছিলেন ১৮৯২ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে জন্মগ্রহণকারী গোলাম আম্বিয়া খান লুহানী। তিনি একা নন, মস্কোয় আরও দুজন বাঙালি বিপ্লবী লুহানীর মতো একই ভাগ্য বরণ করেছিলেন। একজন তৎকালীন বিক্রমপুরের (বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ) বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং অন্যজন সাতক্ষীরার অবনী মুখোপাধ্যায়।
যেভাবে বইটির সূচনা
সম্প্রতি প্রকাশিত গোলাম আম্বিয়া খান লুহানী: এক অজানা বিপ্লবীর কাহিনি বই থেকে বিপ্লবী লুহানীর বর্ণিল জীবন ও বহুমুখী কার্যকলাপ সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি পাওয়া যায়। বইটির লেখক প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান লুহানীর জীবন ও কর্ম উদ্ঘাটন করেছেন তাঁর ৪২ বছরের নিরলস সাধনায়।
মতিউর রহমান ১৯৮১ সালে দিল্লি ভ্রমণে গেলে বিজ্ঞানী ও কমিউনিস্ট নেতা ড. গঙ্গাধর অধিকারীর কাছ থেকে লুহানীর কথা প্রথম জানতে পারেন। গঙ্গাধর অধিকারী ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস নিয়ে কাজ করার সময় লুহানীর বহুমুখী কার্যকলাপ সম্পর্কে জানতে পারেন। ১৯২৯ সালের মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁর গ্রেপ্তারের ঘটনাটি বেশ আলোচিত। তাঁর মুক্তির দাবিতে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন ব্রিটিশ সরকারের কাছে চিঠি লিখেছিলেন।
১৯৮১ সাল থেকে মতিউর রহমান লুহানী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য বার্লিন, মস্কো, দিল্লি ও কলকাতার বিভিন্ন আর্কাইভের শরণাপন্ন হন। তিনি সবকিছু জোগাড় করতে পারেননি বলে বইয়ের ভূমিকায় স্বীকার করেছেন। তবে আপাত ‘বিস্মৃত’ এই বিপ্লবীর ওপর যে পরিমাণ তথ্য তিনি সংগ্রহ করেছেন, সেটিও অভূতপূর্ব।
এই বইয়ে লেখক লুহানীর বহুমুখী কাজের পাশাপাশি পারিবারিক জীবনের বিভিন্ন দিকও তুলে এনেছেন। বইটিতে প্যারিস থেকে সিরাজগঞ্জে মায়ের কাছে লেখা লুহানী ও তাঁর স্ত্রী গ্যাব্রিয়েলের চিঠি এবং তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় লুহানীর পরিবারের সদস্য ও কলকাতার একটি শিপিং এজেন্সির মধ্যকার চিঠি আদান–প্রদানও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বইটির প্রতি লেখকের গভীর নিষ্ঠার প্রমাণ পাওয়া যায় একটি ঘটনা থেকে। ১৯৮০’–এর দশকের মাঝামাঝি রুশ ইতিহাসবিদ ও ভারতবিশেষজ্ঞ লিওনিদ মিত্রোখিনের সঙ্গে লেখকের দেখা হয়েছিল মস্কোয়। ১৯৯১ সালে মিত্রোখিন দিল্লি থেকে প্রকাশিত সোভিয়েত ল্যান্ড পত্রিকায় একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি প্রথমবারের মতো তিনজন বাঙালি বিপ্লবী—বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, অবনী মুখোপাধ্যায় ও গোলাম আম্বিয়া খান লুহানীর করুণ পরিণতির কথা প্রকাশ করেন। তাঁদের সবারই বর্তমান বাংলাদেশের সঙ্গে যোগসূত্র ছিল। নিবন্ধের শেষে মিত্রোখিন লিখেছেন, মতিউর রহমান লুহানীকে নিয়ে একটি বই লেখার পরিকল্পনা করছেন, যা এই বিপ্লবীর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে নতুন অন্তর্দৃষ্টি দিতে পারে। কয়েক দশক পর অবশেষে ২০২৪ সালের অক্টোবরে সেই প্রতীক্ষিত বইটি আলোর মুখ দেখেছে।
বইটি থেকে জানা যায়, লুহানী প্রবেশিকা পরীক্ষা (বর্তমান মাধ্যমিক পরীক্ষার সমমান) পাস করার পর ভারতের আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এবং ১৯১৪ সালে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সে ভর্তি হন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের বিখ্যাত মিডিয়া ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব ফতেহ লোহানী ও ফজলে লোহানী এবং তাঁদের বোন বিশিষ্ট গায়িকা অধ্যাপক হুসনা বানু খানমের মামা। ফজলে লোহানীর মাধ্যমে মতিউর রহমানের যোগাযোগ ঘটে গোলাম আম্বিয়া খান লুহানীর ভাগনে মেজর জেনারেল (অব.) হেলাল মোর্শেদের সঙ্গে; যিনি বহু বছর ধরে পারিবারিক চিঠিগুলো সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন।
বইটি যখন প্রকাশের জন্য প্রস্তুত, তার কয়েক মাস আগে ২০২৪ সালের মে মাসে একটি কাকতালীয় ঘটনা ঘটে। নিউইয়র্কের শিল্প–গবেষক জুলিয়া বডেউইন মতিউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে লুহানীর স্ত্রী গ্যাব্রিয়েল সোয়েন সম্পর্কে জানতে চান। এই যোগাযোগের সূত্র ধরে আরও বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর জানা যায় যে গ্যাব্রিয়েল ছিলেন একজন ফরাসি মডেল ও ফ্যাশন ডিজাইনার।
লুহানীর খোঁজে
মতিউর রহমানের সংগ্রহ করা নথিপত্র থেকে জানা যায়, লুহানী লন্ডনে কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না থেকেও শ্রমিক আন্দোলন এবং সোভিয়েত বিপ্লবের সমর্থনে কাজ করেছেন। জীবিকা নির্বাহের জন্য তিনি সাংবাদিক ও শিক্ষক হিসেবে কাজ করতেন। ১৯২০ থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত তিনি ফ্রান্স, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডে বসবাস করেন এবং সেখানকার সংবাদপত্রগুলোতে ভারতের রাজনৈতিক ও শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে লেখালেখি করেছেন। ইংরেজি ছাড়াও তিনি ফরাসি, ফারসি, জার্মান ও হিন্দি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন।
১৯২১ সালে বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে লুহানী প্রথম একটি প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবী দলের অংশ হিসেবে মস্কো সফর করেন। কিন্তু দলটি কমিন্টার্নের সমর্থন পেতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। তবে লুহানী কিছু সময়ের জন্য সেখানে থেকে কমিন্টার্নের প্রচার বিভাগ অ্যাজিটপ্রপে কাজ করেন। প্যারিসে থাকাকালে তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশনা দ্য মেসেজ অব ইন্ডিয়া সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
এ ছাড়া তিনি কমিটি প্রো-হিন্দুর (ভারতীয় অর্থে) সঙ্গে কাজ করেছেন। এই কমিটি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে কাজ করত। ফরাসি লেখক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মী ওঁরি বারবুস ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। বারবুসের লেখার মাধ্যমে ‘লস্ট জেনারেশন’–এর বহু লেখক প্রভাবিত হয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ও এরিখ মারিয়া রেমার্ক অন্যতম।
প্যারিসে থাকাকালে লুহানীর বিরুদ্ধে ব্রিটিশবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগ উঠলে সেখানে তাঁর থাকার অনুমতি বাতিল করা হয়। এ বছরের জুলাই মাসে আমি প্যারিসে গেলে মোঁপানাস এলাকায় লুহানীর সেই বাড়ির ঠিকানায় যাই। বাড়ির উল্টো দিকে থাকা একটি ক্যাফের লোকদের সঙ্গে আলাপে লুহানীর কাহিনি শুনে তাঁরা অবাক হন। ক্যাফের একজন জানান, বাড়িটি এখনো আবাসিক ভবন হিসেবেই আছে; কিন্তু কোনো বাঙালি থাকেন বলে তাঁরা জানেন না। অপ্রত্যাশিতভাবে পাশের সড়কেই পেয়ে যাই লুহানীর স্ত্রীর পোর্ট্রেট আঁকা প্রখ্যাত শিল্পী আমেদেও মোদিলিয়ানির বাড়ি। যদিও লুহানীর সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর পরিচয়ের অনেক আগেই মোদিলিয়ানি সেই পোর্ট্রেট এঁকেছিলেন। বাড়ির ভেতরে ঢুকে বুঝতে পারলাম, এটি এখন আবাসিক হোটেল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
১৯২৫ সালের অক্টোবরে লুহানী স্থায়ীভাবে মস্কোয় চলে যান। ১৯২৮ সালে তাঁকে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ এবং ১৯৩৩ সালে সোভিয়েত নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। এ সময়ে তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের বৈশ্বিক কেন্দ্র কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালে (কমিন্টার্ন) বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন।
লুহানীর ওপর লেখা এই বইয়ে তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের নানা দিক উঠে এসেছে। তিনি সাংবাদিক, অনুবাদক, গবেষক ও শিক্ষক হিসেবে কমিন্টার্নসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। যুক্ত ছিলেন পিজ্যান্টস ইন্টারন্যাশনাল ও মোপার (বিপ্লবীদের সাহায্য করার আন্তর্জাতিক সংস্থা) সঙ্গে। এ ছাড়া তিনি রাশিয়ান সোভিয়েত ফেডারেটিভ সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক, নারিমানভ ইনস্টিটিউট, ইনস্টিটিউট অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ ও কমিউনিস্ট ইউনিভার্সিটি অব দ্য টয়েলার্স অব দ্য ইস্ট-এ কাজ করেছেন। তিনি মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় বিষয় নিয়েও বক্তৃতা দিতেন।
মস্কোয় অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ কমিন্টার্ন কংগ্রেসে লুহানী ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন। সেখানে তিনি এম এন রায়ের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য প্রকাশ্যে তুলে ধরেন। ১৯৬৪ সালের ৩০ আগস্ট, লিংক-এর মস্কো সংবাদদাতা পি উন্নিকৃষ্ণান একটি নিবন্ধে উল্লেখ করেন যে লুহানী জাতীয় ও ঔপনিবেশিক বিষয়ে কমিন্টার্নের একজন পরামর্শক হিসেবে কাজ করতেন। মতিউর রহমান ৪২ বছরের নিরলস প্রচেষ্টা ও আবেগের সংমিশ্রণে সংগৃহীত নথিপত্র কাজে লাগিয়ে লুহানীর এই অসাধারণ জীবন ও বহুমুখী অবদানকে ফুটিয়ে তুলেছেন।
লুহানী ছাড়াও এই বইয়ে বার্লিন ও মস্কোভিত্তিক ভারতীয় বিপ্লবীদের কার্যকলাপ ও উদ্যোগের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। ১৯২১ সালে লুহানী, বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং পান্ডুরাজ খানখোজে যৌথভাবে ‘ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড রেভল্যুশন’ নামে একটি থিসিস রচনা করে রুশ বিপ্লবের নেতা ভ্লাদিমির লেনিনের কাছে পাঠিয়েছিলেন। এর প্রত্যুত্তরও তাঁরা পেয়েছিলেন লেনিনের কাছ থেকে। উল্লেখ্য, ‘নাইটিঙ্গেল অব দ্য ইস্ট’ নামে পরিচিত বিখ্যাত রাজনৈতিক কর্মী ও কবি সরোজিনী নাইডুর ছোট ভাই ছিলেন বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়।
এই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত লুহানীর প্রবন্ধ ও প্রতিবেদন থেকে তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও বিশ্লেষণক্ষমতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিখ্যাত বিপ্লবী এম এন রায় এবং সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও তাত্ত্বিক অন্তর্দৃষ্টির প্রশংসা করেছেন। সৌম্যেন্দ্রনাথ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি ও সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে।
মরণোত্তর সম্মান
বইটিতে ব্যবহৃত সোভিয়েত গোয়েন্দা নথিপত্র থেকে জানা যায়, স্তালিনের শাসনামলে লুহানী সন্দেহ ও অবিশ্বাসের শিকার হয়েছিলেন। সেই সময়ে অনেককে ভিন্নমতের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এই করুণ পরিণতি থেকে লুহানীও রেহাই পাননি। ১৯৩৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর স্তালিনের নির্দেশে মস্কোর কাছে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা এনকেভিডির প্রশিক্ষণ মাঠ কমিউনারকায় তাঁকে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তবে ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত সুপ্রিম কোর্টের সামরিক কলেজিয়াম তাঁর বিচারকে ভুল বলে ঘোষণা করে এবং তাঁকে মরণোত্তর সম্মান প্রদান করে।
এই বইয়ে লুহানীর লেখা বিভিন্ন প্রবন্ধ, প্রতিবেদন ও ‘ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড রেভল্যুশন’ থিসিসসহ অনেকগুলো চিঠি ও নথি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে ড. বিনায়ক সেনের একটি প্রবন্ধ, লিওনিদ মিত্রোখিনের ‘আ ট্রিপল ট্র্যাপ’ নিবন্ধ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং কমিন্টার্ন–বিশেষজ্ঞ ড. শোভনলাল দত্তগুপ্তের সঙ্গে মতিউর রহমানের একটি কথোপকথন। তাঁদের এই আলোচনায় সেই সময়ের বিপ্লবী, কমিন্টার্ন ও সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
লুহানীর দুর্লভ রঙিন ছবি, তাঁর স্ত্রী গ্যাব্রিয়েলের পোর্ট্রেট ও প্রতিকৃতি, বিভিন্ন শহরে তাঁদের বাসস্থানের ছবি এবং গুরুত্বপূর্ণ চিঠি যুক্ত করার মাধ্যমে বইটি আরও বেশি সমৃদ্ধ হয়েছে। এই বই থেকে একজন বাঙালি বিপ্লবীর করুণ পরিণতি সম্পর্কে যেমন জানা যায়, তেমনি বিচরণ করা যায় ইতিহাসের এক নির্দিষ্ট কালপর্বে, যার প্রভাব আজও ছড়িয়ে আছে আমাদের সমাজ–রাজনীতির নানা স্তরে। নিঃসন্দেহে এই বই ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
খলিলউল্লাহ্ লেখক ও সাংবাদিক
মতামত লেখকের নিজস্ব