আহত পায়ে লড়াই: জাতীয় দলের প্রয়োজনে ঝুঁকি নিয়ে ব্যাট হাতে ফিরলেন পন্ত
Published: 24th, July 2025 GMT
ক্রিকেট কেবল খেলার নাম নয়, এটি কখনও কখনও হয়ে ওঠে আত্মত্যাগের প্রতীক। ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ভারতের টেস্ট দলের সহ-অধিনায়ক ঋষভ পন্ত যেন নতুন করে সেই কথাটাই প্রমাণ করলেন। ডান পায়ের পাতায় চিড় নিয়েও মাঠে নেমে ব্যাটিং করলেন তিনি। এমন একটি দৃশ্য দেশের প্রতি এক ক্রিকেটারের নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি হয়ে রইল।
প্রথম দিন ক্রিস ওকসের বাউন্সারে বলের আঘাতে থেমে গিয়েছিল তার ইনিংস। ৩৭ রানে আহত হয়ে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন পন্ত। চোট এতটাই গুরুতর ছিল যে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই) জানায়, পুরো ম্যাচে আর উইকেটরক্ষকের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না তিনি। সেই দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় তরুণ ধ্রুব জুরেলের কাঁধে।
কিন্তু ম্যাচের দ্বিতীয় দিনে পরিস্থিতি যখন দলের বিপক্ষে, তখন কোনো দ্বিধা না করে ব্যথাতুর শরীর নিয়েই মাঠে নামেন পন্ত। ষষ্ঠ উইকেট পতনের পর ক্রিজে আসার সময় তার হাঁটা দেখে বোঝা যাচ্ছিল যন্ত্রণা কতটা তীব্র। কিন্তু সে যন্ত্রণা ছাপিয়ে উঠেছিল তার দায়িত্ববোধ। দেশের প্রয়োজনে নিজের শরীরের সীমাবদ্ধতাকে অগ্রাহ্য করেছেন তিনি।
আরো পড়ুন:
পন্তের চোটে অস্বস্তি, প্রথম দিনে ২৬৪ রানে থামল ভারত
টস হেরে ব্যাট করছে ভারত
দ্বিতীয় দিনের সকালের শুরুটা ভারতের জন্য ভালো ছিল না। রবীন্দ্র জাদেজা ব্যক্তিগত সংগ্রহে মাত্র এক রান যোগ করেই ফিরে যান। অন্যদিকে শার্দুল ঠাকুর কিছুটা প্রতিরোধ গড়লেও বেন স্টোকসের বলে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে থামেন ৪১ রানে। তবে পন্ত ও ওয়াশিংটন সুন্দরের ব্যাটে ভারত আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। পন্ত তখন পর্যন্ত ৫৫ বল খেলে ৩৯ রানে অপরাজিত, আর সুন্দর অপরাজিত ২০ রানে।
বৃষ্টির কারণে দুপুরের বিরতি এগিয়ে আনা হলেও, তার আগেই ভারতের সংগ্রহ ছুঁয়ে ফেলে ৩২১ রান, ৬ উইকেট হারিয়ে। মাঠে ফেরার সময় কেউ হয়তো আশা করেনি যে পন্ত এতটা লড়াই দেখাবেন। কিন্তু যে ঋষভ পন্তকে আমরা চিনি, তিনি বরাবরই ফ্রেম ভাঙা চরিত্র—যিনি নিয়ম ভাঙেন, ভয়কে হাস্যকর করে তোলেন।
এটি শুধুই একটি ইনিংস নয়, এটি সাহস, দায়িত্ব এবং ভালোবাসার গল্প। ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে হয়তো বারবার ফিরে দেখা হবে ম্যানচেস্টারে পায়ের চিড়ে বাঁধা ব্যান্ডেজসহ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটা এক ব্যাটসম্যানের সেই দৃশ্য। যার হাতে ধরা ছিল কেবল ব্যাট নয়, ছিল দেশের সম্মান।
ঢাকা/আমিনুল
.উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
ঢাকা কি কখনও আর পাল্টাবে না
অন্তর্বর্তী সরকার চাইলেই যে খাতটিতে সংস্কার আনতে পারত, তার মধ্যে এগিয়ে থাকবে সড়ক পরিবহন। জুলাই অভ্যুত্থান যে ছাত্রদের হাত ধরে সূচনা হয়েছিল এবং কোটা সংস্কার আন্দোলনকে যাঁরা ধাপে ধাপে গণ–অভ্যুত্থানের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের বড় একটা অংশ ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে মার খাওয়া প্রজন্ম। ঢাকায় দুই বাসের রেষারেষিতে একাদশ শ্রেণির দুই শিক্ষার্থীর প্রাণহানির ঘটনায় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা দেশজুড়ে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, সেটা ছিল নজিরবিহীন। ২০১৮ সালে সত্যি সত্যি এ দেশের বুকে আঠারো নেমে এসেছিল।
কিন্তু শিশু-কিশোরদের সেই আন্দোলনকে ছাত্রলীগ, যুবলীগের পেটোয়া হেলমেট বাহিনী আর পুলিশ দিয়ে যেভাবে নির্মমভাবে পিটিয়ে দমন করেছিল হাসিনা সরকার, সেটাও ছিল নজিরবিহীন। সেটা ছিল নিজ দেশের শিশু–কিশোরদের বিরুদ্ধে দমনে শক্তিশালী হয়ে ওঠা একটি রাষ্ট্রের যথেচ্ছ বলপ্রয়োগের দৃষ্টান্ত। ঠিক ছয় বছর পর ২০২৪ সালে এসে সব শ্রেণির জনতার অংশগ্রহণে রাষ্ট্রের সেই শক্তিশালী দামনযন্ত্রটিকে রুখে দিয়ে ইতিহাসের চাকাটি পাল্টে দিয়েছিল সেদিনের সেই কিশোর থেকে সদ্য তরুণ হয়ে ওঠা প্রজন্মটি।
আওয়ামী লীগ সরকার সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কোনো কাজ করেনি। তার কারণ পুরোপুরি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক। কর্তৃত্ববাদী শাসনের সঙ্গে যে স্বজনতোষী অর্থনীতি তারা গড়ে তুলেছিল, তার প্রধান একটা জায়গা ছিল যোগাযোগ অবকাঠামো খাত। বাজেটে এ খাতেই সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয়েছে, একের পর এক মেগা প্রকল্প হয়েছে। তাতে ক্ষমতার একেবারে প্রথম বৃত্তে থাকা লোকদের সম্পদ বেড়েছে আলাদিনের চেরাগের মতো। সেই সম্পদের একটা বড় অংশই পাচার হয়ে গেছে।
এ বাস্তবতার বিপরীতে চরম দুর্নীতিনির্ভর পরিবহন খাত বর্গা দেওয়া হয়েছে দলীয় মাফিয়া ও মাস্তানদের হাতে। বলা চলে, সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক দুর্বৃত্তকে পুনর্বাসন করা হয়েছিল এ খাতেই। ফলে সড়কে নৈরাজ্য আর অরাজকতার যে বিষচক্র তৈরি হয়েছে, তার নিষ্ঠুর বলি হতে হয়েছে নাগরিকদের।
ফলে সবাই আশা করেছিলেন, অভ্যুত্থানের পর সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে। ঢাকার মানুষেরা একটা সুশৃঙ্খল বাসব্যবস্থা পাবে। অভ্যুত্থানের পর প্রথম কয়েক দিন যখন পুলিশ ছিল না, তখন ছাত্ররাই ঢাকার সড়কগুলোতে শৃঙ্খলার নজির তৈরি করেছিলেন। বাসসহ অন্য যানবাহগুলো লেন মেনে চলাচল করতে শুরু করেছিল। সবার মধ্যেই আইন মানার একটি আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু কেন জানি শিক্ষার মতো পরিবহন খাত সংস্কারে সরকারের উদ্যোগ নিতে অনীহা দেখা গেল।
অন্তর্বর্তী সরকার বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পের আওতায় ঢাকায় বৈদ্যুতিক বাস সেবা চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঢাকার বায়ুদূষণ ও পরিবেশের কথা মাথায় রেখে এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। সুইডেন থেকে চড়া দামে নিয়ে আসা বিআরটিসির ভলভো বাস পরিণতি কি হয়েছিল সেটা আমরা সবাই জানি। ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থার গোষ্ঠীস্বার্থের তৈরি করা রাজনৈতিক–অর্থনীতির জাল কাটতে না পারলে যত আধুনিক বাস আনা যাক না কেন, সেটা টেকসই হবে কি?এ সুযোগে ঢাকার পরিবহনব্যবস্থায় সুনামির মতো ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা যুক্ত হলো। গত কয়েক বছরে বিশেষ করে গত এক বছরে কর্মসংস্থানে যে ভাটার টান, নিঃসন্দেহে সেই বাস্তবতা পরিস্থিতিকে উসকে দিয়েছে। কিন্তু সড়ক পরিবহনব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা যায়, এমন কোনো পরিকল্পনা না থাকার কারণে এমন বিশৃঙ্খলার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ।
সব মিলিয়ে ঢাকার সড়ক গত এক বছরে আরও বেশি নৈরাজ্যিক আর বিশৃঙ্খল হয়ে উঠেছে। সারা দেশে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে। মোটরসাইকেল ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা গণপরিবহনের বিকল্প হয়ে ওঠায় হতাহতের সংখ্যা কমানো যাচ্ছে না। ঢাকার সড়কগুলো দাবড়ে বেড়াচ্ছে, সেই একই রংচটা ও লক্কড়ঝক্কড় বাস, নোংরা সিট ও শ্বাস বন্ধ করে দেওয় কালো ধোঁয়া আর কানে তালা লাগা হাইড্রোলিক হর্ন। রেষারেষি, দুর্ঘটনা, যাত্রীদের সঙ্গে বচসা, মারামারি—পুরোনো সেই সবই চলছে দিব্যি।
ট্রাফিক পুলিশের অবর্তমানে শিক্ষার্থীরা যখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে সড়কে শৃঙ্খলার কাজে নেমেছিলেন, তখন ঢাকার সড়কে শৃঙ্খলা ও আইন মেনে চলার একটা চিত্র আমরা দেখতে পেয়েছিলাম। ২০১৮ সালের সড়ক আন্দোলনের সময়ও শিশু-কিশোরেরা সৃজনশীল সব পথ বের করে দেখিয়ে দিয়েছিল, সড়কে কীভাবে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা যায়, আর আইন যিনিই ভঙ্গ করেন, তাঁকে কীভাবে জবাবদিহি করা যায়। কিন্তু ছাত্রদের আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রাফিক সহায়তাকারী হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পর সেই স্বতঃস্ফূর্ততা আর বেশি দিন চোখে পড়েনি। বরং তাঁদের পুরোনো ট্রাফিক ব্যবস্থার অংশ করে তোলা হয়েছে।
সবচেয়ে বড় কথা, গোটা পরিবহন খাতে রাজনৈতিক আঁচড় এক বড় গণ–অভ্যুত্থানের পরও এক দিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। শুধু পুরোনো মুখের জায়গায় নতুন মুখ এসেছে। আওয়ামী লীগের জায়গায় এসেছে বিএনপি। আমাদের প্রথাগত ও বড় রাজনৈতিক দলগুলোর বিপুলসংখ্যক নেতা–কর্মীর পুনর্বাসন ও আয়ের জায়গা এটি। সেই কায়েমি স্বার্থের কারণে রাজনৈতিক সরকারের আমলে এ খাতে কাঠামোগত সংস্কার করা খুবই কঠিন।
অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সেই সুযোগ ছিল। বাসকে কেন্দ্রে রেখে একটা সুশৃঙ্খল গণপরিবহনব্যবস্থা গড়ে তোলা এমন কী কঠিন কোনো কাজ ছিল! চাইলে যে করা যায়, সেটা আমরা গত কয়েক মাসে ঢাকার ভাঙাচোরা ও হাঁটার জন্য অযোগ্য অনেকগুলো ফুটপাতের চিরচেনা চেহারা যেভাবে বদলে যাচ্ছে, সেই উদাহরণ দিতে পারি। যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল গত ১৫ মে দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত এক কলামে দেখিয়েছেন, একটি ডেডিকেটেড সিটি বাস সার্ভিস কীভাবে ঢাকার চেহারা বদলে দিতে পারে। তিনি মনে করেন, ঢাকায় দুই হাজার নতুন বাস নামানো গেলেই সেটা সম্ভব।
বুয়েটের বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান গত বছরের অক্টোবরে বলেছিলেন, মাত্র ছয় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা গেলেই ঢাকার গণপরিবহনব্যবস্থার খোলনলচে বদলে দেওয়া সম্ভব। একই ছাতার নিচে একটা সিটি বাস সার্ভিস চালু করতে হবে, যেখানে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে।
অন্তর্বর্তী সরকার বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পের আওতায় ঢাকায় বৈদ্যুতিক বাস সেবা চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঢাকার বায়ুদূষণ ও পরিবেশের কথা মাথায় রেখে এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। সুইডেন থেকে চড়া দামে নিয়ে আসা বিআরটিসির ভলভো বাস পরিণতি কি হয়েছিল সেটা আমরা সবাই জানি। ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থার গোষ্ঠীস্বার্থের তৈরি করা রাজনৈতিক–অর্থনীতির জাল কাটতে না পারলে যত আধুনিক বাস আনা যাক না কেন, সেটা টেকসই হবে কি?
মনোজ দে, প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী