Prothomalo:
2025-09-18@00:44:05 GMT

ছাদকৃষি

Published: 27th, July 2025 GMT

এই শহরে সাদমানের মতো যারা, তাদের বয়স কেবল সংখ্যায় লেখা থাকে, জীবনে নয়। এখন সে ত্রিশ। এমবিএ শেষ করে চাকরির কটা আবেদনপত্র জমা দিয়েছে, তাড়াহুড়ো নেই। চাকরি হোক কিংবা না হোক, হু কেয়ার্স। দিন চলে যাওয়ার মতো একটা ছয়তলা ভবন আছে মিরপুর ডিওএইচএসে, নিজেদের বাড়ি। এই শহরের খুব কম তরুণ আছে, যাদের জীবনের নিরাপত্তাবেষ্টনী এত পোক্ত। সাদমান সেই সৌভাগ্যবানদের একজন, একমাত্র সন্তান। কিন্তু এই থাকার ভেতরেও তার আছে কিছু না থাকা।

সাদমান যখন নর্থ সাউথে বিবিএ পড়ে, ঠিক তখনই তার বাবা ক্যানসারে আক্রান্ত হন। শরীরে ধরে, তারপর মানুষটার সমস্ত ভেতরটাকে ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে দেয়। সাদমান সে সময়েও বেশির ভাগ দিন বন্ধুদের আড্ডায় কাটাত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস, গ্রুপ প্রেজেন্টেশন, এক-আধটা প্রেম, ভাঙা প্রেম, অসৎ সঙ্গে জড়ানোর ব্যর্থতা—সবকিছু নিয়ে তার বাইরের জীবনটা ছিল পুরোদমে চলমান। আর বাড়ির ভেতরটুকু জীবন্ত রেখেছিলেন তার মা। সবকিছু সামলে নিয়েছিলেন তিনি, নীরবতায়, অভিযোগহীন। বাবা চলে যাওয়ার পর বাড়িটা নিস্তব্ধতায় ঢাকা পড়ে। মায়ের কণ্ঠে মনের সুখে অজান্তে ঘরোয়া গান বন্ধ হয়ে যায়, রান্নাঘরের ঘ্রাণেও সংযম। মা নিজেকে খুঁজে নেন এই ছয়তলা বাড়ির ছাদে। সেখানে গড়ে তোলেন তাঁর একান্ত নিজের ছোট্ট জগৎ, একটা ছাদবাগান।

ছাদের অর্ধেকটা জুড়ে কেবলই গাছ। জবা, গাঁদা, গোলাপ, বাগানবিলাস, দোপাটি, টকটকে পাতাবাহার, কাঠবাদাম আর এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা লাউয়ের লতা। অন্য অর্ধেকটা বসার জায়গা। একটা কাঠের বেঞ্চ, পাশে ছোট্ট মেটালের টেবিল, রাতে আলো জ্বালাতে ছোট লাইটিংয়ের মালা, যেটা জ্বলে উঠলে মায়ের মুখেও একটু প্রশান্তি ছড়াত।

এ বাড়িতে মায়ের পর সাদমান সবচেয়ে বেশি মেশে সাত্তার মামার সঙ্গে—বাড়ির দারোয়ান। সাত্তার মামা সেই শুরু থেকেই ছিল। বাবার জীবিত অবস্থায়, মায়ের ছায়া হয়ে, সাদমানের অনুপস্থিতিতে।

মা ছাদের বাগানে সময় কাটাতেন নিয়ম করে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত। হাতের কাজ শেষ হলে ওপরে উঠে যেতেন, কখনো কোনো গাছের শাখা ছেঁটে দিতেন, কখনো নীরবে চেয়ে থাকতেন দূরের আলোর দিকে।

আর এখন? সে ছাদ নীরব।

আর সাদমান?

সে এখন ঘুরে বেড়ায় চারতলার শোবার ঘর থেকে ছাদ পর্যন্ত। নিচতলার ডাইনিংয়ে চা ঠান্ডা হয়ে যায়, আর ছাদে বাতাসে মায়ের নিশ্বাসের অনুপস্থিতি। মা মারা গেছেন মাত্র দুই সপ্তাহ হলো। হঠাৎ করে। খুব সোজাসাপটা বললে, হৃৎপিণ্ডের ব্যর্থতা। কোনোমতে একটা অ্যাম্বুলেন্স ডেকে আনা হয়েছিল, কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি।

দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এখনো সাদমান প্রস্তুত নয়। মায়ের অনুপস্থিতিকে সে মেনে নিতে পারেনি। বাড়ির দেয়াল, ছাদের রেলিং, টবের ভেজা মাটি—সব যেন তার মায়ের স্পর্শ ধরে রেখেছে। এ ক্ষেত্রে সাদমানই শূন্য! সে ভয় পায় বাগানের পাশে দাঁড়াতে, সেই বেঞ্চে বসতে, যেখানে মা বসে থাকতেন সন্ধ্যাগুলোয়। এমনকি সে ভয় পায় সাত্তার মামার চোখের দিকে তাকাতে, সেখানে যে একধরনের দীর্ঘমেয়াদি শোক জেগে থাকে।

তবু এক সন্ধ্যায়, খুব নিঃশব্দে, মেঘলা আকাশের নিচে, হালকা বাতাসে, সাদমান উঠে গেল ছাদে।

আলো জ্বলেনি, বেঞ্চটা খালি।

মা নেই।

ঠিক সেই মুহূর্তে যেন কোথাও থেকে একটা ঘ্রাণ এল। ফুলের নয়, যেন মায়ের ব্যবহৃত হালকা পারফিউমের গন্ধ। বাতাসে মিলিয়ে গেল। সাদমান স্থির দাঁড়িয়ে থাকল। দূরে শপিং মলের ছাদে আলোকসজ্জায় খাবারের আয়োজন।

দুই

মায়ের মৃত্যুর পর ছাদে ওঠা হয়ে উঠছিল না সাদমানের। যেন কোনো এক অলিখিত নিয়মে ছাদটা নিষিদ্ধ। সেখানে মা নেই, এই বাস্তবতাকে মেনে নেওয়াটা সহজ নয়। কিন্তু সেই রাতে, দীর্ঘ নিশ্বাসের ভেতর, হঠাৎ এক আকর্ষণে সে ছাদে উঠেছিল। দোলনাটার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ফার্নগাছটা যেন অনেক শুকিয়ে গেছে। পাতাগুলো কুঁচকে গেছে তার লজ্জার মতো। বাগানবিলাসের ডালগুলো এলোমেলো, কোথাও যেন নড়ছে তাদের অভিমান। বেশির ভাগ টবেই জমে আছে কালচে পানি, কোথাও কোথাও মশা উড়ছে। ফুল স্তিমিত। একসময়ের রঙিন ছাদটা এখন ধূসর, মমতাহীন, মৃতপ্রায়।

সেদিন প্রথম সাদমান উপলব্ধি করল, তার সদা অনুপস্থিতির মধ্যে মা যে এই বাগানটাকে আপন সন্তানের মতো আগলে রেখেছিলেন, প্রতিটি পাতার ওজন বুঝে পানি দিতেন, সকাল-সন্ধ্যায় আলাদা রুটিনে গাছদের দেখতেন, সেটা কখনো এভাবে খেয়াল করে দেখা হয়নি। সে নিচে নেমে সাত্তার মামাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এই কয় দিন পানি দিছেন না?’ সাত্তার লজ্জা মেশানো কণ্ঠে বলল, ‘দিছি মামা।’

সাদমান চুপ করে গেল। সে জানে না কোন গাছের নাম কী, কোথায় রোদ লাগে বেশি, কোথায় লাগে ছায়া। এমনকি রজনীগন্ধা আর বেলিগাছের পার্থক্যও স্পষ্ট নয় তার চোখে।

তবু তার ভেতরটা চিৎকার করে ওঠে। মায়ের স্মৃতিটাকে শুকিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। বহুক্ষণ ছাদে দাঁড়িয়ে থেকেও সমাধান খুঁজে পাচ্ছিল না। ঠিক তখনই তার মনে পড়ল একটা দৃশ্য, গত শীতের এক সন্ধ্যা। ছাদেই আয়োজন করা হয়েছিল একটি ছোট্ট বারবিকিউ পার্টি। বন্ধুদের ভিড়, ধোঁয়ার গন্ধ, হালকা গিটার—সব মিলিয়ে জমজমাট। সেই ভিড়ে এক নতুন মুখ ঘুরে ঘুরে গাছগুলো দেখছিল। কারও সঙ্গে খুব বেশি কথা না বলে, বারবারই পাতার দিকে ঝুঁকে যাচ্ছিল। সে বলছিল, ‘এইটা জেসমিন না?’ কেউ নিশ্চিত ছিল না। তখন মেয়েটি নিজেই বলছিল, ‘হ্যাঁ, এটা গ্র্যান্ড ডিউক জেসমিন, পাতা দেখলেই বোঝা যায়।’

সেই মেয়েটার নাম ছিল সোনিয়া। সাবরিনার ক্লোজ ফ্রেন্ড। চশমা পরা, স্থিরচোখের, আত্মস্থ এক তরুণী। পার্টিতে সবাই যখন খাবার নিয়ে ব্যস্ত, সোনিয়া তখন বাগান নিয়েই ডুবে ছিল। সাদমান ফোনটা হাতে তুলে সাবরিনাকে কল দিল। পরিচয় দিল, জানতে চাইল সোনিয়ার কথা।

‘সোনিয়া এখন অস্ট্রেলিয়ায়, মেলবোর্নে। এমএসসিতে বোটানি পড়ছে।’ সাবরিনা জানাল।

একমুহূর্তের জন্য হতাশ হয়ে গেল সাদমান। তবু হাল ছাড়ল না। সাবরিনার কাছ থেকেই সোনিয়ার ফেসবুক আইডি নিল। পরে গভীর রাতে এক ছোট্ট বার্তায় লিখল,

‘সোনিয়া, ছাদবাগানটার যত্ন নিচ্ছে না কেউ। মা নেই। আমি পারি না। তুমি কি একটু গাইড করবে?’

পরদিন ভোরেই রিপ্লাই এল, ‘ভিডিও কল করো। শুরু করি।’

সেদিন থেকেই শুরু হলো ছাদবাগানের নতুন জীবন। প্রতিদিন সকালে, কখনো দুপুরে, কখনো সন্ধ্যায় ভিডিও কলে সোনিয়া সাদমানকে গাছ চিনিয়ে দেয়।

‘এইটা কিন্তু গাঁদা না, ম্যারিগোল্ড। এটা সানলাইট চায়।’

‘এই পাতাটা দেখো, হলদে হয়ে গেছে মানে ওভার ওয়াটারিং হইছে।’

‘এই ঝুলন্ত গাছটার জন্য নারকেল খোলস দাও।’

সাদমান অবাক হয়ে দেখল, যে ছাদটা এত দিন তার কাছে নিছক এক জায়গা ছিল, সেখানে প্রতিটি গাছের আলাদা নাম, পরিচয়, চাওয়া-পাওয়া আছে। এক সপ্তাহের মধ্যেই বাগানটায় প্রাণ ফিরে এল। পাতারা হাসে, ফুলেরা লাজুক, বাতাসে মায়ের প্রশ্বাস টের পাওয়া যায়।

তবে গাছের পরিচর্যার বাইরেও আরও কিছু বদলে যেতে থাকল। সোনিয়ার সঙ্গে কথা বলতে বলতে একসময় তারা গল্পে ঢুকে পড়ল বই নিয়ে, গান নিয়ে, বাবা-মা নিয়ে, পুরোনো ভুলে!

তিন

সকালে ঘুম ভাঙার পরেই যখন ছাদে গেল, তখন বুঝল।

খালি খোপ।

একটাও নেই।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাদমান একধরনের অবিশ্বাসে তাকিয়ে থাকে খোপের দিকে। যেন চোখ ভুল দেখছে। একবার দুয়ারের ভেতর হাত ঢুকিয়ে খোঁজে, না, কোথাও নেই। খোপের কোনায় পড়ে থাকা পালক। কবুতরগুলো সে নিজ হাতে পুষেছে। মা বলতেন, ‘গাছ আমার, পাখি তোর।’ ছাদের এক কোণে বাগান, অন্য কোণে খোপ।

গত রাতে শহর যেন কেঁপে উঠেছিল শব্দে। ১২টা ১ মিনিট। ঘড়ির কাঁটায় নতুন বছরের সূচনা, আর আবাসিক এলাকার প্রতিটি ছাদ যেন একেকটা ক্ষণস্থায়ী যুদ্ধক্ষেত্র। আতশবাজি ফুটছিল দিগ্‌বিদিক, চিৎকার, বাঁশি, হর্ন—সব মিলিয়ে আকাশের নিচে বৃষ্টি হচ্ছিল শব্দের। আর এই উৎসবের মাঝখানেই, ঠিক একটা ভুল হয়ে গিয়েছিল সাদমানের। খোপের দরজা বন্ধ করা হয়নি।

সে রাতে ছাদে ওঠেনি, এমনকি মনে রাখেনি কবুতরদের কথা। মাথায় ছিল না, নিচে সোফায় বসেই হেডফোনে ডুবে গিয়েছিল পুরোনো গান আর একটা নেটফ্লিক্স সিরিজে।

সপ্তাহ পেরিয়ে যায়। প্রতিদিন সকাল-বিকেল সাদমান ছাদে যায়। খালি খোপের দরজা খুলে রাখে, ছোট্ট প্লাস্টিকের পাত্রে জল দেয়, দানাও ছিটায়। কিন্তু কেউ ফেরে না। কখনো কখনো দাঁড়িয়ে থেকে ভাবতে থাকে, কোন দিকে গেছে ওরা? শব্দের তোড়ে হয়তো এমন দূরে উড়েছে, ফিরে আসার পথটাই ভুলে গেছে। নাকি কেবল ভয়েই আর আসছে না এদিকটায়। কিন্তু এই শহরের কোথা ভয়শূন্য!

সেই সন্ধ্যায়, চুপচাপ জানালার পাশে বসে, ফোন তুলে নেয় সাদমান। সোনিয়াকে কল দেয়। ভিডিও কল। মেলবোর্নে ভোর। সাদমান বলে, ‘তোমার কারণে গাছগুলো বেঁচে গেছে। থ্যাংকস। আর আমার কবুতর হারিয়েছে।’

সোনিয়া খানিকক্ষণ চুপ। বিস্তারিত শোনে। তারপর ধীরে বলে, ‘শহরে আনন্দ কই! আমরা বাজির শব্দে আনন্দ খুঁজি, অথচ কত ছোট প্রাণী শব্দেই মরে যায়, কে ভাবে? রোগী, শিশু আছে।’ তারপর যোগ করে, ‘তুমি তো ঠিকই অপেক্ষা করছ। পাখি একবার গেলে কি আর আসে। হা হা।’

চার

সেই ভোরে, খুব তন্দ্রাচ্ছন্ন একটা সকালে, সাদমানের দরজায় হঠাৎ কড়া নাড়ার শব্দ।

তারপর সাত্তার মামার হাঁপানো গলা, ‘মামা… সাদমান মামা.

.. ওরা ফিরছে... ফিরছে...’

‘কারা ফিরছে?’ জানতে চেয়ে সাদমান ঘুমচোখে উঠে বসল। সাদমানের মনে নেই, কারা হারিয়ে গেছে।

কথাটা শুনেও যেন শরীরে কোনো আলোড়ন নেই। সে ধীরে পাশ ফিরে শোয় আবার। চোখ আধখোলা। হাত বাড়িয়ে পাশের টেবিল থেকে ফোনটা টেনে নেয়। সাত্তার মামা একটু থমকে দাঁড়ায়। তার মুখে বিস্ময়ের রেখা, মামা তো ওদের জন্য দিন গুনত। সন্ধ্যায় ছাদে দাঁড়িয়ে থাকত, একদৃষ্টে খোপের দিকে চেয়ে থাকত। পাখির পালক হাতে নিয়ে দেখত শুকনো কি না।

এখন?

প্রতীক্ষার কাঙ্ক্ষিত পাখিরা ফিরে এসেছে ঠিকই, কিন্তু প্রতীক্ষাকারী কই?

সাত্তার কোনো শব্দ না করে বেরিয়ে যায়। চুপচাপ দানা ছড়িয়ে দেয় খোপের সামনে, প্লাস্টিকের পাত্রে জল ভরে রাখে। ওরা কেঁপে কেঁপে বসে। কেউ উড়ে এসে ছাদের রেলিংয়ে বসে। আবার কেউ দূর থেকে দেখে যায়—পুরোনো বাসা ফিরে পাওয়া নতুন অপরিচিতের মতো।

অন্যদিকে, বিছানার চাদরে সাদমান যেন নিজের ভেতর গুটিয়ে আছে।

কত দিন হয়ে গেল কবুতরগুলো উধাও, সাদমান ঠিক মনে রাখতে পারে না। তার মন কিছু খুঁজে না পেলেও আঙুল চলে যায় এক জায়গায়, সোনিয়ার চ্যাটবক্স। ঘুমকাতুরে চোখে সে একটা শব্দ টাইপ করে, ‘গুড মর্নিং’। তারপর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে স্ক্রিনের দিকে।

সাদমানের খোলা জানালা দিয়ে কবুতরের ডানা ঝাপটানোর শব্দ কি আসে? একটা পালক হাওয়ায় উড়ে বিছানার কিনারায় এসে কি পড়ে?

সাদমান চোখ সরায় না ফোন থেকে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স দম ন স স দম ন র স বর ন র ভ তর ত রপর

এছাড়াও পড়ুন:

কাজাকিস্তানের যাযাবর জাতির করুণ ইতিহাস 

বিংশ শতাব্দীর আগে পৃথিবীর মানচিত্রে কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তান নামের এই পাঁচটি দেশ ছিলো না।  মূলত ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এই রাষ্ট্রগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করে। পরে চীনের সহায়তায় ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলগুলো বাণিজ্যিক কেন্দ্রস্থল হিসেবে পুনরুত্থান হয়েছে। এখন প্রশ্ন  করা যেতে পারে, চীন কেন আবারও  এই অঞ্চলগুলোকে শক্তিশালী করে তুলছে?

ঐতিহাসিকভাবে মধ্য এশিয়া অঞ্চল সিল্করোডের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলো। যা চীনকে মধ্যপ্রাচ্য এবং রোমান সভ্যতার সাথে যুক্ত করেছিলো।  বীজ গণিতের জনক আল খারিজমি, আবু সিনার মতো বিজ্ঞানীদের জন্ম হয়েছে এখানে। যাদের লেখা বই ইউরোপে শত শত বছর ধরে চিকিৎসা ও নিরাময়ের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। চেঙ্গিস খানও এই অঞ্চলে তার সম্রাজ্যের নিদর্শন রেখে গেছেন। পাশাপাশি ঘোড়ার পিঠে আদিম যাযাবর জীবনের ঐতিহ্যও টিকে আছে এখানে। 

আরো পড়ুন:

রাশিয়ার ‍বিরুদ্ধে এবার রোমানিয়ার আকাশসীমা লঙ্ঘনের অভিযোগ

রাশিয়ায় ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্প, সুনামির সতর্কতা 

রাজনৈতিক প্রভাব ও সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করেছিলো রুশরা। উপনিবেশিক শাসন এমনভাবে চালু করেছিলো, যা অনেকটা ব্রিটিশ বা ফরাসি সম্রাজ্যের মতো দেখতে। 
রাজ্যগুলোকে শিল্পায়ন ও আধুনিকায়নের ফলে বিশাল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এমনকি যাযাবর জাতিকে যুদ্ধ যেতে বাধ্য করা হয়েছিলো। আর যাযাবর জাতিকে বসতি স্থাপনে বাধ্য করা হয়েছিলো। এরপর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ফলে কাজাখ জনগোষ্ঠীর চল্লিশ শতাংশ অর্থাৎ ২৫ শতাংশ মানুষ অনাহারে মারা যায়। এবং যাযাবর জনগোষ্ঠীর যে অর্থনীতি, তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। কারণ সোভিয়েত আমলে কাজাখ যাযাবররা যে পশুপালন করতো তার নব্বই শতাংশই মারা যায়। ফলে বাধ্য হয়ে কাজাখদের যাযাবর জীবনযাত্রা ছেড়ে দিতে হয়। বলতে গেলে সোভিয়েত আমলে কাজাখ সভ্যতা ও সংস্কৃতির বেদনাদায়ক পুনর্গঠনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। 

১৯৯১ সালে সোভিয়েন ইউনিয়নের পতন হয়, সৃষ্টি হয় এই পাঁচটি স্বাধীন দেশের। এই দেশগুলো স্বাধীন হয়েছে ঠিকই কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন পরবর্তী বিশ্বে খাপ খাইয়ে নিতে তাদের ব্যাপক সংগ্রাম করতে হয়। তবে বিগত কয়েক দশক ধরে মধ্য এশিয়ার যাযাবর জাতিগুলো নিজস্ব সীমানার মধ্যে এক অনন্য পরিচয় গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। যদিও তাদের ওপর বাইরের প্রভাবও রয়েছে। তুরস্ক এই অঞ্চলে নিজেদের উপস্থিতি আরও বেশি জানান দিচ্ছে। সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক, ধর্মীয় এবং ভাষাগত মিল আছে। এমনকি শিক্ষাগত কাঠামোতেও মিল রয়েছে। তুরস্ক মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার পণ্য রফতানির একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হিসেবেও বিবেচিত। 

জিনজিয়াং প্রদেশে প্রায় এক কোটি উইঘুর বাস করেন। যাদের বেশিরভাগই মুসলিম। এদের নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া উইঘুর পরিচয় মুছে ফেলতে তাদের পুনঃশিক্ষা শিবিরে আটকে রাখার অভিযোগও আছে। যদিও চীন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। 

বৈশ্বিক অবকাঠামো উন্নয়নের পরিকল্পনা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এর চীন মধ্য এশিয়ায় ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়ন করছে। এই অঞ্চলটিকে বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত করতে চাইছে, যা অনেকটা সিল্করুটের মতোই। 

চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ উদ্যোগের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ায় প্রাচীন সিল্ক রোড পুনরুজ্জীবিত করার একটি সম্ভবনা দেখা দিয়েছে। এই রোড পুনরুজ্জীবিত হলে রাশিয়া আর চীনের প্রভাব বলয়ে থাকা এই অঞ্চলের ভূ রাজনৈতিক গুরুত্ব কতটা বাড়বে-সেটাও সময় বলে দেবে।  

ঢাকা/লিপি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরদের কাজ কি শুধু ভাইভা নেওয়া
  • কাজাকিস্তানের যাযাবর জাতির করুণ ইতিহাস 
  • চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী-গ্রামবাসীতে বিদ্বেষ কেন
  • চার্লি কার্ক হত্যাকাণ্ড: ট্রাম্প কি দাঙ্গা–ফ্যাসাদকেই নীতি হিসেবে নিয়েছেন