কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে সুষ্ঠু ভোটে বাধা হতে পারে
Published: 31st, July 2025 GMT
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেখানে এআইয়ের (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ব্যবহার এক নতুন ধরনের হুমকি নিয়ে এসেছে। এটি শুধু প্রচলিত কারচুপির পদ্ধতিগুলোকেই আরও সফিসটিকেটেড বা কৌশলী করে তুলবে না; বরং আমাদের গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি যে জনগণের বিশ্বাস, সেটিই নষ্ট করে দিতে পারে।
নির্বাচনে এআইয়ের প্রভাব কোনো কাল্পনিক গল্প নয়, এটি একটি বাস্তব ঝুঁকি। এআই-চালিত টুলগুলো ব্যবহার করে রাজনৈতিক নেতা বা কর্মকর্তাদের অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য ‘ডিপফেক’ (ভুয়া অডিও, ভিডিও এবং ছবি) তৈরি করা সম্ভব।
এই ডিপফেকগুলো সহজেই মিথ্যা কেলেঙ্কারি ছড়াতে পারে, যা ভোটারদের বিভ্রান্ত করে তাঁদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এআই-চালিত বটগুলো সেকেন্ডের মধ্যে এমন সব মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দিতে পারে, যা একটি রাজনৈতিক দলের জন্য ব্যাপক জনসমর্থনে বা বিরোধিতায় ভূমিকা রাখতে পারে।
যখন জনগণ দেখতে পাবে, তারা যা দেখছে বা শুনছে, তার মধ্যে কোনটা আসল আর কোনটা নকল, তা বোঝা কঠিন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে সংবাদমাধ্যম, নির্বাচন কর্তৃপক্ষ এবং পুরো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিষয়ে সন্দেহ ঢুকে যাবে। এটি একটি দেশের স্থিতিশীলতার জন্য দীর্ঘমেয়াদি হুমকি।
এআই অ্যালগরিদমগুলো বিশাল পরিমাণ ডেটা বিশ্লেষণ করে নির্দিষ্ট ভোটারদের লক্ষ করে তাদের ব্যক্তিগত আগ্রহ ও দুর্বলতা অনুযায়ী রাজনৈতিক বার্তা পাঠাতে পারে। এই ‘মাইক্রো টার্গেটিং’-এর মাধ্যমে ভোটারদের মনোভাবকে প্রভাবিত করা বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে ভোটদানের সময় বা স্থান সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে তাদের ভোটদান থেকে বিরত রাখাও সম্ভব।
আমাদের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এই নতুন প্রযুক্তির ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবেএআই শুধু মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এটি নির্বাচনী পরিকাঠামোর ওপর সাইবার হামলাও জোরদার করতে পারে। এআই-চালিত টুলগুলো আরও সফিসটিকেটেড ফিশিং আক্রমণ তৈরি করে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করতে বা এমন ম্যালওয়্যার তৈরি করতে পারে, যা প্রচলিত নিরাপত্তাব্যবস্থা এড়িয়ে যেতে সক্ষম। এ ধরনের আক্রমণ ভোটার ডেটাবেজ বা ভোটিং মেশিনকে লক্ষ্য করে করা যেতে পারে। সেটি নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তন বা পুরো প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিপত্তির সমাধান কী? এ প্রশ্নের জবাব হিসেবে প্রথমেই মনে রাখা দরকার, এই গুরুতর চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় একটি সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। এখানে এক্সপ্লেইনেবল এআই (এক্সএআই) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এআই মডেলের সিদ্ধান্তগুলো মানুষের কাছে বোধগম্য করে তোলে এক্সএআই। এটি এআইয়ের স্বচ্ছতা বাড়ায়।
ডিপফেক শনাক্তকরণ: এক্সএআই ব্যবহার করে এমন টুল তৈরি করা সম্ভব, যা কেবল ডিপফেক শনাক্ত করে না; বরং কেন একটি বিষয়বস্তু জাল বলে চিহ্নিত হয়েছে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দেয়। এর ফলে মানব ফ্যাক্ট-চেকাররা বিশ্লেষণ যাচাই করতে পারেন এবং জনগণের আস্থা তৈরি হয়।
প্রচারণার নিরীক্ষা: এক্সএআই রাজনৈতিক প্রচারণায় এআই ব্যবহারের নিরীক্ষা করতে পারে। এটি বিশ্লেষণ করে দেখাতে পারে, কীভাবে একটি অ্যালগরিদম তার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা পক্ষপাতদুষ্ট বা কারসাজিমূলক টার্গেটিং কৌশলগুলো প্রকাশ করতে সাহায্য করে।
নিরাপত্তা বৃদ্ধি: সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এক্সএআই হুমকির শনাক্তকরণ সিস্টেমকে উন্নত করতে পারে। এটি ব্যাখ্যা করতে পারে, কেন একটি নির্দিষ্ট কার্যকলাপকে ক্ষতিকর বলে মনে করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের দ্রুত এবং কার্যকরভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে সাহায্য করে।
অংশগ্রহণকারীদের করণীয়: এআইয়ের হুমকি মোকাবিলায় সব গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণকারীকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলো এবং নেতাদের প্রকাশ্যে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, তাঁরা প্রতারণামূলক এআই জেনারেটেড কনটেন্ট বা ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রচারে জড়িত হবেন না। তাঁদের উচিত এআইয়ের যেকোনো বৈধ ব্যবহার সম্পর্কে স্বচ্ছ থাকা এবং এআই জেনারেটেড কনটেন্টে সুস্পষ্ট লেবেল ব্যবহার করা। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক প্রচারে এআই ব্যবহারের বিষয়ে সুস্পষ্ট নিয়ম ও প্রবিধান তৈরি এবং প্রয়োগ করতে হবে। তাদের উচিত এআই-চালিত টুলগুলোতে বিনিয়োগ করা এবং ভোটারদের সচেতন করার জন্য বড় আকারের প্রচার চালানো।
এ ছাড়া একটি যৌথ গবেষণা ও উন্নয়ন দল গঠন করা প্রয়োজন, যারা নির্বাচনের আগপর্যন্ত কমিশনকে এআই এবং সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে নিরবচ্ছিন্ন সহায়তা দেবে। তৃতীয়ত, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজকে এআইয়ের হুমকি সম্পর্কে তথ্য আদান-প্রদান করতে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়লে তা দ্রুত মোকাবিলা করার জন্য একটি সুস্পষ্ট প্রটোকল স্থাপন করা জরুরি। সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজের উচিত ফ্যাক্ট-চেকিং এবং জনগণের মধ্যে মিডিয়া লিটারেসি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা।
আমাদের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এই নতুন প্রযুক্তির ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। এআইয়ের ক্ষমতা যেমন বিশাল, তেমনি এর অপব্যবহারের বিপদও কম নয়।
জনগণের বিশ্বাস এবং একটি ন্যায্য নির্বাচনের অধিকার নিশ্চিত করতে এখনই আমাদের সবাইকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো, বাংলাদেশ সরকারের একটি সম্মিলিত গবেষণা ও উন্নয়ন (আরএনডি) দল গঠন করা। এই বিশেষজ্ঞ দল এআই-সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলো ক্রমাগত বিশ্লেষণ ও অনুমান করবে এবং দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করবে।
অধ্যাপক ড.
আলমগীর হোসেন এআইয়ের সাবেক অধ্যাপক, যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজে অবস্থিত এআরআইটিআইয়ের সাবেক পরিচালক
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এআই চ ল ত র জন ত ক প রক র য় ব যবহ র পদক ষ প জনগণ র এআইয় র আম দ র র জন য ত করত
এছাড়াও পড়ুন:
মানুষ ঠিকমতো ইভিএম বোঝে না, পিআর বুঝবে কী করে: মির্জা ফখরুল
দেশের মানুষ এখনো ঠিকমতো ইভিএম বোঝে না, তারা সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) বুঝবে কী করে—এমন প্রশ্ন রেখেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘নতুন নতুন চিন্তা আসছে। সেই চিন্তাগুলোর সঙ্গে আমাদের দেশ, জাতি ঠিক পরিচিত নয়। এ ব্যাপারে আমি কমেন্ট করব না। তবে একটা কমেন্ট করতে চাই। এই যে পিআর বা আনুপাতিক হারে প্রতিনিধি, এটা আমাদের দেশের মানুষ বোঝেই না। তারা বলে পিআর কী জিনিস ভাই? যারা এখনো ইভিএমে ভোট দিতে পারে না, বোঝে না ঠিকমতো। যার ফলে ইভিএমে ভোট দেয় না। তারা পিআর বুঝবে কী করে? এই চিন্তাভাবনা থেকে দূরে সরে যেতে হবে।’
আজ মঙ্গলবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি শফিউল বারী বাবুর পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এ কথাগুলো বলেন। সভার আয়োজন করে ‘মরহুম শফিউল বারী বাবু স্মৃতি সংসদ’।
দেশের কয়েকটি রাজনৈতিক দল পিআর পদ্ধতি ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে পণ করে বসে আছে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এই দেশের মানুষ যেটাতে অভ্যস্ত সেই ভোটের ব্যবস্থা করেন। তার যেন প্রতিনিধিত্ব থাকে, সেই সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। তাহলেই সমস্যাগুলো সমাধান হবে। না হলে হবে না। বাইরে থেকে এসে বসে বা কাউকে আপনার নতুন নতুন চিন্তাভাবনা দিয়ে কিন্তু দেশের সমস্যার সমাধান করা যাবে না।’
অন্তর্বর্তী সরকারকে অবিলম্বে সংস্কারকাজগুলো শেষ করতে এবং জুলাই সনদ ঘোষণা করতে মির্জা ফখরুল আহ্বান জানান। পাশাপাশি তিনি লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচনের জন্য যে সময়টা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেই সময়টাতে নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘মানুষকে ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিন।’
বিএনপি সংস্কারকে ভয় পায় না উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমাদের অনেকে খোঁটা দিয়ে কথা বলেন, আমরা সংস্কার চাই না। সংস্কারের চিন্তাটাই তো আমাদের। সংস্কারের শুরুটা আমাদের দিয়ে।’
এ সময় তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘ফ্যাসিজমের মূল হোতা’ বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, ‘১৯৭৫ সালের আগে শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি ফ্যাসিজমের মূল হোতা, তিনি গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশাল করে দিয়েছিলেন। সেই বাকশাল থেকে ফিরিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্রে নিয়ে এসে মাল্টিপার্টি সিস্টেমের ব্যবস্থা চালু করলেন জিয়াউর রহমান।’
ঐকমত্য কমিশনের প্রশংসা করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমি কিছু ভালো দিক দেখছি। আজকে খবরের কাগজে দেখলাম, বোধ হয় বারোটি মৌলিক বিষয়ে পরিবর্তনে সবগুলো দল এক হয়েছে।’
এ সময় মির্জা ফখরুল সরকারকে শিশু একাডেমি স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমি স্টেটমেন্ট (বিবৃতি) দিয়েছি। আজকে আবার অনুরোধ করব। আমি শুনেছি, এটা নাকি হাইকোর্টের জায়গা। যারই জায়গা হোক, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া সবার মতামত নিয়ে সেদিন আমাদের শিশুদের বিকশিত করার জন্য এই শিশু একাডেমি স্থাপন করেছিলেন।’
গতকাল এক অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল বলেছিলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের চাঁদাবাজির খবর শুনে তিনি বেদনায় নীল হয়ে গেছেন। বিষয়টি নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটি নিয়ে অনেক বিরূপ মন্তব্য করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা আসলে তা–ই।’
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের সভাপতিত্বে এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক দুই সহসভাপতি আজহারুল হক ও ফরিদ উদ্দিন আহমেদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রিপন, দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আবুল খায়ের ভূঁইয়া প্রমুখ। অনুষ্ঠানে প্রয়াত শফিউল বারীর সহধর্মিণী বিথিকা বিনতে হোসাইন উপস্থিত থাকলেও বক্তব্য দেননি।