আমাদের শিক্ষার্থীরা যেভাবে ওষুধশিল্পের রূপান্তর ঘটিয়েছে
Published: 25th, September 2025 GMT
আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি পড়তে ভর্তি হই, তখনো কল্পনা করিনি যে আমাদের এই খাত এত বড় রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাবে। ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ফার্মেসি বিভাগ আজ এমন সব স্নাতক তৈরি করেছে, যারা দেশি ও বিশ্বের নামী ওষুধ কোম্পানি, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে অসামান্য অবদান রাখছে।
একজন শিক্ষক ও ডিন হিসেবে আমার গর্ব হয় যখন দেখি শত শত শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গেছে বা দেশে থেকে বাংলাদেশের ওষুধশিল্পকে এক বৈশ্বিক শক্তিতে রূপান্তর করেছে। বর্তমানে হাজারো দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি, গবেষণা ও উন্নয়ন, গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ এবং বিপণনে কাজ করছে, যা জাতীয় অগ্রগতির চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছে।
আমার কর্মজীবনে আমি এক অভূতপূর্ব বৈশ্বিক পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছি। বহু দশক ধরে ওষুধের মূল ভরসা ছিল ছোট আণবিক রাসায়নিক উপাদান। বাংলাদেশ এই খাতে দক্ষতা অর্জন করেছে-জেনেরিক ওষুধে আত্মনির্ভর হয়েছে এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সাশ্রয়ী দামে ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করেছে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দী নতুন এক বিপ্লব নিয়ে এসেছে— বায়োলজিকস।
জীবিত কোষ থেকে তৈরি এই অ্যাডভান্স ওষুধ (প্রোটিন, মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ও ভ্যাকসিন) ক্যানসার, অটোইমিউন রোগ ও সংক্রামক রোগের চিকিৎসায় বিপ্লব ঘটিয়েছে। ছোট আণবিক ওষুধ এখনো গুরুত্বপূর্ণ, তবে ভবিষ্যৎ নিঃসন্দেহে বায়োলজিকসের।
২০০৭ সাল থেকে ওষুধশিল্প খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। অল্প কিছু ওষুধের মাধ্যমে শুরু হলেও আজ দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি করছে ডায়াবেটিসের জন্য ইনসুলিন, রক্তাল্পতার জন্য এরিথ্রোপয়েটিন, ক্যানসার ও অটোইমিউন রোগের জন্য মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি এবং জলাতঙ্ক, টাইফয়েড, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হেপাটাইটিস-বি, কলেরা ও সার্ভিক্যাল ক্যানসারের (এইচপিভি) ভ্যাকসিন। একসময় বিদেশ থেকে উচ্চ মূল্যে আমদানি করতে হতো এসব ওষুধ; এখন এগুলো দেশের ভেতরেই বিশ্বের অন্যতম সাশ্রয়ী দামে পাওয়া যাচ্ছে।
যদি সঠিক নীতি, বিনিয়োগ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা যায়, বাংলাদেশ খুব সহজেই বৈশ্বিকভাবে সাশ্রয়ী মূল্যের ওষুধ সরবরাহের কেন্দ্র হতে পারে। এটি কেবল স্বপ্ন নয়; বাস্তবতার রূপ নিতে শুরু করেছে।সবচেয়ে বড় অর্জন হলো, কিছু প্রতিষ্ঠান এখন পুরোপুরি ‘ভার্টিকালি ইন্টিগ্রেটেড’ অর্থাৎ কোষ থেকে ওষুধ তৈরির প্রক্রিয়া-ফারমেন্টেশন, পরিশোধন, প্যাকেজিং পর্যন্ত—দেশেই করছে। এটি বৈশ্বিক মানের জৈবপ্রযুক্তি, যা বাংলাদেশেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি কোম্পানি এখন বিশ্বের সেরা কোম্পানিগুলোর সমকক্ষ পর্যায়ে কাজ করছে। তারা আন্তর্জাতিক ওষুধ কোম্পানি, শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রযুক্তি উন্নয়ন, হস্তান্তর, উৎপাদন, গবেষণা, বিপণন ও নজরদারিতে কাজ করছে। এমনকি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান খ্যাতনামা বৈশ্বিক কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে যৌথভাবে ইস্টভিত্তিক ও এমআরএনএ প্রযুক্তির মতো নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করছে, যা জরুরি স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ।
কোভিড-১৯ মহামারি এই সক্ষমতার এক বাস্তব উদাহরণ। দেশীয় শিল্প দ্রুত ভ্যাকসিন ও ওষুধ উৎপাদন ও সরবরাহ করে দেখিয়েছে তারা কতটা প্রস্তুত। শুধু ফিনিশড পণ্য নয়, বাংলাদেশ এখন সক্রিয় এপিআই উৎপাদন, প্রাক্-ক্লিনিক্যাল ও ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এবং ভ্যাকসিন উৎপাদনেও অগ্রগতি অর্জন করেছে—দেশীয় প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানি আয়ও করছে।
এতে রোগীরা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছে। বিদেশে যে ওষুধের দাম ছিল লাখ টাকার বেশি, তা এখন দেশের ভেতরেই অল্প টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভোগা পরিবারগুলোর কাছে এটি শুধু অর্থের সাশ্রয় নয়, এটি হতাশা ও আশার পার্থক্য।
বাংলাদেশের এই ফার্মাসিউটিক্যাল বিপ্লবের পেছনে রয়েছে আমাদের দক্ষ জনগোষ্ঠী, আমাদের নিজেদের তৈরি মেধাবী পেশাজীবীরা। আমি দেখেছি, আমার শিক্ষার্থীরা গবেষক, বিজ্ঞানী ও শিল্প উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছে; কেউ কেউ বিদেশে গিয়ে সেতুবন্ধ তৈরি করেছে, কেউ দেশে থেকে ভ্যাকসিন ও বায়োটেক উৎপাদনে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
জেনেরিক ওষুধে আত্মনির্ভরতা থেকে শুরু করে অ্যাডভান্স বায়োলজিকস আয়ত্ত করা পর্যন্ত—বাংলাদেশের ওষুধশিল্প এক অসাধারণ পথ অতিক্রম করেছে। বিশ্ব এখন স্বীকার করছে, আমরা শুধু প্রয়োজনীয় ওষুধই নয়, অ্যাডভান্স বায়োলজিকস ও ভ্যাকসিনও দক্ষতার সঙ্গে তৈরি করতে পারি।
যদি সঠিক নীতি, বিনিয়োগ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা যায়, বাংলাদেশ খুব সহজেই বৈশ্বিকভাবে সাশ্রয়ী মূল্যের ওষুধ সরবরাহের কেন্দ্র হতে পারে। এটি কেবল স্বপ্ন নয়; বাস্তবতার রূপ নিতে শুরু করেছে।
অধ্যাপক ড.
মো. সেলিম রেজা ডিন (ভারপ্রাপ্ত), ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরবর হ আম দ র র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
থাইল্যান্ডে চালের দাম ১৫ বছরে সর্বনিম্ন, বিশ্ববাজারে এ বছর কমেছে ১৪%
এশিয়াসহ বিশ্বের চালের বাজারে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এশিয়ায় চালের অন্যতম বৃহৎ সরবরাহকারী থাইল্যান্ডে চালের দাম ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। মূলত বাজারে চালের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
থাইল্যান্ডসহ চালের অন্যান্য বড় উৎপাদনকারী দেশ ভারত ও মিয়ানমারে উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় বিশ্ববাজারেও চালের দাম কমছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার খাদ্যসূচক অনুযায়ী, চলতি বছর চালের দাম কমেছে ১৩ দশমিক ৪০ শতাংশ। এমনকি বিশ্ববাজার চালের দাম আগস্ট মাসে আট বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে। খবর দ্য নেশনের
থাইল্যান্ডে চালের দামের এই নিম্নমুখী প্রবণতা একদম নতুন কিছু নয়, বেশ কয়েক মাস ধরেই এ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে দেশটির কৃষিবিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দীর্ঘ সময় ধরে চালের দাম কম থাকায় দেশটির কৃষকেরা ধানের আবাদ কমিয়ে দিতে পারেন।
থাইল্যান্ডে গত বৃহস্পতিবার ৫ শতাংশ খুদযুক্ত চালের দাম দাঁড়ায় টনপ্রতি ৩৩৫ ডলার। আগের সপ্তাহে যা ছিল ৩৩৮ ডলার। থাইল্যান্ডের কৃষি খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত ১৪ বছরে থাই সরকারের জনতুষ্টিমূলক নীতির কারণে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সরকার কৃষকদের সন্তুষ্ট করতে বিভিন্ন ধরনের নিশ্চয়তা দিয়েছে। এসব কর্মসূচিতে প্রায় ৪০ বিালিয়ন বা ৪ হাজার কোটি ডলার ব্যয় হলেও একধরনের নীতিগত ফাঁদ তৈরি হয়েছে। ফলে কৃষকেরা প্রযুক্তি উন্নয়ন, দক্ষতা বাড়ানো কিংবা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো থেকে নিরুৎসাহিত হয়েছেন।
সেই সঙ্গে থাইল্যান্ডের ব্যবসায়ীরা জানান, বর্ষা মৌসুমের শেষ দিকে বাজারে নতুন চালের সরবরাহ এসেছে। এটাও দাম কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। অন্যদিকে ভারত ও মিয়ানমারের মতো প্রতিযোগী দেশগুলো চালের গুণগত মানের উন্নতি করেছে। আধুনিকতা এনেছে উৎপাদনব্যবস্থায়। ফলে তারা কম খরচে ভালো মানের চাল রপ্তানি করতে পারছে। কিন্তু থাইল্যান্ড এখনো ভর্তুকিনির্ভর ব্যবস্থায় আটকে আছে। এ পরিস্থিতিতে দেশটির কৃষকেরা ক্ষতির মুখে পড়ছেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
এফএওর সূচক কমেছেপ্রতি মাসেই খাদ্যমূল্যসূচক করে থাকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। তাতে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছর বিশ্ববাজারে চালের দাম কেমেছে ১৩ দশমিক ৪০ শতাংশ। গত অক্টোবর মাসে চালের মূল্যসূচক নেমে এসেছে ৯৮ দশমিক ৪–এ। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে তা ছিল ১১৩ দশমিক ৬। সেই সঙ্গে ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে চালের মূল্যসূচক ছিল ১২৫ দশমিক ৭। সেই হিসাবে এক বছরে চালের দাম কমেছে ২১ দশমিক ৭ শতাংশ।
চালের দামের এই পতন শুরু হয় ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ চাল রপ্তানিকারক দেশ ভারত ধাপে ধাপে রপ্তানি–নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে শুরু করে তখন। এ ঘটনা চালের বাজারে বড় প্রভাব ফেলে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সব ধরনের চালের মূল্যসূচক ১৩ শতাংশ কমেছে। খবর ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের
অথচ ২০২৪ সালের শুরুতে এর উল্টো চিত্র দেখা গেছে। তখন ভারত একের পর এক রপ্তানি সীমাবদ্ধতা জারি করলে ২০০৮ সালের পর চালের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। বিশ্বজুড়ে ভোক্তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। মানুষের মধ্যে মজুতের প্রবণতা তৈরি হয়। অন্যান্য উৎপাদক দেশেও সুরক্ষাবাদী পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এর পর থেকে চালের দাম কমতে শুরু করে।