চাকসুর ফলাফল: ২ জন বাদে সবাই শিবিরের
Published: 16th, October 2025 GMT
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। এতে নির্বাচিত ২৬টি পদের মধ্যে এজিএস এবং সহ-খেলাধুলা ও ক্রীড়া সম্পাদক পদ ব্যতীত ২৪ পদে বিজয়ী হয়েছে ছাত্রশিবির মনোনীত ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেল।
বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) ভোরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ মিলনায়তনে এ ফলাফল করেন চাকসু নির্বাচনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড.
আরো পড়ুন:
এই বিজয় জুলাই যোদ্ধাদের, শিক্ষার্থীদের: শিবির সভাপতি
ফলাফলে দেখা গেছে, সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে ৭ হাজার ৯৮৩টি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের ইব্রাহিম হোসেন রনি। ৪ হাজার ৩৭৪ ভোট পেয়েছেন তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের সাজ্জাদ হোসেন হৃদয়।
৮ হাজার ৩১ ভোট পেয়ে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে জয়ী হয়েছেন শিবির প্যানেলের সাঈদ বিন হাবিব। ২ হাজার ৭২৪ ভোট পেয়েছেন তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের শাফায়াত হোসেন।
যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে ৭ হাজার ১৪ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন ছাত্রদলের আইয়ুবুর রহমান তৌফিক। ৫ হাজার ৪৫ ভোট পেয়েছেন তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরের সাজ্জাদ হোছন মুন্না।
খেলাধুলা ও ক্রীড়া সম্পাদক পদে ৪ হাজার ৬৩৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন শিবিরের মোহাম্মদ শাওন। ৪ হাজার ২৫৩ ভোট পেয়েছেন তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের আজহারুল ইসলাম বিপ্লব।
সহ-খেলাধুলা ও ক্রীড়া সম্পাদক পদে ৪ হাজার ৯২৯ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী তামান্না মাহাবুব প্রীতি। ৪ হাজার ৪৯৪ ভোট পেয়েছেন তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরের শাহ পরাণ মারুফ।
সাহিত্য, সংস্কৃতি ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে ৫ হাজার ৩২২ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন শিবিরের হারেস মাতাব্বর। ২ হাজার ৫৭৪ ভোট পেয়েছেন তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্রের তানজির রহমান।
সহ-সাহিত্য, সংস্কৃতি ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে ৬ হাজার ৯৮১ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন শিবিরের জিহাদ আহনাফ। ৩ হাজার ১৭৬ ভোট পেয়েছেন তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী শিক্ষার্থী সম্মিলন প্যানেলের পার্থ চৌধুরী।
দপ্তর সম্পাদক পদে ৩ হাজার ২৫৮ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন শিবিরের আব্দুল্লাহ আল নোমান। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্রের তাহসান হাবিব পেয়েছেন ৩ হাজার ২৩৬ ভোট।
সহ-দপ্তর সম্পাদক পদে ৬ হাজার ৯৮২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন শিবিরের জান্নাতুল আদন নুসরাত। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্রের আলীমুল শামীম রাব্বি ১ হাজার ৫৮ ভোট পেয়েছেন।
সমাজসেবা ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক পদে ৪ হাজার ২২৭ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন শিবিরের প্যানেলের তাহসিনা রহমান। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্রের শুভ হোসেন পেয়েছেন ৩ হাজার ৩১৬ ভোট।
গবেষণা ও উদ্ভাবন সম্পাদক পদে ৫ হাজার ৬২২ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন শিবিরের তানভীর আঞ্জুম শোভন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভয়েস অব সিউ প্যানেলের জালাল উদ্দিন পেয়েছেন ৩ হাজার ১০৬ ভোট।
বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি পদে ৬ হাজার ১২৭ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন শিবিরের মাহবুবুর রহমান। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র থেকে জামাল হোসেন ২ হাজার ৪৮০ ভোট পেয়েছেন।
ছাত্রী কল্যাণ সম্পাদক পদে ৬ হাজার ১৬৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন শিবিরের প্যানেলের নাহিমা আক্তার দ্বীপা। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বামজোট সমর্থিত বৈচিত্র্যের ঐক্য প্যানেলের সুমাইয়া শিকদার ৩ হাজার ৮২৬ ভোট পেয়েছেন।
সহ-ছাত্রী কল্যাণ সম্পাদক পদে ৫ হাজার ৯৩৬ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন শিবির সমর্থিত প্যানেলের জান্নাতুল ফেরদাউস রিতা। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্রের মাইশা মেহজাবিন তুবা ৩ হাজার ১১০ ভোট পেয়েছেন।
স্বাস্থ্য সম্পাদক পদে ৫ হাজার ১১ পদে নির্বাচিত হয়েছেন শিবিরের আফনান হাসান ইমরান। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্রের একেএম হাসিবুল কবির পেয়েছেন ২ হাজার ৮১০ ভোট।
মুক্তিযোদ্ধা ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক পদে ৪ হাজার ৮৬৯ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন শিবিরের মোনায়েম শরীফ। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভয়েস অব সিইউ প্যানেলের রবিউল হাসান শাফি ১ হাজার ৭৯৫ ভোট পেয়েছেন।
ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট ও আন্তর্জাতিক পদে ৪ হাজার ৯৮৭ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন শিবিরের মেহেদি হাসান সোহান। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের শ্রুতিরাজ চৌধুরী পেয়েছেন ২ হাজার ২৬৭ ভোট।
যোগাযোগ ও আবাসন সম্পাদক পদে ৫ হাজার ৬৬৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন শিবিরের ইসহাক ভূঁঞা। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের সায়েম উদ্দিন আহমদ ৩ হাজার ৯৫ ভোট পেয়েছেন।
সহ-যোগাযোগ ও আবাসন সম্পাদক পদে ৫ হাজার ৮১৬ ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন শিবিরের ওবায়দুল সালমান। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের ইয়াসিন আরাফাত ২ হাজার ৬৭৭ ভোট পেয়েছেন।
আইন ও মানবাধিকারবিষয়ক সম্পাদক পদে ৭ হাজার ৩৭৬ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন শিবিরের ফজলে রাব্বি তাওহিদ। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের আব্দুল্লাহ আল ছাকিব ৩ হাজার ১৯৪ ভোট পেয়েছেন।
পাঠাগার ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে ৬ হাজার ৫৮৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন শিবিরের মাসুম বিল্লাহ। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্রের মিনহাজুল ইসলাম পেয়েছেন ২ হাজার ২৯৬ ভোট।
পাঁচজন নির্বাহী সদস্যের মধ্যে সর্বোচ্চ ৬ হাজার ১১৫ ভোট পেয়ে প্রথম হয়েছেন জান্নাতুল ফেরদাউস সানজিদা, ৪ হাজার ৭৮৯ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন আদনান শরিফ, ৪ হাজার ৪১৫ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন আকাশ দাশ, ৪ হাজার ৪১২ ভোট পেয়ে চতুর্থ হয়েছেন সালমান সাকিব এবং ৪ হাজার ৩১২ ভোট পেয়ে পঞ্চম হয়েছেন সোহানুর রহমান সোহান। তারা সবাই শিবির সমর্থিত প্যানেলের।
চাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে মোট প্রার্থী ছিলেন ৯০৮ জন। এর মধ্যে শুধু চাকসুর ২৬টি পদে লড়েছেন ৪১৫ জন প্রার্থী। চাকসুর সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে ২৩ জন, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ২২ জন, সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) ২১ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সবচেয়ে বেশি পাঁচটি নির্বাহী সদস্য পদে লড়েছেন ৮৫ জন।
অন্যদিকে, ১৪টি হল ও একটি হোস্টেল সংসদে লড়েছেন ৪৯৩ জন প্রার্থী। এর মধ্যে নয়টি ছাত্র হলের প্রার্থী ছিলেন ৩৫০ জন এবং পাঁচটি ছাত্রী হলের প্রার্থী ছিলেন ১২৩ জন। এছাড়া একমাত্র শিল্পী আব্দুর রশিদ চৌধুরী হোস্টেল সংসদে প্রার্থী ছিলেন ২০ জন।
চাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ২৫ হাজার ৫২১ জন। এর মধ্যে ছাত্র ভোটার ১৬ হাজার ৮৪ জন এবং ছাত্রী ভোটার ১১ হাজার ৩২৯ জন। সে হিসাবে, ছাত্র ভোটার শতকরা ৫৮.৪৭ শতাংশ এবং ছাত্রী ভোটার ৪১.১৭ শতাংশ।
ঢাকা/মিজান/মেহেদী
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ছ ত রদল ন র ব চ ত হয় ছ ন শ ব র র ম স বতন ত র র ছ ত রদল র সমর থ ত র রহম ন ফল ফল
এছাড়াও পড়ুন:
কারাগার থেকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে ৫ বছরে ২৭৫ বন্দীর মৃত্যু
দেশের ৭৪টি কারাগারে বন্দীর সংখ্যা প্রায় ৮২ হাজার। কিন্তু তাঁদের জন্য স্থায়ী চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র দুজন। অভিযোগ রয়েছে, চিকিৎসকের অভাবসহ নানা সংকট ও অব্যবস্থাপনায় যথাযথ চিকিৎসা পান না অসুস্থ বন্দীরা।
কারা অধিদপ্তরের বিগত প্রায় পাঁচ বছরের হিসাবে, কারাগারে বছরে গড়ে ১৯৬ জন বন্দীর মৃত্যু হয়। ৪ বছর ৯ মাসে মারা গেছেন ৯৩৩ জন। এর মধ্যে কারাগার অথবা কারা হাসপাতাল থেকে বাইরের হাসপাতালে নেওয়ার সময় পথে মৃত্যু হয় বছরে গড়ে ৫৮ জনের। ৪ বছর ৯ মাসে কারাগার থেকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মোট মারা গেছেন ২৭৫ জন বন্দী।
কারা কর্মকর্তারা বলেছেন, ‘প্রেষণে’ ও ‘সংযুক্ত’ হিসেবে কারা হাসপাতালে চিকিৎসকদের পাঠানো হয়। তবে তাঁরা সেখানে থাকতে চান না। কারণ, পদোন্নতির সুযোগ নেই, কাজের চাপ বেশি এবং বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তা হয়েও দায়িত্ব পালন করতে হয় নন-ক্যাডার কর্মকর্তার অধীনে।
কারা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশে ১৪টি কেন্দ্রীয় ও ৬০টি জেলা কারাগার রয়েছে। মোট সংখ্যা ৭৪। এসব কারাগারে বন্দী ধারণক্ষমতা ৪৬ হাজার।
গত ২৩ অক্টোবরের তথ্য অনুযায়ী, কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার তুলনায় বন্দী বেশি রয়েছে ৭৮ শতাংশ (৮২ হাজার)।
বিগত ১০ বছরেও কারা হাসপাতালের দুরবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। বন্দীদের চিকিৎসা ও খাবার নিয়ে দুর্নীতি হচ্ছে। এটা পরিবর্তনে দীর্ঘদিন ধরে মানবাধিকারকর্মীরা কথা বলছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না।মো. নূর খান, মানবাধিকারকর্মীকারাগারে ধারণক্ষমতার অনেক বেশি বন্দী রাখার বিষয়টি নতুন নয়। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও ধারণক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ বন্দী কারাগারে থাকতেন। গাদাগাদি করে বন্দী না রাখা এবং কারাগারে চিকিৎসকের সংকট দূর করতে বড় কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ নিয়ে চিঠি–চালাচালি হয়েছে, কাজ হয়নি। এখনো একই পরিস্থিতি চলছে।
মানবাধিকারকর্মী মো. নূর খান প্রথম আলোকে বলেন, বিগত ১০ বছরেও কারা হাসপাতালের দুরবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। বন্দীদের চিকিৎসা ও খাবার নিয়ে দুর্নীতি হচ্ছে। এটা পরিবর্তনে দীর্ঘদিন ধরে মানবাধিকারকর্মীরা কথা বলছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি বন্দী থাকা দিন দিন বাড়ছে। তিনি বলেন, বন্দীরা রাষ্ট্রের হেফাজতে থাকেন। তাঁদের ভালো চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। অবহেলায় মৃত্যু হলে এর দায় রাষ্ট্র কোনোভাবে এড়াতে পারে না।
কারা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৭৪ কারা হাসপাতালের জন্য অনুমোদিত চিকিৎসক পদ ১৪৮। অর্থাৎ প্রতিটি হাসপাতালে স্থায়ী চিকিৎসক পদ দুটি। তবে বন্দীর চিকিৎসায় ৭৪টি হাসপাতালে স্থায়ী চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র দুজন।স্থায়ী চিকিৎসক দুজনকারা অধিদপ্তর ও কারা হাসপাতাল সূত্র বলছে, বন্দীদের মধ্যে অনেকেই হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি ও লিভারের রোগ, ডায়াবেটিস, চর্ম, দন্তসহ নানা রোগে ভুগছেন। ফলে রোগীদের নিয়মিত চিকিৎসা দরকার।
কারা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৭৪ কারা হাসপাতালের জন্য অনুমোদিত চিকিৎসক পদ ১৪৮। অর্থাৎ প্রতিটি হাসপাতালে স্থায়ী চিকিৎসক পদ দুটি। তবে বন্দীর চিকিৎসায় ৭৪টি হাসপাতালে স্থায়ী চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র দুজন। তাঁদের একজন মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারে এবং আরেকজন রাজশাহী কারা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে রয়েছেন।
কারা হাসপাতালে দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহের কারণ জানতে চাইলে ঢাকার কেরানীগঞ্জে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের চিকিৎসক বিনীতা রায় গত ২১ অক্টোবর প্রথম আলোকে বলেন, কারা হাসপাতালে কোনো পদোন্নতির সুযোগ নেই। ‘পোস্টগ্র্যাজুয়েশন’ (উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন) করার ব্যবস্থা নেই। বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তা হয়েও চিকিৎসকদের নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের অধীনে কাজ করতে হয়।
বিনীতা রায় আরও বলেন, কারা হাসপাতালে রোগীর চাপও বেশি। যথেষ্টসংখ্যক চিকিৎসকের অভাবে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না। অনেক সময় অবস্থার অবনতি ঘটলে বাইরের হাসপাতালে নেওয়ার সময় বন্দী মারা যান।
৭৪ কারা হাসপাতালের জন্য অ্যাম্বুলেন্স আছে ২৭টি। কারা হাসপাতাল থেকে বাইরের কোনো হাসপাতালে অসুস্থ বন্দীকে পাঠাতে হলে অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায় না। তখন অন্য যানবাহনে করে পাঠাতে হয়। এসব যানবাহনের অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে না।স্থায়ী চিকিৎসক না থাকায় সংশ্লিষ্ট জেলার সিভিল সার্জনের দপ্তর থেকে কারা হাসপাতালে অস্থায়ী ভিত্তিতে চিকিৎসক পাঠানো হয়। ৭৪ কারা হাসপাতালে এ সংখ্যা ১০১। কারা কর্মকর্তারা বলছেন, অস্থায়ী চিকিৎসকেরা সকালে এসে দুপুরের পর অথবা বিকেলে চলে যান। তাঁদের বাসাও কারাগার থেকে দূরে। ফলে রাতে কোনো বন্দী অসুস্থ হলে তাঁদের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতালের অস্থায়ী চিকিৎসক আরেফিন সাব্বির প্রথম আলোকে বলেন, ওই হাসপাতালে দুজন অস্থায়ী চিকিৎসক রয়েছেন। দৈনিক অন্তত ৩৫০ বন্দীকে চিকিৎসা দিতে হয়। দুজনের পক্ষে এত বন্দীর চিকিৎসা দেওয়া কষ্টদায়ক। কারা হাসপাতালে বন্দীর রোগনির্ণয়েরও ব্যবস্থা নেই। ফলে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া যায় না।
৭৪ কারা হাসপাতালের জন্য অ্যাম্বুলেন্স আছে ২৭টি। কারা হাসপাতাল থেকে বাইরের কোনো হাসপাতালে অসুস্থ বন্দীকে পাঠাতে হলে অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায় না। তখন অন্য যানবাহনে করে পাঠাতে হয়। এসব যানবাহনের অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে না।
কারাবন্দীদের অনেকে প্রবীণ। ৭০ বছরের বেশি বয়সী মোট বন্দীর সংখ্যা কত, তা জানা যায়নি। তবে কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকা ৩৫০ জন বন্দীর বয়স ৭০ বছরের বেশি।
২০০৩ সালে দেশের কারাগারগুলোর জটিল রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার লক্ষ্যে গাজীপুরে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২–এ ২০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছিল। চিকিৎসা সরঞ্জাম থাকলেও চিকিৎসক, নার্সসহ লোকবলের অভাবে হাসপাতালটির পুরোপুরি কার্যক্রম চালু করা যায়নি।
কাশিমপুর কারাগার-২–এর জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, এই হাসপাতালে চিকিৎসকের স্থায়ী ছয়টি ও নার্সের চারটি পদ থাকলেও সব শূন্য। সিভিল সার্জনের দপ্তর থেকে প্রেষণে দেওয়া দুজন নারী চিকিৎসক দায়িত্ব পালন করছেন। রাতে হঠাৎ কোনো বন্দী অসুস্থ হয়ে পড়লে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা পান না।
নিয়মানুযায়ী প্রতিটি কারাগারে একজন মানসিক চিকিৎসক থাকার কথা। তবে তা নেই। নারী বন্দী আছেন তিন হাজারের মতো। নেই কোনো গাইনি চিকিৎসক।
কারা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক (আইজি-প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কারা হাসপাতালের নানা সংকট দূর করা নিয়ে স্বরাষ্ট্র ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। সমস্যা রয়ে গেছে। কারা হাসপাতালের জন্য অ্যাম্বুলেন্স চেয়ে পাঠানো প্রস্তাব এর আগে অর্থ মন্ত্রণালয় বাতিল করে দিয়েছে। পরে আবারও প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
হাসপাতালে নেওয়ার পথে বন্দীর মৃত্যুনারী ও শিশু নির্যাতনের মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি ছইবুর রহমান (৬০) গত ৫ অক্টোবর সকালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেখান থেকে ওই দিন সকাল ৯টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে।
ছইবুর রহমানের ছোট ছেলে হাবিব আলী ও নাতি মিনহাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ছইবুর ছিলেন কানসাটের একটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। মামলার রায় ঘোষণার পর তিনি রাজশাহী কারাগারে ছিলেন। কারা কর্তৃপক্ষ তাঁদের জানিয়েছে, ছইবুর স্ট্রোক করলে (মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ) তাঁকে রাজশাহী কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মাধ্যমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু হাসপাতালে নেওয়ার পথেই তিনি মারা যান। হাবিব আলী বলেন, তাঁর বাবা সময়মতো চিকিৎসা না পাওয়ায় মারা যান।
কারাগারে ‘আত্মহত্যা’র ঘটনাও ঘটছে। গত ২৪ এপ্রিল রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগারের সেলের গ্রিলের সঙ্গে গলায় গামছা প্যাঁচানো অবস্থায় মো. জুয়েল (৩৪) নামের এক বন্দীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। কারা কর্তৃপক্ষ বলেছে, জুয়েল ‘আত্মহত্যা’ করেছেন। এ ঘটনায় কারারক্ষী রিপন বড়ুয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
সব মিলিয়ে বিগত ৪ বছর ৯ মাসে (২০২১ থেকে ২০২৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে কারাগারে ৯৩৩ বন্দীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে ২০২১ সালে ২০৫ জন, ২০২২ সালে ১৩২ জন, ২০২৩ সালে ২২৭ জন ও ২০২৪ সালে ১৭৯ জন এবং গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৯০ জন বন্দী মারা গেছেন। কারাগার থেকে বাইরের হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যাওয়া বন্দীর সংখ্যা ২৭৫।
‘পরিপূর্ণ কারা হাসপাতাল থাকা জরুরি’কারা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে বলা আছে, তাদের লক্ষ্য বন্দীদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করা, যথাযথভাবে তাঁদের বাসস্থান, খাদ্য ও চিকিৎসা দেওয়া। একজন সুনাগরিক হিসেবে সমাজে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উৎসাহ ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথাও বলছে কারা অধিদপ্তর। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কারাগারগুলোতে গাদাগাদি করে বন্দীদের রাখা হয়। খাবারের মান নিম্ন। চিকিৎসা–সুবিধা অপ্রতুল।
বন্দীদের নানা রোগের চিকিৎসায় চিকিৎসক ও আনুষঙ্গিক সুবিধা–সংবলিত পরিপূর্ণ কারা হাসপাতাল থাকা খুবই জরুরি বলে মনে করেন বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিনের সাবেক সভাপতি মো. টিটো মিঞা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কারাগারগুলোতে গাদাগাদি করে বন্দীদের রাখা হয় বলে তাঁদের চর্মরোগ ও যক্ষ্মার মতো রোগের ঝুঁকি বেশি থাকে। গরমে ‘হিট স্ট্রোক’ও হতে পারে। স্যানিটেশন ও গোসলের ভালো সুবিধার অভাবে বন্দীরা টাইফয়েডে আক্রান্ত হতে পারেন। যথাযথ চিকিৎসা না পেলে নিউমোনিয়ায় ভুগে বন্দীর অবস্থার অবনতি হতে পারে। তিনি বলেন, কারাগারে বন্দীর জন্য পর্যাপ্ত জায়গার ব্যবস্থা করতে হবে। বন্দী রোগে আক্রান্ত হলে তাঁকে বিশেষায়িত হাসপাতালে স্থানান্তরের সুব্যবস্থা থাকতে হবে।